শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২১৮। বাংলাদেশ স্বাধীনতা-আন্দোলনের প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা বিবৃতি | সংবাদপত্র | মার্চ, ডিসেম্বর ১৯৭১ |
পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে
জুলফিকার আলী ভুট্টো
.
করাচী, ২৬ শে মার্চ (পাকিস্তান টাইমস) পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে করাচী বিমানবন্দরে এক হর্ষোৎফুল্ল জনতার উদ্দেশ্যে বলেন যে, পরম করুণাময় আল্লাহর ইচ্ছায় পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে।
তিনি জনতাকে আরও বলেন যে, তিনি এ মুহূর্তে কোন মন্তব্য করবেন না। তবে তিনি ২৯শে মার্চ দলের কেন্দ্রীয় দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন করবেন বলে জানান।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, এখন তিনি যা বলতে পারেন তা হলো আল্লাহর ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।
জনাব ভুট্টোর সাথে ছিলেন জনাব আবদুল হাফিজ পীরজাদা, জনাব গোলাম মুস্তাফা খান মির্জ্জা রফি রাজা , জনাব আলী খান তালপুর এবং মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী।
করাচী বিমানবন্দরে এক বিরাট সংখ্যক লোক জনাব ভুট্টোকে সম্বর্ধনা জানান। তিনি বিমান থেকে বেরিয়ে আসলে সমবেত জনতা “শের-ই পাকিস্তান জিন্দাবাদ”, “ফখরে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ”, “এক রহেগা পাকিস্তান-জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিতে থাকে।
মুজিব দেশ ভাগ করতে চেয়েছে
-ভুট্টো
ডনের (করাচী) এক খবরে প্রকাশ, জনাব ভুট্টো বলেছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বাধীন ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন।
জনাব ভুট্টো সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের কাছে যে খসড়া ফরমুলা পেশ করেন তাতে বলা হয়েছে যে, জাতীয় পরিষদের কোন অধিবেশন বসবে না, জাতীয় পরিষদ দুইটি কমিটিতে ভাগ করা হবে। একটি পশ্চিম পাকিস্তান কমিটি এবং অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান কমিটি, অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রাদেশিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, দুই কমিটি যথাক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান কমিটি ইসলামাবাদে ও পূর্ব পাকিস্তান কমিটি ঢাকা পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবে। এছাড়া অন্তবর্তীকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র মোতাবেক হলেও সমস্ত ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার ভিত্তিতে হস্তান্তর করা হবে।
জনাব ভুট্টো আরও বলেন যে, ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রদেশকে কোনো স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেনি। এতে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন যে, পিপলস পার্টি এ অবস্থায় এই মনে করে যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে, সেখানে স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করা হবে, অতঃপর কেন্দ্রীয় বিষয়াদির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেষে প্রয়োজন হলে দুইটি পৃথক কমিটি গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় পরিষদের সুপারিশের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করুন তিনি এটাই দাবী করেছিলেন। তিনি বলেন যে, একবার যদি প্রদেশগুলোকে ক্ষমতা দেয়া হয় তাহলে পাঁচটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, মার্চ মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁর উপদেষ্টাদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তাতে তারা একটি নতুন ফরমুলা পেশ করেন। এতে তাঁরা তাঁদের পূর্বতন দাবী থেকে সরে গিয়ে বলেন যে, দুটি শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন গঠন করতে হবে এবং জাতীয় পরিষদে শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব পেশ অনুমোদন নেবার প্রয়োজন হবে না।
এই দুটি শাসনতান্ত্রিক কনভেনশন দুটি পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং পরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হয়ে ফেডারেশন নয়, কনফেডারেশনের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। আওয়ামী লীগের এই ডিগবাজীতে আমরা বিস্মিত হইনি। আমরা জানতাম মুজিবুর রহমান কী চান। আমরা জানতাম তাঁর আসল উদ্দেশ্য কী? তাঁর উত্থাপিত প্রস্তাব চালাকি ছাড়া আর কিছু নয়।
জনাব ভুট্টো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। তিনি জনসাধারণকে ভুল পথে চালিত করছিলেন এবং প্রকৃতই তিনি পাকিস্তানের সংহতিতে বিশ্বাস করেন না। ২৩শে মার্চ চূড়ান্ত খেলা দেখানো হয়। বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলা হয়। তাছাড়া জাতির পিতার প্রতিকৃতি পদদলিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে দেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পৃথক করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। জনাব ভুট্টো বলেন, বার কোটি লোকের দেশকে বক্তৃতা, শ্লোগান এবং অন্যভাবে উৎসাহিত করে বিভক্ত ও ধ্বংস করা যাবে না। তিনি বলেন, যেখানে নাইজেরিয়ার মত দেশ একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন হতে দিল না সেখানে পাকিস্তানও দেশকে খণ্ডবিখণ্ড হতে দিতে পারে না।
তিনি জানান, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা পাকিস্তানের নিজস্ব ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
‘ভারত বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করতে পারে’ এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর কোনই অধিকার ভারতের নেই। এরূপ কোন অনুরোধ জাতিসংঘ রক্ষা করতে গেলে তা উস্কানীর কাজ হবে বলে ভুট্টো হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।
দৈনিক পূর্বদেশ, ৩০ মার্চ, ১৯৭১
.
সশস্ত্র বাহিনী দেশপ্রেমিকদের সার্বিক সহযোগিতার দাবী রাখে
-মাহমুদ আলী
.
পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মাহমুদ আলী গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে পরামর্শ না করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাড়াহুড়া করে অতি উৎসাহ বলে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাশ করায় ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি জানিয়েছেন এবং তার আপত্তি খুবই সঠিক। বাস্তবিকই সংশ্লিষ্ট বিষয়টির গুরুত্বকে কোনক্রমেই খাটো করে দেখা যায় না। ভারতীয় লোকসভা প্রস্তাবটি গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার সর্বজনস্বীকৃত আন্তর্জাতিক নীতিকে পদদলিত করেছে। মিঃ করুণানিধির কণ্ঠে তাই, ক্ষুদ্র জাতিসমূহের স্বাধীনতা গ্রাস করার বৃহৎ জাতিগুলোর ফ্যাসিবাদী মতলবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ভারত যা করেছে তাতে অন্যান্য এশীয় দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিসন্ধি প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
ভারতীয় পার্লামেন্টের সর্বসম্মত প্রস্তাবের পরপর পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র ভারতীয় লোকদের অনুপ্রবেশ আমাদের দেশের পূর্ব অঞ্চলের লোকদের জন্য অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, মানুষের জানমাল বিপন্ন হয়েছে এবং অন্যান্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যথায় তাদের উপর এ বিপদ আসতো না।
এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বিকাশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
সশস্ত্র তৎপরতাকে উৎসাহ দান এবং সাহায্য করা ছাড়াও ভারত তার রেডিওসহ সমস্ত প্রচার-মাধ্যমকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষোদগারের এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্লজ্জ মিথ্যা বানোয়াট বিদ্বেষমূলক প্রচারণার কাজে নিয়োজিত করেছে।
সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের এবং তাদের সহযোগীদের প্রতিরোধ করা এবং তাদের একটি চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী মাঠে নেমেছে। আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনী সকল দেশপ্রেমিক মানুষের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার দাবী রাখে। এই সমর্থন যত বেশী হবে, তত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে, দেশের এই অংশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক তৎপরতা শুরু সহজ হবে।
আমি আশা করি ও বিশ্বাস করি যে আমাদের জনসাধারণ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং জাতির আহ্বানে সাড়া দেবেন। যেমনটি তারা ১৯৬৫ সালে ভারত ও তার সহযোগীদের সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন।
দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১
.
বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য ভারত ভিত্তিহীন প্রচারণা চালাচ্ছে
-হামিদুল হক চৌধুরী
.
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বিশিষ্ট এডভোকেট জনাব হামিদুল হক চৌধুরী নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়েছেনঃ
পূর্ব পাকিস্তানীরা যাই চেয়ে থাক না কেন, তারা নিশ্চয়ই দেশের ঐক্য বানচালের পরিকল্পনা করেনি বা করে না।
পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্প্রসারণবাদী সুবিধার জন্য পাকিস্তানকে ধ্বংস করাই ভারতের প্রচারণার একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। এই উদ্দেশ্য পূরণ এবং বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য সকল তথ্য মাধ্যমে বোমা বর্ষণ করে শহরসমূহকে ধ্বংস ও হাজার হাজার লোককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগ বিশ্বের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।
বস্তুতপক্ষে খবর ও অভিমতের ব্যাপারে ভারতীয় বেতার-সময়ের অর্ধেকটাই এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যয় করা হচ্ছে। কতদিন এই ধরণের মিথ্যা টিকে থাকতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানীরা কী চায় তা মাত্র ১২০ দিন আগে ঘোষিত হয়েছে– যখন সমগ্র প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা একটি মাত্র জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনের জন্য ভোট দেন।
জনগণ সমগ্র দেশকে (পূর্ব ও পশ্চিম) একটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করে একটি মাত্র জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে বসার জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে একটি একক দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানসহ পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত সেই দেশের সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।
ভারতীয় প্রচারণাকারীরা কী করে দাবি করেন যে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবং সেই অর্থহীন তত্ত্বের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দিতে শুরু করেছে।
প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের ব্যক্তিদের পাকিস্তান অপেক্ষা ভারতে বেশি পাওয়া যাবে। প্রাণহানি হয়েছে, কারণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হতে বাধ্য, যখন আইন ও শৃঙ্খলা এমন এক পর্যায়ে ভেংগে পড়েছিল যা আমরা ফেব্রুয়ারী ও মার্চ মাসে দেখেছি। এটা খুবই দুঃখজনক এবং এটা এড়ানো প্রত্যেকেরই কাম্য। আমি আশা করি গোটা অঞ্চলের শান্তি এবং উভয়ের দেশের জনগণের কল্যাণের খাতিরে ভারত এই শত্রুতামূলক পথ থেকে বিরত হবে। প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে ভারতের কোনো সন্দেহ থাকলে এখানে তাদের কূটনীতিকদের কাছ থেকে তারা সহজেই তা জানতে পারেন। এই কূটনীতিকরা আবাসিক এলাকায় নিরাপদে বাস করছেন যে আবাসিক এলাকা ভারতের উর্বর বেতার ও প্রচারণাকারীদের মতে ভূমিসাৎ করা হয়েছে।
এখন সকল শ্রেণীর জনগণের কর্তব্য হচ্ছে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দ্বিগুণ নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মনিয়োগ করা। মার্চ মাসে তিন সপ্তাহ যাবৎ হরতালের ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যেক সরকারের কাছে এই আশা করার অধিকার আছে যে তাদের জীবন, স্বাধীনতা এবং পেশা রক্ষিত হবে। যত শীঘ্র সম্ভব বেসামরিক জনপ্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি অভিনন্দনযোগ্য।
দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ১৯৭১
.
ভারতের প্রতি ভুট্টোর সতর্কবাণী
.
মুলতান, ৫ই এপ্রিল।- পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ ভারতের প্রতি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে।
দৈনিক জং-এর এক খবরে বলা হয়, জনাব ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের জনগণ ঐক্যবদ্ধ এবং ভারতের প্রতিটি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের দাঁত ভাংগা জওয়াব দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুত।
জনাব ভুট্টো তার ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসের এক বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমাদের মহান প্রতিবেশী চীন এ অঞ্চলে ভারতকে তার সম্প্রসারণমূলক যুদ্ধ শুরু করতে দেবে না। একথার প্রমাণ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাওয়া গেছে। এশিয়ার এই বিরাট শক্তি ১৯৬৫ সালে ভারতকে যে চরমপত্র দিয়েছিলো ভারতের তা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।
তিনি বলেন, এশিয়ার মহান শক্তি চীনের জনগণ নিজের উক্তিতে অনড়। খাঁটি বন্ধু ও স্বাধীনতা প্রিয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি চীনাদের সমর্থন রয়েছে।
জনাব ভুট্টো আজ মুলতানে পিপিপির কর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণদান প্রসংগে বলেন, জাতি এখন মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুরা দেশের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। একা সরকারের পক্ষে এ সংকট আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়। প্রতিটি নাগরিকদের এ নাজুক মুহূর্তে নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, পাকিস্তান পিপলস পার্টি দেশের নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব ও সংহতির জন্য সচেষ্ট। তিনি বলেন, তার পার্টি এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না যাতে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে পড়বে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা ও সংহতি সংরক্ষণ করা। এ জন্য আমরা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
বর্তমান সংকটের উল্লেখ করে জনাব ভুট্টো বলেন, অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের ছ-দফা কর্মসূচী ছিল মূলতঃ দেশকে দু-অংশে বিভক্ত করার ফর্মুলা। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে তাড়াতাড়ি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তাতে পরিষদে অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর ৬ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন প্রত্যাখ্যাত বিনাশর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট আত্মসমর্পন করেন। কেননা তাঁদের আশা ছিল তারা মন্ত্রীত্ব পাবেন।
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, পিপিপি জানত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে পূর্বে প্রস্তুতকৃত আইন অনুমোদন ছাড়া আর কিছুই করা হবে না। অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ ৬-দফা ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রূপ দিয়েছিল। অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ স্পষ্ট ঘোষণা করেছিল, সে ৬-দফা কর্মসূচীতে এতটুকু পরিবর্তন করবে না। এ জন্য পরিষদে কোন প্রকার অর্থপূর্ণ আলোচনাও সম্ভব ছিল না। আর এ জন্যই পিপলস পার্টি পীড়াপীড়ি করেছিল যে পরিষদের অধিবেশনের আগেই শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয়ে উভয় সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টির ঐক্যমত হওয়া প্রয়োজন।
জনাব ভুট্টো বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান জানুয়ারী মাসে পরিষদের অধিবেশন ডাকতে চাইতেন কিন্তু মার্চে তিনি পরিষদের বাইরে সমঝোতা স্থাপনে সম্মত হন। একথা স্পষ্ট যে, পিপলস পার্টি আইনগত ভাবে দেশকে টুকরো করার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল।
জনাব ভুট্টো বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন নেতা অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি করাচীর এক জনসভায় দেশকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করেন। অথচ তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর হাতে হস্তান্তর করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের সংহতি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই পিপলস পার্টি অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সাথে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল। এ ছাড়া এপিপির ক্ষমতার এতটুকু খায়েশ ছিল না। তিনি বলেন, এটা ছিল দুঃখজনক যে, সেসব রাজনৈতিক নেতাই এমন একজন লোকের নিকট তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী করছিলেন যিনি দেশকে টুকরো করতে চেয়েছিলেন।
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, এটা ছিল মূলতঃ লন্ডন পরিকল্পনার একটা অংশ। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের পরাজিত নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যোগসাজশ করে উক্ত পরিকল্পনাটি তৈরী করেন।
তিনি বলেন, মূলতঃ এসব রাজনৈতিক নেতা নিজের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও আদর্শকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, পিপলস পার্টি যে দেশকে টুকরো টুকরো করা থেকে রক্ষা করেছে ইতিহাস তা প্রমাণ করবে।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আসল সমস্যা হল বর্তমান অর্থনীতির … শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করা। অনুরূপ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও এই একই সমস্যা। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ এই বিশ্বাসে ৬-দফার পক্ষে ভোট দিয়েছে যে, এর মাধ্যমে বর্তমান অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটবে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তারা ৬ দফার পক্ষে ভোট দেয়নি।
পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের যে কোন প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট এক পাকিস্তানের নিশ্চয়তা দিবেন এবং দেশের উভয় অংশ থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটাবেন পিপলস পার্টি তার সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
দৈনিক পাকিস্তান, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১
.
ভারতীয় হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী
পীর মোহসিন উদ্দিনের বিবৃতি
.
পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রেসিডেন্ট পীর মোহসিন উদ্দিন আহমদের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণঃ
গত কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলী সম্পর্কে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম কল্পিত ও নির্লজ্জভাবে মিথ্যা খবর পরিবেশন করে আসছে। এ ধরনের জঘন্য ও মিথ্যা প্রচারণায় তারা এতটুকু ইতস্ততঃ বোধ করছে না।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর উপর ভারতীয় পার্লামেন্টেও একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবরও ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ, সাদা পোশাকে ভারতীয় সৈন্যদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ এবং গভীর সাগরে পাকিস্তানী বাণিজ্য জাহাজ হয়রানীর খবর পাওয়া গেছে।
এসব কার্য্যকলাপের মাধ্যমে ভারত তার আজাদী পূর্বকালের মানসিকতারই পরিচয় দিচ্ছে। ভারতের এসব কার্য্যকলাপ আমাদেরকে আজাদী পূর্ব দিনগুলোতে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যেসময় ব্রিটিশ রাজ্যের ছত্রছায়ায় ভারতীয় হিন্দুরা প্রতারণা করে মুসলমানদের সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে এবং ধর্মীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ ও মুসলিম ছাত্রদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি করে মুসলমানদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করেছে। সুতরাং তৎকালীন ভারতের মুসলমানগণ তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অগ্রগতির নিশ্চয়তা বিধান ও ধর্মীয় ও জাতীয় স্বাধীনতা পুঃনপ্রতিষ্ঠার জন্য ভারত বিভাগ করে একটি সম্মানজনক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু ভারত আজও তার পুরানো নীতি ভুলতে পারেনি। দেশ বিভাগের পর সীমানা চিহ্নিতকরণ ও পাকিস্তানের পাওনা প্রদানে অস্বীকৃতি, পূর্ব পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বন্ধের চেষ্টা, পাকিস্তানের আজাদী হরণ করার প্রচেষ্টা প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।
এবারও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার সম্পর্কে একই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সক্রিয় হয়েছে। ভারত এ যাবত যা করেছে, তা শুধু জঘন্য ও নিন্দনীয়ই নয়, এটা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিরও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং আমি ভারতীয় কার্যাবলীর তীব্র নিন্দা করে ভারত সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনই এই ভারতীয় চক্রান্তের স্বীকার হবে না, বরং ভারতীয় চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্যে তাদের জানমাল কোরবান করতে তারা এতটুকু দ্বিধা করবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের আজাদী রক্ষার জন্য এক কাতারে দাঁড়াবে।
আমি সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী ভাইদের প্রতি ভারতীয় অনুপ্রবেশের সব রকম প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার আবেদন জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনী অভ্যন্তরীণ আইন ও শৃঙ্খলা বজায়, শান্তি প্রিয় জনসাধারণের জান, মাল ও ইজ্জত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ও দেশের সীমান্ত রক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে। সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারী ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা দরকার। সুতরাং আমি এ কাজে সকলের প্রতি সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
দৈনিক পাকিস্তান, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১।
.
ভারত পূর্ব পাকিস্তানীদের দাসে পরিণত করতে চায়
মওলানা মফিজুল হক
.
পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলেমার সাধারণ সম্পাদক মওলানা মিয়া মফিজুল হক বলেন, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষকে চিরদিনের জন্যে দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে নিয়োজিত রয়েছে।
এপিপির খবরে প্রকাশ, গত মঙ্গলবার ঢাকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে মওলানা মফিজুল হক বলেন, ভারত তাদের বেতার প্রচারণা ও সশস্ত্র লোক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বিপথে পরিচালিত করেছে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে এই প্রদেশটিকে ধ্বংস করে দিতে চায়। তিনি বলেন, ভারতীয়রা বন্ধুর ছদ্মাবরণে দরদী সেজে আমাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পঙ্গু করে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী হয়ে ভারতীয়দের সাহায্যের আশায় আছেন তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। অতীতে প্রাকবিভক্ত কালীন দিনে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদ মুসলমানদের সাথে কি ধরণের ব্যবহার করেছিল, তা থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এমন কি এখনও তারা ভারতীয় মুসলমানদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মওলানা মফিজুল হক বলেন, আমরা নির্বাচনের বহু পূর্বেই (অধুনা বে আইনী ঘোষিত) রাজনৈতিক দলকে জাতিকে এক অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে না দেয়ার জন্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের হুঁশিয়ারীর প্রতি কর্ণপাত করেননি। তিনি আরও বলেন, ভারতের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ভারতের যে কোন রকমের হুমকি মোকাবিলায় প্রতিটি পূর্ব পাকিস্তানী এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মওলানা হক শত্রুদের প্রতিহত এবং দেশে আইন শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
পূর্ব পাকিস্তান আঞ্জুমানে মোহাজেরীন এর সভাপতি দেওয়ান ওয়ারাসাত হোসেন খান পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও সংহতি রক্ষার নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে লাখ লাখ মোহাজের যে কোন রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যার্থে পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র ভারতীয়দের প্রেরণের দ্বারা ভারত আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থী ভারত কর্তৃক এই ধরনের আক্রমণাত্মক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য বিশ্বজনমতের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
দৈনিক পাকিস্তান, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১।
.
পাকিস্তানকে ধ্বংস করার আরেকটি পদক্ষেপ
ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ
.
পাকিস্তান কাউন্সিল লীগের এগারো জন নেতা গত সোমবার সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি দিয়েছেনঃ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ভারত পাকিস্তানের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে আসছে। এর বিশেষ কারণ এই যে ভারতের অঞ্চল হতে দুটো অঞ্চলকে আলাদা করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে ভারত মানসিক দিক থেকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি।
একথা সকলেরই জানা আছে যে ভারত বিভাগ বাতিল করার জন্য ভারত প্রতিটি সুযোগেরই সদ্ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। এমনকি ভারত ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের উপর সশস্ত্র হামলাও করেছিল। কিন্তু বীর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও জনসাধারণ এই জঘন্য প্রয়াসকে পুরোপুরি ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমাদের জনসাধারণ কখনোই ভুলবে না যে, লক্ষ লক্ষ মুসলমানের জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে ভারতীয় মুসলমানদের এই বাসভূমি অর্জিত হয়েছে। কোন গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ঐ আত্মত্যাগ করা হয়নি- হয়েছিল ইসলামিক সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে আদর্শভিত্তিক জীবনযাত্রা বাস্তবায়নের জন্য। সমস্যা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা জনসাধারণকে দেশের সংহতি ও আদর্শ রক্ষা থেকে কখনোই বিরত করবে না।
পাকিস্তান এখন বিভক্ত বলে ভারতীয় নেতারা যে অভিমত পোষণ করছেন তা পুরোপুরি ভুল। সমগ্র জনসাধারণ দেশের সংহতি রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পাকিস্তানের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা জনসাধারণকে দেশের সংহতি ও আদর্শ রক্ষা থেকে কখনোই বিরত করবে না।
ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার আর একটি পদক্ষেপ ছাড়া কিছুই নয়। ভারত তাই তার বেতার মারফত মিথ্যা ও অন্যায় প্রচারণা দ্বারা বিশ্বের জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আমরা নিশ্চিত যে, আমাদের জনসাধারণ এই ভিত্তিহীন প্রচারণায় কান দেবেন না।
ভারত আমাদের এই প্রিয় দেশ দখল করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সশস্ত্র সৈন্য পাঠাচ্ছে।
আমরা দৃঢ় কণ্ঠে ভারতের এই দূরভিসন্ধিমূলক কার্যক্রমের নিন্দা করছি। আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য শত্রুর সকল চেষ্টা ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হবার আবেদন জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন (১) পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহ সভাপতি এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, (২) পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল কাসেম (৩) পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দিন (৪) পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আতাউল হক খান (এডভোকেট), (৫) পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ আতাউল হক (এডভোকেট), (৬) পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নুরুল হক মজুমদার (এডভোকেট), (৭) ঢাকা শহর মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ সেরাজুদ্দিন, (৮) পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম মুজিবুল হক, (৯) ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি কে এম সেরাজুল হক, (১০) ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক নেজামুদ্দিন, (১১) ঢাকা শহর মুসলিম লীগের সম্পাদক এ মতিন এডভোকেট।
দৈনিক পাকিস্তান, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১।
.
প্রেসিডেন্টের ব্যবস্থা সমর্থনের আহ্বান
পিন্ডি বারের ৮০ জন সদস্যের বিবৃতি
.
রাওয়ালপিন্ডি, ৭ ই এপ্রিল (এপিপি)। পাকিস্তানের শত্রুদের উস্কানির দরুণ পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্ট সঙ্কটের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তার প্রতি পূর্ণ ও অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য রাওয়ালপিন্ডি বার সমিতির ৮০ জন সদস্য দেশের সকল দেশপ্রেমিক লোকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল এক বিবৃতিতে আইনজীবীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিঃ এন পদগর্নির লিপির জবাবে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। যথোপযুক্তভাবে পত্রের জবাবে পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাধারণভাবে সমগ্র বিশ্বের নিকট এবং বিশেষ করে ভারত সরকারকে এটা পরিষ্কার করে আমরা জানিয়ে দিতে চাই যে, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য দেশের সমস্ত মানুষ পাকিস্তানের শত্রুদের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পেছনে ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, পাকিস্তানের শুরু থেকেই আইনজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি রক্ষার সংগ্রামের প্রথম সারিতে রয়েছে।
আইনজীবিরা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য প্রসিডেন্টের নেতৃত্বে যে কোন পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস প্রসিডেন্টকে দিয়েছেন।
দৈনিক পাকিস্তান, ১ এপ্রিল, ১৯৭১
আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষেই কাজ করছিল
কাজী কাদের
.
করাচী ৮ ই এপ্রিল, (এপিপি)। পাকিস্তান মুসলীম লীগের (কাইয়ুম গ্রুপ) প্রধান সংগঠক জনাব কাজী আবদুল কাদের আজ এখানে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সময়োচিত পদক্ষেপ এবং একই সাথে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি ব্যাপারে একটি কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তা হলো আওয়ামী লীগ নেতারা পাকিস্তানের পরম শত্রু ভারতের পক্ষেই কাজ করছিলেন।
তিনি এখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী জনাব কাদের শেখ মুজিবর রহমানের এবং বে-আইনী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন সমস্ত অরাজকতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানই দায়ী।
তিনি বলেন, নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান গোটা পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে পরিচালিত না করার দরুণই পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ আরো কতিপয় ঘটনাকে শেখ মুজিবুর রহমান মূলধন করেছিলেন। তার গোটা রাজনীতি মাত্র একটি বস্তু অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান এবং তার অধিবাসীদের ঘৃণার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
.
কাজী কাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভারতের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এ জন্যেই তিনি তাঁর রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানে সীমিত রেখেছিলন।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু তারা শোষণের বিরুদ্ধে চটকদার শ্লোগান দিয়ে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীদের মন বিষিয়ে তুলেই বিজয়ী হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ভারতের সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের যোগসাজশের আসল মতলবটা যদি জনসাধারণ জানতো, তাহলে তারা নিষিদ্ধ দলটিকে কোন মতেই ভোট দিত না।
জনাব কাদের বলেন যে, বিগত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র বিরোধী চক্র কুখ্যাত হিন্দু গুন্ডা এবং দুর্বৃত্ত দুষ্কৃতকারী দলের আশীর্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারকালে আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের উদ্দেশ্য অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং আমাদের প্রিয় দেশকে খন্ড-বিখন্ড করার কথা প্রকাশ করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী জনাব কাদের বলেন যে, আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনে যা যা ঘটেছে তার সব কিছুর জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলই পুরোপুরি দায়ী।
তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব ও তাঁর দলের লোকেরা কুখ্যাত বাইশ পরিবারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পয়সা নিয়েছে।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানেকে ভারতের কাছে তুলে দেয়া বা মার্তৃভূমির বাকী অংশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে জনসাধারণ নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি।
রাষ্ট্র বিরোধীদের বিরুদ্ধে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে কাজী কাদের তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের কাছে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র অংকুরেই বিনাশ করে প্রেসিডেন্ট তার রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্বই পালন করেছেন।
কাজী কাদের পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ এবং ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও বেতারের জঘন্য প্রোপাগান্ডা এবং নাক গলানোর জন্যে ভারতকে উৎসাহদানকারী এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির বিকৃত খবর পরিবেশনরত পাশ্চাত্যের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকার তীব্র নিন্দা করেন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে চীন যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে, তিনি তাকে স্বাগত জানান।
কাজী কাদের বলেন যে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ প্রবর্তিত ফ্যাসিবাদী নীতিতেই গত নির্বাচন সম্পাদিত হয়েছিল।তিনি বলেন যে, পাকিস্তান মুসলিম লীগ সব সময় পাকিস্তানের সংহতি ও আঞ্চলিক অখন্ডতা অক্ষুণ্ন নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। যখনই মুসলীম লীগের পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ৬ দফা কর্মসূচীর বিরুদ্ধে কথা বলেছে তখনই তাদের পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের তাবেদার বলে অভিহিত করা হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীই প্রমাণ করেছে যে, পাকিস্তান মুসলীম লীগ যে কথা বলেছিল তা সম্পূর্ণ সত্য।
দৈনিক পাকিস্তান, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১।
.
পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে সোভিয়েত মনোভাবের প্রতিবাদ
সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো
.
