You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
ব্যর্থ মনোরথ ভুট্টোর প্রত্যাবর্তন অভিযান
১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা
১৮ নভেম্বর, ১৯৭১

 

ব্যর্থ মনোরথ ভুট্টোর প্রত্যাবর্তনত
(অভিযান রাজনৈতিক পর্যালোচক)

পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে ৫জন সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল সম্প্রতি পিকিং সফর করেন। সফর সম্পর্কে পাক পররাষ্ট্র দপরের বক্তব্য, অস্ত্র সাহায্য এবং দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বলিষ্ঠতর করার জন্যি এই প্রতিনিধি দলের চীনের রাষ্ট্রনায়কদের সাথে আলাপ আলোচনা।
পররাষ্ট্র দফতরের বক্তব্য ছাড়াও এই সফরের আরো কতকগুলো সম্ভাব্য দিক আছে। কামান, ট্যাংক আর মেশিঙ্গান দিয়েও যখন বাংলাদেশের আন্দোলনকে রোধ করা গেলো না তখন ইয়াহিয়া খাঁ নয়া ফন্দি আটতে শুরু করে। সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপথগামী করার জন্য এই সমস্যায় ভারতকে জড়িয়ে ফেলতে সচেষ্ট হয়। আর সে জন্যই সে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধাবার পাঁয়তারা করে। এই যুদ্ধের হুমকীর পেছনেও জঙ্গীশাহীর দুটো মতলব ধরা পড়ে। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে স্বভাবতঃই বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র এসে মধ্যস্ততা করবে। তখন এই বাংলাদেশ সমস্যা চাপা পড়ে তার জায়গায় পাক-ভারত সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে আলোচনায় স্থান পাবে।
দ্বিতীয়তঃ পাক জঙ্গীশাহী এখন মুক্তিবাহিনীর আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত। বাংলাদেশকে যে আর নিজেদের কবলে রাখা যাবে না এব্যপারেও জঙ্গীশাহীর মনে নেই কন রকম দ্বিধা। কিন্তু এই মুক্তিবাহিনীর দ্বারা বিতারিত হলে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেও সমূহ বিপদ দেখা দেবে এবং এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে একমাত্র পথ ভারতের সাথে যুদ্ধ। ভারত যুদ্ধ করলে জঙ্গীশাহী পরাজিত হবে সন্দেহ নেই কিন্তু এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েও একটা সুদূরপ্রসারী সুফল পাওয়া সম্ভব। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে মুক্তিবাহিনী সুযগের সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশকে করবেন শত্রুকবলমুক্ত। আর জঙ্গীশাহী মুক্তিবাহিনীর কাছে এই পরাজয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ভিন্নভাষাভাষী জাতির জনগণকে বোঝাতে ভারতই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। এই ষ্টেশনেই সে পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র রাখতে পারবে।
কিন্তু পাকিস্তানের এই উদ্দেশ্য বুঝি সফল হলো না। সীমান্ত যখন উত্তেজনা বিরাজ করছে ঠিক সেই সময়ে ভারত সোভিয়েট রাশিয়ার সাথে এক পারস্পরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
ভারত রাশিয়া চুক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ইয়াহিয়া খাঁ পিকিং-এ প্রতিনিধিদল পাঠায়। সে চায় ভারত রাশিয়া চুক্তির পালটা হিসেবে পাক চীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হোক। তাহলেই সর্বনাশ থেকে কিছুটা রাহাই পাওয়া যাবে।
পিকিং সফরের পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ইয়াহিয়া খাঁর একটি সূক্ষ্ম অভিমানও পরিলক্ষিত। এ অভিমান আর কিছুর জন্যই নয়, শুধুমাত্র অস্ত্রের জন্যে সবাই হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনের সাথে ভারতের প্রধান্মন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর দীর্ঘ আলোচনার পর নিক্সন সরকার ঘোষনা করেছেন যে পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য পাঠানো হবে না। এই ঘোষনা যখন ইসলামাবাদে পৌছে, পাক প্রতিনিধি দল তখন পিকিং-এ। প্রতিনিধি পাঠিয়ে পাকিস্তান আবার ইঙ্গিতে এটাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, তোমরা যদি অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করো তাহলে আমরা পুরোপুরি চীনের দিকে চলে যাবো। প্রসঙ্গত, উল্লেখযোগ্য যে ১৯৬৫ সালেও পাকিস্তান অনুরুপ চাল ছেড়ে বেশ কিছুটা সুবিধা আদায় করেছিল।
এবার দেখা যাক ভুট্টোর পিকিং সুফরে আলোচ্য উদ্দেশ্যগুলো সাধিত হলো কিনা।
পিকিং-এ ভুট্টোর মিশন পৌছানোর পরই আলোচনা শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সফরের আগেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক্মহল মনে করেছিলেন যে চীন জরুরী তলব করাতেই প্রতিনিধি দল্টি পিকিং-এ যায়।
অবশ্য এই সম্ভাবনাটিকেও যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না তার প্রমান চীনা উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। তাঁর বক্তব্যে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় বাঙ্গাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের উপর। অস্ত্রের ব্যাপারে চীন সম্পূর্ণ নীরব। পূর্ব বাংলার গণহত্যা সম্পর্কে কিছু না বললেও চীন এটুকু বলেছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার অন্যায় সুযোগ নিয়ে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।
পাক-ভার যুদ্ধ বাধলে চীন সরাসরি জড়িয়ে পড়বে না বলেও চীনের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়।
চীনের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের নীতি বর্তমান সময়ে অনেক পালটেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে নজীরবিহীন গণহত্যা শুরু হবার পর পাক জঙ্গী সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও চীন বাংলাদেশে তার অনুগামীদেরকে জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবারই নির্দেশ দেয়।
বর্তমান সফর সম্পর্কে জঙ্গীশাহী জোরগলায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও সত্যিকারভাবে তারা মোটেই খুশী হতে পারেনি। নিউজ উইকের সাংবাদিকের কাছে ইয়াহিয়া চীন সম্পর্কিত ঘোষণাও অসার প্রমানিত। উপরন্তু যে অস্ত্রেই ভিক্ষার এই পিকিং সফরে সে অস্ত্রের প্রশ্নে পিকিং পুরোপুরি নিশ্চুপ।
সুতরাং যে অকল উদ্দেশ্য নিয়ে ভুট্টোর পিকিং সফর তার কোনটাই ত হলো না উপরন্তু বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে পুনরায় ধর্না দেয়ার পরও সম্পর্ক রুদ্ধ হয়ে গেলো। কেননা ভুট্টো আগেই বলেছেন যে জাতিসংঘ থেকে সমস্যা সমাধানের পথ কোন দিনি খঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে জন্যেই আমরা পিকিং এসেছি।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!