সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১
শত্রুশিবিরে ভুট্টোর উভয় সংকটঃ ইয়াহিয়ার “পিঠাভাগঃ” ষড়যন্ত্রের “”শাসনতন্ত্র”
“ডন” পত্রিকার কুম্ভীরাশ্রু ইয়াহিয়া সরে দাঁড়াবে? (রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
গত ১২ই নভেম্বর কারাচীতে এক জিনসভায় ভাষন দিতে গিয়ে পাকিস্তান পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনের বিজয়ীদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে ৪০ দিনের মধ্যেই আমরা তা উল্টে দেবো। সংবাদটি পরিবেশন করেছেন রয়টার। পিকিং ফেরত ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানে বতৃতা সফরের এটি ছিল শেষ সভা।
বাংলাদেশের ৭৮ জন গণপ্রতিনিধিকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের আসনের “উপনির্বাচনের” ব্যবস্থা হয়েছে। ছয়টি দক্ষিণপন্থি দল জোট বেঁধে সব ক”টি আসন নিজেদের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে এবং ইয়াহিয়া সরকারের পরোক্ষ সমর্থনে তাঁদের সফল হবার সম্ভবনাই বেশী। ইতিমধ্যে ৫২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় এই ছয় জোটের মনোনীত প্রার্থী “নির্বাচিত” হয়েছে। ৩টি আসন পি,ডি,পি’র জৈনক নেতা ভুট্টোর কাছে “বিক্রী” করে দিয়েছেন। বাকী ২০টি আসনের ব্যাপারের চাপাচাপি চলছে। ইয়াহিয়ার এক নয়া নির্দেশে নির্বাচনের ৪দিন পূর্ব পর্যন্ত যে কোন প্রার্থীকে সরে দাঁড়াবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে নিশ্চিত ফলাফলের সম্ভাবনা রয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত যদি একটি আসনেও “নির্বাচন” অনুষ্ঠানের প্রয়োজন না হয়, তবে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ভুট্টো এক্ষেত্রে খুবই বেকায়দায় পড়েছেন। “উপনির্বাচনে”র বিরুদ্ধে যাওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইথচ এই “উপনির্বাচন” তাঁর মেজরিটি দলের নেতা হবার সুযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে, চোখের সামনে তা’ তা দেখেও তিনি কিছু করতে পারছেন না।
নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ডানপন্থীরা একজোট হয়ে ভুট্টোকে কোণ্ঠাসা করে রাখতে চাইছে। “উপনির্বাচনের”র পর এই দক্ষিণপন্থী জোটই ইয়াহিয়ার তথাকথিত পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং নূরুল আমীনের সেই জোটের নেতা হিসাবে “সরকার গঠনে” আমন্ত্রিত হবার সম্ভাবনাই বেশী। ক্ষমতালিপ্সু ভুট্টো তা মেনে নেবেন কেমন করে?
ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হয়ে ভুট্টো পিকিং গমনের পাশাপাশি নূরুল আমীনের পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক সফর এবং ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারদৃষ্টে এক্তহা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইয়াহিহা-ভুট্টো-নূরুল আমীন সমঝোতা স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা ছাড়া আর কোন ব্যাপারেই সমঝোতার প্রশ্ন ওঠে না। তিনজন তিনটি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার প্রতিভু। কাজেই এদের মধ্যে মিল-অমিল-মিল নাটকীয়তায় অবাক হবার কিছু নেই।
* * *
নুরুল আমীনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হলে ভুট্টো কি মেনে নেবেন?
শেখ মুজিবের সাথে উপ-প্রধানমন্ত্রি হতে ভুট্টোর আপত্তি ছিল না। কিন্তুন নূরুল আমীনকে তিনি মানবেন কেন? সুকৌশনে কলকাঠি ঘুরিয়ে তিনি সামরিক বাহিনীর মাধ্যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছেন- তবে কি নূরুল আমীনকে গদিতে বসবার জন্য ইয়াহিয়ার সাথে ভূট্টোর সমঝোতা হতে পারে, নূরুল আমীনেরও। দু’জনকেই একই সাথে নাচাবার খেল ইয়াহিয়ার ভালভাবেই জানা আছে। কিন্তু নূরুল আমীন, ভুট্টো, দুজনকেই একই সাথে খুশী রাখার কোন তেলেসমাতী দাওয়াই ইয়াহিয়ার মদের আলমারীতে লুকানো আছে কি? আয়ুবের হাত থেকে ক্ষমতা নেবার পর ইয়াহিয়াকে বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে কেবল ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় মিলিত হতে দেখা যেতো। প্রত্যেকের সাথেই এই হুঁশের পাগল এমন একটি ভাব দেখাতো যেন অন্য নেতাদের কানাকড়িও দাম নেই, কেবল ওই নেতাদের উপরই যা কিছু ভরসা। একইভাবে ইয়াহিয়া বিভিন্ন দলকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। এমন কি ডানপন্থী দলগুলিও ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।
সুচতুর ইয়াহিয়া এবার ভুট্টো এবং নূরুল আমীনকেও কি সেই একই কায়দায় খেলাচ্ছে?