করাচী, ১৪ ই এপ্রিল (এপিপি)।পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে আজ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের মনোভাবের জোর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি তার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্ণির বাণীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে গণচীনের ভূমিকাকে সঠিক এবং সময়ানুগ বলে অভিহিত করে বলেন, সোভিয়েতের মনোভাব লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের শিক্ষার পরিপন্থী।
পদগর্ণির বাণীর জবাবে জাতিসংঘ সনদ ও বান্দুং নীতিতে বর্ণিত সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘ সনদ এবং বান্দুং নীতি ভুলে গিয়েছে কিনা জানি না। তবে তারা লেনিনের সমাজতন্ত্রের আদর্শ ভুলে গিয়ে থাকলে সেটাই হবে বিস্ময়কর।
ভুট্টো বলেন, এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থপতি ও নির্মাতা ভি আই লেনিনের বৈদেশিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক সংক্রান্ত বিখ্যাত নীতির বরখেলাপ। অথচ উক্ত নীতি হল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান নীতি।
ভুট্টো বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বৃহৎ শক্তিশালী প্রতিবেশী ও পাকিস্তানের এক ভাল বন্ধু।পাকিস্তান তার সাথে ভাল সম্পর্ক চায় এবং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পাকিস্তান সোভিয়েতের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি মন্ত্রী থাকাকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তার ব্যক্তিগত গভীর আগ্রহের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেওয়া নেওয়ার উপাদানটি খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে চিঠি লিখেছেন, যে বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এখতিয়ারে ছিল এবং থাকবে।
যে সংকট দেখা দিয়েছে, স্বভাবতই তার রাজনৈতিক সমাধানই পাকিস্তানের কাম্য হবে।
আমরা রাজনৈতিক সমাধানের সব রকম চেষ্টা করেছি। যখনই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, আমি নিশ্চিত যে, আলোচনার সূত্র বের করা হবে এবং রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর নতুন প্রয়াস শুরু হবে।কেননা রাজনৈতিক নিষ্পত্তিই হলো আসল নিষ্পত্তি।
তিনি অবশ্য বলেন, পাকিস্তান কোন রাজনৈতিক মীমাংসা অথবা অন্য কোন সমাধান পেল কিনা সেটা সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের জনগণের নিজস্ব ব্যাপার। নিষ্পত্তির ধরণ কি হবে সেটা তারাই ঠিক করবেন। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান কিভাবে করবো সে ব্যাপারে অন্য কারো উপদেশ আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা অন্য কোনো দেশের কলোনী নই অথবা কারো প্রভাবাধীন নই যে আমাদের এ ধরনের উপদেশ মানতে হবে।
যাই হোক ভুট্টো বলেন যে, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সময় অন্যান্য কতিপয় দেশের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতে চান না।
আমি এটা বলছি কারণ এ পর্যন্ত তাদের মনোভাব অস্পষ্ট এবং তাদের হস্তক্ষেপের কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ এখনো এমন সিদ্ধান্তমূলক নয় যে, এর প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।যাই হোক আমরা পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি এবং হস্তক্ষেপের মাত্রা বাড়লে এবং আমরা হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলে অবশ্যই আমাদের জনগণকে আস্থায় আনব এবং পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বৈদিশিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার পরই শুধুমাত্র চীন পাকিস্তানকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। চীন প্রধান এশীয় শক্তি এবং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ও জাতিসংঘ সনদ নগ্নভাবে লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করেছে।
ভারতীয় হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের এই ন্যায্য সংগ্রামের চীনা সমর্থনের জন্য পাকিস্তানী জনগণ চীনের কাছে কৃতজ্ঞ।
আমাদের অভ্যন্তরীণ অসুবিধা সমূহ দূর করার কাজ বিদেশী রাষ্ট্রগুলো আমাদের হাতে ছেড়ে দিলে ভাল হয়।
আমরা গুরুতর সমস্যায় নিপতিত এবং আমরা এর প্রতি অবিভক্ত ও পূর্ণ দৃষ্টি দিতে চাই।
জনাব ভুট্টো বর্তমান সংকটের মোকাবিলায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের দাবী জানান।
তিনি বলেন, বৈদিশিক হস্তক্ষেপ রোধের একটি নিশ্চিত পন্থা হলো তার মোকাবিলায় ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ।
তিনি বলেন যে, গঠনমূলক রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ফলপ্রসূভাবে বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়। তিনি জানান যে, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা কাহিনী ও গুজব ছড়িয়ে এই পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করা হচ্ছে। জনাব ভুট্টো বলেন যে, জনসাধারণ বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ দলরূপে পিপলস পার্টিকে নির্বাচিত করেছে। তাই জনগণের প্রতি পিপলস পার্টির সরাসরি ও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমান সংকট অবসানের জন্য তাদের গঠনমূলক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
তিনি বলেন যে, এ ব্যাপারে গত ১লা ও ২রা এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা বর্তমান সংকট সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। জনাব ভুট্টো বলেন, দেশের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতি অবসানের জন্য জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ যে প্রয়োজন সেকথা আমি প্রেসিডেন্টকে বলেছি। জনাব ভুট্টোর ধারণা, প্রেসিডেন্ট সমস্যাটি সমাধানের উদ্দেশ্যে যাতে যুক্ত প্রচেষ্টা চালাতে পারেন সেজন্য তিনি (প্রেসিডেন্ট) ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করতে ইচ্ছুক হচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস, এ ধরনের জাতীয় সমস্যা একমাত্র জনগণই সমাধান করতে পারে। অবশ্য আমরা যদি আমাদের ব্যাপারে ঠিকঠাক করার, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার, অতীত অবস্থা বর্জন ও নতুন করে জীবন শুরুর জন্যে সংকল্পবদ্ধ হই।
পাকিস্তানকে খন্ডিত করার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে
ফরিদ আহমেদের বিবৃতি
.
এপিপি পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ, মৌলবী ফরিদ আহমেদ গতকাল বলেছেন, পাকিস্তানকে খন্ডিত করা এবং মুসলমানদের হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ফ্যাসীবাদের ক্রীতদাসে পরিণত করার ভারতীয় চক্রান্ত বর্তমানে নিরপেক্ষ বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, দেশদ্রোহী ও পাকিস্তানীদের মধ্যে থেকে হিন্দু-ভারতের সংগৃহীত ক্রীড়ণকদের রক্ষা করার জন্য হিন্দুস্থান পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক অত্যাচারের মনগড়া ও ভিত্তিহীন কাহিনী ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। হিন্দু-ভারতের সঙ্গে যে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা ষড়যন্ত্র করছে, তারাই আগ্রহভরে এই মিথ্যা সংবাদ গোপনসূত্র থেকে প্রাপ্ত বলে প্রচার করছে।
তিনি বলেন, এই সব সংবাদদাতা সক্রিয়ভাবে এই কুকর্মে লিপ্ত রয়েছে। ঢাকা শহর ধ্বংস করা হয়েছে, ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও, জেনারেল টিক্কা খানের হত্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত , শেখ মুজিব ও তাঁর অনুগামীগণ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বিভিন্ন অংশের রণাঙ্গণে বিরাট বিজয়ের মিথ্যা সংবাদ বর্তমানে সম্পূর্ণরুপে ফাঁস হয়ে পড়েছে।
মৌলবী ফরিদ আহমেদ বলেন, যাঁরা এই মিথ্যাচার পরীক্ষা করছেন, তাঁদের সীমান্ত পারের এই অসত্য প্রচারণা ঘৃণা সৃষ্টি করেছে।
মৌলবী ফরিদ আহমেদ বলেন, আমরা দুবার চট্টগ্রাম সফর এবং বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনার সুযোগ হয়েছে। ১লা মার্চ থেকে ২৯শে মার্চ পর্যন্ত সময়ে সব শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় করা হয়। রিপোর্ট ও আনুমানিক হিসেবে প্রায় এক কোটি টাকা বেআইনী আওয়ামী লীগ গণবাহিনীর সদস্যরা বন্দুকের মুখে আদায় করেছে। এই কাজে চট্টগ্রামের সুপরিচিত হিন্দু যুবকেরা সক্রিয়ভাবে তাদের সাহায্য করেছে। আমরা বর্বরতার এমন এক অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছি যা এক শ্রেণীর পশু তাদের স্বগোত্রীয় পশুদের ওপরেও প্রয়োগ করে না।
কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে মৌলবী ফরিদ আহমেদ বলেন, ২৬শে মার্চ রাত্রে পাথরঘাটার কার্যরত প্রহরীদের হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ, তারা এমন এক শ্রণীর মুসলমান যাকে হিন্দু ও তাদের সহযোগীরা পছন্দ করে না। এই প্রহরীদের মধ্যে একজন কোন মতে রক্ষা পায় এবং সে শপথ নিয়ে আমাকে বলেছে কিভাবে ২৬শে মার্চ তাদের ওপর হত্যাকান্ড সাধিত হয়েছে। একইভাবে কর্ণফুলীর কাগজকলের কর্মচারীগণ তিনটি ট্রাকযোগে আশ্রয়লাভের জন্য যখন চট্টগ্রাম আসছিল তখন কালুরঘাটের পুলের কাছে তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। শেরশাহ কোলনীতে আরো ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন অংশ থেকে একই ধরনের খবরাখবর পাওয়া গেছে।
সমস্ত ওয়ালেস কলোনী অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছে। কাউকে রেহাই দেয়া হয়নি।
আমাদের মাতৃভূমিতে ভারতীয় এজেন্টদের হাতে আমাদের কি এই মূল্য দিতে হবে? ইসলামের নামে যে দেশের জন্ম, সেই দেশে আশ্রয় লাভের জন্য যারা হিন্দুস্তানে তাদের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন, তারা কি এমন ব্যবহার পাবেন যেমন ব্যবহার পশুরাও মানুষের কাছে আশা করে না?
মৌলবী ফরিদ বলেন, সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হচ্ছে, গত ২৭শে অথবা ২৮শে মার্চ সকালে ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী চার ভাই যখন পবিত্র কোরআন পাঠরত ছিলেন, তখন বেআইনী আওয়ামী লীগ সদস্যদের সাহায্যে ভারতীয় এজেন্টরা তাদের আক্রমণ করে। তিনজনের কাছ থেকে তিনটি কোরআন তারা ছিনিয়ে নেয়। চতুর্থ ব্যক্তি জনাব আব্দুল মজিদ তার কোরআন দিতে অস্বীকার করেন। তখন অন্যান্য তিনজনসহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, একমাত্র ইসলামের নামেই এই দেশের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ভারতীয় এজেন্টরা তথাকথিত সাংস্কৃতিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে এমন জঘন্য কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয়েছে, যা করতে হিটলারের ঘাতকদের বর্বরতাও লজ্জা পাবে।
তিনি বলেন, এই ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতেই সেনাবাহিনী এই সমস্ত লোকদের উচ্ছেদ করে পরিস্থিতি আয়ত্বে এনেছে। এদেরই হিন্দুস্তানী গুন্ডারা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী বলে উল্লেখ করছে। এ সব কারণেই চট্টগ্রামবাসীরা সেনাবাহিনীকে তাদের ত্রাণকর্তারূপে দুই হাতে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। অনেকে প্রকৃত ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমে সেনাবাহিনীর এই মহান কার্যকলাপে চট্টগ্রামের শাহী জামে মসজিদে অশ্রুসিক্ত নয়নে মোনাজাত করেছেন। ভারতের সাহায্যপুষ্ট গুন্ডাদের ষড়যন্ত্র বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচনের জন্য আমি কর্তৃপক্ষকে ঘরে ঘরে তদন্ত চালিয়ে সব রকমের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য অনুরোধ জানাই।
দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
ইয়াহিয়া ভুট্টোর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে
-সলিমী
.
লারকানা, ১৩ ই এপ্রিল (এপিপি)। বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জনাব বি এ সলিমী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতাবাদীর সাথে তার সম্পূর্ণ সম্পর্কহীনতা এবং অননুমোদন ঘোষণা করছেন।
গত রোববার এক বিবৃতিতে তিনি বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের দেশ-প্রেমিক এবং দলের গোপন বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনার সম্পর্কে অজ্ঞ সদস্যদের প্রতি বর্তমান সংকট উত্তরণ এবং জাতীয় সংহতি ও অখন্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পিপলস পার্টি প্রধান জনাব ভুট্টোর সাথে সহযোগিতারও আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পিপলস পার্টি প্রধান জনাব ভুট্টো সাম্প্রতিক সংকটে যে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছেন সেজন্য জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তিনি পাকিস্তানের প্রতি ভারতের শত্রুতামূলক আচরণেরও নিন্দা করেন। সেনাবাহিনীর দক্ষতায় আস্থা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী পাকিস্তানের দুশমনদের সব অশুভ চক্রান্ত নস্যাৎ করে বর্তমান সংকট পাড়ি দেবে তাতে আমরা নিশ্চিত।
জনাব সলিমী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দ্বৈত ভূমিকারও কঠোর নিন্দা করেন
দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
ভুট্টোর নির্দেশঃ প্রেসিডেন্টের হস্ত শক্তিশালী করুন।
চিস্তিয়ান, ১৯ শে এপ্রিল, পিপিআই। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জেড, এ ভুট্টো যারা পাকিস্তনের অখণ্ডতা আর সংহতির বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সম্পর্ক সরকারের কাছে রিপোর্ট করার জন্য দলীয় সদস্যদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এখানকার পিপিপি প্রসিডেন্ট সৈয়দ ইমদাদ হোসেন শাহের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে জনাব ভুট্টো এই আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাঁর দলীয় সদস্যদের প্রতি বর্তমান সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হস্তকে শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান।
পূর্বদেশ, ২০ এপ্রিল, ১৯৭১।
রাজনৈতিক শুন্যতা পূরণের জন্য শাসনতন্ত্র
জারির সুপারিশ
করাচী প্রেস ক্লাবে খান আবদুল কাইয়ুম খান
.
করাচী, ২রা মে (পিপিআই)। কাইয়ুমপন্থী পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান আবদুল কাইয়ুম খান আজ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য একটি শাসনতন্ত্র জারি করার সুপারিশ করেন।
করাচী প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, শাসনতন্ত্রের অভাবে দেশ বেশী দিন চলতে পারে না। তিনি যে শাসনতন্ত্রের উল্লেখ করেন তাতে মৌল অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে এবং দেশের ঐক্য ও সংহতি এমনভাবে বিধিবদ্ধ করতে হবে যাতে ভিতরের ও বাহিরের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। মুসলিম লীগ প্রধান শক্তিশালী কেন্দ্রের সুপারিশ করেন এবং বলেন যে, পূর্বের চেয়ে এখন এর প্রয়োজন আরো বেশী। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেআইনী ঘোষণা করার দাবী জানান।
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ধ্বংস করতে হবে।
এপিপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয় যে , কাইয়ুমপন্থী পাকিস্তান মুসলীম লীগের প্রেসিডন্ট খান আবদুল কাইয়ুম খান গতকাল বলেন যে, দেশের যে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শক্তির মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে।
সিন্ধু প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ, এম, কোরেশী আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতাকালে খান কাইয়ুম বলেন যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বীজ পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির মধ্যেও রয়েছে। তিনি বলেন যে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে সহায়তা করেছিলো এবং নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে অতি সত্বর ক্ষমতা দানের দাবী করেছিলো তাদেরকেও প্রকাশ্যে তুলে ধরতে হবে এবং এই সমস্ত দল গুলোকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত।
সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে অনুরূপ ধ্বংসাত্মক কাজ পশ্চিম পাকিস্তানে ঘটবার জন্যও কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তি চেষ্টা করছে বলে কাইয়ুম খান বর্তমান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ভারত যাতে চীনের বিরুদ্ধে লড়তে পারে সেজন্য তারা ভারতের হাত শক্তিশালী করতে চেষ্টা করছেন। ইতিপূর্বে তিনি বলেছেন, ভারত চীনের
বিরুদ্ধে লড়বার মতো অবস্থায় নেই। সে যে সামরিক সাহায্য পাচ্ছে তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে। সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে যে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ আটক করা হয়েছে তা এরই প্রমাণ।
খান আবদুল কাইয়ুম খান বলেন পাকিস্তান দুই জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি আদর্শ রাষ্ট্র যেখানে হিন্দু ও মুসলিম দু’টি আলাদা জাতি।
তিনি বলেন জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশের জন্য যে নীতি নির্ধারণ করে গেছেন তার বাস্তবায়ন ছাড়া পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, মুসলীম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, ব্যক্তি ঘৃণা এবং খারাপ ইচ্ছার জন্য তিন মুসলীম লীগ এক হতে পারেনি।
কাইয়ুম খান বলেন যে কেবলমাত্র তার দলই শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ছয় দফার খোলাখুলি বিরোধিতা করেছে এবং ছয় দফা সম্পর্কে দেশকে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছে। আজ এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, ছয় দফা আসলে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার কর্মসূচী এবং শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের এজেন্ট।
তিনি বলেন, পাকিস্তান কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি এবং বিদেশী রাষ্ট্র তা ছোট হোক বা বড় হোক তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাক তা পাকিস্তান চায় না। আমরা কোন বিদেশী রাষ্ট্রকেই বিশ্বের পুলিশী ভূমিকায় স্বীকার করবো না।
এর পূর্বে এ, এম, কোরেশী তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, কেবল জনাব কাইয়ুম খানই প্রকাশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও ছয় দফার বিরোধিতা করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে কাইয়ুম খান বলেন যে পাকিস্তানের উভয় অংশে একই সময় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তিনি বলেন যে প্রথম বিষয় হলো এই ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক জীবন ও স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রতিনিধিদের হাতে খন্ডভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তাদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভি্যোগ আসবে।
পশ্চিম পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নবাদী কারা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে কাইয়ুম খান ওয়ালীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন খান আব্দুল গাফফার খান কাবুলে থেকে এই দল পরিচালনা করছেন। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, এমন কোন কথা নেই যে দেশের নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ থেকে আসতে হবে। নেতৃত্বের প্রশ্ন নির্ভর করে নেতার গুণপনার উপর।
পূর্বদেশ, ৩ মে, ১৯৭১।
নয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য
শাহ আজিজের আহ্বান
.
