You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.04 | দেশ বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়: অনিবার্য সমাধি | দেশ বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয়
অনিবার্য সমাধি
দেশ বাংলা*[1]
১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
৪ নভেম্বর, ১৯৭১

[1] দেশবাংলাঃ সাপ্তাহিক। বাংলাদেশের জনযুদ্ধের মুখপত্র। সম্পাদকঃ ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। দীপক সেন কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও ‘অগ্নিশিখা’ প্রকাশনীর পক্ষে বিজয় নগর, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।

 
সম্পাদকীয়
অনিবার্য সমাধি

ইয়াহিয়া খাঁ গভীর গাড্ডায় পড়েছেন। বলা বাহুল্য এই গাড্ডা তিনি নিজেই খুঁড়েছিলেন অবশ্য নিজের পাপ ঢাকার জন্য। বাংলাদেশের জনগণের রায়কে নস্যাৎ করতে হলে যে পাশবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাইতেই হয়, তার দায়দায়িত্ব প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপাবার জন্য ফাঁদ বানিয়েছিলেন। ভাবেছিলেন তাঁর সে ফাঁদে আটকা পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাংলার স্বাধিকারকামী নেতৃত্ব। আর তিনি তাঁর লাঠিয়ালদের নিয়ে মনের সুখে রাজত্ব চালাবেন।
কিন্তু কথায় আছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। ইয়াহিয়াও সম্ভবতঃ একটু বেশী চালাকী করতে গিয়েছিলেন। আর তাতেই পতন-স্বখাত সলিলে।
গত তেইশ বৎসর ধরে বাংলার মানুষকে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত করে পাঞ্জাবের উদরপূর্তির যে প্রচেষ্টা হয়েছে তাতে বাধ সাধতে গেলেই এই ফাঁদ অতি সন্তর্পণে গুটিয়ে আনা হয়েছে। বাংলার মানুষ সরল বিশ্বাসে হাত মেলাতে গিয়ে সে ফাঁদে আটকা পড়েছে। একবার দু’বার নয় অসংখ্যবার। তথাকথিত পাকিস্তানের ইতিহাস ঘঁটাইলেই তা চোখে পড়বে।
ফাঁদ পাতা হয়েছিল ১৯৪৬-এর নির্বাচনে। বাংলার মানুষ জেনেছিল এ নির্বাচনে জয়ী হলে তারা স্বাধীন বাংলার মালিক হবে। মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের মর্মকথাও ছিল তা-ই। বাংলার মুসলমানরা অবিভক্ত ভারত চায়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলা চেয়েছিল। এর পেছনেও হয়তো বা বাংলাদেশে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাহির করার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল ছিল। কিন্তু তা ছিল একান্তই স্বাভাবিক এবং প্রকৃতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা মাত্র। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ইস্যু ছিল দু’টি। সমগ্র উপমহাদেশের একটি মাত্র রাষ্ট্র হবে, না-কি একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হবে। কংগ্রেস ছিল একক জাতীয়তার ধারক, মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্বের। কিন্তু মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্বের ব্যাখ্যা বাংলার মুসলমানদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে উপমহাদেশকে ‘ভাগ’ করার চিন্তা করেনি বাংলার মুসলমান। বাঙালী ফজলুল হকের মুসাবিদা করা ‘লাহোর প্রস্তাব’ই তার প্রামাণ্য দলিল। সোহরাওয়ার্দীর যুক্তবাংলা গড়ার শেষ চেষ্টাও তারই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলার মুসলমান উপমহাদেশে একাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয় চেয়েছিল। আর বঙ্গভঙ্গ বাঙালী হিন্দুর কাছে ছিল মাতৃহত্যার তুল্য। এ জন্যই কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব আজো বাংলার মানুষের কাছে পালিয়ে যাওয়া সোনার হরিন।
কিন্তু ’৪৬ সালের নির্বাচনের পর মুস্লীম লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনী কর্মসূচী ভুলে গিয়ে নির্বাচনের ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের দিকে মন দিয়েছিল। সে নেতৃত্ব ছিল স্পষ্টতই অবাঙালী নেতৃত্ব। বাংলাকে ভাগ করে অথর্ব করে দিতে না পারলে অবাঙালী কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী করা যেতো না, করাচীতে বসে সঙ্খ্যালঘুরা সঙ্খ্যাগরিষ্ঠের উপর শাসন শোষন চালাতে পারতো না। ’৪৬-এ মুসলিম লীগকে জয়যুক্ত করে জিন্নার নেতৃত্ব দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিয়ে বাংলার আনুষ যে ফাঁদে পা দিয়েছিল তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বাধীন বাংলার কবর, ইউনিটারী পাকিস্তানের উদ্ভব। অবশ্য জিন্না এবং আর অবাঙালী নেতাদের বাঁচার আর কোন পথ ছিল না। ইউনিটারী পাকিস্তানে বাঙাল মারা কল বসাতে না পারলে তাঁদের সর্দারী কায়েম রাখা যেতো না কিছুতেই। সে ব্যাপারে তাদের হিসাব ছিল একেবারেই নির্ভুল।
