You dont have javascript enabled! Please enable it!

জীবনচিত্র      নামঃ ডা. মুহাম্মদ শফী

Dr. Muhammad Shafi

পিতার নামঃ সুফি আবদুল লতিফ

পিতার পেশাঃ সরকারি চাকরি

মাতার নামঃ বিবি আয়সা খাতুন

ভাইবোনের সংখ্যাঃ চার ভাই ও চার বোন;

নিজম-অষ্টম

ধর্মঃ ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানা (আদি) : গ্রাম-দিঘড়ে, ডাকঘর

তারকেশ্বর, জেলা-হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

নিহত, নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি-‘মুশতার লজ’, সড়ক-বাটালী রোড, এনায়েতবাজার, ওয়ার্ড নং-২২, ডাকঘর-জি.পি.ও. থানা-কোতোয়ালী, জেলা-চট্টগ্রাম

জন্মঃ ২২ শ্রাবণ-১৩২২; ৫ এপ্রিল ১৯১৫

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৩০, হুগলি জেলা হাই স্কুল, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

আইএসসিঃ প্রথম বিভাগ, ১৯৩২, হাওড়া সরকারি কলেজ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

এমবিবিএসঃ দ্বিতীয় বিভাগ ১৯৩৬, কলকাতা মেডিকেল কলেজ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

শখঃ ছবি আঁকা ফটোগ্রাফি, দাবা খেলা ও বেহালা বাজানো; কলকাতা বেতার ‘আকাশবাণী’র শিল্পী ছিলেন

পুরস্কারঃ ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’ গ্রন্থের জন্য ‘ন্যাশনাল ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৪ ‘রাইটারস গিল্ড পাকিস্তান’ সংস্থা

স্বরচিত গ্রন্থঃ ‘চিকিৎসা বিজ্ঞান’ (অনুবাদ), ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস’ (অনুবাদ), ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’, ‘প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’, ‘চরিত্রহানীর তাৎপর্য’, ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ (অনুবাদ), ‘শান্তি না শক্তি’ (অনুবাদ), ‘হুনানের কৃষক আন্দোলন’, (অনুবাদ) ‘জনযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘজীবী হোক’ (অনুবাদ), ‘নয়া গণতন্ত্ৰ’

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ প্রগতিশীল রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন

চাকরির বর্ণনাঃ চুক্তির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম জেলের দন্ত চিকিৎসক ছিলেন

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ আল-বদর

নিহত, নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ৭ এপ্রিল ১৯৭১, দুপুর ১-৩০ মি.

মরদেহ প্ৰাপ্তিস্থানঃ পাওয়া যায়নি

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ নেই

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য দান/পুরস্কারঃ পাননি

স্ত্রীর নামঃ বেগম মুশতারী শফী

বিয়েঃ ১৬ জানুয়ারি, ১৯৫৫

সস্তান-সন্ততিঃ তিনপুত্ৰ ও চার কন্যা

ইয়াসমিন ফারজানাঃ এম.এ (ইতিহাস), ব্যবসায়ী

মো. এবাদ ইয়াসিন শফীঃ ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা, ব্যবসায়ী

মে’রাজ তাহসীন শফীঃ এমকম (ব্যবস্থাপনা), ব্যবসায়ী

নাসরিন রিজওয়ানাঃ বিএ, বিদেশে চাকরিরত

নেয়াজ মোহসিন শাকীঃ এমকম (হিসাব বিজ্ঞান), ব্যাংকার

নাজনীন রুমানাঃ এম.এ (সমাজ বিজ্ঞান), শিক্ষকতা

শারমিন তারানাঃ এমএ (ফাইন আর্টস), গৃহিণী

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ

এহসান (শহীদ চিকিৎসকের শ্যালক)

 

তথ্য প্রদানকারী

মে’রাজ তাহসীন শফী

শহীদ চিকিৎসকের দ্বিজীয় পুত্র

বাড়ি-‘মুশতারী লজ’, সড়ক-বাটালী রোড,

এনায়েতবাজার, ওয়ার্ড নং-২২,

ডাকঘর-জি.পি.ও. থানা-কোতোয়ালী,

জেলা-চট্টগ্রাম-৪০০০

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৬১

 

আমার স্বামী

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

মুশতারী শফী

 

১৯৫৫ সাল। ১৬ জানুয়ারি। আমার বয়স ১৫ পেরোবার পরের দিনডা. শাফীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তাঁর সাথে আমার বয়সের বেশ ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁর সদাহাস্য প্রাণচঞ্চল আমুদে স্বভাব, তারুণ্য, আমার প্রতি উদার মনোভাব, অগাধ ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করেছিল। আমি যেন এক নিশ্চিত আশ্রয় পেলাম। শিশুকালে মাতৃ-পিতৃহীনা হওয়ায় আমার লেখাপড়া তেমন হয়নি, কিন্তু তিনি আমার শিক্ষার পিপাসা মেটাতে চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গৃহশিক্ষক রেখে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম, পরে গিটার শিক্ষা। সবকিছুতেই তিনি যেন আমাকে পুরোপুরিভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি সফল হইনি, সে ব্যর্থতা আমারদেখেছি অনেককে প্রথমে তাঁর রোগী হয়ে আসতেন, পরে এমন বন্ধু হয়ে যেতেন যে কেবল তাঁরই নয়, পরিবারের সবার এমন কি তাঁর আত্মীয় পরিবারে কেউ এলে তাঁদের কাছ থেকেও তিনি ফি নিতেন না। ডা. শফী প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক অথচ ধৰ্মিক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলের রাজবন্দিদের চুক্তির ভিত্তিতে চিকিৎসা করতেন। আর এ জন্যই তাঁর পক্ষে আরো সম্ভব হয়েছিল গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া । মাঝে মধ্যে কড়া পুলিশ প্রহরায় রাজবন্দিদের নিয়ে আসা হতো আমাদের গৃহসংলগ্ন তাঁর চেম্বারে। জেল কর্তৃপক্ষকে বলে এ কাজটি তিনিই করেছিলেন কৌশলে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি বাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে রাজনৈতিক আড্ডা, মাঝে মধ্যে গণসঙ্গীতের আসর। এ সময় চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘প্রান্তি ক’, পরে ‘জাগৃতি’এই দুটি প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। প্রচুর অর্থ সাহায্য করতেন এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলে অনেক রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হন, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। যাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন, তাঁরা আসতেন গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ৷

