শিরোনামঃ শান্তির পারাবাত
সংবাদপত্রঃ আমার দেশ** বাংলাদেশঃ ১১শ সংখ্যা
তারিখঃ ১১ নভেম্বর, ১৯৭১
[** আমার দেশঃ সাপ্তাহিক। সম্পাদকঃ খাজা আহমদ। মুক্ত বাংলার কোন এক অঞ্চলে “আমার দেশ” মুদ্রনালয় হতে মুদ্রিত ও “আমার দেশ” কার্যালয় হতে খাজা আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত।]
শান্তির পারাবাত
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উপমহাদেশের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির মুখে পাশ্চাত্য দেশগুলোর সফর শেষ করিয়া স্বদেশে ফিরিয়া আসিতেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আজীবন গণতন্ত্রের পূজারি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কি পরিস্থিতিতে শান্তির সন্ধানে বাহির হইয়াছেন। তা প্রণিধানযোগ্য। ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে এশিয়ার খুদে হিটলার ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ লোকালয় জনপদ ধ্বংস ও নারী নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সমুদ্রের জলস্রোতের মত বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত পার হইয়া ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করে। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মানবতার খাতিরে সীমান্ত পথ বন্ধ করিয়া দিয়া ছিন্নমুল ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি শরণার্থীদের নরখাদক ইয়াহিয়ার জল্লাদ সৈন্যদের কামানের মুখে ঠেলিয়া দিতে পারেন নাই। বরং পাক বাহিনীর গণহত্যা, গণতন্ত্র হত্যা ও নারী নির্যাতনের মত পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতাকে বাচাইবার প্রয়োজনে তিনি বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাইয়া গণতান্ত্রিক মুল্যবোধ ও মানবিক আদর্শের উজ্জ্বল স্থাপন করিয়াছেন। বর্বর ইয়াহিয়া পাকিস্তানের ‘সংহতি ও অখন্ডতা’র নামে ‘ইসলাম’ রক্ষার ছদ্মাবরণে বাংলাদেশকে পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করিবার জন্য বাংলাদেশ ১০লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করিয়া, তিন কোটি বাঙ্গালীকে গৃহহারা করিয়াছে, এক কোটি বাঙ্গালীকে ভারত ভুখন্ডে বিতাড়িত করিয়া ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করিবার অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত হইয়াছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়া অনগ্রসর একটি দেশের পক্ষে এই বিপুল বোঝা বহন করা এককভাবে অসম্ভব ব্যাপার। স্বভাবতঃই আশা করা গিয়াছিল বিশ্বগোষ্টী এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ও তজ্জনিত ব্যাপক সংকট রোধে সক্রিয়ভাবে আগাইয়া আসিবেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যা থেকে ইয়াহিয়াকে বিরত করার জন্য এবং শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়ার মানবিক কাজে বিশ্বগোষ্টীর কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নাই। বরং কোন কোন গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র জল্লাদ ইয়াহিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা ও জনপদ উচ্ছ্যেদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করিয়াছে। এমনকি কোন কোন রাষ্ট্রের তর্জনি সংকেতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো গংরা ভারতের সার্বভৌমত্তের উপর আঘাত হানিবার জন্য সীমান্ত সৈন্য মোতায়েন করিয়া যুদ্ধোন্মদনায় মাতিয়া উঠিয়াছে। শুধু তাহাই নয়, ভারত বিরোধী প্রচারণা, উগ্র সাম্প্রদায়িক ভেদভুদ্ধিতে উস্কানি দিয়া ভারতের রাজনইতিক,সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করিবার চক্রান্ত চালানো হইতেছে। এমনি এক দুর্বিসহ সংকট ও চাপের মুখেও ভারত মানবতার খাতিরে প্রশংসনীয়ভাবে এহেন সমস্যার মোকাবিলা করিতেছে। সাথে সাথে ভারত বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নৃশংস বর্বরতা বন্ধ করিয়া বাংলাদেশে নির্বাচিত সদস্যদের ইচ্ছানুযায়ী জনগণের আশা-আকাংক্ষার পরিপূরক একটই ন্যাসঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বগোষ্ঠীর প্রতি আবেদন জানান। কোন কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের কণ্ঠস্বর বঙ্গবন্ধুকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়া তাহার সাথে সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানান। কিন্তু দুর্বিত্ত ও কপট ইয়াহিয়া বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাক-ভারত বিরোধ রূপে চিত্রিত করিবার দুরভিসন্ধি নিয়া দখলীকৃত বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করিয়া কোন কোন উপনিবেশবাদী প্রভুর উৎসাহে ও প্রেরণায় ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধাইবার সর্বনাশ খেলায় মাতিয়া উঠিয়াছে।
এমনি এক অবস্থায় একদিকে এক কোটি শরনার্থীর চাপে সৃষ্ট ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা, অন্যদিকে মুরব্বিদের আশীর্বাদপুষ্ট ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়ার রণহুংকার জনিত উপমহাদেশে শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বিচলিত করিয়া তোলে। তদপুরি কোন কোন বৃহৎ শক্তির বাংলাদেশে ফ্যাসিষ্ট বর্বরতাকে দীরঘায়িত করিয়া এবং শরণার্থী সমস্যাকে জিয়াইয়া রাখিয়া উপমহাদেশে ‘বরের পিসি ও কনের মাসী’ সাজিবার নিষ্ঠুর চক্রান্তে শ্রীমতি গান্ধী উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, বেলজিয়াম ও অস্ট্রিয়া সফরে গিয়া এই সব দেশের সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশ সংকটের মূল কারণ এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানের গুরুত্ত বুঝাইয়া বলিয়াছেন। তিনি এই কথাও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বুঝাপড়া করিতে হইবে-ভারতের সঙ্গে নহে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হইয়াছে। বাংলার বিস্তীর্ন এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। তদপুরি রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার চারটি পুর্বশর্ত ঘোষণা করিয়াছেন। উপরোক্ত শর্তের আলোকে শ্রীমতি গান্ধী বৃহৎ শক্তিগুলোকে বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের মূল সূত্র কোথায় তা বুঝাইতে সক্ষম হইয়াছেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। পাকিস্তানের যুদ্ধোন্মদনা ও অব্যাহতভাবে ভারত ভুখন্ডে গোলাগুলিবর্ষণের মুখে শ্রীমতি ইন্দিরার পাশ্চাত্য দেশ সফরের গুরুত্ব বিশ্ববাসী উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন বলিয়াও আমাদের ধারণা। স্বদেশে ফিরিয়া আসিয়া শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সংকট সমাধানে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গের মনোভাব সম্পর্কে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পর্যালোচনা করিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন বলিয়া ওয়াকেবহাল মহলের ধারণা। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের ৭০ কোটি মানুষের আশা-আকাংক্ষার পরিপূরক হিসাবে শ্রীমতি গান্ধী কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহাই দেখিবার জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করিতেছি।