You dont have javascript enabled! Please enable it!
    শিরোনাম      সংবাদপত্র       তারিখ
শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিম সফরান্তিক সাফল্য       অভিযান

১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা

  ১৮ নভেম্বর,১৯৭১

 

শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিম সফরান্তিক সাফল্য

তিন সপ্তাহকালে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ সফর করে ভারতের প্রধান্মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী গত ১৩ই নভেম্বর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তা সফরসূচির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ছিল বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, বৃটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানী। বর্তমান সফর পশ্চিমের দেশের রাষ্ট্রনায়কের সাথে বাংলাদেশ প্রশ্ন আলোচনায় মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে শেঈমতি গান্ধী পালাম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন।
পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, যে সমস্ত দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতোদিন পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করে আসছিল শ্রীমতি গান্ধীর সফরে সে সমস্ত দেশগুলো এখন অন্ততঃ নিরপেক্ষ থাকবে বলে আশা করা যায়।
শ্রীমতি গান্ধীর পশ্চিম দেশ সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার প্রশ্ন প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য কি রকম।
শ্রীমতি গান্ধী প্রথম থেকেই বলে আসছেন যে, বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং ভারত তাতে হস্তক্ষেপ করার বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশে গণোহত্যা পরিস্থিতির ফলে লক্ষ লক্ষ লোক যে ভারতে শরণার্থী হয়েছেন এটাও একটি বাস্তব সত্য। ভারত মানবতার খাতিরেই তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তা ভারতের অর্থনীতিতে একটা প্রচণ্ড আঘাত। সুতরাং এই বাংলাদেশ সমস্যা এদিক দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বাংলাদেশে এখনও জঙ্গীশাহী গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় শরণার্থীদের ভারত পুনরায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে না। তাহলে মানবতা কথাটা হয়ে পড়বে অর্থহীন। শরণার্থীও এই পরিস্থিতিতে স্বদেশে ফিরে যেতে মোটেই রাজি নন। বাংলাদেশে তাই প্রয়োজন আশু রাজনৈতিক সমাধান।
এই বক্তব্যের আলোকেই এখন বিচার করে দেখতে হবে বর্তমান সফরের উদ্দেশ্য।
এটা বুঝতে কারুরই কষ্ট হওয়া উচিত নয় যে, বাংলাদেশ সমস্যার সঠিক যোক্তিকতা পশ্চিমী দেশগুলোকে অনুবাধন করাবার প্রচেষ্টাতেই শ্রীমতি গান্ধীর এই সফর।
পাকিস্তান এতোদিন ধরে প্রক্সার করে বেড়িয়েছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বৈব মিথ্যা এবং ভারতের কারসাজীতেই বিচ্ছিন্নতাবাদীর অনুপ্রবেশকারীদের সাথে পূর্ব বাংলায় নানারকম নাশকতামূলক কাজে অংশ নিয়েছে।
পাকিস্তানী প্রচারের এই ধুম্রজালসৃষ্টি হয়ত বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোকে বিভ্রান্ত করেছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান পেয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক কাজ সরঞ্জাম।
কিন্তু সামরিক সাজ সরঞ্জাম পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক বিজয় অর্জন করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিপুলসংখ্যক পাকসেনা খতম ও জখম হওয়ার ফলে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এখন ভাঙনের মুখোমুখি।
এই ভাঙনকে ঠেকাতে বিকল্প কর্মসূচী অবশ্যই ইয়াহিয়া খাকে পেশ করতে হবে। ইয়াহিয়া খা ইতিমধ্যেই বিকল্প পন্থা হিসাবে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছেন। রণহুংকার ছেড়েছেন ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে পাক-ভারত সমস্যার উদ্ভব হবে। তাহলে সামরিক বাহিনীর ভাঙনও রোধ হবে উপরন্তু বাংলাদেশ সমস্যার হবে অবসান।
কিন্তু আমরা জানি ভারত একটি শান্তিকামী দেশ। যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে ভারত সদাসচেষ্ট। আর এই সম্ভাব্য যুদ্ধকে এড়িয়ে উপমহাদেশ শান্তি অক্ষুন্ন রাখতেই শ্রীমতি গান্ধী পশ্চিমা দেশগুলো সফরে যান।
উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলোকে মনে রেখেই এবার বর্তমান সফরের মূল্যায়ন করে দেখা যাক।
অষ্ট্রিয়া ও বেলজিয়ামে শ্রীমতি গান্ধীর সফর খুবই সার্থুক হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এটাও সত্যি যে পাকিস্তানের উপর দুটো দেশের প্রভাব খুবই কম। তবে কোন দেশ থেকে সাহায্য না পেলেও তাঁদের কাছে অস্ত্রের জন্য ধর্ণা দেওয়া ইয়াহিয়ার পক্ষে মোটেই বিচিত্র নয়। কাজেই এই পথটিও এবার রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ দুটো দেশই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতীয় নীতিকে পুরোপুরি সমর্থন জানানো হবে। এবং পাকিস্তানকে কোনরকম অস্ত্রই সাহাজ্য করা হবে না।