ডা. শফীকে দেখতাম তখন আনন্দে আত্মহারা হতে। আমাকে অনুরোধ করতেন তাঁদের রেঁধে খাওয়াতে, পরে এ কাজ আমার গা-সওয়া হয়ে গেলেও মাঝে মধ্যে আমি বিরক্ত হলে তিনি বলতেন, ‘এদের সেবা করা মানেই দেশের কাজ’। একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ‘দেশের কাজ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছো?’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘বুঝবে না, তুমি এখনো ছেলেমানুষ। ঠিক আছে পূর্ণেন্দুদা অথবা হারুন এলে ওদের কাছ থেকে জেনে নিও।’

 

২৬২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

ডা শফী নারীশিক্ষার ব্যাপারে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেন গভীরভাবে। সেই সাথে বিশ্বাস করতেন। নারীর সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ছাড়া সামাজিক কল্যাণ এবং দেশের অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই তাঁর একান্ত সাহায্য-সহযোগিতায় আমি গড়ে তুলেছিলাম ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ডা. শফী প্রথম জীবনে বেহালা বাজাতেন, ছবিও আঁকতেন। কিন্তু পেশাগত কারণে সেসবের চর্চা আর অব্যাহত থাকেনি। তবে ছবি তোলার শখ ছিল তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত। ‘বান্ধবী সংঘের’ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন একমাত্র বিনে-পয়সার ক্যামেরাম্যান। ১৯৬৮ সালে সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ক্ষুদ্র ছাপাখানা আমরা প্রতিষ্ঠা করি আমারই বাসগৃহে। এই প্রেস প্রতিষ্ঠার পেছনেও ডা. শফীর ছিল অপরিসীম উৎসাহএর সিংহভাগ অর্থ তিনিই দান করেছিলেন। শুধু তাই নয়। চেম্বারে রোগী দেখার পরের সময়টুকুও তিনি প্রেসের জন্য দিতেন।

ডা. শফীর স্মৃতিকথা বলতে গেলে দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় আনিবার্যভাবে এসে পড়ে। তাই তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে একাত্তরের কথা বলতেই হবে। ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের অবাঙালি অধুষিত এলাকায় বাঙালি নিধন চলছে পুরোদমে। এ সময় একদিন আমাদের পাড়ায় এনায়েত বাজারের বাঙালি ছেলেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে দা, ছুরি, হকিস্টিক, লোহার রড ইত্যাদি নিয়ে অবাঙালী বাড়ী আক্রমণ করতে হৈচৈ করে ছুটে এলো। আমাদের এই এলাকায় আগাখানি ও বোহারা সম্প্রদায়ের অবাঙালি ব্যবসায়ীদের বসবাস বেশী। ডা. শফীকে দেখলাম সেই ক্ষুব্ধ জনতার সামনে ছুটে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে, বক্তৃতা করে, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শ ব্যাখ্যা করে, এমনকি নিজের জীবনদানের জন্য প্রস্তুত বলে জানালে সেই উন্মত্ত জনতা থেমে যায়, ফিরে যায়। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিল তাঁর রোগী। ডা. শাফীর আরেকটি গুণ ছিল দরিদ্র প্রতিবেশী এবং শ্রমজীবী মানুষদের কাছ থেকে কখনোই ফি নিতেন না। শুধু তাই নয়, অনেকেই বুঝতো না ‘ডেন্টাল সার্জন’ মানে কেবলই দাঁতের চিকিৎসক। সাইনবোর্ডে ‘ডাক্তার’ লেখা আছে, তাই যে কোনো রোগের জন্যই ওরা আসতো, এমনকি গভীর রাতেও আসতো। তিনি বিরক্ত হতেন না, দেখতাম হাসিমুখে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ দিচ্ছেন, বড় রকমের কিছু হলে চিঠি লিখে পাঠাতেন অন্য ডাক্তারের কাছে যাতে ফি না নেয়। অথবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন, ভালো না হওয়া পর্যন্ত খোঁজখবর নিতেন। এ কারণেই তিনি সবার পরিচিত ছিলেন, অনেকেই তাঁকে ভালোবাসতো, শ্ৰদ্ধা করতো, আর তাই অবাঙালি প্রতিবেশীরাও সেদিন রক্ষা পেয়েছিল।

এলো সেই কালরাত ২৫ মার্চ। চট্টগ্রাম শহর হঠাৎ করেই যেন ভয়ানক রকম থমথমে হয়ে উঠলো। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা, ফিসফিস, নিম্নস্বরে আলোচনা।

রাত প্রায় ১০টা। পথঘাট নিঝুম। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ইলেকট্রিসিটি নেই। সারা শহর অন্ধকার। বিকেলের দিকে কে একজন উড়ো-ফোনে বলেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’ শঙ্কা সবার মনে। সেই অবস্থায় ডা. শফী গোসল করে এলেন (তাঁর চিরদিনের অভ্যাস খুব ভোরে আর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা)মন শান্ত ও স্থির করার জন্যই কি না জানি না, গিটারটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বাজাতে অনুরোধ করলেন। আমি রেগে বললাম, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, গান-বাজনা করার মতো মনের অবস্থা আছে?’ তাঁর মুখ কিন্তু প্ৰসন্নতায় ভরা। বললেন, ‘তুমি ভীত ও বিচলিত। আমার কিন্তু আনন্দ হচ্ছে। বাঙালিদের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা এবার পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার পাকিস্তানিরা পাততাড়ি না গুটিয়ে পারবে না, দেখে নিও। যাকগে, একটু বাজাও না?’ তিনি আমাকে সহজ করতে চাইলেও আমি সহজ হতে পারছি না। বুক কঁপছে। হাত কাঁপছে। কী বাজাবো? সুর তো সব ভুলে যাচ্ছি। একটা নজরুল গীতির সুর বাজাতে চেষ্টা করলাম। বেসূরো হলো। তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অত কঠিন সুরে কেন? রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটি বাজাও,-‘নাই নাই ভয় হবে জয়।’ বাজালাম।