শ্যাম্পেন পূজারী ইয়াহিয়াকে শুরুতে হাবা গোবা মনে হতো। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ইয়াহিয়াকে “ভালো মানুষ” বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় থাকতে চায় না, গণতন্ত্র কায়েম করে ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়, এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতেন। ইয়াহিয়া নিজেও সেরকম ভাবসাব দেখিয়ে এসেছে।
কিন্তু সময়ে প্রমানীত হয়েছে যে, ইয়াহিয়া শেয়ানের শেয়ান। বিশ্বকে ধোঁকা দেবার জন্য তার সর্বশেষ “পদক্ষেপ” সম্পর্কে যা কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তার “পাতায় পাতায় বেড়ানো” শয়তানী বুদ্ধির আরো কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
শোনা যাচ্ছে, ইয়াহিয়ার শাসনতন্ত্রে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ হিন্দুকে আলাদা রেখে দেখাবার চেষ্টা হবে যে, “পাকিস্তানে” বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা অবাঙালীদের চাইতে বেশী নয়। আর যেহেতু পাকিস্তান “ইসলামিক” রাষ্ট্র, সেহেতু মুসলমানদের সংখ্যা দিয়েই “গুরুত্ব” যাচাই হবে।
বিগত সাইক্লোন, গৃহযুদ্ধ এবং বিপুলসংখ্যক আদিবাসীর দেশত্যাগের কারণ দেখিয়ে এবারকার জনগণনায় বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ দেখিয়ে আগামীদেতে তদনুযায়ী ভাগ বাঁটোয়ারার নীতিও তাতে লিপিবদ্ধ থাকবে।
ইয়াহিয়া তার “শাসনতন্ত্র” পরিষদে পেশের আগে সাধারণ্যে প্রকাশ দূরের কথা, এমনকি বিভিন্ন দলের নেতাদের দেখতে দেবে না। এ ব্যাপ্রে নূরুল আমীনের অনুরোধও প্রত্যাখাত হয়েছে। অর্থাৎ উপনির্বাচনের প্রহসন শেষ হবার পর “আপনি মোড়ল”দের নিয়ে যে পরিষদ গড়া হবে তাতে এই “শাসনতন্ত্র” কেবল পড়েই শোনানো হবে এবং তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র কর্তব্য হবে হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করা।
* *
এই মেকী গণপরিষদেও যাতে বাঙালীদের কর্তৃত্ব না থাকে, ইয়াহিয়া সে ব্যাপারেও সজাগ। ৮৭ জন আওয়ামী লীগ নেতার সদস্যপদ বহাল রাখার পেছনেও হয়তো সেই অভিসন্ধি কাজ করেছে। কারণ, তাঁদের অনুপস্থিতিতে পরিষদে “উপস্থিত” সদস্যদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা বেশী থাকছে এবং আর্ডিনান্সের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইন জারী করে এই বিপুলসংখ্যক সদস্যে অনুপস্থিতিতেই ইয়াহিয়া তার কাজ হাসিল করে নিতে পারবে।
***
সম্প্রতি করাচীর “ডন” পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে এ ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। “ডন” এর মতে এভাবে বাঙালীদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে রেখে পরিষদের অধিবেশনে বসানো হলে তা গনতন্ত্র সম্মত হবে না। “ডন” পত্রিকা তবে গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে সংগ্রামে নেমেছে? তাও কি সম্ভব?
আসলে “ডন” পত্রিকার দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ। “ডন” এর মুরব্বি ইউছুফ হারুণের স্বার্থ মার্কিন জোয়ালে বাঁধা। পশ্চিম পাকিস্তানের ডানপন্থী মার্কিন কর্তাভজার দল এইভাবে পরোক্ষ চাপ দিয়ে পাকিস্তানের অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার আসনগুলিও শুণ্য ঘোষণা করাতে চায়, যাতে করে সেগুলিও আবার নির্বাচন হয় এবং তাঁরা সেগুলি আপোষে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে বগল বাজাতে পারেন। এতে তাঁদের ডবল লাভ। একদিকে শূন্য খোঁয়াড়ে আরো কিছু মেষ কিংবা মোষের আমদানী, অন্যদিকে ভুট্টোর সংখ্যাগরিষ্ঠকে চাপা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে নিজেদের হারানো সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ।
ইয়াহিয়া কি সরে দাঁড়াবে? এ নিয়ে কিছু জল্পনা-কম্পনা দেখা যাচ্ছে। প্রধানতঃ পশ্চিমা দেশগুলিতেই এ ধরনের খবর রটেছে বা রটানো হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ইয়াহিয়ার স্থলে ওমর বা অন্য কেউ ক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করবে।
স্পষ্টতঃ এটি একটি রাজনৈতিক “ফিলার”। ইয়াহিয়াকে সরিয়ে দিলে বাঙালীদের মনোভাব কি দাঁড়ায় পশ্চিমা শক্তিবর্গ তা বুঝে দেখতে চায়। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। পাক-সামরিক বাহিনীকে বাঙালীরা এখন আর বিচ্ছিন্নভাবে দেখছে না, এ সত্য পশ্চিমারা বুঝে থাকবে। ফলে এ ব্যাপারে খুব বেশীদূর অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তারা পাচ্ছে না।