You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা, মুজিব নগরঃ ১০ম ও ১১শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

‘একদা এক ব্যাঘ্রপ্রবর বৃদ্ধ ও অর্থব হওয়ায় খাদ্য সংগ্রহে অসমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু স্বপ্রচেষ্টায় খাদ্য সংগ্রহ করিতে না পারিলে ক্ষুধায় প্রাণ যায়, ফলে সেই ব্যাঘ্র তৎকর্তৃক নিহত এক ব্যাক্তির সুবর্ণ কঙ্কণদ্বয় লইয়া এক পঞ্চপল্বল সমাচ্ছন্ন দীর্ঘিকা সংলগ্ন পথিপাশ্বে সাত্বিকভাবে আহার্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লোভী পথিকের আশায় বসিয়া রহিল”। ইত্যাদি ইত্যাদি। কথামালার গল্পে এই ধরনের গল্পকথা পড়িতে পাওয়া যায়। কিন্তু মনুষ্য সমাজও যে এ ধরণের বহু ভেকধারী হিংস্র শ্বপদের বিচরণক্ষেত্র তাহার উৎকৃষ্ঠতম প্রমাণ বর্তমান ভুট্টো – ইয়াহিয়া সামরিক জান্তা ও তাহাদের দালাল বাংলাদেশবাসী মুসলিমলীগ পন্থী বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতকের দল।

কয়েকদিন পূর্বে মুক্তাঞ্চল ও ফিল্ড হাসপাতাল পরিভ্রমণে গিয়া উপরোক্ত গল্পটি ও পরিণাম পাশাপাশি চোখের সম্মুখে পড়িয়া গেল। মুক্তাঞ্চলের বুকে নেকড়ের ফেউদের রাতের অন্ধকারে ছিটাইয়া যাওয়া একখানি ইস্তাহার একজন গ্রামবাসী আমাদের হাতে দিল। ইস্তাহারে লিখা ছিল – ‘ইসলাম পাকিস্তানের প্রানকেন্দ্র” , “পাকিস্তান ইসলামের দূর্গ” সে সঙ্গে ধর্মের জিগির দিয়া বাঙ্গালী মুসলমানদের মার্শাল ‘ল’ কর্তৃপক্ষের নিকট আত্নসমর্পনের জন্য অনুরোধ ও প্ররোচণা। স্বাক্ষর ছিল জনৈক আহম্মদ আলি বিশ্বাস, চেয়ারম্যান আলমডাঙ্গা শান্তি কমিটির। সেই শান্তি নিদর্শন পাওয়া গেল বি, ভি, এ, সি ফিল্ড হাসপাতালে। উক্ত অঞ্চলের দুইজন গ্রামবাসী মুক্তিফৌজের ঠিকানা না বলিতে পারার শান্তি কমিটি চাবুকের আঘাতে সমগ্র পৃষ্ঠদেশের চামড়া তুলিয়া এবং সবুট পা এর লাথিতে পাজরার হাড় ভাঙ্গিয়া দিয়া শান্তি নমুনা দেখাইয়াছে।

কিন্তু ইহা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও তাহার পদলেহী কুত্তার দল মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ডভাবে মার খাইয়া আজ শান্তিবাহিনী প্রচারকের মুখোশ পরিতে বাধ্য হইয়াছে। কিন্তু পর্দার অন্তরালে তাহাদের বাঙ্গালীর তাজা খুনের লোভে স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। তাই তাহারা একাধারে প্রচার চালাইতাছে বাংলা শান্ত (?) কেবল মাঝে মাঝে দুষ্কৃতিকারী (!) দের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলিতেছে; অপরদিকে যত্রতত্র যখন তখন কারফিউ জারী করিয়া মুক্তিফৌজ গেরিলাদের সন্ধান গৃহে গৃহে তল্লাশী ও জনসাধারণের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাইতাছে। দোসর হইয়াছে শান্তি কমিটির ভেকধারী, বাঙ্গালীর কলঙ্ক মুসলিম লীগ পন্থী ভাড়াটিয়া দালালগণ।