রাত পৌনে বারোটার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলে আমি বাচ্চাদের ও বাড়ির নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেও তিনি তেমন হননি। পরদিন ২৬ মার্চ, কলকাতা রেডিওতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবি থেকে গৃহীত সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান ও ঘোষকের কণ্ঠে ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু’ হওয়ার ঘোষণা শুনে ডা. শাফী উত্তেজনায় টেবিলে ঘুষি মেরে বললেন, ‘দেখে নিও, আমাদের দেশ এবার স্বাধীন হবেই।’ বলতে বলতে আবেগে তাঁর চোঁখে পানি এলো।

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৬৩

 

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

ঢাকার সাথে টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। খবর রটেছে, ঢাকা। ম্যাসাকার হয়ে গেছে। পুরুষরা সবাই বেরিয়ে পড়েছে খবরাখবর জানতে । কেবল বেলাল মোহাম্মাদ ও ডা. শফী আছেন বাসায়। হঠাৎ বেলাল ভাই বললেন, ‘আচ্ছা ভাবি, যারা অস্ত্ৰ হাতে যুদ্ধ করতে পারে করবে, কিন্তু যারা পারবে না, তাদের করণীয় কী?’ আমি নির্বাক চেয়ে রইলাম। তিনি আবার বললেন, ‘ঢাকা রেডিও স্তব্ধ। চট্টগ্রাম রেডিওটা তো কাজে লাগাতে পারি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নাম দিয়ে চালু করে দিলে কেমন হয়?’ প্রস্তাব শুনে ডা. শফী আনন্দে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

বেলাল মোহাম্মদ বেরিয়ে গেলেন, যাওয়ার সময় বলে গেলেন কথাটা এখন যেন প্ৰকাশ না করি। সেদিনই সন্ধ্যায়। আবুল কাশেমের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’অবশ্য আগেই বেলাল ভাই ফোনে বলেছিলেন ‘রেডিওটা অন করে রেখো।’ আমাদের উল্লাস আর ধরে না। ডা. শফী রেডিওর ভলিউম এমন বাড়িয়ে দিলেন যে, বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেল। ডা. শফী বললেন, আমাদের এবারে কাজ হবে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী কেবন নিয়মিত শোনা নয়, যে যা শুনবে কাগজে টুকে রাখতে হবে, বেলালদের কাজে লাগবে।’ আমি আর আমার ভাই এহসান (এমকম শেষ বর্ষের ছাত্র তখন, ডা. শফীর সাথে তাঁকেও হারিয়েছি)মিলে তাই করলাম। শুনছি আর দ্রুত লিখছি। বেলাল ভাইসহ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ কর্মীরা ফিরে এলো রাত সোয়া ১১টায়। ডা. শফীর এই নির্দেশ দারুণ কাজে লাগলো। রাত জেগে, মোমের আলোয় সেসব খবর ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে তৈরি করা হলো আগামী দিন প্রচারের জন্য কিছু মেটেরিয়ালসএভাবে আমার বাসায় ডা. শফীর একান্ত সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতারের কাজ চলতে লাগলো ২৯ মার্চ পর্যন্ত।

২৭ মার্চএদিন ডা. শফী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরেকটি দুঃসাহসিক কাজ করলেন। সন্ধ্যায় ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন অর রশীদ এলেন আমার বাসায়। ব্যস্ত হয়ে ডা. শফীকে নিয়ে ঢুকে গেলেন চেম্বারে। দরজা বন্ধ করে কাটালেন কিছু সময়। শুনলাম টাইপরাইটারের খটাখট শব্দ। অল্প পরে ডা. শফী আমাকেও ডেকে নিলেন ভেতরে। চৌধুরী হারুন বললেন, ‘ভাবি, আপনার এখানে আমরা কিছু জিনিস রাখবোকিছু অ্যামুনেশনস্‌।’ আমি ভয় পেয়ে বললাম, এই মধ্যশহরে, বাড়ির দু’পাশে রাস্তা, চারদিকে অবাঙালি, এ অবস্থায় এসব এখানে রাখা কি ঠিক হবে?’ ডা. শফী বললেন, ‘ভাবছো কেন? দেশকে মুক্ত করতে হলে বুকে সাহস রাখতে হবে। তাছাড়া ভয়ের কোনো কারণ নেই। হারুন সব ব্যবস্থা করেছে। হ্যাঁ, চৌধুরী হারুন এভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন—আমার বাড়ির দোতলাটা খালি পড়ে ছিলসেটা একটা অবাঙালির নামে কোর্টস্ট্যাম্প পেপারে বাড়ি ভাড়ার চুক্তিনামা ইংরেজিতে টাইপ করা হয়েছে। তারিখ দেয়া হয়েছে এক বছর আগের। বাড়ির মালিক হিসেবে সই করলাম আমি, অবাঙালি ভাড়াটিয়ার নাম সই করলেন চৌধুরী হারুনরাত ৯টার দিকে দুটি ট্রাক এসে থামলো, তিন-চারজন কর্মী ছেলেসহ চৌধুরী হারুন, ডা. শফী, আমার ভাই এহসান সবাই মিলে গুলিভর্তি কাঠের বাক্সগুলো উপরে তুলতে লাগলো। আর তখন থেকেই অশুভ আশঙ্কায় আমার বুক থেকে থেকে কাঁপতে থাকে।

