শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান |
মুক্ত বাংলা
১ম বর্ষ ঃ ৩য় সংখ্যা |
০৪ অক্টোবর ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্ব জনমত এবং পশ্চিম পাকিস্তানী মজলুম জনতার বিবেকের কাছে একখানা আবেদনপত্র পেশ করেছেন। আবেদন পত্রে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে অবাধ গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটতরাজ ও গৃহদাহের করুণ বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের গণবিবেককে আহবান জানিয়েছেন মানবতার এ জঘন্য অপমানকে বন্ধ করতে রক্ত পিয়াসী ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য।
বিশ্বের গণবিবেক ইতিমধ্যেই জেগেছে। ৫ টি মহাদেশের গণকন্ঠেই বজ্রস্বরে আজ আওয়াজ তুলছে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের তান্ডবের বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখনো চুপ কেন? স্বাভাবিক ভবাবেই প্রশ্ন জাগেঃ বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের অবাধ নরহত্যা তথা ব্যাপক অরাজকতা সম্পর্কে ওরা কি ওয়কিবহাল নয়? অথবা জেনে শুনেই তাদের এই উদাসীনতা?
কিন্তু আমরা জানি তারা উদাসীন কিংবা বাংলাদেশ সমপর্কে সম্পুর্ন অজ্ঞ নয়। তাঁরা বাকশক্তিহীন। স্বাধীনতা তথা পাকিস্তান রাষ্ট্রসৃষ্টি হওয়ার পরেও তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। সামন্তচক্র, তাদের দোসর পুঁজিবাদী –মহল ও সৈরাচরী শাসকগোষ্ঠির স্বার্থে মোল্লাদের মাধ্যমে ধর্মের দোহাই দিয়ে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে রাখা হয়েছে তাদেরকে। স্বাধীনতার ২৪ বছরে বাংলাদেশে লুটপাট করে যা ধনসম্পদ ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সবকিছুই ব্যয়িত হয়েছে সর্দার, পীর, মীর, সাহেবজাদা প্রভৃতি বিভিন্ন খেতাবে পরিচিত মসাজচক্র ও তাদের দুস্কার্যের দোশর পুঁজিপতি মহল এবং সৈরাচারী শাসকগোষ্ঠির আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখেই, গরীব জনসাধারন তাতে একটুও উপকৃত হয়নি। তারা দিন আনে দিন-খায়।
পাকিস্তানী গণতন্ত্রের শেষ ভরসা ছিল বাংলাদেশ। তাই পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্ত গোষ্ঠী, পুঁজিপতি, সৈরাচারী শাসকচক্রের বাংলাদেশকে এত ভয়। আর সেই হেতু পাকিস্তানে জন্মলগ্ন থেকেই ওরা ডিভাইড এন্ড রূল এর আশ্রয় নিয়ে সুকৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানী সরলমনা জনগণের কানে কানে বাঙ্গালী মুসলমানেরা খাঁটি মুসলমান নয়, নিম্নমানের হিন্দু সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে তাই ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানগুলো পালন করেনা। ধর্মের জন্য সত্যিকারের মহব্বত বাঙ্গালী মুসলমানদের নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সেদিন ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন পূর্বমুহুর্তে ইসলামের ধ্বজাধারী ‘মাওলানা’ নামে পরিচিত ফ্যসিস্ট রাজনৈতিক দলের ডিরেক্টর মওদুদি সাহেব (পান্জাবে দশ হাজার কাদিয়ানী হত্যা করানোর নায়ক) বাংলাদেশ সফর করে লাহোরে পৌছেই বলেছিলেন, বাঙ্গালী মুসলমানেরা কালিপুজা করে থাকে।
কিন্তু মওদুদী সাহেবের ঐ নতুন আবিষ্কারে বাঙ্গালী মুসলমানেরা মনে কোন আঘাত পায়নি। শুধু কৌতুক অনুভবই করেছে। কারন তাদের জানা আছে ইসলাম ধর্মের মূলগ্রন্থ করআন শরীফে মহানবী মুহাম্মদ (দঃ) কে ‘খাতেমুন-নবী’ বা সর্বশেষ নবী বলে উল্লেখ করে নবীদের আবির্ভাবের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও পান্জাবে নতুন নবী আবির্ভুত হয়েছিলেন। এমনকি ‘পারভেজ’ নামক জনৈক ব্যাক্তি খোদায়ী দাবি পর্যন্ত করেছিলো। এবং ওদের উত্তরাধীকারীরাই তো পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো থেকে সযত্নে দুরে সরিয়ে রাখা তাদের রাজনৈতিক চেতনাবোধকে জেগে উঠতে বাধার সৃষ্টি করেছে। জনশক্তিকে ওদের বড় ভয়। কিন্তু আর কতদিন ঐ বিরাট শক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভবপর হবে? কারণ ওরা এখন জাগতে শুরু করেছে যে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ওঁদেরকে আলো দেখাবে। গনপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আকুল আহবানও তাদের কানে যেয়ে পৌছেছে। সাড়া দেবার জন্য ছটফট করছে তাদের বিবেক। কারণ দুনিয়ার মজলুম জনগণ একাত্ববোধেরই প্রতীক।
পশ্চিম পাকিস্তানী সামন্তগোষ্ঠী, পুঁজিবাদী মহল ও সৈরাচারী শাসকচক্র আত্মস্বার্থ বজায় রাখার কুমতলবে এখন উন্মাদপ্রায়। তাদের উন্মত্ততার ঘোর যখন কাটবে তখন দেখতে পাবে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন নাটক অভিনীত হচ্ছে। কুশীলবগণ তাদের অপরিচিত অথচ সুদক্ষ এবং তাহারা নিজেরা পড়ে রয়েছে বহু নিচে। নিচে থেকেই করুন নয়নে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে উপরের দিকে তারা তাকাবে। কিন্তু কেউই টেনে তোলার জন্য এগিয়ে আসবেনা, বলবেনা উঠে এসো।
তাই আমাদের বিশ্বাস পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আহবান নিস্ফল হবে না।
————–