এরপর এই তেইশ-চব্বিশ বছরে সেই একই খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। শাসন্তন্ত্র ছাড়াই দেশ চলেছে দশ বছর। ‘দুই পরিষদে’র ভূত চাপাবার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে পৃথক নির্বাচন বহাল রাখার। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে ‘বাঙ্গাল’কে পাকিস্তানী বানাবার কোশেশ হয়েছে। সে অবশ্য ধোপে টেকেনি। কিন্তু ’৫৪ সালের নির্বাচনের পর বাংলার মানুষ আবার ফাঁদে পড়েছে। মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে জয়ী হবার অল্প দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট ভাংগন ধরালো। আওয়ামী লীগ বের হয়ে এলো যুক্তফ্রন্ট থেকে। নৌকার মাঝি হক সাহেব মাল্লাবিহীন হয়ে সমুদ্রে ভাসলেন। মাল্লার একের হাত-পা অপরে ভাংলো ‘দাঁড়া-দাঁড়ি করে। মারীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে কোরান শরীফের পাতার মার্জিনে স্বাক্ষরিত হলো পাঁচদফা চুক্তি, পশ্চিমা নেতাদের সাথে।এক ইউনিট আর সাংখ্যাসাম্য মানলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বিনিময়েপেলেন চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বানিজ্য, উন্নয়ন, সর্বক্ষেত্রে দুই অংশের সমান সমান বখরা কায়েম করার এবং গণতান্ত্রিক শাসন্তন্ত্র চালু রাখার অঙ্গীকার। কিন্তু এটাও ছিল আরেকটি ফাঁদ। বাংলাদেশ পরিষদের অভ্যান্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালো, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র দেশগুলি হারালো তাদের স্বকীয়তা। সোহরাওয়ার্দী উভয়ের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকলেন। কিন্তু বিনিময়ে পেলেন না কিছুই। পশ্চিম পাকিস্তানিরা চুক্তির আর সব ধারা বেমালুম চেপে গেল। কোরান শরীফের পাতায় লেখা ওয়াদাও তারা ভাংতে পারেন কারণ ধর্মটা শোষকের খোলস, বিশ্বাসের অঙ্গ নয়। এক বিশ্বাসঘাতকতারই চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল বাংলার অধিকার নিয়ে চাপ সৃষ্টির পর আকস্মিকভাবে পাঞ্জাবী চক্রের সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত সুচতুর ও সুদক্ষ রাজনীতিকও নাকি সেদিন অসহায় শিশুর মত বলে উঠেছিলেন, ‘আমি মানবতার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি’।
তারপর ’৫৯ সালের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ফলাফল পূর্বাহ্নে আঁচ করে সামরিক শাসন জারী থেকে শুরু করে, ’৬২-র শাসন্তন্ত্র জারী, ’৬৫-র নির্বাচন, ’৬৯-এর গোলটেবিল বৈঠক ’৭০-এর নির্বাচন, একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি। প্রতিবারই বাংলার মানুষ নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। প্রতিবারই প্রতারিত হয়েছে।
’৬৯-র গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং পার্লামেন্টারী শাসনে প্রত্যাবর্তনের ঘোষনায় বিশ্বাস করেছে বাঙালী। সে বিশ্বাসের পরিণতি দ্বিতীয় দফা সামরিক শাসন, আয়ুবের গদীতে ইয়াহিয়ার অভিষেক। ’৭০-এর নির্বাচনের জন্য ইয়াহিয়া যখন ‘আইনগত কাঠামো আদেশ’ জারী করে, তখন বাংলাদেশের দু’একটি দল তাতে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর জনসমষ্টি তামেনে নেয়, ইয়াহিয়ার ‘সদিচ্ছায়’ বিশ্বাস স্থাপন করে। ইয়াহিয়া সে বিশ্বাসের মূল্য তার স্বনিয়মেই দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে।
কিন্তু কথা আছে, সাতদিন চোরের আর একদিন গৃহস্থের। এবার গৃহস্থের দিন এসেছে। ইয়াহিয়া এবং তার মুরব্বীদের সমস্ত হিসাব ভন্ডুল করে দিয়ে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। ২৪ বছরের বিশ্বাসঘাতক তার জবাব সে আজ দেবেই। ইয়াহিয়ার প্রতিটি অস্ত্র ফিরে গিয়ে তার নিজের বুকে বিধছে। বাংলাকে এবং বাংলার মানুষকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য যে চোরাবালির ফাঁদ পাতা হয়েছিল, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক জান্তা তাতেই আটকা পড়েছে।
এ চোরাবালি থেকে তাদের নিস্তার অনিবার্য সমাধিতে।