২৯ মার্চ। চট্টগ্রাম শহর পুরো দখলে চলে গেল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর। চট্টগ্রাম পুরো তাদের দখলে চলে গেলে আমার আতঙ্কের কথা বেলাল ভাইকে জানিয়েছিলাম। তিনিও শঙ্কিত হয়ে ডা. শফীকে অনুরোধ করেছিলেন ওগুলো সরিয়ে ফেলতে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কাজে লাগতে পারে, অতএব ওগুলো মেজর জিয়াকে দিয়ে দেয়া হোক। হারুন ভাইকে প্রস্তাবটা জানিয়েছিলেনতিনি রাজি হননি। আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। ডা. শফী বাইনোকুলার নিয়ে ছাদে সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখেন পাকসেনাদের

 

২৬৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

কোথায় কোথায় দেখা যাচ্ছে। আমার বাড়ির পূর্বদিকে পাহাড়ের উপর কোর্ট বিল্ডিং। পশ্চিমেও পাহাড়। তার ওপর সিআরবি অফিস আর ‘ইপিআরের’ হেডকোয়ার্টার। কোর্ট বিল্ডিং ওরা দখল করে কামান বসিয়েছে ইপিআর হেডকোয়ার্টার মুখে। যে কোনো সময় গোলা ছুড়লে আমার বাড়ির ওপর এসে পড়তে পারে। এই ভয়ে অনেকেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

এলো ৭ এপ্রিল। যে তারিখটি রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে আছে আমার বুকের গভীরে। এদিনেই হারিয়েছি আমি আমার একটি মাত্র ভাইকে, আমার সন্তানেরা হারিয়েছে ওদের স্নেহময় পিতাকে।

সকাল ৯টা। একটা জিপ আর একটা লরি এসে থামালো বাড়ির সামনে। চোখের নিমেষে সৈন্যরা আমার বাড়ি ঘিরে ফেললো। তারপর ড্রইংরুমের দরজায় দুমদুম ধাক্কা। ডা. শফী নিজেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন, ওরা জানতে চাইলো, ‘ডা. শাকী কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি’। ‘তুমি এখানে দাঁড়াও’-ওঁকে ড্রইংরুমে দাঁড় করিয়ে রাখলো। সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির ভেতরে। প্রতিটি রুম, বাথরুম, রান্নাঘর তছনছ করে খুঁজলো। ভয়ে আমি কাঠ। যদি এবার দোতলায় যায় এবং তালা ভাঙে-তারপর? কিন্তু না ওরা দোতলায় গেল না। অফিসারকে কী যেন বলে লরিতে গিয়ে উঠলো, সাথে ডা. শফীকেও নিয়ে গেল সার্কিট হাউসে।

আমার আকুল অনুনয়-বিনয়, বাচ্চাদের কান্না, কোনো কিছুতেই ওদের মন গললো নাকিন্তু না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুপুর ১২টার দিকে তিনি ফিরে এলেন। চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না, ডা. শফী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। বাচ্চারা আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে ওর আব্বাকে। সবার হাজার প্রশ্ন, ‘কী করে এ সম্ভব হলো?’ ডা. শাফী ম্লান হেসে বললেন, ফিরে এসেছি ব্রিগেডিয়ার বেগের জন্য। পাকিস্তানের বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মীর্জা আসলাম বেগ ছিলেন ডা. শফীর রোগী। জেনারেল বেগের দাঁতে ক্যান্সার হয়েছে, এই তথ্য মিথ্যে প্রমাণ করে তিনি তাঁকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। আমি এবার কেঁদে বললাম, ‘এসেছো যখন আর এক মুহুর্ত এ বাড়িতে নয়, এক্ষুণি চলো অন্য কোথাও।’ তিনি এবার রাজি। বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু এই দিনের বেলা বেরুতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা। সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। সন্ধ্যা হোক।’ দুপুর ১টা। ভাত দেয়া হয়েছে টেবিলে। বাচ্চাদের নিয়ে তিনি সবে খেতে বসেছেন। আবার গুলির শব্দ, বেরিয়ে দেখি ৪০-৫০ জন সৈন্য আমার বাড়ি আবার ঘিরে ফেলেছে। এরা অন্য গ্রুপ। সাথে দু’জন অফিসার। সৈন্যরা আবার ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতর। ডা. শফী খাওয়া ছেড়ে ওঠে গেলেন ওদের সামনে। আমিও গেলাম ওর সাথেআমার ভাই এহসানও এসে দাঁড়ালো পাশে।

ওরা বললো, ‘তুমি আর তোমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে এলিগেশন আছে। তোমরা আওয়ামী লীগ করে। গোপন রেডিওর সাথে যুক্ত, তোমাদের এখানে গোপন অন্ত্রও আছে।’

শেষের কথায় বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এত যে সাহসী ডা. শফী, তাঁর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ আমিই সাহসের সাথে প্রতিবাদ করলে ওরা হেসে একটা টাইপ করা কাগজ খুলে ধরেছিল আমাদের চোখের সামনে। হ্যাঁ, এক, দুই করে এগারোটি অভিযোগ রয়েছে আমাদের নামে। আর তাতে স্বাক্ষর রয়েছে আমাদের অবাঙালি প্রতিবেশী দু’জনের, তার মধ্যে একজন ডাক্তার। এদেরকেই ডা. শফী একদিন বাঁচিয়েছিলেন। সৈন্যরা এবার

