শিরোনামঃ সম্পাদকীয় সংগ্রামী বাংলার ডাক
সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা* বিপ্লবী আলী আসাদ সংখ্যা
তারিখঃ ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১
[সংগ্রামী বাংলাঃ বাংলাদেশের মুখপত্র। প্রধান পৃষ্ঠপষকঃ মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানী। প্রধান সম্পাদকঃ আবদুর রহমান সিদ্দীক। সংগ্রাম বাংলা প্রেস, ঢাকা হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সংগ্রামী বাংলার ডাক
সংগ্রামী বাংলা ডাক দিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ডাক, জনযুদ্ধের ডাক । পশ্চীম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, অত্যাচারী, জালেম, জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে মরণপণ মহাসংগ্রামের ডাক ।
এ সংগ্রাম রক্তলোলুপ দানব বাহিনীর বিরুদ্ধে-পরস্পদ হরণকারী নরপিশাচদের বিরুদ্ধে, নারী ইজ্জতহন্তা জল্লাদের বিরুদ্ধে, দেশী-বিদেশী শোষকদের বিরুদ্ধে, জঙ্গী শাসকদের দেশী দালাল ও বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে এ এক দুর্বার অভিযান । এ অভিযান চলছে, চলবে । যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় ।
বাংলা আমাদের দেশ, আমাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি । আমাদের শৈশবের লীলাভূমি, আবাল্যের ক্রীড়াভূমি, সারাজীবনের কর্মস্থল, আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, বর্ণনীতির প্রাণকেন্দ্র । বাংলার মাটি আমাদের কাছে তীর্থক্ষেত্রের মত পবিত্র, পুণ্যভূমি । বাংলার শোষিত, লাঞ্চিত, নির্যাতীত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান আমাদের সংগ্রামের আশা-ভরসা । বাংলার প্রকৃতি, বাংলার আকাশ-বাতাস, জল-স্থল, নদী-প্রান্তর, বাংলার শহর-বন্দর-গ্রাম, আমাদের কাছে স্নেহময়ী স্বপ্নরাজ্যের মত, আমাদের প্রেরণার উৎস । আমাদের সেই প্রিয় জন্মভূমি আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসি বাঙালী জাতিকে । এ দেশে আমাদের পিতা, পিতামহ, পূর্বপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করেছেন, আবার দেশের মাটিতেই তাদের শেষ শয্যা রচিত হয়েছে । পূর্ব পুরুষদের রক্তে গড়া এই বাংলা, তাদের ত্যাগের দুঃখ-কষ্টের, ব্যথা বেদনা, সুখ-দুঃখের স্মৃতি বিজড়িত, আমাদের এই সাধের বাংলাদেশ । বাঙালী আমাদের আশা-ভরসার প্রতীক । বাংলা আমাদের কাছে স্বপ্নের দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ, সৌন্দর্যের লীলাময় সুন্দর দেশ । বাংলার ভাষা আমাদের সংগ্রামের প্রেরণা, বাংলার মুক্তিই আজকে আমাদের আদর্শ, আমাদের সাধনা । বাংলার সূর্য উঠে সংগ্রামের বাণী নিয়ে, বাংলার চলে যায় নতুন দিনের আগমনী গান গেয়ে ।
সকল দেশের চাইতে সেরা আমাদের এই বসুন্ধরা । এই বাংলায় এসেছে মোগল পাঠানেরা ভাগ্য বিধাতা হয়ে । এসেছে পর্তুগীজেরা ডাকাত আর দাস ব্যবসায়ীরূপে-ইংরেজ ফরাসীরা বণিকের বেশ, এসেছে এই বাংলাদেশ । অবশেষে এসেছে বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, ধনিক, পুঁজিপতি, শিল্পপতি আর তাদের লোকলস্কর- সৈন্য সামন্ত, সরকারী কর্মচজারী, পাকিস্তানের নামে ইসলামের নামে । লুণ্ঠনে, লুণ্ঠনে, শাসনে-শোষণে, কূশাসনে নিষ্পেষণে, অত্যাচারে – অবিচারে জর্জরিত হয়েছে পাকিস্তানোত্তর বাংলাদেশ । পাঠান রাজত্বে যা হয় নাই, মোগলরা যা করে নাই, যা করতে বিদেশী বিজাতী ইংরেজদের হৃদয় কেঁপেছে, শেষ পর্যন্ত তার চাইতেও জঘন্যতম অপকর্ম সাধন করেছে আজকের পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খাঁর জঙ্গীবাহিনী । তাদের রোষানল থেকে নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধা, রুগ্ন, গৃহপালিত জীব, ঘর বাড়ী, দোকান পাট, মন্দির মসজিদ গীর্জা কিছুই রক্ষা পায় নাই । মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ । জঙ্গী বাহিনী মানবতাকে হত্যা করে, ন্যায়নীতিকে বলি দিয়ে, ধর্মের আদর্শকে পদদলিত করে, মুক্তিকামী জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছে । যার নজীর মধ্যযুগেও বিরল । নাদির শাহ তৈমুর বা চেঙ্গিশের নৃশংসতাকেও লজ্জা দিয়েছে পাকবাহিনীর বর্বরতা । এত চোখের জল ঝরেছে যার নজীর বিংশ শতাব্দীতে খুব বিরল ।
