You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়: সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা | - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয়

সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা

সাপ্তাহিক বাংলা

১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা

২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

[**সাপ্তাহিক বাংলাঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। সম্পাদক- মাইকেল দত্ত। রূপসী বাংলা প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স এর পক্ষে বিজয় কুমার দত্ত কর্তৃক মুদ্রিত এবং মুজিবনগর ও সিলেট থেকে একযোগে প্রকাশিত।]

সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা

ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম সামরিক বর্বরতার শিকার সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পাগল বাঙালীর প্রাণ-ফসলের জ্বলন্ত প্রতীক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে। নিউয়র্কের জাতিসংঘ ভবনে সমবেত বিশ্বের ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সামনে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি জানাতে গেছেন বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। মানবাধিকারের নিশানবরদার, শোষিত-নিপীড়িত জাতিসমূহের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিঘোষিত আদালত জাতিসংঘের আজ চরম পরীক্ষা। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলি কোন পথ অবলম্বন করেন, তাঁরা শোষিত-নির্যাতিত মানবতার শৃঙ্খলমুক্তিতে এগিয়ে আসবেন নাকি রক্তপিপাসু দানবের সাম্রাজ্যবাদী রনলিপ্সার কাছে মাথা নত করবেন বিশ্বের সাড়ে তিনশ কোটি মানুষ তা দেখার জন্য আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জাতিসংঘ একটা কর্মক্ষম জীবিত প্রতিষ্ঠান নাকি ক্ষুদ্র ও মাঝারী রাষ্ট্র এবং জাতিসমূহের ভাগ্য নিয়ে পরিহাসে রত বৃহৎ শক্তিবর্গের দাবা খেলার ছক মাত্র, বাংলাদেশ প্রশ্নে এবারকার জাতিসংঘ অধিবেশনের কার্যকলাপে তারও চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে।
দেশের মাটিতে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হামলা যতই তীব্র হয়ে উঠেছে, আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব বাঙ্গালী জোয়ানরা ততই সুসংবদ্ধ ও সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। ইয়াহিয়া জঙ্গি সরকারের মুরব্বি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ততই বেসামাল হয়ে আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশ সমস্যাটিকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের বিজয় অত্যাচার, অনাচার এবং জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বিজয়- এই বাস্তব সত্যটি কোন সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী কিংবা নয়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রের নিকট সুখকর হতে পারে না- তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বময় জাতিগত নিপীড়ন, বর্ণবৈষম্য এবং ক্ষুদ্রের উপর বৃহতের পীড়নমূলক কর্তৃত্ব যেভাবে ক্রমেই সীমা ছাড়িয়ে চলেছে- এবং সে ব্যাপারে জাতিসংঘ এতকাল যে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছে, বাংলাদেশ প্রশ্নে হঠাৎ করে বদলে যাবে, নির্জীব বিতর্কসভা হঠাৎ করে দৃঢ়সংকল্পে, কর্মমুখরতায় ভরে উঠবে, তেমন আশা সম্ভবত কেউই করেন না। কিন্তু তবু বাংলাদেশের ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। একদিকে নজিরবিহীন বর্বরতা, রক্তের প্লাবন, বাস্তুত্যাগী মানুষের স্রোত এবং নিজদেশে পরবাসী কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা, আরেকদিকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাস্তব কঠিন সত্য। পৃথিবীর প্রায় সব জাতিকেই রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে, এমনকি আজকের বিশ্বের শক্তির আধার যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনকে সম্ভবত তুলনামূলক অনেক বেশী কঠোর ও কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের রক্তের মুল্য দিতে আজ বিশ্ববিবেকের অনীহা বিস্ময়কর বইকি।
সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম মিত্র বিশ্বের বিভিন্ন গণতন্ত্রমনা দেশ ও জনসমষ্টির সুতীব্র ঘৃণা এই ষড়যন্ত্রের নায়কদের পাপ অন্তঃকরণে সাড়া জাগাতে পারছে না। জাতিসংঘ তাই আজও মূক, বধির। কেবল লোক দেখানো তৎপরতা আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে- কর্তার ইচ্ছায় কির্তন। মানবতার দুশমনদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোন শক্তিই যদি না থাকে এই ‘বিশ্বসরকারের’ ভিয়েতনাম, কঙ্গো, বিয়াফ্রা, ফিলিস্তিন, লাতিন আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের সর্বত্র পশুশক্তির বর্বর হামলায় ক্ষতবিক্ষত স্বাধীনতাকামী জাতিসমূহের মত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি জাতিসংঘ কেবল নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকাই গ্রহণ করে চলে তবে আজ নিশ্চিতরূপে বিশ্বমানবতার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে চূড়ান্ত ঘোষণা- এমন কাঠের পুতুল জাতিসংঘের কোন প্রয়োজন নেই। অতএব সাঙ্গ হোক এই কীর্তনের পালা।