You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র চাই কি ? দেশবাংলা, ১ম বর্ষঃ ৪র্থ সংখ্যা ১৮ নভেম্বর , ১৯৭১

 

বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র চাই কি?
আওয়ামী লীগেকে মন স্থির করতে হবে
(দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ)

বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং অধিকৃত বাংলার পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনীর শক্তিও সুসংহত হয়ে উঠছে। এক কথায় স্বাধীনতার চরম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে।
এই ক্রান্তিলগ্নে দেশের রাজনীতিক ক্ষেত্রেও আসছে বিপুল পরিবর্তন। দক্ষিণপন্থী দলগুলি ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছে। বামপন্থী ও আধাবামপন্থী দল-উপদলগুলিতেও পোলারাইজেশন শুরু হয়েছে নতুনভাবে।
বিগত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে এখন দল না বলে “প্লাটফর্ম” বলাই ভালো। মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগে এখন বামপন্থী “প্রায়-নক্সাল” চিন্তাধারা থেকে শুরু করে বুর্জোয়া উদার নৈতিকতাবাদ পর্যন্ত সব রকমের চিন্তাধারা পাশাপাশি কাজ করছে। বিভাগ পূর্বকালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের এই অবস্থার তুলনা হতে পারে।
স্বভাবতঃ বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ এবং তার অনুগামীদের প্রাধান্য থাকবে। ন্যায়সংগতভাবেই আজ তাই প্রশ্ন উঠতে পারে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশকে কোন পথে চালাবে ?
অনেকে বলে থাকেন, আগে স্বাধীনতা আসুক, তারপর সে সব কথা চিন্তা করা যাবে। বিভাগ পূর্বকালে মুসলিম লীগ এ ধরনের কথাই বলতো। প্রকৃত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের নাকের ডগায় মুলা বেঁধে এগিয়ে নেবার অভিসন্ধি চাড়া এটা আর কিছুই নয়।
বস্তুতঃ যারা (চন্দ্রবিন্দু হবে) আজ স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে তাঁদের সবার সামনেই স্বাধীনতা পরবর্তীকালের একটি সুনির্দিষ্ট চিত্র থাকা অত্যাবশ্যক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে তথাকথিত “স্বাধীনতা” অর্জিত হয়েছিল, গত ২৪ বৎসর তার বিষময় ফল ভোগ করার পর পুনরায় কোণ অজানার পথা পা বাড়ানো বাঙালী জাতির জন্য নির্বুদ্ধিতারই নামান্তর হবে।
সংগ্রামের গতি প্রবাহ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকে এমন এক স্তরে এনে দিয়েছে যখন সংগ্রামকে সঠিক খাতে পরিচালনার খাতিরেই আজ কতগুলি বিষয়ে মনস্থির করার প্রয়োজন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেই আজ এসব প্রশ্নের মোকাবিলায় বলিষ্ঠভাবে এগিয়ে আসতে হবে। দেশবাসীর সামনে সুস্পষ্ট ভাষায় তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরে তদনুযায়ী সর্বশ্রেণীর মানুষের মানসিক প্রস্তুতির জন্য কাজ করে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগকে প্রথমেই স্থির করতে হবে স্বাধীনতা বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতি চালু থাকবে কি-না, না-কি সেখানে তাঁরা একদলীয় শাসন চালু করবেন।
বাংলাদেশের মানুষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এবং বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতার রদবদল আনতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনচক্র এই শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের পথ আগলে দাঁড়ায় এবং নজিরবিহীন নৃশংসতার মাধ্যমে নির্বাচনের রায় বানচাল করতে প্রয়াসী হয়। অতঃপর বাংলার ছাত্র- তরুণ ও স্বাধিকারকামী জনতা অস্ত্র ধরেছে এবং সশস্ত্র সংরামের পথে পা’ বাড়িয়েছে একান্ত বাধ্য হয়ে।
এ থেকে অনেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক পার্লামেন্টারী রাজনীতির ব্যর্থতার প্রামাণ্য উদাহরণ এবং এ থেকেই প্রমাণিত ( এখানে প্রামাণিত) হয় যে “সশস্ত্র” বিপ্লব ছাড়া জাতীয় মুক্তি অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের তরুণদের একাংশ সংগ্রামের যৌক্তিকতা প্রচার করেছিলেন পূর্ব থেকেই। এবার তাঁরা হাতে- কলমে তা’ প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছেন। অতঃপর পার্লামেন্টারী রাজনীতির “বিলাসিতা” চিরদিনের জন্য দেশ থেকে দূর করার কথা তাঁরা চিন্তা করছেন কিনা আমাদের জানা নেই।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বর্তমান সংগ্রামকে তাঁদের নির্বাচনের বিজয়েরই চূড়ান্ত পরিণতি মনে করেছেন। তাঁদের মতে বর্তমান সংগ্রাম সশস্ত্র হলেও তা প্রকৃত প্রস্তাবে নিয়মতান্ত্রিক। কারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সংগ্রাম চলছে। কাজেই এ সংগ্রাম অন্যান্য দেশের সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং একে কোন অবস্থাতেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান বলা যেতে পারে না। তাঁরা মনে করেন, ইয়াহিয়া নিয়মতান্ত্রিকতার পথ থেকে সরে গিয়ে যে অনিয়মের পথ বেছে নিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সেই অনিয়মকে উৎখাত করে নিয়মতান্ত্রিকতাকেই পুনর্বহাল করতে চান। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে তাঁরা গণপরিষদের অধিবেশন ডাকতে মুহুর্তও বিলম্ব করবেন না এবং যথারীতি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কায়েম করবেন, এ কথা তাঁরা বলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এ ধরনের বক্তব্য যদি দলের স্থির সিদ্ধান্তের পরিচায়ক হয়ে থাকে তবে কার্যক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটা দরকার বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল সন্দেহ নাই । বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় পার্লামেন্টারী রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ হয় এবং আস্থা দুই-ই বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহে গনমনে বিভ্রান্তি এসেছে। সে বিভ্রান্তি এখন বাড়ছে বই কমছে না।