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৬৫

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

দুপদাপ শব্দে ওঠে গেল দোতলায়। ওরা দুমদাম শব্দে তালা ভাঙছে। সে সময়ের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমার নেই। আমরা মৃত্যুর প্রহর গুনছি। তালা ভাঙা শেষ হতেই ওরা উত্তেজনায় ছুটে এলো। হড়বড়িয়ে মেজরদের কী বলতেই ‘হোয়াট’ বলে হুঙ্কার ছাড়ল মেজর। আগুন ঝরছে ওদের চোখে। মুখে কুটিল হাসি। বললে, ‘চলো উপরে।’ আমরা তিনজনই ওদের সাথে গেলাম উপরে। মেজর বোখারী মুচকি হেসে বললো, ‘মিসেস শফী তুমি বলেছে তোমার ভাড়াটিয়ারা এসব রেখে গেছেন গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। দেখ তো প্রতিটি বাক্সের ওপর কত তারিখ লেখা আছে?’ আমরা তিনজনই প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখলাম প্রতিটি বাক্সের ওপর লাল কালিতে ইংরেজিতে লেখা ২৭.০৩.১৯৭১ ওরা এবার ডা. শফী আর এহসানকে দিয়েই বাক্সগুলো ট্রাকে তুললো। আর আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে বললাম, হারুন ভাই, এ আপনি কী করলেন?’ আমরা তৈরি হলাম। কিন্তু না, ওরা আমাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করলো না। গুলির বাক্সগুলো ট্রাকে তোলা হলে আমাদের তিনজনকেই বললো জিপে উঠতে। আমার ভাই এহসান অনুমতি চাইলো ওদের কাছে, ‘আমি একটু অজু করে আসি।’ ওরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে বললে, ‘যাও।’ আমি বোবা কান্নায় ইশারায় বললাম, তুই আর এখানে আসিস না ভাই, পালিয়ে যা। কিন্তু না, এহসান ঠিক অজু করে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরে এলো। বাচ্চাদের কান্না-চিৎকার পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে গেলাম জিপের কাছে। উঠতে যাব, দুই মেজর পাঞ্জাবি ভাষায় নিজেরা কী যেন বললো; তারপর একজন আমাকে বললো উর্দুতে, ‘মিসেস শফী তুমি এখন থাকো। তোমার বাচ্চারা বড় বেশি কাঁদছে। প্রয়োজন হলে পরে নেব তোমাকে। কিন্তু খবরদার পালাবার চেষ্টা করবে না। তাহলে তোমার স্বামী আর ভাইকে তো পাবেই না, বাড়িটা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিব’।

এই প্রথম আমি মেজরের দুই হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম, ‘তোমরা তো আমার ভাই আর স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছ, এই ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আমি কোথায় যেতে পারি? কিন্তু তোমরা কথা দিয়ে যাও ওদের ফিরিয়ে দেবে? ওরা বলেছিল, ‘আমরা কথা দিচ্ছি ওরা ফিরে আসবে।’ পাঠান-পাঞ্জাবিরা নাকি মিথ্যা কথা বলে না! তবু ঐ সময় ওদের ঐ কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মনে হলো ডা. শফী যেন বিশ্বাস করেছিলেন। তাই তাঁর মুখ সামান্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল প্রচ্ছন্ন আশায়। আমাকে শেষ কথা বলেছিলেন, ‘তুমি ভেবো না, ঘরে যাও বাচ্চাদের কাছে। দেখো, আমি আবার ঠিক ফিরে আসবো।’ না, তিনি আর ফিরে আসেননি। এর পরের কাহিনী এক সুবিশাল বিস্তৃত অভিজ্ঞতার কাহিনী। দেশের মুক্তিযুদ্ধ আর আমার জীবনযুদ্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যে স্মৃতিসমুদ্রের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অবগাহন করে আমি আজও এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি—আমার একটিমাত্র ভাই ও আমার স্বামী ডা. শফীসহ সব দেশপ্রেমিক শহীদ ফিরে আসবেন এই বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে।

 (*রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি ১৯৭১ থেকে সঙ্কলিত)

 

২৬৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

একজন শহীদের প্রতিকৃতি

ডেন্টাল সার্জন মুহাম্মদ শফী

ডা. সিকদার নাজমুল হক

 

চমৎকার বেহালা বাজাতেন ডেন্টাল সার্জন মু. শকী। রাতে ক্লিনিক থেকে ফিরে বেহালায় তুলতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায় হৃদয়ের এ পাত্রখানি।’ তাঁকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল ওরা। হত্যা করলো নির্মমভাবে।

১৯৭১ সালে এক শ্রেণীর রাজাকার, আলবদরের সহায়তায় সারা দেশজুড়ে পাকসেনারা বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ চালালো। শহীদ হলেন অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার। হত্যা করা হলো ডা. ফজলে রাব্বী ও ডা. আলীম চৌধুরীর মতো ডাক্তারদের। যাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ফজলে রাব্বী হল ও ডা. আলীম চৌধুরীর হলের নামকরণ। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাক্তারদের তালিকায় একজন ডেন্টাল সার্জনও রয়েছেন। অথচ তার নাম অনেকেরই অজানাতিনি চট্টগ্রামের ভেন্টাল সার্জন মুহাম্মদ শফী|

 

চট্টগ্রামের ‘মুশতারী লজ’

চট্টগ্রাম শহরের একটি সুপরিচিত এলাকা এনায়েত বাজার। প্রধান রাস্তার পাশেই একটি হলুদ রঙের চারতলা বাড়ি। বাড়িটির নাম ‘মুশতারী লজ’ডাক্তার শফীর বাড়ি এটি। এ বাড়ির দোতলায় বার্তমানে বসবাস করছেন ডা. শফীর পরিবারবার্গ।