ঢাকা ৪ঠা মে এপিপি। জাতীয় পরিষদের সাবেক বিরোধী দলের সহকারী নেতা শাহ আজিজুর রহমান গত সোমবার এক বিবৃতে ভারতের নয়া সাম্রাজ্যবাদী দুরভিসন্ধিকে নস্যাৎ করার পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সার্বিকভাবে
সহযোগিতা দান করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান। শাহ আজিজের বিবৃতির অংশ বিশেষ নিম্নে দেওয়া হলঃ
আমার দেশবাসী পাকিস্তান সৃষ্টি ও তার অস্তিত্ব সংরক্ষণের সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন রয়েছে। বিশ্ব পার্লামেন্টারী ফোরামে আমি ভারতের দুরভিসদন্ধি ও কাশ্মীর সম্পর্কে, ন্যায়সঙ্গত দাবি সম্পর্কে আমাদের জাতীয় অভিমত পেশ করেছিলাম। পাকিস্তান সরকার এ ধরনের কয়েকটি বক্তৃতা প্রকাশ ও প্রচারও করেছিলেন।
রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্বাধিক সুযোগ সুবিধাদানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃবর্তনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সচেষ্ট ছিলেন। আওয়ামী লীগ নামে পূর্ব পাকিস্তান প্রধান রাজনৈতিক দলটি সাম্প্রতিক নির্বাচনে পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেও গণতন্ত্র পুনঃবর্তনের সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের তথাকথিত সন্ত্রাসবাদীদের শ্লোগানে এখানে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল। সর্বত্র ভীতি ও বিরাজ করছিল। গত নির্বাচনের সময় আমাকে ও আমার কর্মীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে নানা রকম অভি্যোগ উত্থাপন করেও কোন রকম সাড়া পাওয়া যায়নি।মানুষের দেশপ্রেমের নিশ্চয়তা পরিমাপের কোন যন্ত্র নেই বলে তিনি জানান।
দেশের সংহতি বিনষ্ট করার জন্য ২৫ শে মার্চের আগে যারা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো দেশ প্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী তাদের সে প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যে জঘন্য হস্তক্ষেপ করছে তিনি তার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক সমস্ত বিধি নিষেধ লঙ্ঘন করেছে। ভারতের বন্ধুত্বের মুখোশ বিশ্বের কাছে ধরা পড়ে গেছে। ভারত যাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে সে জন্য তিনি হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেন। নয়া সাম্রাজ্যবাদ ভারতকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে দেশ প্রেমিকদের সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতাদানের জন্য শাহ্ আজিজুর রহমান জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে
-হাজারভী
.
পেশোয়ার, ১৩ ই মে (এপিপি)। পশ্চিম পাকিস্তান জমিয়ত উল-উলামা-ই ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা গোলাম গাউস হাজারভী বিশেষ করে প্রাদেশিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।কারণ তার মতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রদেশগুলোতে অবস্থা কিছুটা অনুকূল হয়েছে।
গত মঙ্গলবার এখানে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সব গণপ্রতিনিধি দেশপ্রেমিক বলে পরিচিত যদি তাদেরকে প্রদেশের শৃংখলা বজায় রাখার দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয় তাহলে ভারতীয় অনুপ্রবেশের বাকী সব কিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কাজে তারা সেনাবাহিনীকে বিরাটভাবে সাহায্য করতে পারবেন। মওলানা হাজারভী বলেন যে, এই সরকারের কর্ম হবে অস্থায়ী। তবে বিশ্বজনমতকে পাকিস্তানের পক্ষে আনায় তা অনেক দূর সাহায্য করবে।
পূর্বদেশ, ১৪ মে, ১৯৭১।
মুফতি মাহমুদ বলেন-ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী হাস্যকর
লায়লপুর, ২০ মে (এপিপি)। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা মুফতি মাহমুদ আজ যে কোন প্রকারে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীকে হাস্যকর আখ্যায়িত করেন। কেননা এখন জাতি তার অস্তিত্বের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে।
এখানে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে জমিয়ত নেতা বলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত আস্থা পোষণ করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি আলোচিত হতে পারে না। এই প্রদেশে পূর্ণ অর্থনৈতিক পুনর্বাসন হলেই এই আস্থা ফিরে আসা সম্ভব হতে পারে। সরকারের সামনে এখন প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে যত শীঘ্র সম্ভব অর্থনৈতিক জীবন পুনঃবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং ইহা সম্ভব সমগ্র জাতি, সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানালে।
তিনি বলেন যে দেশের এক অংশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তা আরো জটিলতার সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে একটি আইনগত অসুবিধাও রয়েছে। আইনগত কাঠামো নির্দেশের সংশোধন না করা হলে এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেননা এতে প্রদেশে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তের কোনো বিধান নাই।
যে কোন প্রকারেই হোক না কেন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে তার পূর্বে জাতীয় পরিষদকে একটি শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে যা এখনো হয়ে ওঠেনি।
সংকট নিরসনের জন্য প্রসিডেন্টের একটি শাসনতন্ত্র দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, তার বিশ্বাস হলো জনপ্রতিনিধিদেরই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা উচিত। অবশ্য তিনি এও বলেন যে প্রেসিডেন্ট যে আইনগত কাঠামো নির্দেশ জারি করেছিলেন তাই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসেবে অনুমোদন করতে পারেন।
পূর্বদেশ, ২১ মে, ১৯৭১।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্নে আলোচনা করেছি
সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো
করাচী, ২১ শে মে (এপিপি)। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো গতকাল এখানে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার আলোচনা অনুযায়ী চলতি সালের শেষের মধ্যে কিছুটা ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করেন।
পিপলস পার্টি প্রধান জনাব ভুট্টো এখানে ক্লিফটনে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা করেছিলেন। গতকাল সকালে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। জনাব ভুট্টো বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা করেছেন এবং এ সকল প্রশ্নে তার দলের মতামত প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয় তখন জনগণের পক্ষে কিভাবে সরকারী কাঠামোয় অংশগ্রহণ ও তার গণতন্ত্রীকরণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন প্রশ্ন করা হলে ভুট্টো বলেন, এই সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
তিনি বলেন, তিনি এখন বিস্তারিত বিবরণ দিবেন না। কারণ, অন্যান্য কারণের মধ্যে খোদ পাকিস্তানই দেখিয়েছে যে কথার বন্দী হওয়া কিরূপ বিপজ্জনক।
এক জন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে খন্ড খন্ডভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের মধ্যে ঔপনিবশিক আচরণের মনোভাব সৃষ্টি হবে বলে কতিপয় নেতা যে মত প্রকাশ করছেন তা কার্যত জোরদার হবে কিনা। জনাব ভুট্টো বলেন, তিনি এই মতের সঙ্গে একমত নন।
জনাব ভুট্টো দেশের বর্তমান সমস্যাবলী সমাধানের ব্যাপারে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আহ্বান জানান।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের কতিপয় নির্বাচনী এলাকায় উপনির্বাচন হবে বলে তিনি মনে করেন। পূর্ব পাকিস্তানের নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের যতখানি সম্ভব ক্ষমা করা উচিত।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের রাজনৈতিক সামঞ্জস্য বিধানের জন্য রাজনৈতিক দল আইনের কড়াকড়ি শিথিলে তার কোন আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, তার দলের সদস্যদের আনুগত্য সম্পর্কে তার কোন সন্দেহ নাই এবং অন্যান্য দলের এম এন এ রা তার দলে যোগ দিতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তবে পিপলস পার্টি তাদের খোশ আমদেদ জানাবে কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন।
যাই হোক অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দল পরিবর্তনের ব্যাপারে কিছুটা শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী।
ভুট্টো বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনাকালে তিনি সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক তৎপরতা পুনরুজ্জীবনের জন্য তার দলের দাবী পুনরুল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, সংবাদপত্র এমনিতেই সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী পরিচালিত এবং সেন্সরশীপ কড়াকড়ি নিষ্প্রয়োজন বলে তার দল মনে করে।
দৈনিক পাকিস্তান, ২২ মে, ১৯৭১।
রহমতে এলাহী বলেন-নতুন করে নির্বাচন চাই
করাচী, ২৩ শে মে (পি পি আই)। জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল চৌধুরী রহমতে এলাহী আজ নয়া আদমশুমারীর ভিত্তিতে দেশে নতুন করে নির্বাচনের দাবী করেন। আজ বিকালে স্থানীয় এক হোটেলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় আমাদের ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক জীবন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
জামাত নেতা পূর্ব পাকিস্তান সফর করে এখানে ফিরেছেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে মোটামুটি অবস্থা স্বাভাবিক এবং সেখানে মিল কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে চৌধুরী রহমতে এলাহী বলেন যে, এ সময় ক্ষমতা হস্তান্তর করা ঠিক হবে না।
তিনি ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও দেশ বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে সংকট থেকে জাতিকে বাঁচানোর জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করেন। তিনি ভারতকে পাকিস্তান বিরোধী ষড়যন্ত্র করার জন্য অভিযুক্ত করেন। সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানীদেরও প্রশংসা করেন। সমগ্র পূর্বাঞ্চল সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পূর্বদেশ, ২৪ মে, ১৯৭১।
জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার সময় এসেছে
নওয়াবশাহে ভুট্টো
নওয়াবশাহ, ৩১ শে মে (এপিপি)। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জেড, এ ভুট্টো আজ আবার বলেন যে, জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বারাই শুধু বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।
তিনি বলেন যে যার রাজনীতির সাথে জড়িত ও দেশের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল তাদের ছাড়া
কারো পক্ষে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দলীয় কর্মী ও ছাত্রদের এক সভায় জনাব
ভুট্টো বলেন যে, যারা জনসাধারণের বিশ্বাসভাজন তাদের হাতে এখন ক্ষমতাতা তুলে দেবার সময় এসেছে। এর ফলে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে পারবে। তিনি বলেন, জনগণই এই রায় দিয়েছে এবং তা যত শীঘ্র সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত। জনাব ভুট্টো বলেন, আমরা জনসাধারণের সঙ্গে রয়েছি এবং দরকার হলে নিজেদের জীবনের বিনিময়েও নির্বাচনের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা
হবে। তিনি বলেন যে পাকিস্তান পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত। এর পাঁচটি প্রদেশই শক্তিশালী না হলে দেশ শক্তিশালী হতে পারে না। তিনি বলেন, শেখ মুজিব যে ভুল করেছিলেন তিনি
তা করবেন না এবং শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের তরুণদের জন্য যে বিপর্যয় ডেকে এনেছেন
সিন্ধুর তরুণদের তেমনি ধ্বংস হতে তিনি দেবেন না। তিনি বলেন, আমি সিন্ধুর যুবকদের ভুল পথে নয়, সঠিক পথে পরিচালিত করব। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বলেন যে, জাতীয়
পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর কেন্দ্রে ও প্রদেশগুলোতে
জনসাধারণের সরকার গঠিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির জন্য তা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন যে, যারা নির্বাচনে হেরেছে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের সুযোগ নেয়া উচিত নয়। তাদের জনসাধারণের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হওয়া
উচিত নয়। -দৈনিক পাকিস্তান, ২ জুন, ১৯৭১
.
পাকিস্তানের নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান আতহার আলীর বিবৃতি
সাবেক এম এন এ ও পাকিস্তান মরকাজী জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট মোঃ আতহার আলী পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য আরো উদ্যমের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার এপিপি পরিবেশিত এক বিবৃতিতে তিনি জনগণকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, মুসলমানের শত্রুদেশগুলো লাখো লাখো মুসলমানের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তানের ক্ষতি
সাধনের জন্য বিরামহীন চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন পাকিস্তান রক্ষা পেলেও শত্রুর চক্রান্তের
অবসান ঘটেনি। এই পবিত্র দেশকে দারুণ আঘাত হানার জন্য শত্রু চেষ্টার ত্রুটি করবে না। পাকিস্তান, ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ বশতঃ তারা যা ইচ্ছে তাই
করতে পারে।
-দৈনিক পাকিস্তান, ৮ জুলাই, ১৯৭১
.
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের জীবনের নিরাপত্তা নেই-একথা ভিত্তিহীন
-ডঃ সাজ্জাদ হোসেন
লন্ডন, ৮ই জুলাই (রয়টার)-
পূর্ব পাকিস্তানের শহর ও গ্রামে বাঙ্গালীদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই বলে যে কথা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক গতকাল তা অস্বীকার
করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যানসেলর ডঃ এস সাজ্জাদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ডঃ এম মোহর আলী টাইম পত্রিকায় লিখিত এক দীর্ঘ চিঠিতে তাঁদের এই অস্বীকৃতির কথা জানান। বিদেশে প্রচারিত নৃশংসতার কাহিনী উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই যে এ ধরনের কাহিনী প্রচার অব্যাহত থাকার ফলেই এ
রকম সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে শহরে ও গ্রামে বাঙ্গালীদের
বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙ্গালীদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই।
বুদ্ধজীবীদের পাইকারী হত্যা করা হয়েছে বলে যে কাহিনী প্রচারিত হয়েছে, অধ্যাপকদ্বয়
তাও অস্বীকার করেছেন। চিঠিতে বলা হয় যে, মার্চের ২৫শে-২৬শে তারিখে
জগন্নাথ ও ইকবাল হলের আশেপাশের এলাকায় যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক প্রাণ
হারিয়েছেন বলে জানা যায়। চিঠিতে বলা হয় যে, আমাদের ৩ জন সহযোগী
প্রাণ হারাতেন না যদি না তারা যে ভবনগুলোতে বাস করতেন সে গুলোকে আওয়ামী লীগ
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতার ঘাঁটি
হিসেবে ব্যবহার করতো।
দৈনিক পাকিস্তান, ৯ জুলাই, ১৯৭১ .
.
প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তান সফরের উপর গুরুত্ব আরোপ
আসগর খানের প্রদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা লাহোর, ১৬ই জুলাই (এপিপি)- তাহারিকে ইন্তেকলাল পার্টি প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান
গতকাল এখানে বলেন যে রাজনৈতিক প্রশ্ন সমাধান পূর্ব পাকিস্তানীদের সকলের সমর্থন পেতে
হলে একটি নতুন উদ্যোগ ও জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নয়দিন ব্যাপী পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে প্রত্যাবর্তনের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার
মার্শাল বলেন যে, এটা করা না হলে খুব কম সংখ্যক বাঙ্গালী আগামী উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কারণ তাঁর মতে এখন বাঙ্গালীদের উপ-নির্বাচনের
ব্যাপারে খুব উৎসাহী মনে হয়না। ইন্তেকলাল নেতা আরো বলেন যে তার
উল্লেখিত ব্যবস্থার মধ্যে প্রেস সেনসরশীপ তুলে নেয়া, রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং অপরাধী আইন পরিষদ তালিকা প্রকাশও রয়েছে।
তিনি আরো বলে যে, শীঘ্রই প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তান সফর সমস্যা সমাধানের পথে অনেক
খানি সহায়ক হবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে এখন অনেকেই প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি কামনা
করছে। এক প্রশ্নের উত্তরে ইন্তেকলাল নেতা বলেন যে, তার মনে কোন সংশয় নেই যে, এরূপ
ব্যবস্থা গৃহীত হলে পূর্ব পাকিস্তান উপ-নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে কিন্তু এ
উদ্যোগ গ্রহণে বিলম্ব হলে দেশের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক হবে যা ইতিপূর্বে আর
কোনদিন হয়নি।
.
বেয়াইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ সদস্যরা সমস্যা সমাধানের জন্য কত দূর সাহায্য করতে পারে
জানতে চাওয়া হলে তাহরিক নেতা বলেন যে সকল সদস্যই সমাজ বিরোধী কাজে লিপ্ত ছিলেন না। সরকারের সঙ্গে একটা গ্রহণসোগ্য সমাধানে পৌঁছার জন্য বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যদের সমর্থন পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন। পূর্ব পাকিস্তানে আগামী উপ-নির্বাচনে তার দল অংশ গ্রহণ করবে কিনা এরুপ এক প্রশ্নের উত্তরে তাহরিক নেতা জানান যে আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ দেশের আইন ও শৃংখলা পরিস্থিতি, শাসনতন্ত্র সংশোধনীর পদ্ধতিসমূহ এবং আইন পরিষদগুলো চালু হবার পর কি ধরনের সামরিক ছত্রছায়ায় থাকতে হবে তখন তা আরো ভালভাবে জানতে পারা যাবে। ইতিমধ্যে ঘটনাসমূহও একটা পরিষ্কার রুপ নেবে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তাহরিক নেতা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছুই এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে। তবে প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অতিশয় হতাশাগ্রস্ত।
-দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ জুলাই, ১৯৭১
ফজলুল কাদের চৌধুরীঃ জাতীয় সম্মেলনের
প্রস্তাব
লাহোর ১৬ জুলাই (এপিপি)-
.
দেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা আলোচনার জন্য কনভেনশন মুসলিমলীগের প্রেসিডেন্ট জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী গতকাল সকালে রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। স্থানীয় একটি হোটেলে এক সাংবাদিক
সম্মেলনে ভাষণদানকালে তিনি বলেন যে জাতি আজ তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সবচেয়ে ‘মারাত্মক
সংকটের’ মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে এবং এই সংকট নিরসন ও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রধান নেতাদের নিয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান হচ্ছে এই মুহূর্তের সবচেয়ে
জরুরী কাজ। জনাব চৌধুরী বলেন যে, এই জাতীয় সম্মেলনে অবশ্যই পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের আশা আকাংখার মধ্যে সমন্বয় সাধনের ফর্মুলা উদ্ভব করতে হবে। তিনি বলেন যে, এখানে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনাকালে তার এই প্রস্তাবটি অভিনন্দিত
হয়েছে। জনাব চৌধুরী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ট দল নিজের ভুলের জন্য তার অস্তিত্ব
হারিয়ে ফেলেছে এবং এই পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের প্রশ্নটি নতুন করে বিবেচনা করা উচিৎ। সম্মেলনে যোগদানকারীরা ইচ্ছা করলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
জনাব চৌধুরী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হচ্ছে। তবে সেখানকার
সমস্যাগুলোর ব্যাপারে প্রজ্ঞা, বিবেচনা ও সতর্কতার সাথে কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিৎ।
তিনি বলেন যে ভারতীয় এজেন্টদের উৎখাতের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে শুভেচ্ছা ও
আস্থা তৈরীর কাজ করে যাওয়া উচিত। তিনি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯৬ জন
লোক পাকিস্তানের জন্য ভোট দিয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ বছর ধরে তরুণদের অপরিপক্ক মনে যে
কারণেই হোক বঞ্চনার ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে এবং এই বঞ্চনা ও অবহেলা মোকাবেলার জন্য
সংগ্রামের মাত্রা তাদের জানা ছিল না। তিনি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিকারের পাকিস্তানীর অভাব নেই।
.
তিনি বলেন যে ভারতীয় এজেন্টদের দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত বাংলাদেশ বেতার থেকে দিন রাত তাঁর ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতার মৃত্যুদন্ডের কথা তারস্বরে ঘোষণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের জন্যে সংগ্রাম করে যাবেন। কারণ যদি পাকিস্তানই না থাকে, তাহলে অধিকারের জন্যে সংগ্রামের অবকাশ কোথায়।
-দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ জুলাই, ১৯৭১
জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সম্পর্কে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ
লাহোর, ২১শে জুলাই (এপিপি)-
পশ্চিম পাকিস্তান পিডিপির প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান গতকাল বিকেলে এখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণদানকালে বলেছেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং এখন তা প্রেসিডেন্টের নিজের হাতে গ্রহণ করায়
জাতীয় পরিষদ সদস্যদের আর কোন অস্তিত্ব থাকছে না। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ বলেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে চিরদিনের জন্য তার সমাধান হওয়া উচিত। ক্ষমতা হস্তান্তরের মত অন্যান্য প্রশ্ন পরে আসতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ বলেন যে, তার দল সবসময়েই এই মত পোষণ করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের অধিকাংশ সদস্যকে পাওয়া না যাওয়ায় ও তারা আত্মগোপন করায় বর্তমান জাতীয় পরিষদ তার প্রয়োজনীয়তা ও ইপ্সিত ফলদানের
ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেন যে, একটি জাতীয় পরিষদের পরিবর্তে এটি এখন একটি
আঞ্চলিক পরিষদে পরিণত হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগারদের সাথে রাজনৈতিক
সমঝোতা করার কথা বলার জন্য পিপিপি প্রধান জনাব ভুট্টোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা ভুল
হবে। কারণ তাহলে সমস্ত দলকে নিষিদ্ধ করা হত না। তিনি আইন ও শৃংখলা পরিস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানোর জন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ভুট্টোর সমালোচনা করেন।
-দৈনিক পাকিস্তান, ২১ জুলাই, ১৯৭১
ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্টের ফর্মুলা বর্তমান সংকটের একমাত্র সমাধান- তোফায়েল মোহাম্মদ
লাহোর, ২৩ জুলাই এপিপি
জামাতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ আজ এখানে বলেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্ট যে ফর্মুলা পেশ করেছেন, দেশের বর্তমান রজনৈতিক সংকট সমাধানের এটাই হচ্ছে একমাত্র সম্ভাব্য পন্থা। তবে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের বিগত বেতার
ভাষণে উল্লিখিত ৪ মাস সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। কারণ
এই সময়ে নগণ্য সংখ্যক ভোটার ভোট দান করতে আসতে পারেন। মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ লাহোর বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে তার পূর্ব পাকিস্তান সফরের
অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন। মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ শূন্য আসনে গত সাধারণ
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর পরই যাদের স্থান তাদেরকে নির্বাচিত ঘোষণা করার দাবীর কথা পুনরায়
উল্লেখ করেন। তিনি শেখ মুজিবর রহমানের বিচার শুরু করার জন্য
সরকারের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মানসিক স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সেখানে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা একান্ত
দরকার।
-দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ জুলাই, ১৯৭১
.
আলেমদের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সহযোগিতার আহবান
এপিপি পরিবেশিত খবরে বলা হয় যে, নেজামে ইসলাম পার্টির পার্লামেন্টারী বোর্ডের সম্পাদক
সৈয়দ মনজুরুল আহসান ও যুগ্ম সম্পাদক মওলানা আবদুল মতিন আলেম সম্প্রদায়কে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা প্রদান এবং জনগণের নিকট দেশের মৌলিক আদর্শ ব্যাখ্যা করার আহবান জানিয়েছেন। এক যুক্ত বিবৃতিতে তাঁরা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার
ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীরসময়োচিত পদক্ষেপকে অভিনন্দিত করেন এবং রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের নির্মুল করার ব্যাপারেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না।
এই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে জাতীয় পূনর্গঠনমূলক কাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিতকরণের
জন্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্ণভাবে সহযোগিতা করা। বিবৃতিতে তারা
রাজাকারদের দায়িত্ববোধের প্রশংসা করেন। পূর্ব পাকিস্তানে আলেম, মসজিদের ইমামদের
দেশের মৌলিক আদর্শ জনগণের নিকট ব্যাখ্যা করার বিষয়টি তাদের কর্মসূচীর অন্তর্গত করার জন্য তারা আহবান জানান।
-দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ জুলাই, ১৯৭১
.
সরকার পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা যথাযথভাবে মোকাবিলা করছে
করাচী বিমান বন্দরে খান সবুর করাচী, ২৯শে জুলাই, (এপিপি)- পাকিস্তান মুসলিম
লীগের (কাইয়ূম গ্রুপ) সেক্রেটারী জেনারেল খান আবদুস সবুর গতকাল এখানে
বলেছেন যে প্রদেশ যে বিপুল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা
যথার্থভাবে মোকাবিলা করছে। গতকাল ঢাকা থেকে করাচী পৌঁছানোর পর বিমান বন্দরে তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করছিলেন। তিনি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তান
কর্তৃপক্ষ তাদের সীমিত সুযোগ নিয়ে সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করছেন। পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচনে তাঁর দলের সাফল্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে পি-এম- এল এর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। খান সবুর বলেন যে পিপলস পার্টি ও নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগের সদস্যদের মধ্যে কোন জোট হওয়া বা না হওয়া তাদেরই ব্যাপার তবে তা পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কোন সুবিধা করতে পারবে
বলে মনে হয়না।
-দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ জুলাই, ১৯৭১
.
বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবী
করাচীতে গোলাম আজম
.
করাচী, ১লা সেপ্টেম্বর (এপিপি)।– গতকাল পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীরে আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম অবিলম্বে জাতীয় পরিষদ বাতিল এবং যখনই সময় অনুকূল হবে তার সাথে সমগ্র দেশে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়াছেন। গতকাল এখানে জামাত অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দান কালে তিনি বলেন যে, পরবর্তী আদমশুমারী সমাপ্ত হওয়ার পরই দেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়া উচিৎ।
তিনি অবিলম্বে পরবর্তী আদমশুমারী অনুষ্ঠানের দাবী জানান। কারণ পরবর্তী আদমশুমারী অনুষ্ঠানের সময় বেশ আগেই হয়েছে। তিনি সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং তাঁদের নেতৃবৃন্দের শাস্তিদানের আহ্বান জানান। এই প্রসঙ্গে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী গ্রুপ), জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পরিচালিত লীগ ও ন্যাপের (ওয়ালী গ্রুপ) পূর্ব পাকিস্তানের শাখার নাম উল্লেখ করেন।
তাঁর মতে এসব দলের সদস্যরা এখনো পূর্ব পাকিস্তানে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশার ভাব সৃষ্টি করছে। পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য তিনি ৫ দফা পরিকল্পনার কথা সুপারিশ করেছেন। অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, ঢাকায় সদর দফতরসহ “পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনর্বাসনের জন্য অর্থনৈতিক কমিটি” নামে একটা বিশেষ সংস্থা নিয়োগ করা উচিৎ। এই সংস্থার কাজ হবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখা এবং সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপায় উদ্ভাবন ও সুপারিশ পেশ।
দ্বিতীয়ত যত শীঘ্র সম্ভব বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনার তৃতীয় দফা হচ্ছে পৃথক উত্তরবঙ্গ প্রদেশ স্থাপন এবং এজন্য নয়া শাসনতন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম তদারক করা খুব অসুবিধাজনক। কারণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র নদ এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। তিনি বলেন, চতুর্থ দফা হচ্ছে ফসল হানির দরুন পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। শেশ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের বেকার সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং বলা হয় যারা কাজ করতে চান, তাদেরকে কাজ দিতে হবে। অধ্যাপক আজম পাকিস্তানের রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
তিনি বলেন, কোন ভাল মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের’ সমর্থক হতে পারে না। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী নির্মূল করার জন্য একমন ও দেশ প্রেমিক লোকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভাল কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শহীদ রশীদ মিনহাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, এই আত্মত্যাগের নিদর্শন থেকে তরুণরা উপকৃত হতে পারে।
-দৈনিক পাকিস্তান, ২সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
শাসনতন্ত্র প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের ভাষণ
নেতৃবৃন্দের অভিমত
নূরুল আমীন
করাচী, ১৮ই সেপ্টেম্বর (এপিপি)।- পাকিস্তানের ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান জনাব নূরুল আমীন আজ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ভাষণকে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকে একটা বাস্তব পদক্ষেপ বলে অবহিত করেন। তিনি বলেন যে, শাসনতন্ত্রে সংশোধনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিকার, প্রেসিডেন্ট যা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, তা স্বীকৃত হয়েছে ও উপরোক্ত ধরনের সংশোধণী পদ্ধতিও সহজতর করা হয়েছে।
এতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রেসিডেন্ট জনসাধারণের অভিপ্রায় গ্রহণে প্রস্তুত রয়েছেন। যদিও আমি খসড়া শাসনতন্ত্র দেখিনি, তবু আমি আশা করি, পিডিপি ম্যানিফেষ্টোতে উল্লেখিত প্রদেশ ও কেন্দ্রের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ব্যাপারে আমি যে সমস্ত দাবী পেশ করেছি, সে সব যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আন্তঃ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও নয়া শাসনতন্ত্রের যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।
মওলানা মওদুদী
লাহোর, ১৮ই সেপ্টেম্বর (এপিপি)।– জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী আজ এখানে বলেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট যে নয়া পদ্ধতি ঘোষণা করেছেন তা যুক্তিসংগত বলেই মনে হয়। প্রেসিডেন্টের ভাষণ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গ মওলানা মওদুদী বলেন যে, তিনি (মওদুদী)সর্বদাই এমত ব্যক্ত করে এসেছেন যে জাতীয় পরিষদকে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে বলার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টের উচিত খসড়া প্রণয়ন করে তা জাতীয় পরিষদে পেশ করা।
বর্তমানে প্রায় সেই একই ধরনের পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
জেড এ ভুট্টো
করাচী, ১৮ই সেপ্টেম্বর, (এপিপি)।– শাসনতন্ত্র সংশোধন প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট আজ যে ফরমুলা ঘোষণা করেন পিপিপি প্রধান ভুট্টো তৎসম্পর্কে কোন মন্তব্য প্রকাশে অস্বীকার করেন। সাংবাদিকরা এ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য প্রকাশে অসম্মতি জানিয়ে বলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি প্রথমে পিপিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে আলাপ আলোচনা করবেন।
ফরিদ আহমদ
পিপিআই’র খবর বলা পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মৌলভী ফরিদ আহমদ গতকাল শনিবার রাতে শাসনতন্ত্রিক বিষয়ে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন যে, জনসাধারণের ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাতে না পারলে এদেশে কোন শাসনতন্ত্রেরই সাফল্য লাভের কোন সম্ভাবনা নেই।
মওলানা ফরিদ আহমদ সন্তোষজনক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে দুটো বিষয় সুপারিশ করে বলেন যে, প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র উক্ত বিষ দুটি সংক্রান্ত ভুল বুঝাবুঝির নিরসন এবং কতিপয় সুবিধাভোগী কর্তৃক লক্ষ লক্ষ লোকের শোষণ মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করে অনুন্নত এলাকার বিশেষ প্রয়োজন পূরণ করতে না পারলে এর সাফল্যের সম্ভাবনা কম।
-দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পূর্বশর্ত
লাহোরে নূরুল আমীন
লাহোর, ২১শে সেপ্টেম্বর (এপিপি)।– আজ স্থানীয় হোটেলে লাহোর আইনজীবীদের দ্বারা তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে পিডিপি প্রধান জনাব নূরুলআমীন আলাদা আলাদাভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। জনাব নূরুল আমীন বলেন, পুরোপুরিভাবে গঠিত জাতীয় পরিষদের কাছে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। দেশের পূর্বাঞ্চলে এক বিশেষ অবস্থা বিদ্যমান থাকায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এখনো হয়নি বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
কারণস্বরূপ তিনি বলেন, এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সেখানে পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা সৃষ্টি সম্ভব নয়। পিডিপি নেতা বলেন, একনায়কত্ববাদ কিংবা সেনাবাহিনীই এখন দেশের উত্তর অংশকে একত্রে রাখতে পারে বলে যারা বলাবলি করেছেন তাঁদের সাথে তিনি একমত নন। এই ধরনের মনোভাব যত তাড়াতাড়ি অবসান ঘটবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল বলে তিনি উল্লেখ করেন। জনাব নূরুল আমীন আবার ঘোষণা করেন যে, একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পাকিস্তানের উভয় অংশকে অটুট ও ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আজ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে যোগসূত্র আবার প্রতিষ্ঠিত করবে। ১৯৫৮ সালে এই যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, এই যোগসূত্রের অভাবেই দেশের উভয় অংশের জনগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।
জনাব নূরুল আমীন দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, বিপদের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং ২৫শে মার্চের পর তা কাটিয়ে উঠা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রয়াস পায়।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আজ বুঝতে পেরেছেন যে তারা ৬ দফার অন্তরালে প্রচ্ছন্ন এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার ব্যাপারে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দৈনিক পাকিস্তান, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
জামাত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে রাজী নয়,
মন্ত্রী সম্বর্ধনায় গোলাম আজম
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
পূর্ব পাকিস্তান জামাত ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম বলেছেন, জামাত ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজি নয়। তিনি বলেন, জামাতের কর্মীরা শাহাদাৎ বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয়। গতকাল শনিবার স্থানীয় হোটেল এম্পায়ারে ঢাকা শহর জামাত কর্তৃক প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী জনাব আব্বাস আলী খান ও রাজস্বমন্ত্রী মওলানা একেএম ইউসুফেওকে প্রদত্ত সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক গলাম আজম ভাষণ দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, সারা প্রদেশ সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পরও যে কয়েক হাজার লোক শহীদ হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই জামাতের কর্মী। আইন সভার মাধমে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়নি সেই মন্ত্রিসভায় জামাতের যোগদান সম্পর্কে তিনি দলের নীতি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বর্তমান প্রদেশের জনসংখ্যার শতকরা যে ২০ ভাগ সক্রিয় রয়েছে তারা দুভাগে বিভক্ত। একদল পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায় আর একদল পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। জামাতে ইসলামী শেষোক্ত দলভুক্ত। তিনি বলেন, জামাতের যে দুজন সদস্য মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন তাদেরকে দলের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাত রাজাকার বাহিনীতে লোক, শান্তি কমিটিতে লোক যোগ দিয়েছে সেই উদ্দেশ্যেই মন্ত্রিসভায় লোক পাঠিয়েছে। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা যে কাজ করেছি সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই দুজনকে মন্ত্রিসভায় প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই মন্ত্রী পদ ভোগের বা সম্মানের বস্তু নয়। আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি।………………..