পাকিস্তানে কোনকালেই পার্লামেন্টারী রাজনীতি পরীক্ষিত হয়নি। শুরু থেকেই কায়েমী সার্থ ( বানান) এবং সামরিক বাহিনীর অন্যায় প্রভুত্ব দেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতির বিকাশ স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে নস্যাৎ করে দেওয়া, ১৯৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ভয়ে সামরিক শাসন জারী, আয়ুবের “মৌলিক গণতন্ত্র” এবং সর্বশেষ ইয়াহিয়ার ডিগবাজী সেই অন্যায় প্রভুত্ব কায়েম রাখার অপকৌশলেরই বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ ।
স্বাধীন বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম বারের মত সেখানে গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হবে। বলা বাহুল্য এট একান্তভাবেই এখন আওয়ামী লীগের উপরে নির্ভরশীল। সেজন্যে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই কয়েকটি ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
(১) দলীয় পরিধিতে নিয়মতান্ত্রিকতা কায়েম করতে হবে এবং সংগ্রামের সর্বস্তরে নিয়মতান্ত্রিক গণপ্রতিনিধিত্বকে ঊর্ধেব তুলে রাখতে হবে। বিগত নির্বাচনে যারা ( চন্দ্রবিন্দু হবে) নির্বাচিত হয়েছেন , সরকার গঠন এবং সরকার পরিচালনায় তাঁদের সম্মিলিত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং বর্তমান জরুরী অবস্থাতেও পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসীর নিশ্চয়তা বহাল রাখতে হবে।
(২) মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মনেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি তথা, পার্লামেন্টের প্রতি আনুগত্য গড়ে তুলতে হবে এবং ভবিষ্যতে দেশের বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্র সমর্পণের কথা মনে রেখে তদনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।
(৩) বিরোধী দলের অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে। বিশেষ করে যে সব দল ভবিষ্যত পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসী মেনে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ নেবে সে সব দলকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত বিরোধী দল পার্লামেন্টারী রাজনীতির সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই ভবিষ্যতে পার্লামেন্টারী রাজনীতি কায়েমের অভিলাষী হয়ে থাকে তবে এ ধরনের বিরোধী দল গড়ে ওঠার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করা তো চলবেই না, বরঞ্চ সরকারী ভাবে আনুকূল্য দেখাতে হবে।
(৪) মুক্তিবাহিনীকে একক কমান্ডে সংগঠিত রাখতে হবে এবং সামরিক বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে, যাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব বাংলাদেশে “পাকিস্তানী রাজনীতি”র পুনরাবৃত্তি না ঘটতে পারে।
(৫) এডমিনষ্ট্রেসশনকেও দলনিরপেক্ষ ভাবে গড়ে তুলতে হবে। এমনকি রাজনৈতিক মতাবলম্বী ব্যক্তিদেরও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন দলনিরপরেক্ষ থাকার অভ্যাস “করাতে” হবে।
প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এ সব পদক্ষেপ আওয়ামী লীগের জন্য “ত্যাগ” স্বীকার । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, পরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং কর্মী বাহিনীর “নিজেদের প্রয়োজনেই” এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, কেবলমাত্র পার্লামেন্টারী সুপ্রেমেসী বহয়াল রেখে বিগত নির্বাচনের রায় কার্যকরী করার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের হাতে আগামী দিনের বাংলাদেশের কর্তৃত্ব আসতে পারে। অন্যথা মাঝপথে নৌকার গতি পরিবর্তন এবং হাত বদলের সম্ভাবনাই যে বেশী , পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দিকে তাকিয়ে তা বিনা দ্বিধায় বলা যায়।
যারা (চন্দ্রবিন্দু প্লিজ) পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন, এতে অবশ্য তাঁদেরও হতাশ হবার কিছু নেই। আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের পথেই রাজনীতি করতে হবে অন্যদের নিজ নিজ পথে। ইতিহাস আপন নিয়মেই তার পথ করে নেবে, সে ভবিষ্যতবাণী এখনই করা যাবে না।
তবে আমাদের প্রতিবেশী ভারতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি রাজনীতির স্বীকৃত মাধ্যম। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারও সম্ভবতঃ চাইবেন না তাঁদের বাড়ীর পাশে একটি সামরিক একনায়কত্ব বা ফ্যাসিবাদী একদলীয় শাসন খাড়া হোক। কারণ ভারতের রাজনীতিতে, বিশেষতঃ তার পূর্বাঞ্চলের নাজুক পটভূমিতে তার প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোক এবং একদলীয়ে কর্তৃত্বের স্থলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমঝোতা স্থাপিত হোক ভারত সরকারের পক্ষে সেটা কামনা করাই বেশী স্বাভাবিক । আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র কায়েম করতে চাইলে এই অনুকূল পরিবেশে খুবই সহায়ক হবে সন্দেহ নেই।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!