ডা. শফী সম্পর্কে অনেক কথা জানালেন তাঁর স্ত্রী বেগম মুশতারী শফী| তিনি জানালেন, ডা. শফী ডেন্টাল সার্জারি পাস করেন ১৯৪২ সালে কলকাতা ডেন্টাল কলেজ থেকেচাকরি করেছেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। সে সময় কলকাতার নামকরা ডেন্টাল সার্জন ডা. আর ডাব্লু কন্সটেন্টের ক্লিনিকে কাজ করেছেন কিছুদিনএরপর নিজস্ব ক্লিনিক খুলে বসেন কলকাতার বউ বাজার স্ট্রিটেতার শৈশব কেটেছে হাওড়ায়। ওখানে স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি ভর্তি হয়েছিলেন হাওড়া সঙ্গীত বিদ্যালয়ে। বেহালা বাজানোর হাতেখড়ি সেখান থেকেই। বড় হয়ে আকাশবাণী কলকাতার তালিকাভুক্ত বেহালা বাদক হয়েছিলেন তিনি।

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৬৭

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

১৯৫০ সালে ডা. শফী চলে আসেন বাংলাদেশে। চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ক্লিনিক খুললেন এনায়েত বাজারে তার বাসার নিচতলায়।

 

১৯৭১

১৯৭১-এ শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিকামী মানুষের মতো ডা. শফীও ছিলেন একাত্মসরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি তিনি। তবে মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা করার জন্য তাঁর ব্যাপক অবদান ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অজানা নয়। তখন চট্টগ্রাম রেডিওতে চাকরি করতেন বেলাল মোহাম্মদ। তার সঙ্গে ডা. শফীর আলাপ-আলোচনা হলো। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা বাস্তবে রুপ নেয়।

কালুরঘাটে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেডিওর ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে শুরু হলো অনুষ্ঠান প্রচার। ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের নামকরণ হলো  ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্ৰ’, পরে এর নাম পাল্টে  ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে বেলাল মোহাম্মদ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ’ নামে একটি বই লিখেছেন। ডা. শাফী সম্পর্কে অনেক কথা লেখা আছে সে বইতে।

চিকিৎসক পরিচয়ে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারদের সঙ্গে ছিল ডা. শফীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। যোগাযোগ ছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গেও। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, রাজনীতিবিদ পূর্ণেন্দু দস্তিদারসহ আরো অনেকে আসতেন ডা. শাফীর বাসায়।

ডা. শফীর স্ত্রী বেগম মুশতারী শফী তখন ছিলেন চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের আহ্বায়িকা। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো ‘বান্ধবী’ নামে একটি মহিলা বিষয়ক মাসিক পত্রিকা। ডা. শফীর বাড়ির উঠানে ছিল ছাপাখানা। সে কারণে ছাপাখানাটির নামকরণও হয়েছিল ‘মেয়েদের প্রেস’স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এবং সংস্কৃতির কল্যাণের জন্য ডা. শফী, পরিবারের কর্মতৎপরতার বিষয়টি পাকসেনাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশায় এ পরিবারটিও চিহ্নিত হলো।

 

যা ঘটেছিল ৭ এপ্রিল সকালে

একাত্তরের ৭ এপ্রিল। সকাল ১০টা। হঠাৎ দরজায় নক করলো কারা যেন। বেগম মুশতারী শফী দরফা খুলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে বাঁধা দিলেন ডা. শফী। নিজেই ওঠে গিয়ে দরজা খুললেন। দেখা গেল, অস্ত্র হাতে মিলিটারি দাঁড়িয়েওরা প্রশ্ন করলো, ডা. শফী কার নাম? অকপটে নিজের নাম স্বীকার করলেন ডা. শাফীকিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে নিয়ে জিপে উঠালো মিলিটারিরা। নিয়ে গেল সার্কিট হাউসে। ডা. শফীর বুঝতে বাকি রইলো না, মৃত্যু নিশ্চিত।

কিন্তু তাঁর ভাগ্য ভালো বলতে হবে। সে সময় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ছিলেন মির্জা আসলাম বেগ। মির্জা আসলাম বেগের সঙ্গে ছিল ডা. শফীর জানাশোনা। ব্রিগেডিয়ার মির্জার অনুরোধে মিলিটারিরা তাঁকে ছেড়ে দিলো এবং বেলা ১১টায় জিপে করে বাসায়ও পৌঁছে দিলো।

 

দরজায় লাথির শব্দ

ডা. শফী বাসায় ফিরে আসায় উৎকণ্ঠা থেকে রক্ষা পেলো তাঁরা পরিবারবর্গ। সেদিনই দুপুরবেলা। সময় ১টা ৩০ মিনিটডাইনিং টেবিলে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছেন ডা. শফীএমন সময় দরজায় লাথির শব্দ। খাওয়া রেখে বেগম শাফী দরজা খুললেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ৩০-৩৫ জন মিলিটারি। বেগম শফী তাকিয়ে দেখেন, আশপাশের বাড়ির ছাদেও অস্ত্ৰ হাতে মিলিটারি দাঁড়িয়েবুঝতে পারলেন, তাদের বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে। মিলিটারিদের মধ্যে একজন ছিলেন মেজর বোখারী। বেগম মুশতারী শফী তাকে চিনতে পেরেছিলেন। মেজর বোখারী তার ব্রিফকেস খুলে বের করলেন শফীর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপতত্র। পড়ে শোনালেন অভিযোগগুলো। ডা. শফীর ড্রইংরুমে লেনিনের ছবি টানানো ছিল। মেজর বোখারী জানতে

 

২৬৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

চাইলেন, ছবিটি কার? এরপর বললেন, উপরে চলো। দোতলায় যাওয়ার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন বেগম শফীমুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য ওখানে বাক্সভর্তি করে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল অনেক অস্ত্ৰদোতলার তালা ভেঙে বাক্সগুলো খোলা হলো। মেজর বোখারী রাগে ফেটে পড়লেনচোখ গরম করে বললেন- ‘তুম জরুর আওয়ামী লীগ করতা হায়।’

