You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (পাকিস্তান থেকে শিক্ষা নিতে হবে)
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা (১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা)
তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়

পাকিস্তান থেকে শিক্ষা নিতে হবে
বাংলাদেশ তার স্বাধীন ক সার্বভৌম সত্তা নিয়ে আত্নপ্রকাশ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে রুপায়িত হয়েছে লাখো শহীদের প্রাণের মূল্যে, আযূত কর্মীর নিরলস সংগ্রামে, প্রতিটি পরিবারের সীমাহীন দূঃখভোগ এবং অবিশ্বাস ত্যাগস্বীকারে। স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতেই হয়, কিন্তু বাঙ্গালী জাতি মূল্যের অধিক দিয়েছে।
পৃথিবীর বুজে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এ শিশুর তোলপাড় হয়েছে অনেক বেশী। জন্মের আনুষঙ্গিক গর্ভযন্ত্রণায় সারা বিশ্ব কেঁপে উঠেছে। জন্মকে ত্বরান্বিত করার জন্য “অপারেশন” ও চালাতে হয়েছে। এক অর্থে বাংলাদেশ “সিজারিয়ান বেবী”। আর সে জন্যই সম্ভবতঃ এই শিশুর প্রতিপালনে প্রথম থেকেই খুব বেশি সতর্ক হওয়া দরকার।
ঔপনেবেশিক এবং কায়েমী স্বার্থের শোষণে বাংলাদেশে কোনকালেই সুস্থ অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারেনি। বৃটিশ শাসনামলে আজকের বাংলাদেশ ছিল কলিকাতার ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি মহলের শোষণের প্রশস্ত তম ক্ষেত্র। রাজধানী শহর কলিকাতারকে কেন্দ্র করে সেদিন যে পুঁজিচক্র গড়ে উঠেছিল, তাতে বাংলার মানূষের অংশিদারিত্ব ছিল না। পাকিস্তানি শাসনের চব্বিশ বছরে এই শোষণের হার আরো বহু গুনে বেড়েছে। তারপরও যা ইছু অস্থি চর্ম অবশিষ্ট ছিল, এবারকার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং পালায়মান শত্রুসেনাদের “পোড়ামাটি” নীতির জন্য তা’ও ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে।
অর্থাৎ নবজাতকের জন্ম ঘটেনি সোনার পালংকে, রূপার চামচ মুখে। ঘটেছে খোলা আকাশের নিচে, অপরসীম দুঃখদুর্দশায়, শত-সহস্য সমস্যার বেড়াজালে।
তাই আজ যাঁর জন্মলগ্নে এই নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই নিজেদের এই গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
পাকিস্তান এই ব্যাপারে আমাদের সামনে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্ম-বৃত্তান্ত যা-ই হোক না কেন, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি পাকা-পোক্ত আসন নিয়েই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুতেই আভ্যন্ত্রীণ ঐক্যের্ব অভাব ছিল না, বৈদেশিক সহায়তারও কমতি ছিল না। রাষ্ট্র হিসেবে এটিছিল পৃথিবীড় “পঞ্চম বৃহত্তর রাষ্ট্র”। তা সত্ত্বেও মাত্র ২৪ বছরেই তার রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে চ্রমার হয়ে গেল। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে পাকিস্তানী রাজনীতির দিকে চোখ ফেরাতে হবয়। দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানে অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী কায়েমী স্বার্থ চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসে এবং ধাপে তা রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র থেকে, আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠিতন্ত্র এবং সর্বশেষ সামরিক হটারীতায় পর্যবসিত হয়।পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল জনগণের নামে। কিন্তু সেই জনগণের কোন ভূমিকাই থাকেনি অয়াকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জীবনে।
জনসমর্থনের বদলে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের লেহুড়ে বৃত্তিকেইরাষ্ট্র-ক্ষমতার নিয়ামক করে তোলা হয়েছে। তারই অবশ্যম্ভাবি পরিণিতিতে একদিকে চলেছে সাধারণ মানুষের উপর সীমাহীন শোষণ, অন্যদিকে চলেছে জাতিগত নিপীড়ন। এই শোষণ ও নিপীড়নের পরিণতি আজ চোখের সামনে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অশ্রু আর রক্তের ফসল। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সমানাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে এই আশা নিয়েই বাংলার মানুষ এত ত্যাগ স্বীকারে এগিয়ে গেছে।আগামী দিনে বাংলাদেশকে সেই প্রত্যাশা অবশ্যই পূরণ করতে হবে, নতুবা বাংলাদেশ ও ইতিহাসের ব্যতিক্রম হবে না। মৃত পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকেই সে শিক্ষা দিতে হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!