You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ইয়াহিয়া-ভুট্টো ক্ষমতা দ্বন্ধ
সংবাদপত্রঃ প্রতিনিধি ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১

[প্রতিনিধিঃ সাপ্তাহিক স্বাধিন্তাকামী বাংলার মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র। শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন জায়গা হতে সম্পাদক, আহমেদ ফরিদ উদ্দীন কর্তৃক রক্তলেখা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়ঃ
নাটকের প্রথম অংকঃ
ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস
সম্প্রতি মুলতানে দলীয় কর্মীদের এক সমাবেশে পিপলস পার্টির প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর (ভুট্টোর) দলে ভাঙ্গন সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করেন । অভিযোগ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, এ ব্যাপারে সরকারী তহবিল থেকে প্রচুর অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে উস্কানি দেয়া হচ্ছে ।
খবরটি ক্ষুদ্র এবং সংক্ষিপ্ত । কিন্তু ক্ষুদ্র এবং সংক্ষিপ্ত হলেও খবরটির একটি বিশেষ রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে । পর্বতের ধুয়ো দেখে যদি আগুনের অস্তিত্ব অনুমান করা যায় তাহলে এই ক্ষুদ্র সংবাদ থেকেও পাকিস্তানী রাজনীতিতে একটা ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাবে । ইয়াহিয়া- ভুট্টোর ক্ষমতা দ্বন্দের একটা চিত্র প্রস্ফুটিত হবে । ক্ষমতার এই দ্বন্ধ আমাদের কাছে কিছুমাত্র অপ্রত্যাশিত কিংবা অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না । এমনটি হবারই কথা । না হলেই বরং অস্বাভাবিক মনে হতো । পাকিস্তানী রাজনীতি সম্বন্ধে সাধারণ একটু ধারণা থাকলেই ব্যাপারখানা সবিস্তার বোঝা যাবে ।
ইয়াহিয়া ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান । দেশ রক্ষাই ছিল তার একমাত্র দায়িত্ব । কিন্তু পূর্বসুরীদের মতোই শুধু দেশ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না । পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হবার একটা রঙ্গিন স্বপ্নও দেখতেন নাদির শাহের উত্তর পুরুষ ইয়াহিয়া । স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার সুযোগও এসে গেল । আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দেখা দিল আন্দোলন। ওরা পাঞ্জাবী শাসন থেকে অব্যাহতি পেতে চায় । ওরা স্বায়াত্তশাসন চায় । তীব্র গণজোয়ারে আইয়ুব ভেসে গেলেন । প্রেসিডেন্ট হলেন ইয়াহিয়া । হাতে পেলেন দেশের সর্বময় ক্ষমতা । কিন্তু ইয়াহিয়া এটাও জানতেন, বাংলার মানুষ আর ঘুমিয়ে নেই । তারা আগের চেয়ে অনেক সচেতন । ওরা দুর্বার । কিন্তু ক্ষমতায় যে তাঁকে থাকতেই হবে । যেভাবেই হোক । তাই তিনি ভোল পাল্টে ধরলেন নতুন সুর । ধরলেন নতুন গান । বললেন, তিনি রাজনীতি বোঝেন না। বোঝবেনও না । ওটা রাজনীতিকদের কাজ । তাই দিলেন নির্বাচন । আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই তুলে দেবেন দেশের শাসনভার । পাঞ্জাবী শাসকচক্রের ধারণা ছিলো, যতো পপুলারই হোক না কেন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না । ক্ষমতা পাবে না শেখ মুজিব । বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবীও অনুচ্চারিত থেকে যাবে । কিন্তু তাদের সব ধারণা, সমস্ত বিশ্বাস সমস্ত সম্ভাবনাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো । অসম্ভব সম্ভব হলো । পক্ষান্তরে ভুট্টোর পিপলস পার্টি রইলো দ্বিতীয় স্থানে । ইয়াহিয়া-ভুট্টো-পাঞ্জাবী চক্র প্রমাদ শুনলেন ঠিক হলো, কিছুতেই মুজিবকে ক্ষমতা দেয়া চলবে না । বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে না । যেমন করেই হোক, যেভাবেই হোক ভুট্টোকেই দেয়া হবে দেশের শাসন ভার । কর্মসূচী হোক ভুট্টোকেই দেয়া হবে দেশের শাসন ভার । কর্মসূচী অনুসারে সবই হলো । জাতীয়- পরিষেদের অধিবেশন বাতিল হলো । সৈন্যবাহিনী রাস্তায় নামলো । আলোচনা চললো । অবশেষে ২৫শে মার্চ থেকে ব্যাপক গণহত্যা চললো । শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হলো । আওয়ামী লীগ বেআইনি ঘোষিত হলো । সবই পরিকল্পনা অনুযায়ী হলো । সবই কথা মতো, সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবী নিয়ে ভুট্টো ক্ষমতা চাইলেন । ইয়াহিয়াও ক্ষমতা ছাড়বেন বলে এতো কিছু করেননি । তিনি দেশের জরুরী সংকটময় পরিস্থিতির কথা তুলে ভুট্টোকে নিরস্ত করতে চাইলেন । ভুট্টো তা মানবে কেন ? তারও ক্ষমতা পাবার অধিকার রয়েছে। তাই শুরু হলো ক্ষমতার দ্বন্ধ । টাগ অব ওয়ার । এটা নাটকের প্রথম অংক । আমরা উৎসাহী দর্শকরা নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছি ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!