ডা. শফী ও বেগম শফীর ছোট ভাইকে দিয়ে অস্ত্রভর্তি বাক্সগুলো গাড়িতে উঠালো মিলিটারিরা গাড়িতে টেনে তুললো বেগন শফী ও তাঁর ছোট ভাইসহ ডা. শফীকে। বাসার বাকি সবাই কাঁদছিল তখন। মিলিটারিটা কী যেন বলাবলি করে বেগম শফীকে ছেড়ে দিলো। বললো-‘খবরদার, পালাবে না। নইলে ডিনামাইট দিয়ে বাড়িটি উড়িয়ে দেবো।’ একজন সৈনিকের হাত ধরে কেঁদে ফেললেন বেগম শফী-‘কথা দাও আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেবে।’

 

মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে সবাই

বাড়ির গেটে চারজন মিলিটারিকে পাহারায় রেখে বিকেল পাঁচটায় এলো আরেক গ্রুপ মিলিটারি৫০ হাজার দাবি করলো ওরা। হুমকি চাললো, টাকা না দিলে বাসার বাকি সবাইকে ধরে নিয়ে যাবেসেমুহূর্তে ডা. শফীর বাসায় ছিল মাত্র ৭০ টাকা। দেশের অবস্থা খারাপ বলে আগে থেকেই প্রচুর খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে রাখা হয়েছিল। ফলে হাতের বাড়তি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল সবই। ডা. শফীর ক্লিনিকেও তেমন রোগী ছিল না। ব্যাংকও ছিল বন্ধ। ফলে মিলিটারিদের ৫০ হাজার টাকা দাবির কথা শুনে বেগম শাকীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি আলমারিতে রাখা তার অলঙ্কারগুলো মিলিটারিদের দিতে চাইলেন; বললেন, ‘এগুলোর মূল্য ৫০ হাজার টাকার বেশি হবেওগুলো নিয়ে যাও।’ কিন্তু কিছুতেই রাজি হলো না মিলিটারিরা। শেষবারের মতো ওরা হুমকি দিয়ে গেল- ‘আগামীকাল সকাল আটটায় আবার আসবো। পঞ্চাশ হাজার টাকা জোগাড় না হলে বাসার আর কাউকে রেহাই দেবো না।’

সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত এলো। রাত শেষে সকাল আসবে। আটটা বাজবে, টাকার জন্য মিলিটারিরা আসবে। শেষ পর্যন্ত বাসায় সবাইকে ধরে নিয়ে হত্যা করবে। রাত গভীর হচ্ছিলো। আর ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছিল ডা. শফীর পরিবার।

 

ভয়ংকর রাতে

বেগম শফী তাঁর স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে জানালেন—তখনো চারজন মিলিটারি আমাদের বাড়িটি পাহারা দিচ্ছিলো। গভীর রাতে আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে মিলিটারিদের দৃষ্টি এড়িয়ে বাসায় ঢুকলো ডা. শফীর বন্ধুর ভাই আলমগীরবললে, ‘ভাবী, সকাল হওয়ার আগেই বাসা ছেড়ে পালাতে হবে।’ সারা চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুৎ নেই সন্ধ্যা থেকেই। বাইরে ধবধবে জোছনা। দূর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল বারবার। হঠাৎ আকাশে মেঘ করলো। চাঁদ ঢাকা পড়লো ঘন মেঘে। বৃষ্টি নামলো মুষল ধারেএমন সুযোগ আর আসবে না। আলমগীর নামের সেই নিঃস্বাৰ্থ ছেলেটি পাহারারত মিলিটারিদের দৃষ্টির আড়ালে এক এক করে বাড়ি থেকে আমাদের বের করে নিয়ে এলো। ভয়ঙ্কর রাতে বৃষ্টিতে ভিজে গভীর অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচলাম আমরা। সকালে আশ্ৰয় নিলাম মিরেরশরাই নামক স্থানে সেখানকার পীর সুফি আবদুল লতিফ সাহেবের ওখানে। সেখানে ছিলাম কিছুদিন। কিন্তু এ জায়গাও আমাদের জন্য নিরাপদ বলে মনে হলো না। মিরেরশরাই থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনদিন তিন রাত পায়ে হেঁটে চললাম। তারপর উদয়পুর হয়ে আগরতলায় গিয়ে পৌঁছলাম। ওখানেই ছিলাম বাকি নয় মাস।

 

ডা. শফীর স্মৃতি

বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি বেগম মুশতারী শফী ছেলেমেয়ে নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে এলেন। ডা. শফীর লাশ অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো। কিন্তু কোথাও তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।

ডা. শফীর বাসার সবকিছু লুট করে নেয় পাকসেনারা নষ্ট করে ফেলে তার অনেক স্মৃতি। ডা. শফীর

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৬৯

 

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

বেহালাটির সন্ধান পাওয়া যায়নি কোথাও। তার অল্প কিছু কাপড়াচোপড় সংরক্ষণ করতে পেরেছেন বেগম শফীডা. শফীর একমাত্র ছবিটি সংগ্রহ করা হয়েছে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে। রাস্তায় ছেঁড়া কাগজের স্তুপ থেকে তার নেমপ্লেট উদ্ধার করা হয়। বেগম শফী জানান, দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘একরাইলিক বেজিন’ দিয়ে ডা. শফী তাঁর নাম লিখেছিলেন এ নেমপ্লেটটিতে।

পাকবাহিনী ডা. শফীর ডেন্টাল ক্লিনিক তছনছ করে ফেলে। ভেঙে দেয় তাঁর ডেন্টাল চেয়ার। ডা. শকীর একটি স্ট্রেচার এবং ভাঙা ডেন্টাল চেয়ারটি মেরামত করে চট্টগ্রামের একজন ডেন্টাল সার্জন বর্তমানে ব্যবহার করছেন। ডা. শফীর অল্প কয়েকটি কাপড়, ফ্রেমে বাঁধাই করা একটি ছবি, নেমপ্লেট, স্ট্রেচার এবং ডেন্টাল চেয়ার আজও তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছে।

 

