You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় (স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই)
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা (১ম বর্ষঃ ১৩শ সংখ্যা)
তারিখঃ ১১ নভেম্ভর, ১৯৭১

সম্পাদকীয়ঃ
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ নাই

আট মাস যাবৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলিতেছে। একদিকে ইসলামবাদের জঙ্গী সরকারকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অস্ত্র অস্ত্র সাহায্য করিতেছে, গণচীন তাহাকে অভয়বাণী শুনাইতেছে অন্যদিনে তাহারা বিশ্বশান্তির জিম্মাদার সাজিয়া বাংলাদেশের একটা শান্তিপুর্ণ মীমাংসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেছে।
ইয়াহিয়ার গনহত্যার মুখে ইহারা নীরব ছিল। আমেরিকা ও বৃটেন ইহাকে এখনও পাকিস্তানের আভ্যন্ত্রীণ ব্যাপার বলিয়া চালাইতেছে। ইন্দোনেশিয়ার ব্যাপক গণহত্যার সময় আমরা গণচীনকে ধিক্কার বাণী উচ্চারণ করিতে শুনিয়াছি। এমন কি কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন করিয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যায় আজ মহাচীন নীরব। যুদ্ধের প্রশান্তি তার চোখেমুখে, এপ্রিল মাসে ব্যাপক গণহত্যার মুখে ঢাকায় বাক্স বাক্স গুড়া দুধ পাঠায়াছে সাহায্য বাবদ। কাদের জন্য সে সাহায্য ছিল, কেন দেওয়া হইয়াছিল আমরা জানি না।
ভারত ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাহাদের দায়দায়িত্ব কার্যতঃ একাই বহন করিতেছে। পাকিস্তানের উস্কানীর মুখে এখনও সংযমের পরিচয় দিতেছে। বাংলাদেশ সমস্যাকে এখন পাক ভারত সমস্যা রূপে দাঁড় করাইবার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চোখের ঘুম গিয়াছে। তাহাদের চোখের ঘুম আরও একটি কারণে গিয়াছে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য তাহাদের আশার গুড়ে বালি। বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য লড়িতেছে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে তাহারা ঘাতক ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় নামকাওয়াস্তে থাকিতে নারাজ। সাম্রাজ্যবাদীদের সাধের ঘাঁটি পাকিস্তানের এই হালে বিচলিত হইয়া তাহারা শরণার্থীদের মধ্যে টাকা ঢালিতেছে। মুক্তি সংগ্রামে শরিক অঙ্গদলগুলির মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য টাকা ঢালিতেছে। কোন কোন রাজনৈতিক দলের নাম দিয়া সুকৌশলে ছয় দফার পক্ষে গণভোট নেওয়ার জন্য গোপনে শরনার্থীদের মধ্যে প্রশ্নাবলী ছাপাইয়া বিলাইতেছে। ইহাদের উদ্দেশ্য যেন মুক্তিযুদ্ধে শরিক আঙ্গদলগুলি পরস্পরকে সন্দহ করে। তারপর কাদা ছোড়াছুড়ি। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ। কিন্তু তাহাদের এইসব চালে দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীদের আর ভোলানো যাইবে না।
একথা আজ পরিষ্কার করিয়া বলার সময় আসিয়াছে যে, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের চিরশত্রু। ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্রের হত্যাকান্ডে যে সব বড় বড় আদর্শের বুলি সত্ত্বেও নীরব থাকিয়াছে, সামান্য নিন্দা ভাষণে যাহাদের আপত্তি, পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য যাহারা মাথাব্যাথার পরিচয় দেন তাহারাও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষ নহে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের শত্রু তথাকথিত শরনার্থী বুদ্ধিজীবী যাহারা বাংলাদেশের এই দুঃসময়ের মিত্রদের উপর কটাক্ষ করিয়া টু পাইস কামাইতেছেন আর মুখে বলিতেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশ তাহাদের কাম্য। এই সব ভন্ড দেশপ্রেমিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরা শ্মশানের প্রান্তচর বাসী জীবদের মতই ঘৃণ্য। দেশবাসীর উচিত ইহাদের চিনিয়া রাখা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যাহারা নৈতিক সমর্থন যোগাইতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর অর্থ মুক্তিসংগ্রামের ক্ষতি করা, ইহা একটি বালকেও বুঝে কিন্তু আমাদের তথাকথিত স্বাধীন বুদ্ধিজীবীরা উহা বুঝেননা এমন নহে। আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ, বিশ্ব ইউনিয়ন ফেডারেশন বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সংগঠন করিতেছে। এইসব বুদ্ধিজীবীদের লেখায় তাহার স্বিকৃতি নাই।
কোথায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য কলম ধরিবেন তাহা না করিয়া, অন্ধ সোভিয়েত বিদ্বেষের বস্তাপচা খেউড় যত্রতত্র আওড়াইয়া মার্কিন প্রভুর মনোরঞ্জন করেন। আর তাদের মোসাহেবদের বাহবা কুড়াইয়া থাকেন।
বাংলাদেশ শত্রু কবলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যোদ্ধারা অস্ত্র সংবরণ করিবে না। পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের কোন প্রস্তাব কখনই কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নহে। কোন মহলের এই ধরণের প্রচেষ্টার অর্থ মুক্তিযোদ্ধের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাতের সামিল। দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীরা এই ধরণের মীরজাফরী চক্রান্ত ঐক্যবদ্ধভাবে ব্যর্থ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুর্যোদয়ের মতই অনিবার্য।