শুধুমাত্র প্রশাসনই নহে মুক্তিফৌজের আক্রমণ ও বাঙ্গালির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অসহযোগিতার ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ প্রচন্ডভাবে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। বাংলার অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও প্রশাসন সুষ্টভাবে চলিতেছে ইহার প্রমাণ করিতে না পারিলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ঋণ দিতে অস্বীকার করিয়াছে। মুক্তিবাহিনীর নিরলস, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করিবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম ও তৎসহ নৌবাহিনী ও গানবোটের নিশ্ছিদ্র প্রহরার ফলে বিদেশী সাহায্য দ্রব্যসহ কোন জাজাহ পাকিস্তানের বন্দরে যাইতে পারিতেছে না। ফলে বর্হিবাণিজ্য এবং সাহায্য প্রাপ্তির আশা সুদূরপরাহত। কোন বাঙ্গালীর নিকট হইতে তাহারা একটি পয়সাও কর বা খাজনা পাইতেছে না। ফলে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠিয়াছে জঙ্গীশাহী ও তাহার দালালদের মধ্যে। বাঙ্গালীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিবার জন্য তাহারা নানারূপ ছলনা ও তৎসহ বিনীত প্রার্থনার আশ্রয় লইয়াছে। উক্ত ইস্তাহারে এও লেখা আছে, “ আমাদের একান্ত অনুরোধ আপনাদের ছেলেমেয়ে স্কুল ও কলেজে পাঠাইয়া শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করুণ। খাজনা ও বিভিন্ন প্রকারের করদান করিয়া পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত করুন”।

এত প্রলোভন, প্ররোচনা বা নিরযাতন সত্ত্বেও আজ এ কথা স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে,পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নাই, যে জাগ্রত বাঙ্গালীর প্রাণে যে স্বাধীনতা সূর্যালোক দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা বিনষ্ট করিতে পারে- বিনষ্ট করিতে পারে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ় শপথবদ্ধ সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর সংগ্রামী ঐক্যকে। দিকে দিকে মুক্তিবাহিনীর বলদীপ্ত অগ্রগতি, ১৭-১১-৭১ সকাল সাড়ে পাঁচটা হইতে ঢাকার বুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ, পাক বাহিনীর যত্রতত্র মুক্তিফৌজের ভুতদর্শন প্রভৃতি ইহার স্বাক্ষর বহন করিয়া চলিতেছে।

তবুও আত্মসন্তষ্টির সময় নয়। আজ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর সম্মুখে কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হইয়াছে। যে কোন বাঙ্গালীর সামান্যতম ভুলের জন্যও জাতির জীবনে নিদারুণ সংকট নামিয়া আসিতে পারে। তাই প্রতিটি বাঙালীকেই আজ প্রতিটি পদক্ষেপ করিতে হইবে সুচিন্তিতভাবে। যাহাতে বিভেদ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বেঈমান দলের আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ না ঘটিতে পারে তাহার জন্য প্রখর দৃষ্টি রাখিতে হইবে। তৎসহ সর্বপ্রকারে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করিতে হইবে মুক্তিফৌজে যোগ দিয়া, তাহাদের আহার্য ও আশ্রয়ের ত্বরান্বিত এবং আমরা লাভ করিব আমাদের ইপ্সিত ফল শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ।

