You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ ২১২। যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী
সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
যশোর, আখাউড়া ও লাকসাম
পাকিস্তানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রনে রয়েছে
সাপ্লাই লাইন যাতে নির্বিঘ্নে থাকে
সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছেঃ জেনারেল ফরমান আলী
.
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গতকাল সোমবার ঢাকায় বলেন, বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী আত্ম্ররক্ষামূলক যুদ্ধ চালাতে সম্পূর্ণ সক্ষম।
এপিপির সময়বার্তা পরিবেশক ইকবাল আলী খান এ খবর প্রদান করেন। সাংবাদিকদের সাথে এক ঘরোয়া বৈঠকে জেনারেল ফরমান আলী বলেনঃ আক্রমণকারীকে পরাজিত করার জন্যই আমরা এখানে আছি।আমাদের লাইন যাতে বিঘ্নিত থাকে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে করতলগত রাখতে পারবে কি না এ সম্পর্কে এক বিদেশী সংবাদদাতা তাকে জিজ্ঞেস করলে জেঃ তার জবাবে বলেন, কেন পারবে না? এ সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ আস্থাবান। আর সে কারণেই আপনারা আমার মুখে হাসি দেখছেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেন, সাধারণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে আত্ম্ররক্ষামূলক যুদ্ধ চালাতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অগ্রবর্তী অবস্থানের পতন ঘটলে পরবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা খুবই মুশকিল হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন যে, শত্রুর অগ্রাভিযান যাতে চরমভাবে স্তব্ধ করে দেখা যায় তার জন্য আমাদের নিজেদের পছন্দমত জায়গায় শত্রুদের বাধা দান করাই হলো পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধরত পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর লক্ষ্য। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানী এলাকা দখলে ভারতীয় দাবী তাৎপর্যহীন। কারণ আমাদের যুদ্ধ কৌশলেরই একটা অংশ।

তিনি যশোর, লাকসাম ও আখাউড়া পাকিস্তানী সেনাদলের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যশোর কোনদিনই শত্রু কবলিত হয়নি। ‘যশোর যদি শ্ত্রু কবলিত হয়ই তবে তা প্রচন্ড যুদ্ধের পরই মাত্র হবে।

দু’দেশেরই বিশ্ব সমরের ন্যায়
যুদ্ধ চালানোর সামর্থ্য নেই
পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে তিনি বলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ন্যায় একটা যুদ্ধ চালানোর সামর্থ্য ভারত ও পাকিস্তানের দুদেশেরই নেই।

তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের মাতৃভূমির আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করে না।

হিলির যুদ্ধ
তিনি বলেন যে, হিলিতে রেল লাইনের এ পার্শ্বে ভারতীয়দের কোন এখতিয়ার নেই। হিলিতে গত ১৪ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে। রেলওয়ে লাইন হল ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত রেখা।
ভারতীয় নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম পৌছার চেষ্টা
জেনারেল বলেন যে, রোববার ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম পৌছার চেষ্টা চালায়। আমাদের নৌযান তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। একজন প্রশ্নকারীর জবাবে তিনি বলেন যে, কুমিল্লা পাকিস্তানীর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে জেনারেল বলেন, ফেনীতেও পাকিস্তান সেনাদল যুদ্ধ চালাচ্ছে।

চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়
তিনি জানান যে ভারতীয়রা চট্টগ্রামের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। কিন্তু সেখানে সেনারা বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

