You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদপত্রঃ দাবানল ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়

(১)
আরো জোরে আঘাত হানো
ইয়াহিয়া খানের সাধের আশা পূরণ হয়নি। বাহাত্তুর ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবীকে চূর্ণ করতে পারেনি তাঁর লেলিয়ে দেয়া সামরিক বাহিনী। যদিও বাংলাদেশে তারা নির্মমতা এবং নিষ্ঠুরতা, হত্যা, লুন্ঠন এবং ধর্ষণের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তবু বাংলাদেশের জনগণকে এক ইঞ্চি নোয়াতে পারেনি। চূড়ান্ত সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলার জনগণ ন্যায়ের নামে, শোষিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নামে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বয়স দশ মাস পুরো হতে চলছে। এর মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানের পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গন্তব্য নেই। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ নানা রণাঙ্গনে দূর্বার হয়ে উঠেছে। আমাদের সুশিক্ষিত দেশপ্রেমিক গেরিলাদের উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে দেশের অভ্যন্তর প্রায় কাবু হয়ে এসেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যে ক্যান্টনমেন্টগুলোর উপর ভরসা করে ইয়াহিয়া খান গোঁফে তা দিতে দিতে ভেবেছিলেন, শক্তিবলে বাংলাদেশকে পদানত করে রাখতে পারবেন সে ভরসার কেন্দ্রবিন্দুগুলো জঙ্গীলাটের চোখের সামনে ভেঙ্গে পড়ছে। এ পর্যন্ত আমরা খবর পেয়েছি যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন আসন্ন। মুক্তি সেনানীরা বীর বিক্রমে ধাওয়া করছে সিলেট অভিমুখে। চট্টগ্রাম অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, ঢাকা মহানগরী গোটা প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুমিল্লাতে জোড় লড়াই চলছে, খুলনা জেলা প্রায় মুক্ত হয়ে এসেছে। অনেকগুলো বিমানবন্দর মুক্তিযোদ্ধারা কামান দাগে তছনছ করে দিয়েছে। তার ফলে স্যবরজেট থেকে মার্চ এপ্রিল মাসের মতো গুলী, বোমাবর্ষণ করারও সুবিধা হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলোতে এখন আর বিদেশী জাহাজ ভিড়তে সাহস করছে না। মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামে ও বন্দরে অনেকগুলো বিদেশী জাহাজ জখম করেছেন অথবা একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। বিদেশ থেকে নয় শুধু, পশ্চিম-পাকিস্তান থেকেও জলপথে সমর সম্ভার আমদানীর পথ একেবারে বন্ধ হয়ে পড়েছে। বস্তুতঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বন্দী। আমাদের সাহসী সেনানীরা তাদেরকে চারদিক থেকে তাড়া করে একবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। আজ তারা আহত বন্য পশুর মতো-তারা জানে তাদের পালাবার কোনো পথ খোলা নেই। প্রদীপ যেমন নিভবার আগে দপ করে জ্বলে উঠে, শত্রুও তেমনি চূড়ান্ত পরাজয়ের পূর্বে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখছে। কিন্তু তারা ভালভাবে জানে যে, তাঁদের বাঁচবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে আমাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে তুলতে হবে, শত্রুর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে দিতে হবে। কোন রকমের সাহায্যে তারা বলীয়ান হয়ে উঠার রাস্তা একেবারে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে ফেলতে হবে। সামান্য অবহেলায় শত্রু শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। জোড়ায় জোড়ায় আঘাত করে ইয়াহিয়ার যুদ্ধাস্ত্রটাকে একেবারে অকেজো করে ফেলতে হবে। কোন দয়া, কোন অনুকম্পা নয়। দশ লক্ষের মতো বাঙ্গালী জনগণকে তারা যে নৃশংসতায় হত্যা করেছে, একই নৃশংসতা আজ তাদের ফেরত দিতে হবে। ইয়াহিয়া খানের হুকুম বরদার সৈন্যদের এই ভাগ্যলিপি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে- অত্যাসন্ন হয়ে আসছে সে দিন। সুতরাং শত্রুর উপর আঘাত, আঘাত তীব্র আঘাত হানো।

(২)
ঈদ দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিভা নিয়ে এসেছে
বাংলাদেশে এবারের ঈদ এসেছে সম্পূর্ণ এক নতুন রুপে। এক মর্মান্তিক পরিবেশ। আমাদের জীবন থেকে এবার ঈদের সকল আনন্দ ধুয়ে মুছে গেছে, আছে শুধু সন্তানহারা জননীর আকুল ক্রন্দন, সদ্য বিধবার দীর্ঘশ্বাস, ধর্ষিতা মা বোনদের তীব্র আর্তনাদ, আর স্বজন হারানোর শোক। অন্যদিকে মাতৃভূমির শৃংখল মোচনের জন্য আছে দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশে ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের ভিতরেও সাধারণ মানুষ সর্বক্ষণ আতংকের অস্থিরতায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। আনন্দ করার প্রিয়জনরা আজ পরস্পর থেকে দূরে। আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, এবারের ঈদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলেও আমরা বিশ্বাস করি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল সমাপ্তি বাঙ্গালী জীবনে বয়ে আনবে পরিপূর্ণ মুক্তির আনন্দ। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন আগামী ঈদের পূর্বে সমস্ত বাংলাদেশকে মুক্ত করে ঈদের আনন্দ উৎসব উপভোগ করতে পারবো।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!