সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
শরণার্থী শিবিরে
(শিবির প্রতিনিধি)
এখনো শরণার্থীরা আসছেনঃ ৫ লক্ষ শিশু মারা যাবে?
শবণার্থীরা বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন
ভারত সরকার “ইসিএমে”র সাহায্য চেয়েছেন
করিমপুর শিবিরবাসীদের জন্য হাসতাপাল
পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী জেলাসমূহের শরণার্থী শিবিরগুলিতে এখনো প্রতিদিনই হাজার হাজার নতুন শণার্থী এসে পৌছাচ্ছেন। ওদিকে পাকিস্তানি কতৃপক্ষ দাবী করছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি “শান্ত” এবং শরণার্থীরা ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও পৈতৃক ভিটামাটির আকর্ষণে কিছু কিছু শরণার্থী ফিরে যাবার চেষ্টা যে করছেন না, তা নয়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই মাঝপথ থেকে তাঁদের ফিরে আসছে হচ্ছে। যারা কোন প্রকারে নিজ নিজ গ্রামে পৌছাতে পেরেছেন তাঁদেরও অধিকাংশকে পুনরায় ভারতে চলে আসতে হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরণের ঘটনা নিত্যই ঘটছে। তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্র বিষেষে অভ্যন্তর ভাগেরও বহূ থানা, ইউনিয়ন এমনকি মহকুমা এখন কার্যতঃ মুক্তাঞ্চল। কিন্তু পাক-বাহিনীর দূর পাল্লার কামান ও বিমান হামলায় এ সব এলাকার সাধারণ মানুষ যারা এতদিনও কোনপ্রকারে ভিটেমাটি আঁকরে থেকেছে তারা এখন নিরাপদ আশ্র্যের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে আসছেন।
বাংলাদেশের ভেতর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষাবাদ বন্ধ থাকায় এবং বাড়তি এলাকা থেকে ঘাটতি এলাকায় খাদ্যশস্যাদির সরবরাহ না থাকায়, স্থানে স্থানে চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বানিজ্যের অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় দিনমজুর ও বেসরকারি সংস্থার কর্মচারীরা অধিকাংশই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ধরণের ব্যক্তিরা নেহাৎ পেটের তাড়ায় দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন এবং স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে শরনার্থী শিবিরগুলিতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, নদীয়া, চব্বিশপরগনা প্রত্যেক জেলায় দৈনিক কয়েক হাজার নতুন শরণার্থী আসছেন। এদের অধিকাংশই মুসলমান চাষী ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর। গত সপ্তাহে কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই দশহাজার নতুন শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছেন।
***
শরণার্থী শিবিরগুলিতে শিশুখাদ্যের অভাব ক্রমেই বাড়ছে। কতিপয় বিদেশী ত্রানসংস্থা এবং ভারতীয় রেডক্রস-এর পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে কিছু পরিমাণ শিশুখাদ্য সরবরাহ করা হলেও, তা প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। শিবিরবাসীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাঁদের প্রাপ্য শিশুখাদ্য সঠিকভাবে বিতরণ করা হয় না। বিভিন্ন শিবিরে অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুমৃত্যের হার মারাত্বক রকমে বেড়েছে। কিছুদিন পূর্বে জাতিসংঘের জনৈক বিশেষজ্ঞ শিবিরগুলি পরিদর্শন করে বলেছিলেন, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হলে অচিরেই কমপক্ষে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যুমুখে পতিত হবার সম্ভবনা রয়েছে।
