শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ( অসুর নিধন উৎসব)
সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
অসুর নিধন উৎসব
বাংলার ঘরে ঘরে শারদীয় বাঁশি উঠেছে। এই আনন্দের আহ্বান বাঙালী মাত্রের মনই সাড়া না দিয়ে পারে না। এই উৎসবের সঙ্গে বাঙালী জাতির নাড়ীর টান অত্যন্ত নিবিড় এবং গভীর। একদিন সমাজ বিবর্তনের ধারা এই উৎসবের আঙ্গিক হয়ত পালটাবে। কিন্তু এর অন্তর্নিহত প্রীতির বাণী একভাবে না একভাবে বাঙালী চিত্ত সঞ্জীবিত করে রাখবে।
এবার বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বিস্তৃত অংশ দেশের বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন; ইয়াহিয়া সরকারের নেকড়ে বাহিনী তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে, প্রিয় মাতৃভূমি থেকে, জীবনের নাট্যমঞ্চ থেকে প্রচণ্ডতম পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে দেশের বাইরে ছুড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেই পুরাতন সাম্প্রদায়িকতা আবার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে তার স্বাভাবিক পরিণতি স্বরূপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এক খাট্টা হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাদের বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ-অতীতের রক্তাত্ত স্মৃতি বড় করুন এবং বেদনাদায়ক। এক মাত্র উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নই তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই সংবাদ শুনার জন্য শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার শ্রবণ উৎকর্ণ হয়ে রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণতরঙ্গমুখর এই উত্তরণ মুহূর্তের দেবীর বোধন গীতি ভেসে উঠেছে। এইবার পূজা আর পুষ্পে নয়, বিল্প পত্রে নয়, দূর্বাদলে নয়। এবার রক্তে রক্তে মাংসে মাংসে মগজে মজ্জায় দেবীর আবাহন গীতি বেজে উঠেছে, এই সুর নতুন, এই প্রাণস্পন্দন অভিনব, এই আত্মত্যাগ অভূতপূর্ব। এবার শারদীয় উৎসব শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে নয়, বাঙালী জাতির অন্তর্গত প্রতিটি সম্প্রদায়ের কাছেই নতুন তাৎপর্যে ধরা দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শোষণ পুঁজিবাদ- এর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক ক্ষমাহীন সংগ্রাম, এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতি স্বাধীন হবে। বাংলাদেশে তারা সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িক কলুষমুক্ত একটি সুন্দর সমাজ সৃজন করবেন। এই সময়ে এই মহান ঐতিহ্যময়ী উৎসব উপলক্ষে আমরা একটি কথা স্পষ্ট ভাবে জানাতে চাই- তা হলো শারদীয় উৎসব বাংলাদেশের সমাজের একাংশের ধর্মীয় উৎসব হলেও গোটা বাঙালী জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বিশেষ করে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিতে সাহিত্য সৃজনলোকে এই উৎসবের অবদান অনেক বেশি। আমরা বলতে চাই যারা ধর্মীয়ভাবে নিজেদের ভক্তিপিপাসা এই উৎসবের মাধ্যমে মেটাতে চান- তারা সেভাবেই এই উৎসবকে বরণ করে নিন। যাদের ধর্মীয় উৎসব নয়, তারাও এই উৎসবের ক’টি দিন জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং শিল্প চর্চারদিন হিসেবে গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের যে মহান জাতি গঠনে দীপ্ত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে,তাতে করে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে না। একটি প্রাণবন্ত জাতি গঠনের এই দ্রুত শক্তিশালী প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে এক সম্প্রদায়কে গ্রহণ করতে হবে। তা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। জাতির মাত্র কঠিন অগ্নিপরীক্ষার দিনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে প্রতিটি সংগ্রামী বাঙ্গালীর কাছে আমার এই আহ্বান আমাদের কাগজের মারফত, দেশের ভেতর প্রতিটি ঘরে, মুক্তি সংগ্রামীদের প্রতিটি ব্যারাকে এবং প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলে দিতে চাই- এবারের শারদীয় উৎসবের একটি মাত্র রঙ্গ তা হলো সমরঙ্গ। বাংলাদেশের যুবক, যুবতী, ছেলে, জোয়ান, বুড়ো এই সময় রঙ্গেই উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক। এটাই এবারের শারদীয় উৎসবের দাবী, বাঙালী মরবে, মরতে বাঁচার পথ পরিষ্কার করবে, সুতরাং সকল বাঙালী ভাই বোন, ছেলে মেয়ে, মা- বাবা যে যেখানে আছেন এই পরম লগ্নে প্রাণ খুলে গেয়ে উঠুন- জয় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।