বাবাকে মনে পড়ে

ডা. শফীর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে মেজো ছেলে মেরাজ তাহসিন শফী, ছোট ছেলে নেয়াজ মোহসিন শফী ও ছোট মেয়ে শারমীন তারানা শফীর সঙ্গে সেদিন কথা হয়েছিল। অন্যদের মধ্যে বড় মেয়ে ফারজানা লন্ডনে অবস্থান করছেন। বড় ছেলে ইয়াসীন রিয়াদে কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার। দ্বিতীয় মেয়ে রিজওয়ানা চট্টগ্রামে শ্বশুরবাড়িতে। তৃতীয় মেয়ে নাজনীন তার স্বামীর সঙ্গে ঢাকায়। বাবার স্মৃতি মনে পড়ে কিনা জানতে চাইলে ডা. শফীর ছোট মেয়ে শারমীন তারানা শফী জানালেন- ‘বাবার কথা মনে পড়ে। তবে যে স্মৃতিটি আজও আমার মানে উজ্জ্বল তা হলো, যখন বাবাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি এবং আমার আরেক ভাই ড্রেসিংরুমে কাপড়া-চোপড়ের আড়ালে ভয়ে জড়সড় হয়ে লুকিয়ে ছিলাম।’  মেজো ছেলে মেরাজ তাহসীন শফী বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের বাসার দোতলায় যখন অস্ত্রভর্তি বাক্স রাখা হছিল তখন একটি বাক্স থেকে বন্দুকের গুলি খসে গিয়ে সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়েছিল। বাবা আমাকে বলেছিলেন, খবরদার, একথা কাউকে বলো না।’

বেহালা বাদক ডেন্টাল সার্জন লোকান্তরিত। কিন্তু তাঁর শিল্প বেঁচে আছে উত্তরসূরিদের মধ্যে। পরিবারের সবাইকে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতে উৎসাহিত করতেন ডা. শফীবাবার কাছে বেহালা বাজানো শিখেছেন মেজো মেয়ে রিজওয়ানা। বড় মেয়ে ফারজানা চট্টগ্রাম রেডিওর নজরুল সঙ্গীত শিল্পী (বর্তমানে লন্ডনে)ছোট মেয়ে তারানা চারুকলা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেগম মুশতারী শফী গল্পকার হিসেবে তার পরিচিতি সাহিত্য মহলে। বই বেরিয়েছে পাঁচটিরও বেশি। শিল্পচর্চার যে বীজ, ডা. শফী বুনেছিলেন তাঁর পরিবারে, তা এখন শাখা-প্রশাখা মেলে বিস্তৃত।

 

(*সাপ্তাহিক বিচিত্রা; বিজয় দিবস সংখ্যা-১৯৯১, পৃ. ৬৯ থেকে সঙ্কলিত)

 

২৭০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অম্বেষণ

মেজর এসএমএইচএস বোখারী এবং

মেজর জেড খান

 

সম্পাদনাঃ ডা. এম এ হাসান

প্রকাশনাঃ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি,

জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার

প্রকাশকালঃ মে ২০০১ নাম

 

 

নামঃ মেজর এসএমএইচএস বোখারী (২৪ এফ এফ, পিএসএস-৪২২৪)

নামঃ মেজর জেড খান

স্থানঃ চট্টগ্রাম।

 

অপরাধঃ ৭ এপ্রিল ১৯৭১, ডাক্তার শফীর বাড়িতে গিয়ে উপরোক্ত দু’জন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর তাঁরা ডাক্তার শফীর বাড়ির পেছনের এক হিন্দু বাড়িতে যায়। এ বাড়িটি ছিল জমিদার কেওয়ারী নামে এক ভদ্রলোকের। জমিদার পরিবারের সবাই আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু ঐ বাড়ির ৮০-৮৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ পুরোহিত তখনও মন্দিরে ছিলেন। মেজর বোখারী ও মেজর জেড খান মন্দিরে ঢুকে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতকে গুলি করে হত্যা করে।

 

সাক্ষীঃ ডাক্তার শফীর স্ত্রী বেগম মুশতারী শফী এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

হামদুর রহমান কমিশনের কাছে মেজর এস এম এইচ এস বোখারী স্বীকার করে যে, রংপুরে দু’জন বাঙালি অফিসারসহ ৩০ জনকে বিনাবিচারে গুলি করা হয়।

মেজর এস এম এইচ এফ বোখারী, মেজর জেড থান ও তাদের সহযোগীদের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য— Article 6(b), 7(1)(a), 7(1)(e), 7(1)(i), 7(100), 7(1)(K) 8(2)(b)(i), 82)(b)(ո): 8(2)(c)(i)-1, 8(2)(c)(i)-2. 8(2)(c)(i)-3, 8(2)(e)(iii), 8(2)(e)(iv), 8(2)(e)(ix), ধারায় অভিযুক্ত করা যায়।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ    ২৭১

 

শহীদ ডা. মুহাম্মদ শফী

 

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২

খ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৮ম পর্যায়; ১৯৯৯ (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

গ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ১৬০

ঘ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ৭৮।

ঙ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।

চ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ৮১

ছ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ২৮।

জ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস; সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ; প্রথম খন্ড।

ঝ. সেই রাজাকার; প্রকাশনাঃ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, জনকণ্ঠ প্রকাশনী; প্রকাশকালঃ জুলাই ২০০১; পৃ. ৭৭, ২৭৯-২৮০।

ঞ. *সাপ্তাহিক বিচিত্রা; বিজয় দিবস সংখ্যা-১৯৯১, পৃ. ৬৯।

ট. স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন গুলো; লেখক; মুশতারী শফী; প্রকাশনা; অনুপম প্রকাশনী।

ঠ. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান; সম্পাদনা; এ এস এম সামছুল আরেফিন; প্রকাশনা; ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯৫; পৃ. ৫৪৪।

ড. যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ; সম্পাদনাঃ ডা. এম এ হাসান; প্রকাশনাঃ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টার; প্রকাশকালঃ মে ২০০১।

 

 

২৭২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!