You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

জঙ্গীশাহীর চক্রান্ত ব্যর্থ করুন

দস্যুসর্দার ইয়াহিয়া আবার যুদ্ধের হুঙ্কার ছাড়িয়াছে। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করিবার পরদিনই অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য বলিয়াছে অবস্থা “স্বাভাবিক” হইলেই সে তাহার প্রতিশ্রুতি মত কাজ করিবে। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিবে। ইহার পর ২৮শে জুন আর একটি বেতার ভাষণে কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইবে এবং “দুষ্কৃতিকারী” অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের দমন করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হইয়াছে তাহারও একটি বয়ান দেয়। বলা বাহুল্যা এই দুইটি বেতার ভাষণেই পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা যে ভারতীয় “অনুপ্রবেশকারী” ও কিছু “দুষ্কৃতিকারী”র কারসাজি উহা বলিতে বিস্মৃত হয় নাই। গত ২৩ বছরে পাকিস্তানী পররাষ্ট্রনীতির একটি স্তম্ভ ছিল ভারত বিরোধী প্রচারণা করা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই চিরাচরিত সুরটি ইয়াহিয়া চক্র বর্জন করিবে ইহা আমরা কখনও আশা করি নাই।

কিন্তু গত ১২ই অক্টোবর বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আর একবার যুদ্ধের হুমকী বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বৈকি। অবশ্য পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি পুরাতন প্রতিশ্রুতির বুলির ভাঙ্গা রেকর্ড ঘাতক ইয়াহিয়া বাজাইতে ভুলে নাই। দেখা গিয়াছে যে, ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনীর বর্বরতা, নারকীয় অত্যাচার ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এক মন এক প্রাণ হইয়া রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে। ইয়াহিয়া টিক্কা চক্র সেদিন ইহা স্বপ্নেও আশা করিতে পারে নাই যে, তাহাদের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতি প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবে, পাল্টা আঘাত হানিবে। গ্রামেগঞ্জে শহরে বন্দরে শত্রুকে পদে পদে বাধা দিবে তাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকরা নতুনভাবে প্রচারণা শুরু করিবে। বিশ্ববাসীকে তাহারা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে যে, ভারতই বাংলাদেশের সমস্যা জিয়াইয়া রাখিয়াছে। ভারতে অব্যাহত শরণার্থী স্রোতের মুখেও প্রথম দিকে ইয়াহিয়া গলাবাজি করিয়াছে সর্বক্ষণ। তারপর এখন সুর পাল্টাইয়া বলিতেছে যে, ভারত শরনার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা দিতেছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এখন তীব্র হইতে তীব্রতর হইতেছে দস্যুবাহিনীর অধিকৃত এলাকার উপর মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতে আঘাতে তাই বেসামাল ইয়াহিয়া বারবার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকী দিতেছে। যে মিত্রদের উৎসাহে মন্ত্রণায় ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা অব্যাহত রাখিয়াছে সেই মুরুব্বীদের পরামর্শেই সে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কার দিতেছে। এবারের হুঙ্কারের আগেভাগেই সে ভারতের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করিয়াছে।

একথা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইয়াহিয়ার গদি রক্ষা, ততোধিক একটি অবাস্তব ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র-পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের হাত হইতে রক্ষা করার জন্য ইসলামাবাদের জঙ্গী চক্রকে ভারত আক্রমণে উৎসাহিত করিতেছে। গত মার্চ মাস হইতে জুন মাস পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া সরকারকে জঙ্গী জেট বিমানের খুচরা অংশ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তথা ট্যাঙ্ক ইত্যাদির খুচরা অংশ সরবরাহ করিয়াছে। বাংলাদেশে অভিযান চালাইয়া পাকিস্তানী বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও উহার বিমান বহর কিংবা ট্যাঙ্ক বহর ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র এমন কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয় নাই যে, তন্মূহুর্তেই এই সব খুচরা অংশ ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন পড়িয়াছিল। প্রয়োজনবোধে পাকিস্তানকে টিকাইয়া রাখার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবেই ইহা মার্কিন সাহায্যের আগাম অংশ। এইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক ভারত সমস্যা হিসাবে মোড় ঘুরাইতে পারিলে