পাকিস্তান জামাতে ইসমালীর ডেপুটি আমীর মওলানা আব্দুর রহিম বিশ্বের মুসলমান, পাকিস্তানের জনগণ, বিশেষ করে জামায়াতের জন্য দোয়া করে মোনাজাত করেন।
-দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন সাধারণভাবেই প্রয়োগ করে উচিত
-আসগর খান
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
তাহরিক-ই-ইশতেকলাল পার্টি প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের সকল এম,এন,এ ও এম,পি,এদের ক্ষেত্রে কার্যকরী করার আহ্বান জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব আসগর খান তাঁর দলের পক্ষ থেকে উক্ত সুপারিশের কথা ঘোষণা করা করেন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন সাধারণভাবেই প্রয়োগ করা উচিত এবং পদমর্যাদা ও অবস্থান নির্বিশেষে আওয়ামী লীগের সকল এম,পি,এ ও এম,এন,এ-দের এই ক্ষমায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
তিনি বলেন, এই সুপারিশ যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে এই প্রদেশে যে সকল সদস্যের মৃত্যুতে পরিষদের আসন খালি হয়েছে যে সকল আসন ব্যতীত আর কোন আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে না। তাহরিকের এই সুপারিশ সরকার যদি গ্রহণ না করেন তখন উপ-নির্বাচনে অংশ গ্রহণ সম্পর্কে তাঁর দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে জনাব আসগর খান জানান।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার উল্লেখ করে জনাব আসগর খান বলেন, এটা দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা নয়া দিগন্তের সূচনা করেছে।…………..
তাহরিক প্রধান এখানে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও শান্তি কমিটির সদস্যগণ কর্তৃক পল্লী এলাকার জনগণকে হয়রানি করা সম্পর্কে অভিযোগ করে বলেন, আমি এখানে অবস্থানকালে এ সম্পর্কে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা সত্য।
পল্লী এলাকায় জনগণকে ব্যাক্তিগত শত্রুতা ও তাঁদের রাজনৈতিক মতামতের জন্য হয়রানি করা হচ্ছে। তাঁদের উপর নিপীড়ন চালান হচ্ছে। তাঁদের যেন আর হয়রানি না করা হয় সে সম্পর্কে তিনি সরকারের নিকট আহ্বান জানান।
মন্ত্রীদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অনুমতি দান সম্পর্কিত আদেশ সম্পর্কে জনাব আসগর খান বলেন, এতে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে। মন্ত্রীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিলে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না।
পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে তাহরিক প্রধান বলেন, আমরা দেশে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছি। গণতন্ত্রের সাধারণ বিধান হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া। পূর্ব পাকিস্তানের যথেষ্ঠ পরিমাণে নির্বাচিত সদস্য রয়েছে। কিন্তু তাঁদের পরিবর্তে পরাজিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এতে গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা হচ্ছে। যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হচ্ছে ন্যায়সংগত বিধান; যারা পরাজিত হয়েছেন তাঁদের হাতে নয়। পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত সদস্যের অভাব নেই। এরূপ বহু সদস্য আছেন যাদের আসন বহাল রাখা হয়েছে এবং যারা পাকিস্তানে বিশ্বাসী। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পরিষদেরই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা উচিত।
ভারতীয় হামলার আশংকা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তাহরিক প্রধান বলেন, আমি সবসময়ই এই মনোভাব পোষণ করে আসছি যে আমরা উভয়ই প্রতিবেশী। আমাদের পাশাপাশি বাস করতে হবে। পাকিস্তানকে শান্তিতে বাস করতে হবে এবং ভারত একটি বৃহৎ দেশ। তাকেও প্রতিবেশীর সাথে শান্তিতে বসবাস করতে হবে। যুদ্ধ কোন সমাধান দেবে না। উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। যে সকল পাকিস্তানী ভারত গমন করেছে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠান উচিত। পাকিস্তান এ ব্যাপারে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগে সম্মত হয়েছে কিন্তু ভারত রাজী হয়নি। তিনি বলেন, এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে পাকিস্তানের ভাগ্য তাঁর সীমান্তের বাইরে নির্ধারিত হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান হতে কত লোক ভারত গমন করেছে সে সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন জন বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ করেছেন। কাজেই কোনটা সত্য কোনটা সত্য নয়, তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ভারত কি প্রচার করছে তা আমি জানিনা। তবে এদের নিজ নিজ বাড়ীঘরে ফিরে আসতে দেয়া উচিত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানেও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে পরিস্থিতি শান্ত বলে সেখানে সরকার গঠনের কোন প্রয়োজন নেই বলে অনেকে যুক্তি দেখান। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে যেখানে শান্তি আছে সেখানে গণতন্ত্রের দরকার নেই।
দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।
-দৈনিক পাকিস্তান, ১ অক্টোবর, ১৯৭১
শাসনতন্ত্রে এল এফ ওর মৌলিক নীতি অনুসরণের সুপারিশ
জামাতের মজলিশে সুরা
পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর মজলিশ-ই-সুরা আশা প্রকাশ করেছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পরিচালনাধীনে যে শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে তাতে আইন কাঠামোর মৌলিক নীতিগুলি বিশ্বস্ততার সাথে অনুসৃত হবে।
এপিপির খবর প্রকাশ, গতকাল রোববার মজলিশের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, এটা মজলিশের বিবেচিত অভিমত যে শাসনতন্ত্রে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো অন্তুর্ভূক্ত নাইলে এতে জাতির আশা আকাংখা প্রতিফলিত হবে না।
(১) কোরান ও সুন্নাহ শাসনতন্ত্রের প্রধান উৎস।
(২) ফেডারেল ও পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র।
(৩) পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী।
(৪) পি, ডি, এম-এর ৮দফা কর্মসূচী অনুযায়ী পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন।
(৫) পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব হবে নির্ধারিত সময়ে দেশের দু অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা।
(৬) নির্ধারিত সময়ে সশস্ত্র সার্ভিস সহ কেন্দ্রীয় সরকারের সব বিভাগ থেকে বৈষম্য দূর করা এবং
(৭) মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা।
-দৈনিক পাকিস্তান, ৪ অক্টোবর,১৯৭১
প্রদেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভুট্টোর বাণী
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক বাণীতে দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর দলের ওয়াদার কথা পুনরায় ঘোষণা করেন। গতকাল রোববার ঢাকা থেকে এপিপি এই বাণী পরিবেশন করেছে। গতকাল রোববার পূর্ব পাকিস্তানে শুভেচ্ছা ও রাজনৈতিক সফরে আগত পাকিস্তান পিপলস পার্টির দশ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল চেয়ারম্যান ভুট্টোর সেই বাণী নিয়ে আসেন।
তাঁর বাণীতে জনাব ভুট্টো বলেন যে জাতির জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে হবে। পাকিস্তানীদের দ্বারা পাকিস্তানীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে এবং সকলের প্রতি শুভেচ্ছা ও সহানুভূতিরমনোভাব নিয়ে পরস্পর ভাই হিসেবে শান্তিতে বসবাস করতে হবে।
তাঁদের বক্তব্যকে সহানুভূতি নিয়ে বিবেচনা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়েপিপলস পার্টির প্রধান বলেন যে আমরা সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটাবো এবং জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখবো।
গণ অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সব সময়ই চেষ্টা করে আসছি এবং এই বিরাট কষ্টসাধ্য কাজে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের হাতে হাত মিলিয়ে কাজের পক্ষপাতী।
সংগ্রামের এই কালরাত্রির অবসান অবশ্যই ঘটাতে হবে এবং নতুন দিনের আবির্ভাব নিশ্চয়ই ঘটবে। তিনি বলেন গত ৮ মাস ধরে আমার দল গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করে আসছে। অনেক রক্তপাত হয়েছে। পাকিস্তানীরাপাকিস্তানীদের হত্যা করার মহাবিয়োগান্তক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ফলে জাতি আজ এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
১৯৬৭ সালে আমি এই সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছিলাম যে জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে আমাদের সত্যিকারের মুক্তির একমাত্র পথ। এই পথ ছাড়া অন্য কোন পথ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সঙ্কটের আবর্তে নিয়ে যাবে। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত আমাদের দেশ অতি দরিদ্রও। আমরা দুর্ভিক্ষের অভিশাপে অভিশপ্ত এবং নির্মম সামাজিক, রাজনৈতিক ও শ্রেণী শোষণে পর্যদুস্ত।
এই চির দারিদ্রের অবসান ঘটিয়ে জাতিকে সম্মুখপানে এগিয়ে নেবার একমাত্র পথ হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সর্ব প্রথম আমরাই বলেছিলাম যে পুরব পাকিস্তানের জনগণ অপেক্ষাকৃত গরীব অথচ সেখানে শোষণের মাত্রা অধিকতর। আমরাই সকলের আগে বলেছিলাম যে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাধিক্য জনগণের কথার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। জাতীয় সমঝোতা ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নে জনগণের অংশ গ্রহণের দাবী সর্ব প্রথমে আমরাই উত্থাপন করেছি।
আজকে আবার মারা জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের ওয়াদার পুনরুল্লেখ করছি। তাঁর বাণীতে ভুট্টো বলেন, জাতির জীবনে অবশ্যই নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে হবে। আমাদের পার্টি সম্পর্কে শত্রুরা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণকারীপ্রতিক্রিয়াশীলরা ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করছে।
আমাদের বক্তব্য সঠিকভাবে শোনার জন্য আপনাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। আমরা সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটাবো। আল্লাহর দৃষ্টিতে যেমন সকল মানুষ সমান তেমনি আইনের দৃষ্টিতে সকল পাকিস্তানীদের সমান বলে বিবেচনা করতে হবে।
দৈনিক পাকিস্তান, ১১ অক্টোবর, ১৯৭১
জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত
– শফিকুল ইসলাম
রাওয়ালপিন্ডি, ১০ই অক্টোবর (পিপিআই)- কাউন্সিল মুসলিম লীগেরভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব শফিকুল ইসলাম বলেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে অবিলম্বে কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত। পূর্ব পাকিস্তানের তিন জন প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্য হিসেবে বিশ্ব সফরে রওয়ানা হবার পূর্বে এক সাক্ষাৎকারে জনাব শফিকুল ইসলাম বলেন যে তাঁদের এই বেসরকারী সফরের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অব্যাহত ভারতীয় প্রচারণার ফলে সৃষ্টি ভুল বোঝাবুঝি দূর করা।
জনাব ইসলামের লন্ডনের পথে করাচী রওয়ানা হওয়ার পূর্বে এই সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সহজতর করার জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয় শাসনতন্ত্র জারী না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার থাকা উচিত।
তিনি বলেন যে এতে সকল স্তরের জনগণের মধ্যে আস্থার ভাব সৃষ্টি হবে। জনাব ইসলাম বলেন যে দেশের আদর্শ ও অখণ্ডতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।
– দৈনিক পাকিস্তান, ১২ অক্টোবর, ১৯৭১
ভারতীয় প্রচারণাচ্যালেঞ্জেরসম্মুখীন হয়েছে
শাহ আজিজ
নিউইয়র্ক, ২৪শে অক্টোবর (এপিপি)।– পূর্ব পাকিস্তানের একজন বিশিষ্ট নেতা শাহ আজিজুর রহমান গতকাল এখানে বলেন যে, বাংলাদেশ ধাপ্পার সরূপ এখন বহুলাংশে উদ্ঘাতিত হয়ে গেছে। জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলে অন্যতম সদস্য জনাব রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে গতকাল এপিপির বিশেষ সংবাদদাতার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখানে এক মাসেরও অধিক সময় অবস্থানকালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তারা সবাই পাকিস্তানের বক্তব্য বেশ আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করেছেন।
তিনি বলেন, এটা এখন আর এক তরফা ব্যাপার নয় এবং ভারতীয় প্রচারণার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন চ্যালেঞ্জেরসম্মুখীন হচ্ছে। জনাব রহমান বলেন, জাতিসংঘ প্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ থেকে ভারত বিরত থাকলে পাকিস্তান ভারতীয় সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের যে আশ্বাস দিয়েছে, ে জন্য বিশেষভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন।
ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তের উভয় পার্শ্বে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব গ্রহণের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রশংসা করা হয়। শাহ সাহেব বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যাপক সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘোষণার ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পূর্বেই সৃষ্ট ভুল ধারণা অবসানে বেশ সহায়ক হয়েছে। সেনাবাহিনীর কথিত নির্যাতন সম্পর্কে ভারতের উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন বিদেশে বসবাসকারী বহুসংখ্যক বাঙ্গালী যারা ভারতীয় প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা এখন পাকিস্তান সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজন হচ্ছে ভারতীয় মিথ্যা প্রচারণাকে প্রকৃত ঘটনার আলোকে অত্যন্ত নিপুণভাবে খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে সুদক্ষ পাকিস্তানীদের প্রেরণ করা। শাহ সাহেব বলেন, আমরা যাদের সাথেই দেখা করেছি ও কথা বলেছি, তাঁরা একথা বুঝতে পেরেছেন যে উথান্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভারত উদ্বাস্তুদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে না।
– দৈনিক পাকিস্তান, ২৫ অক্টোবর, ১৯৭১
রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাঁদের আরো অস্ত্র দেয়ার সুপারিশ।
প্রেসিডেন্ট সকাশে নূরুল আমীন
লাহোর, ১৬ই নভেম্বর (এপিপি)।– পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট জনাব নূরুল আমীন আজ এখানে গভর্নর ভবনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নব্বই মিনিট ব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের পর জনাব নূরুল আমীন সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি প্রধানতঃ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সেখানকার আসন্ন উপ-নির্বাচন সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচনের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর ধ্বংসাত্মকতৎপরতাবাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি জানান যে প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার ও তাঁদের আরো অস্ত্র দেয়ার সুপারিশ করেছেন। তিনি বলেন যে, সেখানে রাজাকাররা খুব ভাল কাজ করছে কিন্তু বর্তমানে তাঁদের সকলের নিকট অস্ত্র নেই।
রাজাকাররা তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকদের হত্যা করছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে জনাব নূরুল আমীন তার সত্যতা অস্বীকার করেন। জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, তিনি ২০শে ডিসেম্বরের পূর্বেই খসড়া শাসনতন্ত্রটি প্রকাশের জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট প্রস্তাব করেছেন।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০শে ডিসেম্বর শাসনতন্ত্র জারির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। পিডিপি প্রধান বলেন যে ২০শে ডিসেম্বরের পূর্বেই খসড়া শাসনতন্ত্রটি প্রকাশ করা হলে ২৭শে ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই রাজনৈতিক দলগুলো খসড়া শাসনতন্ত্রটি বিবেচনা করার জন্য আরো সময় পাবে। এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব আমীন বলেন যে প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তরের কর্মসূচীতে অটল থাকবেন। তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনীর হাতে যত বেশি দিন ক্ষমতা থাকবে, দেশের জন্য ততই খারাপ হবে।