মেজর জেনারেল একজন বিদেশী সাংবাদিককে জানান যে বর্তমানে ঢাকায় বিপন্ন জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণের জন্যই ৬ই ডিসেম্বর তারিখ ঢাকায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ রাখার ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জাতিসংঘের অনুরোধে সম্মত হয়। কিন্তু ভারতীয় জঙ্গী বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে আক্রমণ চালিয়ে তাদের ঢাকা ত্যাগের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি স্মিতহাস্যে বলেন, ঠিক জানিনা কেন ভারতীয়রা এমন কাজ করলো। জাতিসংঘ কর্মচারীর ঢাকা ত্যাগ করুক তারা হয়তো তা চায় না।
রানওয়েতে একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে আজ ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে একটা গর্ত সৃষ্টি করা ছাড়া হাম্লাকারী ভারতীয় বিমানসমূহ বিশেষ কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এতক্ষণে রানওয়ে হয়তো মেরামতও করা হয়ে গেছে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন যে ১৯৬৭ সালে জুন যুদ্ধে ইসরাইল যেমনটি করেছিল তেমনভাবে ভূমিতে রাখা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমানসমূহ ধ্বংস করাই ভারতীয় বিমান বাহিনীর বার বার ঢাকা বিমানবন্দেরের ওপর আঘাত হানার প্রধান লক্ষ্য।
জাতিসংঘের দুটো এবং অপর একটা টুইন বিমান ছাড়া ভারতীয়রা ভূমিতে রাখা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আর একটা বিমানের ওপরও আঘাত হানতে পারেনি। বিমান বিধ্বংসী কামানসমূহ চমৎকার কাজ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেন যে ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় হামলাকারী ভারতীয় জঙ্গী বিমানসমূহের যে দুর্গতি হয়েছে তাতে অবশ্যই আক্রমণকারীর একটা উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে। তিনি বলেন যে গতকাল (সোমবার) বিকাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬টি ভারতীয় ভারতীয় বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি হাল্কা বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে গুলি করে ভূপাতিত করা হয় ও অপর ১০ টি পি, এ, এফ বিমান ভূপাতিতি করে। ক্ষতিগ্রস্ত অপর ৫টি ভারতীয় বিমান অবশ্য ভারতে পাড়ি জমাতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে ২টি বিমান চট্টগ্রাম এলাকায় পাকিস্তান নৌবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পাকিস্তান জেনারেল রাও ফরমান আলী বলেন যে ভারত কর্তৃক তিনটি মুখ্য সাফল্যকে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বড় ধরনের হামলায় বিরাট সাফল্য বলে প্রচার করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় সকল পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে তিনি জানান।

উত্তর ময়মনসিংহ

উত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় কৌশলগত যুদ্ধ চলছে বলে মেজর জেনারেল জানান। তিনি বলেন যে কামালপুর ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে পাকিস্তান সেনাদল ভারতীয় পক্ষের ৬ থেকে ৭ গুণ অধিক লোককে হতাহত করে ঠাকুরগাঁ এলাকায় বরাবরই ভারতীয়দের মূল অভিযান চলছে বলে তিনি জানান।
.
ভারতীয় সেনা অতি সহজেই ঢাকায় ঢুকতে পারবে কিনা, এ মর্মে একজন বিদেশী সাংবাদিক প্রশ্ন করলে মেজর জেনারেল বলেন, ফাজিলকা অতিক্রম করে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে শতদ্রু যেমন আমাদের জন্য বাধাস্বরূপ, তেমনি ব্রহ্মপুত্রও একটা চমৎকার বাধা।

সিলেট এলাকা

ভারতীয়রা এ এলাকায় যে সাফল্য লাভ করেছে তা পুনর্দখল করার জন্য সিলেটে যুদ্ধ চলছে বলে তিনি জানান। এ এলাকায় ভারত তিন ডিভিশন সৈন্য মোতায়ন করেছে। তিনি আরো জানান যে আখাউড়া ও কুমিল্লার দক্ষিণবর্তী লাকসামের বিপরীত দিকে অবস্থিত চৌদ্দগ্রাম নামক এলাকায় ভারতীয় সৈন্য চাপ সৃষ্টি করছে।

দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে

জেনারেল ফরমান আলী বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বাত্নক যুদ্ধের পর রাষ্ট্রবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের তৎপরতা বর্তমানে প্রকৃতপক্ষে স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাফল্য, বিশেষ করে ঢাকার আকাশে পাকিস্তানী বৈমানিকদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে জনসাধারণ মোটামুটি উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।

ঢাকায় ছত্রী সৈন্য প্রেরণ সহজ নয়

পূর্ব অংশের প্রধান নগরী ঢাকা দখলের পথ সুগম করার ব্যাপারে ঢাকার ভারতীয়দের ছত্রী সৈন্য অবতরণের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জেনারেল ফরমান আলী বলেন যে, এটা খুব সহজ নয়। তিনি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, জার্মান ছত্রী সৈন্য অবতরণ করানো হলে বৃটেনকেও এমন হুমকির সম্মুখীন হতে হয়ছিল। কিন্তু বৃটেন আজো টিকে আছে বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, স্থায়ী হবে বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান বিরোধিরা মনে করেছিল যে, পাকিস্তান ৬ মাসের বেশি টিকবে না।

কিন্তু পাকিস্তা ২৫ বৎসর টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!