এ দুটো দেশের পর শ্রীমতি গান্ধী যান বৃটেনে। সেখানে আলোচনা হয় প্রধানমন্ত্রী হীথ এবং পরাষ্ট্রমন্ত্রী হিউমের সাথে। বৃটেনের এই দুই নেতা পাকিস্তানের পক্ষে মত প্রকাশ করলেও তাঁদের পুরনো রক্ষণশীল নীতির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। বৃটেনের এই দুই রাষ্ট্র শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আগ্রহ প্রকাশ করলে শ্রীমতি গান্ধী স্পষ্টই বলেছেন যে পূর্ব বাংলায় উপযুক্ত পরিস্থিতি ফিরে না এলে শরনার্থীরা সেখানে ফিরে যেতে পারে না। আর এজন্যে দরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক রাজনৈতিক সমাধান। বাংলাদেশ প্রশ্নে পাক-ভারতে আলোচনার কোন প্রশ্নই ওঠেই না। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথেই আলোচনায় বসতে হবে।
শ্রীমতি গান্ধীর এই সঠিজ বক্তব্যের পর বৃটেনের মনোভাব যে কিছুটা বদলেছে তাঁর কারণ তাঁরা বলতে শুরু করেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে কার্যকরী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বৃটেন সচেষ্ট হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও শ্রীমতি গান্ধীর সফর ফলপ্রসু হয়েছে; নিক্সন সরকার স্পষ্টই বলেছেন, পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করা হবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক সমাধানে তাঁর সরকার পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেবেন।
অস্ত্র সাহায্য সত্যিই কি বন্ধ হবে- এ ব্যাপারে অনেকের মতই হয়ত সংশয় আছে। তাঁর কারণ ভারতের পরাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আমেরিকা সফর শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সাহায্য করবে না। কিন্তু এর পর পরই আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র পাঠায়।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একবার অস্ত্র সাহায্য বন্ধের কথা স্বয়ং নিক্সনই ঘোষণা করেছেন। সুতরাং সরাসরি ঘোষণা বরখেলাপের সম্ভাবনা খুবই কম।
কাজেই এদিক দিয়ে গান্ধীর সফর অনেকখানি সার্থক হয়েছে বলা যায়।
ফ্রান্সের নেতৃবৃন্দও রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদু শ্রীমতি গান্ধীর সম্মানে প্রদত্ত ভোজসভায় বলেছেন যে পূর্ব বাংলার সংকট মূলতঃ রাজনৈতিক। বাংলাদেশের জনগণের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান করতে হবে। তা না হলে পাক-ভারত উপমহাদেশে অশান্তির ঝড় বইবে, যার ফল হবে খুবই মারাত্মক।
পম্পিদুর বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রশ্নে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গী যে ভারতের অত্যন্ত কাছাকাছি সেটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
সবশেষে শ্রীমতি গান্ধী যে-দেশ সফর করেন তাহলো জার্মানী। এই পশ্চিম জার্মানীতেই শ্রোমতি গান্ধীর সবচেয়ে বেশী ফলপ্রসু হয়েছে। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার উইলি ব্রান্টের বক্তব্য হলো, পূর্ব বাংলা সমস্যাটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং তাঁর সমাধানও তাকেই করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত উপমহাদেশে সৃষ্টি হয়েছে চরম উত্তেজনা। এই উত্তেজনা উপশমকল্পে ব্রান্ট তাঁর সীমিম ক্ষমতা ও প্রভাব খাটাতেও রাজি হয়েছেন।
পূর্ব বাংলার সংকট নিরসনে শেখ মুজিবের মুক্তিকে প্রাথমক করণীয় হিসেবে বিবেচনা করে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার প্রয়োজন বলে চ্যান্সেলার ব্রান্ট অভিমত প্রকাশ করেন। এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি চিঠি দেবেন বলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন।
উইলি ব্রান্টের এই উদ্যোগ সফল হতে পারে। কেননা পশ্চিমের বহু সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রই পশ্চিম জার্মানির সাথে অনেক দিন পর্যন্ত কোন সম্পর্ক রাখেননি। কিন্তু ব্রান্ট ক্ষমতাধীন হবার পর থেকেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে লেনদেনের সম্পর্কও গড়ে ওঠে। আমরা জান বহুদিন ধরেই জার্মান সমস্যা একাধিকবার তৃতীয় বিশ্বযদ্ধের হুমকী দিয়েছে। কিন্তু সেই জার্মান সংকটও উইলি ব্রান্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ফলে সমাধা হয়েছে।
উইলিই ব্রান্ট অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু একটি বারের জন্যেও তিনি বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেননি। বৃটেন আমেরিকার মত পাক-ভারত আলোচনা কিংবা ভারিতের মাটিতে রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষক স্থাপনের পরামর্শও ব্রান্টের মুখ দিয়ে বেরোয়নি।
সবগুলো দেশের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে এটুকু বলা যায় যে শ্রীমতি গান্ধীর এই সফর বৃহৎ শক্তিবর্গের চোখ খুলে দিয়েছে। খোদ আমেরিকা এবং বৃটেনও অনুধাবন করতে পেরেছে, প্রায় এক কোটি লোক যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তা কিছুতেই ভারতের অভিসন্ধিমূলক প্রচারণা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যিই স্বাধীনতাসংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে এটা বোঝা যায় যে বৃহৎ শক্তিবর্গ এখন সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের সমর নায়ক ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন যাতে করে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসেন এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে পশ্চিমী রাষ্ট্রবর্গ সকলেই একই সুরে গাইতে শুরু করেছেন। শ্রীমতি গান্ধীও পশ্চিমা শক্তির কাছে এরকম কিছুরই প্রত্যাশা করেছিলেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!