পিপিআই পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, জনাব নূরুল আমীন জানান যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি বলেন যে ভবিষ্যতে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনার সময় তিনি শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে কি পরিমাণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হচ্ছে তা জানতে চান। প্রেসিডেন্ট তাঁকে আশ্বাস দেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে। ‘সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের’ কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে চারটি বিষয় যথা প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়, মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্য কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনা করে এ সাহায্য ও ঋণ সংগ্রহ করবে এবং বিভিন্ন প্রদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রদেশগুলোতে তা ব্যয় করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে শেখ মুজিবের মুক্তি প্রশ্ন নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কথা বিবেচনা করছেন।
তিনি জানান যে, প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার ও তাঁদের আরো অস্ত্রশস্ত্র দিতে সম্মত হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের ধ্বংসাত্মকতৎপরতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন কেবল যে একটি যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে তাই নয়, প্রকৃতপক্ষে উক্ত এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এপিপির খবরের আরো বলা হয়, অপর এক প্রশ্নের জবাবে জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, বেআইনী ঘোষিত আওয়ামীলীগের টিকিটে নির্বাচিত ও বহাল জাতীয় পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সকলে হয়ত এখন দেশে উপস্থিত নেই, তবে ২৭শে ডিসেম্বর সকালের মধ্যে তাঁরা হয়ত পরিষদের অধিবেশনে বসার জন্য ফিরে আসতে পারেন।
তিনি বলেন যে বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের অন্য কোন দলে যোগদানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দল আইন কোন বাধা নয়। তবে তিনি রাজনৈতিক দল আইনটিকে অবাধ গণতন্ত্রের পথে বাধাস্বরূপ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে তিনি জাতীয় পরিষদের ছ’জনপিপিপিপ্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রহস্য সম্পর্কে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট বিষয়টি সম্পর্কে অনুসন্ধান করবেন বলে তাঁকে জানিয়েছেন।
জনাব নূরুল আমীন বলেন যে, জাতীয় পরিষদেও ছ’দলীয় মৈত্রী জোট অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (পিডিএম) মত এই জোট যাতে একজনেরনেতৃত্বাধীনে থাকে সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
– দৈনিক পাকিস্তান, ৭ নভেম্বর, ১৯৭১
চীন সফর সম্পূর্ণ সফল হয়েছে
ভুট্টো
করাচী, ১২ই নভেম্বর, (এপিপি)।– পাক-ভারত উপ-মহাদেশের ভাগ্য ভিয়েনা, রোম বা প্যারিসে নির্ধারিত হবে না, এই উপ-মহাদেশের মাটিতেই নির্ধারিত হবে। পিপলস পার্টি প্রধান জনাব ভুট্টো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি উপরোক্ত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। তিনি আব্দুল্লাহ হারুন রোডে এক বিশালজনসমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অব্যাহত হস্তক্ষেপ এবং আক্রমণাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ভারত পাকিস্তানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সেই যুদ্ধ শুধু ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তেই সীমিত থাকবে না। তিনি বলেন, ভারত যেন তার পিকিং সফরের ফলাফলকে তার স্বপক্ষে মনে করে ভুল না বোঝে। কেননা চীন পুনরায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের নগ্ন হামলার মুখে পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে। তাঁর পিকিং সফর কতটা সফল হয়েছে সময় আসলেই তা বোঝা যাবে।
তিনি পুনরায় বলেন, আমার চীন সফর সফল হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বিদায় সম্বর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই, অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীপেংফেই-য়ের বিবৃতির উল্লেখ করেন।
তারা বলেছেন, পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের মিশন সফল হয়েছে। আমার কর্তব্য সমাধান করে সন্তুষ্ট হয়ে আমি ফির এসেছি। তিনি ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীজগজীবন রামের সাম্প্রতিক বিবৃতির নিন্দা করেন। এই বিবৃতিতে জগজীবন রাম বলেছেন, ভারত পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলো দখল করার পর ছেড়ে দেবে না। ভুট্টো বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীই যুদ্ধ করবে না পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক যুদ্ধ করবে। প্রতিটি গ্রাম, শহর ও সড়কে যুদ্ধ শুরু হবে। তিনি বলেন, তবে হোক দমাদম মস্তকালান্দার। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সোভিয়েটের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারতকে বহু খেসারত দিতে হবে। কেননা পাকিস্তানও এ ধরনের চুক্তি করেছিল। কিন্তু পরে তা নিরর্থক প্রমাণিত হয়েছে। আমি ভারতকে নোটিশ দিচ্ছি, অস্ত্র ্যাগ কর। পাকিস্তানকে হুমকি দেয়া বন্ধ কর।
আমাদের উপর যুদ্ধ যদি চাপিয়ে দাও তাহলে তা হবে চূড়ান্ত যুদ্ধ, সর্বাত্মক যুদ্ধ। তিনি দক্ষিণপন্থী ছয় দলের মৈত্রীর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন নিজে ছয় দলের আমীর না হয়ে মওলানা মওদুদীকে তার আমীর করিয়েছেন। তিনি বলেন, পিপলস পার্টি শ্রমিক কৃষক, ছাত্র বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের সাথে মৈত্রী করবে।
– দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ নভেম্বর, ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর পদ পূর্ব পাকিস্তানীকে দিতে হবে
গোলাম আজমের দাবী
(স্টাফ রিপোর্টার)
গতকাল সোমবার পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ এক জন পূর্ব পাকিস্তানীকে প্রদানের দাবী জানিয়েছেন। ছয় দলের নির্বাচনী জোটের নেতা জনাব নূরুল আমীনের ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত লাহোরে প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন যে, এই দেশের এই অংশের জনগণের মন থেকে অতীতে বঞ্চনারমনোভাবক্রমশঃ দূর করতে হলে প্রধান রাজনৈতিক পদটি অবশ্যই একজন পূর্ব পাকিস্তানীকে দিতে হবে।
ন্যায় বিচার এটাই দাবী করে। তিনি বলেন আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইয়েরা একথা ভালোভাবেই জানেন যে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে তাঁদের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক অধিকার থেকে বিশেষ করে আইয়ুব খানের দীর্ঘ দশ বছরের একনায়কত্বশাসনামলে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর ফলেই জাতি বর্তমানের গুরুতর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে।
দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ভুয়া থিওরি
জনাব ভুট্টোর সমালোচনা করে জামাতের নেতা বলেন এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে ক্ষমতার জন্য জনাব ভুট্টোকে এক অদ্ভুত ধরনের পাগলামী পেয়ে বসেছে।
এই পাগলামীর জন্যই তিনি একই রাষ্ট্রে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের থিওরি সৃষ্টি করেছিলেন। ক্ষমতার লোভে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এমনভাবে বেসামাল হয়ে পড়েছেন যে তাঁরা অন্যান্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে আপত্তিজনক ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন। গত ক’মাস থেকে জনাব ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার খায়েশ মনে মনে পোষণ করে আসছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ‘ছ’ দলের মৈত্রী এবং পাকিস্তান ভিত্তিতে বামপন্থী নয় এমন দলগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশাকে মনে হয় ভেঙ্গেচুরমার করে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণের ধারণা হচ্ছে যে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে জনাব ভুট্টো ক্ষমতার অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে ভীত ছিলেন। এই হতাশার মনোভাবই জনাব ভুট্টোকে তাঁর পথ থেকে শেখ মুজিবর রহমানের অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পরিচালিত করেছিল।
প্রাদেশিক জামাতের আমীর বলেন, আমার মনে হয় জনাব ভুট্টো নিজেও নিজেকে অপরাধী বলে মনে করেন। এ কারণেই গত সাত মাস ধরে এখানকার জনগণ যে মহাসঙ্কটের মোকাবিলা করছেন সে সময় জনাব ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তান সফরের আসতে পারেননি। আমি বুঝতে পারি না এই মনোভাব নিয়ে তিনি কি করে জাতীয় নেতা হওয়ার দুঃসাহস করেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে তিনি জাতীয় নেতা হওয়ার গুণাবলী অর্জন করুন আমি বরং এই মোনাজাতই করি। দেশের সংহতির স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনোভাবকে উপেক্ষা না করার জন্য বিবৃতিতে তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান।
– দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১
দক্ষিনপন্থী সাত দলের মৈত্রী জোট
লাহোর, ১৫ই নভেম্বর (পিপি আই)।- সাতটি দক্ষিন পন্থী রাজনৈতিক দল আজ পিডিপি প্রধান জনাব নূরুল আমীনের নেতৃত্বে সংযুক্ত কোয়ালিশন পার্টি গঠনে সম্মত হয়েছে। আজ সকালে এখানে উক্ত দলগুলোর প্রধান নেতৃবৃন্দের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পরে নবগঠিত দলের প্রধান জনাব নূরুল আমীন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ” বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য সাধনে যে প্রধান বিষয়টি কাজ করেছে তাহলো জাতীয় আদর্শ বজায় ও রক্ষার জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প। তিনি বলেন যে এই ঐক্যজোটে অংশগ্রহণকারীরা পাকিস্তানে একটি পূর্ণাংগ ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাবেন।
প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর প্রকাশিত যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়, “আমরা অর্থাৎ সাত দলের অনুমোদিত প্রতিনিধিরা এখানে ঘোষনা করছি যে আমরা এক নেতা জনাব নূরুল আমীন সাহেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একটি সংযুক্ত কোয়ালিশন পার্টি হিসেবে কাজ করবো।”
প্রকৃতপক্ষে এই মৈত্রী জোটের কোন নাম দেয়া হয়নি। একজন সাংবাদিক যখন জানতে চাইলেন যে মৈত্রীজোটের ব্যাপারে পিডিপি প্রধানের নেতৃত্বকে তারা কিভাবে আখ্যায়িত করবেন, তখনই কেবল জনাব নূরুল আমীন ত্বরিত এটার “সংযুক্ত কোয়ালিশন পার্টি” নামকরণ করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ এই নামকরণে সম্মত বলে মনে হয়। ঘোষণাটিতে আরো বলা হয় যে, আমাদের জনগণের জন্য এক নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত ইসলামী ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি সুসঙ্গত, সুস্পষ্ট ও কার্যকরী নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একমনা দলগুলোর মধ্যে অবিলম্বে সর্বোচ্চ পরিমাণ ঐক্য সাধনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দলগুলো একমত।
নবগঠিত সংযুক্ত কোয়ালিশন পার্টি অঙ্গ দলগুলোর সাধারন লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য কাজ করে যাবে। এই পার্লামেন্টারী মৈত্রী জোটের নেতা হিসেবে জনাব নূরুল আমীনের নির্বাচন হয় সর্বসম্মত। ঘোষণায় যারা স্বাক্ষর করেন তাঁরা হলেন, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির জনাব নূরুল আমীন, পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম গ্রুপ) প্রেসিডেন্ট খান আবদুল কাইয়ুম খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারী মালিক মোহাম্মদ কাসিম, জামাতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ, জমিয়তুল ওলামায়ে পাকিস্তানের ———- এবং মারকাজী জমিয়াতুল ওলামায়ে পাকিস্তানের এডভোকেট জনাব ইকবাল আহমদ। শেষোক্ত দল পূর্ব পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম দল হিসেবে কাজ করছে। জনাব নূরুল আমীন বলেন যে মৈত্রীজোটের অঙ্গ দলগুলোর নেতৃবৃন্দ জনগণের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দেশের উভয় অংশে শীঘ্রই সফরে যাবেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব নূরুল আমীন ছাড়াও ইতিপুর্বে ঘোষণায় স্বাক্ষরদানকারী বিভিন্ন দলের কতিপয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। সংযুক্ত পার্টিতে নয়া সদস্য গ্রহণের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে কি পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে সে সম্মর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব নূরুল আমীন বলেন যে বিভিন্ন অঙ্গ দলের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
তবে তিনি বলেন যে নয়া দলকে এই মৈত্রীজোটে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত অবশ্যই সর্বসম্মত হতে হবে। কেন্দ্রে তিনি কোন জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষপাতী হবেন কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এক পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন,” নয়া কোন দল সরকার গঠন করলে তিনি সেটাকে আর কি নামে আখ্যায়িত করবেন।”
জনাব নূরুল আমীন বলেন, তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠনের আহবাণ জানাবেন।
জাতীয় পরিষদে সংযুক্তি পার্টির সম্ভাব্য শক্তি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে এই পর্যায়ে এ ব্যাপারে কিছু বলার সময় আসেনি। তিনি বলেন, ”উপনির্বাচন শেষ হতে দিন, তারপর দলীয় শক্তি সকলেরই জানা হয়ে যাবে।”
-দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১
বিপ্লব অনিবার্য
জুলফিকার আলী ভুট্টো
করাচী, ১৭ই নভেম্বর (এপিপি)।- পাকিস্তানের জনসাধারণ কোন অবস্থাতেই ‘পুতুল সরকার’ গ্রহণ করবে না। পিপলস পার্টি প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ এ কথা বলেছেন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় দফতরে দলীয় কর্মী সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। ভুট্টো বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মত প্রতিফলনে সক্ষম সরকার গঠনে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে বিপ্লব অনিবার্য।
ভুট্টো তার ২৯শে সেপ্টেম্বরের চার দফা ফর্মুলার পুনরুল্লেখ করে বলেন তাঁর দল এই ফর্মুলায় অবিচল রয়েছে। তিনি উক্ত ফর্মুলা যাচাই ও পরীক্ষা করে দেখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এছাড়া দেশ সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে পারে না। ২৯ শে সেপ্টেম্বর ভূট্টো চার দফা সুপারিশ পেশ করেছিলেন, যা তার মতে প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনাকে আরো সুস্পষ্ট ও অর্থবহ করবে।
ভূট্টোর এই চার দফা হলোঃ-
(ক) ১৮ই সেপ্টেম্বরের ঘোষনা তাতে সন্নিবেশ করার জন্য আইন কাঠামো আদেশ সংশোধন করতে হবে এবং প্রেসিডেন্টের বিবৃতির কতিপয় বক্তব্য আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা দরকার।
(খ) খসড়া শাসনতন্ত্রের বিধি বিধানসমূহ সংস্কার কর্মসূচীর পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।
(গ) শাসনতন্ত্র বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবানের সাথে সাথেই কেন্দ্রে ও প্রদেশগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে হবে।
(ঘ) পিপলস পার্টিকে পাকিস্তানের উপ- নির্বাচনে ভালোভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
জনাব ভূট্টো বলেন, তিনি নয়া শাসনতন্ত্র এবং ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১৮ই সেপ্টেম্বরের পরিকল্পনা বিনা শর্তে গ্রহণ করেননি।
“আমরা সেটাকে সামনের দিকে একটি সঠিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছিলাম। ভূট্টো বলেন, দেশের অস্তিত্বের সংকটজনক মুহুর্তে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সরকার, যে সরকার কার্যকরভাবে বৈদেশিক আক্রমণের মোকাবেলা করতে পারবে এবং জনগণের আশা আকাংখা মোতাবেক অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে সক্ষম হবে”।
তার দলের পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ভূল হয়েছে বলে ভূট্টো স্বীকার করেছেন। ‘কিন্তু প্রশ্নটা ছিল দেশকে রক্ষার প্রশ্নে। শে কথা চিন্তা করেই আমরা উপ-নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি’। ভূট্টো বলেন, দেশে তাঁর অনুপস্থিতিকালে তার দলের নেতারা পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের উপ-নির্বাচনেও অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তার অনুপস্থিতিতে এটা করা ঠিক হয়নি।