* * * *

মোহাররম আর রমজান। পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট পবিত্রতম দুইটি মাস। রমজান মাসের প্রথম দিন হইতে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান সূর্যোদয়ের পূর্বে শয্যাত্যাগ করিয়া পবিত্র শুচিশুদ্ধভাবে আল্লাহ পাক-এর উদ্দ্যেশে নামাজ পড়ে। সমস্ত দিন সর্বপ্রকার আহার্য মাদক দ্রব্য বর্জন করিয়া সাত্ত্বিকভাবে সংসার তথা পৃথিবীর কল্যানের জন্য খোদা তায়ালার নিকট নির্দিষ্ট ওয়াক্ত অনুযায়ী মোনাজাত করে। রমজানের শেষে সমস্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ঈদ্গাহ ময়দানে একত্রিত হয় নামাজ পড়ে কোরান শরিফ পাট শোনে। রমজান মাসের ঐতিহ্য লইয়া আলোচনা করে গোটা মাস ধরিয়া হিংসাদ্বেষ বর্জন করিয়া সংযম শিক্ষা করিয়া শাস্ত্রের অনুশাসন পালন করে পৃথিবীর প্রতিটি মুসলমান।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বুকে রমজান মাস পালিত হইতেছে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের রক্তের হোলঈখেলার দ্বারা। অথচ নরমুণ্ডের দ্বারা গোন্ডুয়া তথা বাঙালীর খুনে হোলীখেলার সুদক্ষ ক্রীড়াবিদ ইয়াহিয়া ভুট্টো এবং তাদের সামরিক জুন্টা ও দালালরাই প্রচার করিতেছে বাংলার মুসলমানরা নাকি কাফের হইয়া গিয়াছে, তাহারা পবিত্র ইসলামের অবমাননা করিয়াছে। শুধু তাহারাই নহে বাঙালী কাফের মুসলমানদের জন্য তাহাদের তাহজীব তমদ্দুন বিপন্ন হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, বিপন্ন অবস্থা হইতে ত্রাণলাভের জন্য পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রের দরবারে করুণ আকুতি জানাইয়াছে। এবং কতিপয় রাষ্ট্রও পরের মুখে ঝাল খাইয়া, বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া মন্তব্য করিয়া দূর হইতে গোঁফে তা’ দিতেছে।

কিন্তু সরাবের পেয়ালায় চুমুক দিয়া বাঙ্গালীর রক্তে হস্তরঞ্জিত করিয়া জঙ্গীশাহী কোন ইসলামের অনুশাসন পালন করিতেছে। কোন হাদিসে লেখা আছে নররক্তোশ্মান করিলে ধর্ম্রাজ্য স্থাপিত হইবে।,বেহেস্ত নামিয়া আসিবে মর্তের বুকে? নারী ধর্ষন, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করিয়াই একমাত্র ইসলাম ধর্ম পালন করা যায় এ কোন নবীর উপদেশ? কোন আল্লাহ-পাক’এর নির্দেশ? এ কথা একবারও কি সেই ইসলামের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রনায়কগণ চিন্তা করিয়াছেন! এবারো কি তাহারা সেই এজিদ সিমারের উত্তরসূরী ইয়াহিয়া ও তাঁর সামরিক জুন্তাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছে, রাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক, মর্টার, কামানের গোলায়, বিমান কর্তৃক বোমাবর্ষনের দ্বারা গ্রাম, নগর, জনপদ শ্মশানে রূপান্তরিত করার নীতি কোন জঙ্গনামায় লিখিত আছে? আমরা জানি তা’ তাহারা করেন নাই। কারণ তাহারাও জানেন আর আমরা বাঙালীও জানি এর পশ্চাতে আছে সাম্রাজ্যবাদী শোষনের হীন কলাকৌশল। আছে নয়া উপনিবেশ কায়েম রাখিবার জন্য বিংশ শতাব্দীর সীমারদের হিংস্র থাবা।
তাই আজ এ কথা স্পষ্ট বলিয়া দেওয়ার সময় আসিয়াছে যত জমকালো আবরণেই হোক না তাহা ধর্মীয় জিগির, হোক না তাহা বিচ্ছিন্নতাকামীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান সেই আবরণকে ভেদ করিয়া তোমাদের স্বরূপ আজ বাঙ্গালীর দৃষ্টিতে প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে। রমজান মাসের শেষ আকাশে ঈদের পবিত্র চাঁদ দেখা গিয়াছে। সাবধান এজিদ সীমারের দল, এ চাঁদ শুধুমাত্র পবিত্র ঈদের চাঁদ নহে। এ চাঁদ পরাধীনতার আমাকে নিশ্চিত করিয়া স্বাধীনতার চন্দ্রোদয়। অদূরভবিষ্যতে বাঙালী মুক্তি্যোদ্ধারা তোমাদের নিশ্চিহ্ন করিয়া স্বাধীনতার পুর্ণচন্দ্রকে ছিনাইয়া আনিবে। কোন ভেদ নীতি বা সহসা প্রতিবন্ধক আমাদিগকে দমাইয়া রাখিতে পারিবেনা। কারণ আমরা প্রথমে বাঙালী তারপরে হিন্দু বা মুসলমান ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!