শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
এবার দেশ গড়ার পালা | দেশ বাংলা
১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা |
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
এবার দেশ গড়ার পালা
দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ
‘আর কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী স্থানান্তরিত হবে। সম্প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ কথা ঘোষনা করেছেন।
মুক্তিবাহিনী এবং ভারতিয় বাহিনীর সম্মিলিত অগ্রাভিযানের মুখে পাকিস্তানী জংগী চক্রের পশ্চাদপসরণ এবং একের পর এক শত্রু ঘাঁটিগুলির পতন দেখে তাঁর এ আশাবাদে বিশ্বাস স্থাপন না করার কোন কারণ আমারা দেখি না। ইতিমধ্যেই মুক্ত জেলাগুলিতে পুরাদমে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা এখন বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর প্রভৃতি কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনী এখন কার্যতঃ আত্মসমর্পণের দিন গুনছে।
একের পর এক বিভিন্ন এলাকা বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বে আসার সাথে সাথে এখন স্বভাবতই পুনর্গঠনের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার দেশ গড়ার পালা।
চার প্রদেশ
বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করা প্রশাসন ও উন্নয়ন তৎপরতায় প্রতিটি অঞ্চলের প্রতি যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপের দাবী উঠেছিল ২৫শে মার্চের আগেই। এখন এ ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছন জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ‘কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেমব্লি’ গঠন করা হবে। এই এসেমব্লিকে চার প্রদেশের কাঠামো এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক নির্ধারণের ভার দেওয়া যেতে পারে। এ সব প্রদেশ কেবলমাত্র প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনে গড়তে হবে। এক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন ওঠার কোন কারন নেই। আপাততঃ চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেহসের মর্যাদা দিলেই চলবে। এতে করে ঢাকা শহরের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ কমবে এবং দেশে আরো কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর শহর গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তবে মনে রাখা দরকার, কোন অবস্থাতেই ‘দুই’ প্রদেশ গঠনের কথা চিন্তা করা চলবে না। কারন সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক রেষারেষিতে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
গনহত্যা ঠেকাতে হবে
শত্রুর চর এবং সহযোগীদের শাস্তি দেবার ভার জনগনের উপর বা স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ছেড়ে দেওয়া চলবে না। কারণ, তেমন অবস্থায় ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য অনেক নিরীহ ব্যক্তিরও লাঞ্জিত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তা’ছাড়া শত্রু সহযোগী অবাঙ্গালী দেরকেও’ হ্ত্যা করার লাইসেন্স কাউকে দেওয়া চলবে না। এ ব্যাপারে সরকারের সময়োচিত ঘোষণা সুবিবেচনার কাজ হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে যথাবিহিত বিচার করে তবেই অপরাধীকে যোগ্য শাস্তি দিতে হবে। বাংলার মাটিতে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর এক ফোঁটা রক্তও অনাবশ্যক ঝরান উচিত হবে না।
ঋণভিত্তিক অর্থনীতি চাই না
বাংলাদেশে প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকেই ব্যাপকভাবে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তড়িগড়ি ‘সোনার বাংলা’ বানাবার কথা বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে কৃষিভিত্তিক। কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য হতে হবে। ঋণভিত্তিক তথাকথিত ‘শিল্পপতিদের অর্থনীতি’ নয়। তাই অনাবশ্যক ঋণ পরিহার করে সুস্থ ভিত্তিতে জাতীয় অর্থনীতেকে ধাপে ধাপে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য দেশবাসীকে কৃচ্ছসাধনার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে এখন থেকেই।
ঋণ করা যার অভ্যাস, তার ঋণের অভাব হয় না। বিশেষ করে বিশ্বে জখন ‘মহাজনী রাজনীতি’ পুরাদমে চালু রয়েছে। কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ পরিণতি পাকিস্তানে আমরা দেখেছি, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখেছি। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেওয়া যাবে না।