নূরুল আমীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের দাবী করায় ভূট্টো তার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ” পূর্ব পাকিস্তানের উপ-নির্বাচনে যেভাবে তারা আসন লাভ করেছেন। সে জন্যে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আর এখন তারা তাদের শক্তির বড়াই করে কথা বলছেন।” আমাদের দলের কর্মী ও নেতারা গত সাধারন নির্বাচনের পর বহু স্থানে সরকারের হাতে কষ্ট পেয়েছেন, জেল খেটেছেন। আমাদের রেকর্ড একেবারে পরিষ্কার।
ক্ষমতা লাভের জন্য আমরা কোন কর্তৃপক্ষের সাথে ষড়যন্ত্র করছি, কেঊ সেই দোষ আমাদের দিতে পারে না। ভূট্টো বলেন, তাঁর দল ক্ষমতার জন্য লালায়িত নয়। দেশের ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য তারা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যদি প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্ট পদ চান আমরা তা মেনে নেব। এমন কি জনগণ যদি চান, আমরা জেলে যেতেও প্রস্তুত।
অবশ্য তিনি বলেন, আমরা কখনোই পুতুল সরকার মেনে নেবো না। যদি গোটা দেশের জনগনের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা সম্ভব না হয় তাহলে দেশের অর্ধেক অংশের প্রকৃত প্রতিনিধিরা চলতি সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসুন। ভূট্টো বলেন, তার দল সংখ্যাগরিষ্ট দল এবং তারাই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি বলে তার বিশ্বাস। ‘ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমি পূর্ব পাকিস্তানে যেতে পারি।’ সেখানকার জনসাধারণের সাথে দেখা করতে পারি এবং এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে পারি। তিনি বলেন, আইনগত ও রাজনৈতিক কারনে তার দল উপ-নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।
(ক)- পাকিস্তানকে রক্ষা করা। (খ) একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং (গ) একটি বেসামরিক সরকার গঠন করার জন্যই তাঁর দল উপ-নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে দুঃখের সঙ্গে এবং চোখ বন্ধ রেখে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পিপলস পার্টি জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চেয়েছি। রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে আলোতে আসুন- সামরিক কার্যক্রম পিছনে পড়ে থাক আমরা তাই চেয়েছি। কারণ সামরিক পদক্ষেপ কোন সমস্যার সমাধান করে না। ঊল্টো তা জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলে। ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না কিংবা প্রেসিডেন্ট হতে চাই না। আমি যদি লারাকানা পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে জনগণের সেবা করতে পারি তাতেই আমি খুশী থাকব।’
তিনি বলেন, গরীবের সমস্যা তা পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান যেখানকারই হোক এক। তারা সবাই শোষিত। সাত দলীয় জোট গরীবদের ক্ষমতারোহণে বাধা দিচ্ছে। তবে গরীবের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলবে। আমরা বৃটিশ, রাজপুত, হিন্দু, শিখ এমন কি জেনারেলদের যুগ দেখেছি। এবার আসবে গরীবের যুগ এবং কেউই তা রোধ করতে পারবে না।
– দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
‘আক্রমণ করাই দেশ রক্ষার বড় কৌশল’
দলাদলি ভূলে ঐক্যবদ্ধ হোনঃ গোলাম আজম
লাহোর, ২৩শে নভেম্বর, (এপিপি)।- পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামী আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম জনসাধারণের প্রতি রাজনৈতিক দলাদলি ভূলে গিয়ে কার্যকরভাবে ভারতীয় হামলা মোকাবিলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে এখানে পৌঁছে তিনি সাংবাদিকদের সাথে আলাপ করছিলেন। তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব মন্ত্রী মওলানা এ,কে,এম ইউসুফ এবং জামাতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুর রহিমও ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশেষ ভারতীয় আক্রমণ প্রশ্নে গোলাম আজম বলেন, এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। তফাৎ হলো এই যে, এবারের আক্রমণটা আরো বড় আকারের। তিনি বলেন, দেশকে রক্ষার সবচেয়ে বড় কৌশল হলো আক্রমণ করা। তিনি এ কথা বহুবার বলেছেন এবং এখন এটা আরো বেশী সত্য।
তিনি বলেন, আত্মরক্ষার কৌশল শত্রুকে আরো বেশী উৎসাহ ও শক্তিশালী করে তোলে। ভূট্টোর নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছুক মাত্র একজন লোক দলীয় রাজনীতি করেছেন।
ভারতীয় হামলার এই হুমকির মুখে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দেশে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষপাতী। তার এই সুপারিশ তিনি তার দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পেশ করবেন বলে জানান। গোলাম আজম বলেন, গত ৮ মাস ধরে সীমান্তের ঘটনাবলীর দরুন পূর্ব পাকিস্তানের লোক খুব উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, দুষ্কৃতিকারীরা খুবই সক্রিয়, ভারত প্রকাশ্যে তাদের সাহায্য করেছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চলছে এবং প্রকৃত ভোট গ্রহণ করার অসুবিধা রয়েছে। নয়া অর্ডিন্যান্সের ফলে আরো বহু প্রার্থী নাম প্রত্যাহার করবেন বলে আশা করা যায়। বিমানবন্দরে ভূট্টোকে সম্বর্ধনা জানানোর উদ্দেশ্যে আগত বিপুলসংখ্যক পিপলস পার্টি কর্মী জামাতে ইসলামী ও অধ্যাপক গোলাম আজমের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। সমবেত জামাত কর্মীরাও পাল্টা শ্লোগান দেয়।
– দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭১
তাঁবেদার সরকারের শরীক হবো না
– ভূট্টো
লাহোর, ২৫ শে নভেম্বর (এপিপি)।- পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো আজ বলেন, পাকিস্তানের ‘নতজানু’ হয়ে উপ মহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৃহৎ শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ কামনা করা উচিত নয়, বরং দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা উচিত।
রাওয়ালপিন্ডি যাত্রার প্রাক্কালে বিমান বন্দরে এক সাক্ষাৎকারে জনাব ভূট্টো বলেন যে, ‘অপর কোথায়ও না গিয়ে’ একটা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে উপমহাদেশের বর্তমান সংকটের সমাধান আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
তাড়াহুড়া করে পাকিস্তানের জাতিসংঘে যাওয়াও উচিত হবে না বলে জনাব ভূট্টো আবার দাবী করেন। বিশ্ব সংস্থার কোন বিষয় উত্থাপন করা হতে কোন রাষ্ট্রকে বিরত করতে অবশ্য জাতিসংঘ সনদে কোন বাধা নেই, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগে ভেটো প্রদত্ত হওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। কোন তাঁবেদার সরকারের সাথে তিনি যুক্ত হতে চাননা বলে আজ এখানে পুনরায় উল্লেখ করেন।
দু’এক দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হচ্ছে বলে আজ সকালে এক শ্রেণীর সংবাদপত্রে যে জোরালো খবর ছাপা হয়, তার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এ মন্তব্য করেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে অপর এক খবরে বলা হয়ঃ জনাব ভূট্টো আজ এখানে বলেন যে জাতীয় সংকট নিরসনে জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট জাতির ভাগ্য ন্যস্ত করতে হবে। আজ বিকেলে লাহোর থেকে এখানে আগমন করে ইসলামাবাদ বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে জনাব ভূট্টো বলেন যে, ‘তাঁবেদার সরকার চাপিয়ে দিয়ে’ সংকট সমাধান সম্ভব নয়। আগামী কাল প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর বৈঠকের কথা আছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে, ‘আরো খারাপ’ হয়েছে। পরিস্থিতি বহুদিন যাবত মন্দ ছিল, তাই তার পার্টি ক্রমাগতভাবেই বলে আসছিল যে রাজনৈতিক সমস্যা জনগণের মনোনীত প্রতিনিধিদের রাজনৈতিকভাবেই সমাধা করা উচিত।
জনাব ভূট্টো বলেন, সময় দ্রুত হাতছাড়া হচ্ছে। তিনি এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, ‘চলতি বছরের শেষ নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরেও চলে যেতে পারে’।
– দৈনিক পাকিস্তান। ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
আগে ক্ষমতা হস্তান্তর, পরে জাতীয় সরকার
নুরুল আমীন
লাহোর, ২৬শে নভেম্বর (পিপি আই)।- সংযুক্ত কোয়ালিশন দলের প্রধান জনাব নূরুল আমীন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে জাতীয় সরকার গঠনের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তা গণতান্ত্রিক উপায়েই করা উচিত। সংযুক্ত কোয়ালিশন দলের জরুরী বৈঠকের পর আজ সন্ধ্যায় এখানে তাঁর হোটেল কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ইউসিপির সাথে সব দল জড়িত হতে পারে এবং এটাকে একটা জাতীয় সরকার বলা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, তিনি সব সময়ই জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে। এভাবেই যতো বেশী সংখ্যক সম্ভব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে একটি সরকার গঠন করে বর্তমান সঙ্কট কাটানো সম্ভব। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সংযুক্ত কোয়ালিশনের জন্য ২৭শে ডিসেম্বর একটি পবিত্র দিন নয়। নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি বলেন অবশ্য এটা সম্পূর্নভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উপর নির্ভর করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জরুরী অবস্থা ঘোষনার পর আলোচনা ও তাদের আস্থাশীল করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উচিত ছিলো সকল রাজনৈতিক দলের একটি বৈঠক আহ্বান করা।
ভারতের এই যুদ্ধ শুরুর জন্য তিনি সামরিক সরকারকে দায়ী মনে করেন কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুষ্পষ্টভাবে বলেন, ‘না’। গণতান্ত্রিক সরকার অধিষ্ঠত থাকাকালেও যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় সরকার বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে কিনা তিনি এ প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। পশ্চিম পাকিস্তান পিডিপির নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান অবিলম্বে জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত বলে গতকাল যে বিবৃতি দিয়েছেন তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, নবাবজাদা তার সাথে আলোচনা করেননি।
নবাবজাদা যা বলেছেন তা তাঁর ব্যক্তিগত মত।
– দৈনিক পাকিস্তান। ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১
সত্যিকার অর্থেই ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান
গোলাম আজম
রাওয়ালপিন্ডি, ১লা ডিসেম্বর (এপিপি)।- পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে অনুরোধ জানাইয়াছেন এবং প্রেসিডেন্টকে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র ও অর্থ দফতরের দায়িত্ব পূর্ব পাকিস্তানীদের হাতে দিতে হইবে।
প্রেসিডেন্টের সহিত ৭০ মিনিট কাল স্থায়ী এক বৈঠকের পর আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক গোলাম আজম বলেনঃ প্রেসিডেন্টের সহিত বৈঠকের সময় তিনি প্রেসিডেন্টকে এই মর্মে পরামর্শ দিয়াছেন যে অতীতে যে সমস্ত অবিচার করা হইয়াছে সেগুলি দূরীভূত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা অর্জনই হইবে বর্তমানের প্রধান কর্তব্য। ইহাতে প্রেসিডেন্টের সাড়া প্রদান উৎসাহব্যঞ্জক বলিয়া তিনি মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক গোলাম আজম বলেন, প্রেসিডেন্ট তাহাকে এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আস্থা অর্জনের ব্যাপারে তিনি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালাইবেন। তিনি বলেন জনগণের বর্তমানে প্রধান কাজ হইতেছে দেশের প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় একত্রিত হওয়া। জনাব গোলাম আজম এই মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে বর্তমান সংকট মোকাবিলা করার জন্য জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করিবেন। তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী রূপে আখ্যায়িত করিয়া তিনি বলেন যে তাহাদিগকে মোকাবিলা করার জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট। এ প্রসঙ্গে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি আহবান জানান।
জনাব ভুট্টো সম্পর্কে গোলাম আজম বলেন যে, প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব নূরুল আমীনসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে ভুট্টো যে সকল মন্ত্যব্য করিয়াছেন যে ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শীঘ্রই অনুষ্ঠানের দাবী
পিণ্ডিতে সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে খান কাইয়ুম
রাওয়ালপিন্ডি, ১লা ডিসেম্বর (এপিপি)। কাইয়ুম পন্থী মুসলিম লীগ প্রধান খান আবদুর কাইয়ুম খান শীঘ্রই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জ্ঞাপন করেন।
গতকাল করাচী হইতে পিণ্ডি আগমনের পর সাংবাদিকদের নিকট খান কাইয়ুম বলেন যে, আগামী মাসের ২৭ তারিখের মধ্যে তিনি পবিত্রতা দেখিতে পাননা। কাজেই সুবিধামত যত শীঘ্র সম্ভব পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা উচিত। জনাব কাইয়ুম খান বলেন, জাতীয় পরিষদের যাহাতে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে না পারে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর যাহাতে সম্ভব না হয়, তজ্জন্য ভারত ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করিতেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চিরাচরিত ভারতীয় নীতি অনুসরণে এক্ষণে তাহারা পুরামাত্রায় যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছে তিনি বলেনঃ জনসাধারণ অ সরকারকে এক যোগে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করিতে হইবে।
এক প্রশ্নের জবাবে খান কাইয়ুম বলেন যে, ন্যাপের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তিনি সমর্থন করেন এবং মন্তব্য করেন যে অনেক আগেই ন্যাপকে বে-আইনী ঘোষণা করা উচিত ছিল। যাই হোক, দেশের প্রতি যে তাহাদের আনুগত্য নাই, তাহা এক্ষণে উপলব্ধি করা হইয়াছে।
তিনি বলেন যে, এই ধরনের দলকে শাসনতন্ত্র রচনায় অংশগ্রহণ করিতে দেওয়া যায় না।
সমর পরিষদ গঠনের সম্ভবনা সম্পর্কে মুসলিম লীগ প্রধান বলেন যে, প্রেসিডেন্ট এই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
যথার্থ গণ প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরই দেশের অখণ্ডতা রক্ষার একমাত্র উপায়
পি,পি,পি কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাব।
পেশোয়ার, ২রা ডিসেম্বর (এপিপি)।– গতকাল এখানে জনাব জেড এ, ভূট্টোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পি,পি,পির কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে জনসাধারণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের নিকট অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানানো হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির ছয় ঘণ্টাব্যাপী দুইটি অধিবেশনে সামগ্রিক জাতীয় সমস্যা আলোচনা করা হয়। উক্ত আলোচনাকালে এই মর্মে গুরুত্ব আরোপ করা হয় যে, সত্যিকারভাবে ক্ষমতা যাহাদের, তাহাদের নিকট উহা হস্তান্তরের মাধ্যমে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা সম্ভব।
ভারতীয় আক্রমণের ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উক্ত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়। প্রস্তাবে পরাজিত জনগণ বিরোধী ও পাকিস্তান বিরোধী ব্যক্তিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করিয়া বলা হয় যে, সেই রূপ কার্য ভারতের নিকট আত্মসমর্পণের শামিল হইবে এবং উহার দ্বারা দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত তাসখন্দ চুক্তির পথ সুগম করা হইবে। জাতীয় লক্ষ্যকে যথাযথ হস্তে অর্পণ ব্যতীত পুনর্মিলন ও পুনর্গঠনের দ্বৈতকার্য সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করা যাইবে না বলিয়া উহাতে মন্তব্য করা হয়।
প্রস্তাবে আরো বলা হয় যে, আমরা যাহারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি তাহারা অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের এই গুরুতর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
প্রস্তাবে অতঃপর বলা হয় যে, ভারতীয় আক্রমণকারীরা পূর্ব পাকিস্তানে অগ্রসর হইতেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উপর যুদ্ধের মেঘ জমিয়ে উঠিতেছে। সমগ্র জাতি এক সংকটজনক পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছে। জাতির ভবিষ্যৎ এক চরম সংকটের সম্মুখীন হইয়াছে। এই সর্বৈব ও গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ইতিহাস জনগণের দুর্জয় নেতৃত্বের প্রতি তাগিদ দিতেছে বলিয়া উক্ত প্রস্তাবে বলা হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১