পশ্চিম বাংলার বাজারে শিশুখাদ্য এমনিতেই দুষ্প্রাপ্য। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত এখানেও একশ্রেনীর ব্যবসায়ী শিশুর খাদ্যের কালোবাজারিতে লিপ্ত রয়েছে এবং শরণার্থী শিবিরের জন্য প্রাপ্ত শুরু খাদ্যেও কোন কোন ক্ষেত্রে কালো গুদামে চলে যাবার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ছাত্রপরিষদ এবং যুব কংগ্রেসের সামপ্রতিক দ্রব্যমূল্যবিরোধী আন্দোলনের জের হিসাবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে এবং শিশুখাদ্য বিক্রীর ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। এর সুফল শরণার্থী শিবিরগুলিতে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
শরনার্থী শিবিরগুলিতে শিশুদের প্রয়োজনের দিকে ত্রাণসংস্থাগুলির আরো কিছুটা বেশী নজর দেওয়া দরকার এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির যথাযথ বিতরণ হচ্ছে কি-না সেদিকেও আরো বেশী দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
***
শরণার্থী শিবিরগুলি সীমান্তের খুব কাছাকাছি থাকায় এখানে মারাত্বক রকমের যুদ্ধাতংক বিরাজ করছে, এ ব্যাপারে আমরা গতবারেও আলোচনা করেছি। যুদ্ধ হোক বা না হোক, শরণার্থীরা যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ক্ষেত্রবিষেষে রাত কাটাচ্ছেন, শিবিরগুলিতে ঘুরে এলেই তা হৃদরঙ্গম হবে।
যে ভীতি-সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য শ্রণার্থীরা পিত্রপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে এসেছেন, সেই একই ভীতি-সন্ত্রাস এখানেও তাঁদের তাড়া করছে। “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়”, শরণার্থীদের অবস্থাও তথৈবচ। তা ছাড়া সীমান্ত এলাকাগুলিতে যুদ্ধ এক রকম লেগেই গেছে বলা যায় না কি?
শরণার্থী শিবিরগুলি সীমান্ত এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নতুন করে নির্মাণের খরচা এবং ঝক্কি বিরাট হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষেত্র বিষেষে তা” করাই হয়তো বাঞ্ছনীয় হবে। সীমান্ত থেকে বেশী দূরে সরিয়ে নিলে শরণার্থীরা ভারতের জনসাধারণের সাথে মিশে গিয়ে ভারতের জনস্নগখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে, এ আশংকা কেউ কেউ করছেন। কিন্তু এভাবে ভয়-সন্ত্রাসের মধ্যে থাকতে হলে ক্রমাগত অধিকসংখ্যক শরণার্থী শিবির ছেড়ে যাবার পথ খুঁজবে এবং তার ফল আও মারাত্বক হতে বাধ্য।
ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের জন্য কতিপয় খদ্যদ্রব্যাদির প্রয়োজন মেটাবার জন্য ‘ইউরোপীয় কমন মার্কেটের’ নিকট আবেদন জানিয়েছেন।
এ যাবৎকাল বিভিন্ন সূত্রে যে পরিমাণ সাহায্য প্রতিশ্রুত হয়েছে তা” হিসাবে ধরার পর ১৯৭১-“৭২ সালে কি পরিমাণ অতিরিক্ত সাহায্য দরকার হবে, ভারত সরকার তার একটি তালিকাও সেই সাথে পেশ করেছেন।
ভারত সরকারের হিসাবে ১৯৭১-‘৭২ সালে শরণার্থীদের জন্য আরো ৩১১,০০০ টন চাল, ১৭৫,০০০ টন গম, ৫০,০০০ টন চিনি, ১৮৭,০০০ টন ডাল, ৪০,০০০ টন লবন, ৮,৩০০ টন গুঁড়া দুধ প্রয়োজন হবে। শরণার্থীদের জন্য সর্বমোট ৪,৩৪,০০০ খানা কম্বল দরকার বলে হিসাব ধরা হয়েছে এবং এ ব্যাপারেও ই,সি, এম এর সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি করিমপুরে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার কোরের উদ্যোগে একটি ১৫ বেডের হাসপাতাল প্রতিষ্টিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের পরিচালনাধীন এই হাসপাতালটিতে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এই হাসপাতাল থেকে কয়েক লক্ষ শরণার্থী উপকৃত হবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।