শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
দেশদ্রোহী |
মুক্ত বাংলা
১ম বর্ষ ঃ ৭ম সংখ্যা |
১১ অক্টোবর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
দেশদ্রোহী
বাংলাদেশ আজকের দুনিয়ায় এক চরম যুদ্ধে লিপ্ত। বাঙ্গালী জাতির লক্ষ্য দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ডিক্টেটর ইহাহিয়া খান গণতন্ত্রের শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও সামন্তগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরুপে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে গণতন্ত্রকে পৃথিবীর এ অংশ থেকে চিরদিনের মত মুছে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর।বাঁচা মরার এ লড়াইয়ে বাংলার সকল মানুষ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ। কৃষক মজদুর থেকে আরম্ভ করে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী যিনি যখনই সুযোগ পাচ্ছেন জালেম পাকিস্তান সরকারের সহিত সকল সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের অধীন কর্মরত কূটনীতিকগণও সুযোগ পাওয়ামাত্র খুনী পাকিস্তান সরকারকে ধিক্কার দিয়ে বাংলাদেশের এই গৌরবজনক সংগ্রামে কাতারবন্দী হচ্ছেন। বাংরাদেশের অধিকৃত এলাকায় সনাতন মুসলিম লীগ পন্থী বা গোঁড়াপন্থী বলে এতকাল যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্ধ সমর্থক বলে ধরে নেওয়া হতো তাদেরও এখন চৈতন্যদয় হয়েছে এবং মুক্তিফৌজের বিজয় ও পান্জাবীদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য গোপনে আল্লাহর দরবারে দোয়া-দুরদ পাঠেরও সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌছেছে।
কিন্তু আজও কিছু সংখক বিপথগামী সুবিধাবাদী, উচ্চাভিলাষী বাঙ্গালীদের কার্যকলাপ আমাদেরকে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুক্ষীন করছে। জাতিসংঘের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে সত্যিকার পরিস্থিতিটা পৃথিবীর ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ থেকে একদল সুযোগ্য প্রতিনিধি জাতিসংঘে গিয়েছেন। এবং ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন বিভিন্ন দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাই জাতিসংঘে সমবেত দুনিয়ার ১৩০ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণেরসামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার সাহস পাননি খুনী ইয়াহিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহী।ওদের দরকার হল একজন বাঙ্গালী শিখন্ডীর। খুঁজে বের করলো মাহমুদ আলীকে ।
জনাব মাহমুদ আলীর বর্তমান অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার জীবনের গোড়া থেকেই শুরু করতে হয়। মাহমুদ আলীর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ও প্রধান গুরু মাওলানা ভাষানী। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাহমুদ আলীর ভূমিকায় বিভিন্ন রুপ বহুবার আমরা দেখেছি। মাহমুদ আলীর ‘নও বেলাল’ পত্রিকা এককালে পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রগতিশীল পত্রিকা ছিল। পূর্ব বাংলা (পূর্ব পাকিস্তান) যুবলীগের সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী। পাকিস্তানের সর্বপ্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘গণতন্ত্রীদলের’ প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী এবং সাবেক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সেক্রেটারী মাহমুদ আলীকেও আমরা দেখেছি। আমাদের স্পষ্ট স্মরন আছে ১৯৫৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে যখন গলা টিপে হত্যা করার অপচেষ্টায় রত এবং ছাত্র জনতা তাদের বিরুদ্ধে সংগামে লিপ্ত, তখনই ঢাকার তৎকালীন অন্যতম ‘ও-ক’ রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক কনফারেন্সে যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী বলেছিলেন, ধর্মের বন্ধনই যদি রাষ্ট্র গঠণের প্রধান ভিত্তি হয় পূর্ব বাংলা তার নিকটতম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া অথবা মালয়েশিয়ার সংগে ফেডারেশনে থাকতে পারে। আর অফগানিস্তান ইরানকে নিয়ে পাকিস্তান আরেকটি ফেডারেশন গড়ে তুলুক। ওতে আপত্তি কোথায়? এবং এখানেই ট্রাজেডী যে, মাহমুদ আলীকে আমরা এতকাল গণতন্ত্রী, পগতিশীল ও আত্মানিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রবক্তা বলেই বিশ্বাস করে এসেছি সেই মাহমুদ আলীর আসল রুপটাও অমন ও পুঁজিবাদের তিনি এক নিকৃষ্টতম দালাল সেটা আদৌ আমরা জানতামনা। বাঙ্গালী জাতির জীবন মরন সংগ্রাম তাঁর প্রকৃত চেহারাটাকে বাংলাদেশের জনগণ তথা বিশ্বমানবের কাছে সহসাই তুলে ধরলো।
পাকিস্তানের জন্মের দীর্ঘ ২৪ বছরের মধ্যে কোন বাঙ্গালীকে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা রুপে পাঠানো হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই- মাহমুদ আলীতো দুরের কথা। এবারে বড় ফ্যাসাদে পড়ে পৃথিবীকে ধোকা দেবার জন্যই একটা পুতুলের প্রয়োজন হলো ইসলামাবাদের জল্লাদদের। আর সেই পুতুল নেতার ভূমিকায়ই ধরা দিয়েছেন মাহমুদ আলী। জাতির মুক্তিলাভের মহান সংগ্রামে যখন বৃদ্ধ জননেতা জনাব ভাষানী থেকে শুরু করে দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মী মাত্রই জীবনপণ করে কাজ করে যাচ্ছেন, তখনই মাহমুদ আলী গিয়েছেন জাতিসংঘে স্বজাতি ও নিজ দেশের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানীদের দালাল হয়ে ওদের পক্ষে সাফাই গাইতে এবং স্বজাতির কুৎসারটনা করার জন্য বিশ্বরাষ্ট্র সভায়।মাহমুদ আলী জাতিসংঘে নিজেকে পূর্ব বাংলার অধীকারী বলে জাহির করেছেন এবং সেটাইতো বর্তমান পরিস্থিতিতে তার আসল যোগ্যতা। তার দালালী সুলভ বক্তৃতায় বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য আওয়ামিলীগ, মুক্তিফৌজ ও ভারতকে দোষারপ করে ধীকৃত খুনী ইহাহিয়া ও টিক্কাদের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে প্রানপণ চেষ্টা করেছেন তিনি। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী সমর সেনও নিজেকে পূর্ব বাংলার সাবেক অধিবাসী বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার বক্তৃতায় বাংলাদেশে ইহাহিয়া খানের নরপশু সৈন্যবাহিনী কর্তৃক যে অকথ্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তার করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। শ্রী সেন বর্তমানে শুধু ভারতের নাগরিক নন – বিশ্বসভায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধিও। কিন্তু মাহমুদ আলী বাংলাদেশেরই বাসিন্দা। বাংলাদেশ সম্পুর্ন মুক্ত হলে মাহমুদ আলীর মত পথভ্রষ্ট দালালদেরকে পান্জাবিরা সংগে নিয়ে যাবেনা। ছেঁড়া জুতোর মত প্রয়োজন শেষে বাংলাদেশেই ফেলে যাবে – সে কথাটা আমাদের অজানা নেই। তবে ইতিহাস যে মাহমুদ আলীদের ক্ষমা করবেনা, একথাটা আমরা দৃঢ়চিত্তেই বলতে পারি। মীরজাফর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাবীর লোভে সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কিন্তু মাহমুদ আলী জীবনে মাত্র একটিবারই তুচ্ছ সাময়িকভাবে ’নেতা’ বনার লোভে স্বজাতি ও নিজের অতীত জীবনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। ‘ভারতের দালাল’ ‘কমিউনিষ্ট’, ও রাষ্ট্রবিরোধী বলে এই মাহমুদ আলীই কয়েকবার পাকিস্তানী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চরম মূহুর্তে তার ভূমিকা সত্যিই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখন তিনি দেশদ্রোহীর ভূমিকা পালন করছেন। তার অপমৃত্যু ঘটেছে। তাই আমাদের পরিচিত মাহমুদ আলীর অমন অপমৃত্যুর জন্য আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খানের দালাল মাহমুদ আলীকে জানিয়ে রাখছি
’তোমাদের বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে এই জনতা’
—————