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশেষভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এক ঢিলে দুই পাখি মারিতে পারিবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাক-ভারত সমস্যার অঙ্গ হিসাবে উহার পৃথক সত্ত্বা হারাইয়া পাক-ভারত সমস্যার লেজুড় হইয়া পড়িবে এবং সাবেক পাকিস্তানকে বহাল তবিয়তে সাম্রাজ্যবাদের আলালের ঘরের দুলাল হিসাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুষ্ট গ্রহ হিসাবে টিকাইয়া রাখা হইবে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার একটি মাত্র অর্থ এই মহাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি দূর্বল হওয়া। বাংলাদেশের এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম প্রথমাবধি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একটি গণতান্ত্রিক আদর্শ ও জাতীয় মুক্তির জন্য বাঙ্গালীরা আজ অস্ত্র ধরিয়াছে। অপরদিকে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধিলে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার এই খণ্ডে শান্তি স্থাপনের নামে এবার মুরুব্বী সাজিয়া ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়তায়-নয়াদিল্লীরই বর্তমান নিরপেক্ষ নীতিকে বর্জন করিতে বাধ্য করিতে পারিবে। এভাবে ভিয়েতনামে পরাজয়ের গ্লানি ও ক্ষয়ক্ষতি পোষাইয়া লওয়া যাইবে। প্রথমাবধি বাংলাদেশ সমস্যা “পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার” বলিয়া একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের বকধার্মিক সাজার চেষ্টা এবং অপরদিকে বাংলাদেশ সমস্যা অব্যাহত থাকিলে পাক-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া উহারা দিনরাত চিৎকার করিতেছে। তাহাদের এই সব বাকচাতুর্য ও প্রচারণা তাৎপর্যহীন নহে। এবারের ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ সেই ইঙ্গিতই বহন করে।

মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের এই চক্রান্ত ব্যর্থ করার দায়িত্ব আমাদের। ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনীর উপর আমাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং এই সময়ে যে সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্নভাবে সাহায্য করিতেছে উহা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করিতে হইবে। আমাদের মধ্যে তথাকথিত বহু দেশপ্রেমিক হঠাৎ গজাইয়া উঠিয়াছেন-তাহারা আমাদের পাঁচ পার্টির এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করিয়া থাকেন এবং ঘটনার বাস্তব বিশ্লেষণের নামে এই কথা বুঝাইতে চাহেন যে, বাংলাদেশ সরকারকে সোভিয়েত বক্ষে ঠেলিয়া দেওয়ার জন্য কারসাজি চলিতেছে। একদিকে সোভিয়েতের ভূমিকা আশানুরূপ নহে বলিয়া তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা এবং অপরদিকে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্যের বিরুদ্ধে মামূলী ধরণের নিন্দা করিয়া উহারা চলিয়াছেন। অথচ প্রতিদিনই সোভিয়েত ইউনিয়ন কোথায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বলিয়াছে অণুবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগাইয়া উহার মধ্যে ত্রুটি খোঁজেন, উল্লাসিত হইয়া উঠেন। যেন ভাবখানা এই যে, ‘বলি নাই রাশিয়া নিজের স্বার্থ ছাড়িয়া এক পাও বেশী বাড়িবে না। এই দেখো সোভিয়েত আলজেরিয়া যুক্ত ইস্তেহার, এই দেখ পদগর্নি ইরানে কী বলিয়াছেন।’ পাকিস্তানী বেতারের মিথ্যা প্রচারণাও এই ক্ষেত্রে কাজে লাগাইতে ইহারা পিছপা নহেন।

বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী অভিযান চালাইয়া যেখানে হিমশিম খাইতেছে সেখানে কিসের জোরে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয় ইহা একটি বালকও বলিতে পারে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত ছাড়া ইয়াহিয়ার সাধ্য নাই বাংলাদেশ সমস্যা সামনে রাখিয়া ভারতের সহিত যুদ্ধ বাঁধাইতে সে সাহসী হয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!