You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.16 | মুক্তাঞ্চলের চিঠি | নতুন বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

মুক্তাঞ্চলের চিঠি
(নিজস্ব প্রতিনিধি)

ময়মনসিংহ জেলার অষ্টগ্রাম থানা, রংপুর জেলার ফুলবাড়ী থানা এবং দিনাজপুর জেলার তেঁতুলিয়া থানা সম্পূর্ণরুপে মুক্ত অঞ্চল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, কৃষক সমিতি প্রভৃতি সংগঠনগুলির সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটি, গণবাহিনী ও মুক্তিফৌজের সুদৃঢ় প্রতিরোধের মুখে টিকিতে না পারিয়া ইয়াহিয়ার জোয়ানরা এইসব এলাকা হইতে চিরদিনের জন্য পাততাড়ি গুটাইতে বাধ্য হইয়াছে। এই মুক্ত অঞ্চলে এখন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইতেছে নবজীবনের জয়গান।

অষ্টগ্রাম

উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গন হইতে ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের জনৈক নেতা জানান যে, উক্ত জেলার অষ্টগ্রাম থানায় পাক হানাদাররা আজ পর্যন্ত প্রবেশ করিতে পারে নাই। ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠনের ঐক্য দুষ্কৃতিকারীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া দিয়া অষ্টগ্রাম থানাকে আজ পর্যন্ত মুক্ত রাখিয়াছে। এখানে এইসব সংগঠনের সমন্বয়ে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হইয়াছে। এই সংগ্রাম কমিটি বিভিন্নভাবে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছে। সংগ্রাম পরিষদ থানার দুষ্কৃতিকারীদের ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করিয়াছে। পাক হানাদারেরা যাহাতে থানার কোন অংশে প্রবেশ করিতে না পারে সেজন্য সকল যাতায়াত পথ নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। একদিন পার্শ্ববর্তী জেলা কুমিল্লা হইতে কয়েকজন রাজাকার এই থানা এলাকায় প্রবেশ করিলে তাহাদের গ্রেফতার করা হয়।

মুক্তিবাহিনী

সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এই থানায় যুবকদের লইয়া একটি মুক্তিবাহিনী গড়িয়া উঠিয়াছে। এই বাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান হইতে দলে দলে ছাত্র ও যুবকেরা ভীড় জমাইতেছে। এই মুক্তিবাহিনী ঢাকা জেলার সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করিয়া পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুক্তভাবে কয়েকটি ‘অপারেশন’ চালাইয়াছে। এই বাহিনীর প্রতি আশে পাশের থানা সমূহের বিভিন্ন গ্রামের আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ইহার সঙ্গে মুক্তাঞ্চলের পরিধিও বিস্তার লাভ করিতেছে।

গণআদালত

সংগ্রাম কমিটি গত ২৫শে মার্চের পরেই উক্ত থানায় একটি গণআদালত গঠন করে এই গণআদালতের মাধ্যমে মুক্তাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা হইয়াছে। ফলে, যাতায়াত ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়ায় জিনিস পত্রের দাম পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইলেও জনসাধারণের মনোবল ভাঙ্গিয়া যায় নাই- বরং মুক্তাঞ্চলের পরিধি ও মুক্তিবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনোবলও বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে।

পার্শ্ববর্তী থানাসমূহে নির্যাতন

অষ্টগ্রাম থানা অঞ্চলে প্রবেশ করিতে না পারায় পাক হানাদার বাহিনী ইহার পার্শ্ববর্তী থানার গ্রামসমূহে হত্যা, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি নিপীড়ন চালাইতেছে। কিন্তু অষ্টগ্রামের মুক্তি বাহিনী ও সংগ্রাম কমিটি ঐসব অঞ্চলের সহিত যোগাযোগ রক্ষা এবং সময় বুঝিয়া আকস্মিক হামলা চালাইয়া পাক হানাদের

বিভিন্ন সময়ে নাজেহাল করায় জনগণের মনোবল ঠিক রহিয়াছে। অষ্টগ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে গৌরিপুর, পূর্বধলা দূর্গাপুর, দল মাকান্দা, বারহাট্টা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, ভৈরব ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া প্রভৃতি অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হানাদার সৈন্যকে হত্যা করে ও যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।

ফুলবাড়ী

রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার ফুলবাড়ী থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে, এই থানায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হইতেই এই থানায় আওয়ামী কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয় গণবাহিনী। এই গণবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বর্তমানে ধরলা নদী বরাবর প্রতিরক্ষা লাইন(ডিফেন্স লাইন) স্থাপন করিয়া লালমনিরহাট হইতে পরিচালিত পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ স্বার্থকভাবে প্রতিহত করিয়া আসিতেছে।

বিভিন্ন সমস্যা

এই এলাকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনও অধিকৃত এলাকার সহিত, সংশ্লিষ্ট থানায় জনসাধারণ অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছে। বর্তমানে এখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে দুস্থ জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষতঃ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রণকারী লোকজনের পরিবারবর্গকে সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন।

আঞ্চলিক প্রশাসন সমীপে

সম্প্রতি অবিলম্বে সাহায্যাদি প্রদান এবং বেসামরিক প্রশাসন ও মুক্তিবাহিনীর কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধনপূর্বক আদর্শ প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েমের দাবীতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহিত সাক্ষাত করেন। তিনি অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সাহায্য, পুনর্বাসন ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রাদান করিয়াছেন।

মনোবল অটুট

যাহা হউক, শত সমস্যা ও অসুবিধা সত্ত্বেও জনগণের মনোবল অটুট রহিয়াছে। প্রত্যেক রবিবার হইতে গড়ে ২/১ জন করিয়া সবলদেহী সুস্থ যুবকেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছে। মুক্তিবাহিনীর শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে।

তেঁতুলিয়া

দিনাজপুর জেলার তেঁতুলিয়া থানাও আগাগোড়াই মুক্ত। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই থানার কোন গ্রামে আজ পর্যন্ত প্রবেশ করিতে পারে নাই। প্রত্যেক গ্রামের ঘর হইতেই সুস্থ-সক্ষম যুবকেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করিয়াছে।

এই থানাটি বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী এখান হইতে বোদা, পঁচাগড়, দেবীগঞ্জ, রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে বহু অভিযান চালাইয়াছে। এই সব অভিযানে বহু পাক সৈন্য নিহত, বহু ব্রীজ ধ্বংস, ঠাকুরগাঁও (মহকুমা শহর) বিজলী সরবরাহ কেন্দ্র বিধ্বস্ত ও বহু রাজাকার খতম হইয়াছে।