বাঙালীর অপরাধ তারা স্বাধীনতা চায়, সর্বপ্রকার বিদেশী শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে চায় । বাঙালী জাতি সেই মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ- এ সংগ্রাম বাঙালীর বাঁচার সংগ্রাম; এই পৃথিবীতে তারা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে বাঁচতে চায় । বাংলার ভাষা, বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সবই আলাদা, স্বতন্ত্র । এই বাঙালী তাদের নিজস্ব দেশ, আবাসভূমি এই পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকে দিতে চায় । কোন বিদেশী বহিরাগত জালেমদের শাসন বাঙালী মানতে চায় না, মানতে পারে না কোনদিন ।
বাংলার ক্ষেতখামার, নদনদী, জলবায়ু, বন-জঙ্গল, শহরগ্রাম, ঘরবাড়ী, অট্টালিকা, কলকারখানার সমুদয় সম্পত্তির মালিক বাংলার জনসাধারণ । তাতে সকলের সমান অধিকার । বাঙালী আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু, আমাদের আপনজন- তারা স্বদেশে বিদেশে যেখানেই বাস করুক না কেন । বাঙালীর সুখে আমরা সুখী, তাদের দুঃখে আমরা দুঃখী, ব্যথায় ব্যথিত, সকলের তরে সকলে আমরা । বাঙালীর রক্ত এক ও অভিন্ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম- সমগ্র বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রাম । এ বাংলা নেতাজী সুভাষের পিতৃভূমি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জন্মভূমি , রবীন্দ্রনাথের কবিতার উৎস, নজরুলের শৈশবের লীলাভূমি, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহার জন্মস্থান, বিপ্লবী শহীদ সূর্য্য সেন, প্রীতিলতা, প্রফুল্ল, তীতুমির, শহীদ বরকত, সালাম, আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল, রওশনরা ও অন্যান্য মুক্তিকামী, বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল, ভাস্বর এক অপরূপ দেশ ।
যারা আমাদের ২৩ বছর ধরে অবিরাম শোষণ করেছে । নির্মম শাসনেই ষ্টীমরোলার চালিয়েছে, তাদের প্রতি কোন দয়া নাই, যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে বাংলার মাটি লাল করে দিয়েছে, তাদের সংগে কোন আপোষ নাই । যারা মা বোনের মান সম্ভ্রব ভূলণ্ঠিত করেছে তার প্রতিশোধ আমাদের নিতে হবেই । বাংলার শিশুদের আর্তক্রন্দন, বৃদ্ধের দীর্ঘ নিঃস্বাস, মা বোনের চোখের জল আমাদের মোছাতেই হবে । গৃহ-হারাদের নিজ গৃহে ফিরিয়ে নিতেই হবে । হতাশা হবেন না শরণার্থীরা নিরাশার কারণ নাই, পিতৃহারাদের মাতৃহারাদের বেদনার বোঝা বইতে হবে না । মা বোনদের মুক্তির দিন আগত । মনে বহু ব্যাথা আছে, বেদনা আছে, অনেক দুঃখ জমা হয়ে আছে প্রতিটি হৃদয়ে । আছে প্রতিহিংসার আগুন । যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক, শোষক, ধনি, বণিক, সওদাগরের পৃষ্ঠপোষিত সামরিক সরকার । যে সমস্ত বীর যোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না, তাদের আমরা আর ফিরে পাব না কোনদিন । কিন্তু তাদের জীবনের ত্যাগের বিনিময়ে কি পাব আমরা আমাদের নিজের দেশ, দুঃখী বাংলাকে ত্যাগ, দুঃখ, কষ্ট, রক্তদান ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রাম হয় না-হতে পারে না ।
তাই আমাদের আহবান, যত বেশী ত্যাগ ও যত বেশী রক্ত দেব তত তাড়াতাড়ি আমাদের জয়ের দিন এগিয়ে আসবে । রক্ত দিতে শিখেছে বাংলার কৃষকেরা, কারখানার শ্রমিকেরা, স্কুল কলেজের ছাত্ররা, ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছেন বাংলার মা বোনের, দুঃখ বরণ করেত শিখেছে বাংলার শিশুরা । তাই স্বাধীনতার দিন নতুন বাংলার দিন আগত । জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী ।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এই যুগ সন্ধিক্ষণে সর্বপ্রকার ত্যাগের ব্রত নিয়ে সংগ্রামের বাণী নিয়ে, মুক্তির আদর্শ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে “সংগ্রামী বাঙালী” । শোষণ শাসনের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধের হাতিয়াররুপে । সকলের হাতে হাত মিলিয়ে জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে অবিশ্রাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিচ্ছে-সংগ্রামী বাংলা সকলের সাহায্য ও সহযোগীতাই আমাদের মূলধন ।
মুক্তিকামী জনগণকে জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন ।
“সংগ্রামী বাংলা” জিন্দাবাদ
স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ ।