জীবনচিত্রঃ নামঃ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
Dr. Mohammad Mortaza
পিতার নামঃ মাওলানা আবদুল মান্নান আল আযহারী
পিতার পেশাঃ শিক্ষকতা
মাতার নামঃ সায়রা বেগম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই ও এক বোন
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-আড়ংঘাটা, ব্যাঙ্কের হাট,
ইউনিয়ন-দৌলতপুর, ডাকঘর-আড়ংঘাটা,
উপজেলা-দৌলতপুর, জেলা-খুলনা
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি নং-১৪/এ, সড়ক-ফুলার রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা, ডাকঘর-রমনা, জেলা-ঢাকা
জন্মঃ ১ এপ্রিল ১৯৩১। চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
প্রবেশিকাঃ প্রথম বিভাগ, ৮৬% মার্কসহ, ১৯৪৬, সরকারি বালিগঞ্জ হাই স্কুল কলকাতা, ভারত
আইএসসিঃ প্রথম বিভাগ, ৮৫% মার্কসহ, ১৯৪৮, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা
এমবিবিএসঃ ১৯৫৪, ১ম, ২য় ও ৩য় বর্ষের অর্ধসময় কলকাতা মেডিকেল কলেজ, প্রথম স্থান। বাকিটুকু ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঞ্চম স্থান
শখঃ সাহিত্য রচনা, সংস্কৃতিচর্চা
পুরস্কারঃ ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’ গ্রন্থের জন্য ‘ন্যাশনাল ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৪ ‘রাইটারস গিল্ড পাকিস্তান’ সংস্থা
স্বরচিত গ্রন্থঃ ‘চিকিৎসা বিজ্ঞান’ (অনুবাদ), ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস’ (অনুবাদ), ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’, ‘প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’, ‘চরিত্রহানীর তাৎপর্য’, ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ (অনুবাদ), ‘শান্তি না শক্তি’ (অনুবাদ), ‘হুনানের কৃষক আন্দোলন’ (অনুবাদ), ‘জনযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘজীবী হোক’ (অনুবাদ), ‘নয়া গণতন্ত্র’
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাঃ মার্কসিস্ট রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
চাকরির বর্ণনাঃ মেডিকেল অফিসার, প্রধান মেডিকেল অফিসারঃ মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সাল থেকে আমৃত্যু
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ আল বদর
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার তারিখঃ ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্ৰাপ্তি স্থানঃ মিরপুর বুদ্ধিজীবী শহীদ মিনার
প্রাপ্তি তারিখঃ ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২
কবরস্থানঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবি নজরুল সমাধি চত্বর
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বি.এম.এ কেন্দ্রীয় কাৰ্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ সাঈদা মোর্তজা
বিয়েঃ ১৩ এপ্রিল, ১৯৬৭ সাল
সন্তান-সন্ততিঃ এক পুত্র ও এক কন্যা
দ্যুতি অরণিঃ এমএস(অর্থনীতি), ইউএসএ, গৃহিণী
অর্ণব নীলিমঃ পিএইচডি ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্স, ইউএসএ
তথ্য প্রদানকারী
সাঈদা মোর্তজা
শহীদ চিকিৎসকের স্ত্রী
বাড়ি নং-১৪/এ, সড়ক-ফুলার রোড,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা,
ডাকঘর/থানা-রমনা, ঢাকা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫১
আমার স্বামী
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
সাঈদা মোর্তজা
স্মৃতিচারণ করতে গেলে মন চলে যায় সেই ‘৬১ সালে। বলা যায় ডা. মোর্তজার সঙ্গে পরিচয় আমার তখন থেকে। বেশ ছোটবেলা থেকেই আমি আমার খালার সঙ্গে। খালা (ডা. হালিমা খাতুন) শিক্ষকতার কাজ নিয়ে তখন ফুলার রোডে আমাকে আর মেয়ে লাবণীকে নিয়ে থাকেন। একই পাড়াতে থাকতেন ডা. মোর্তজা। লাবণীর সর্দি, কাশি, জুর লেগেই থাকে। ডাকা হয় ডা. মোর্তজাকে। এসব বিষয়ে আলাপ করতে দেখেছি খালার সাথে। সেসবের তেমন কিছু আমি বুঝতাম না। সে সময় একবার খালাকে নিজের লেখা বই উপহার দিলেন, ‘প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’। মনে পড়ে বইয়ের নাম পড়ে ভয়ে আমি বইটি ধরতে সাহস পাইনি। অনেক পরে জানলাম প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কিত সনাতন ধারণার বিরোধিতা করা হয়েছিল বইটিতে। যাই হোক, ’৬৩-তে খালা বিদেশে গেলেন। আমরাও চলে গেলাম ও-পাড়া ছেড়ে।
আবার দেখা ‘৬৬-তে। খালা ফিরে বাসা পেলেন নীলক্ষেতে। অসুখ-বিসুখে আবার ডাক্তার সাহেবকে ডাকা। প্রয়োজনে তিনি সবসময় আসতেন। কিন্তু কোনোদিন কোনো রকম বিশেষ আপ্যায়নের চেষ্টা করলে রেগে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় সবার বাসায় তাঁর যারায়াত ছিল, তবে সামাজিক সম্পর্ক ছিল না বলা যায়। চিকিৎসার কাজ করে বাকি সময় কাটাতেন পড়াশোনা করে, পত্রিকায় লিখে।
‘৬৭-এর ২৩ এপ্রিল আমাদের বিয়ে হয়। এটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় একটা আলোচনার বিষয়। তাঁকে সবাই ধরে নিয়েছিল চিরকুমার হিসেবে। বিয়ের এক সপ্তাহ আগেও জানি না আমার বিয়ে হচ্ছে এবং তা ডা. মোর্তজার সঙ্গে। তিনি খালার কাছে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছেতেই তিনদিনের মধ্যে বিয়ে ঘটে গেল। বিয়ে হলে ফুলার রোডের বাসায় এলাম শহীদ মুনীর চৌধুরীর গাড়িতে। তিনি নিজেই ড্রাইভ করেছিলেন। ডা. মোর্তজার অভিভাবক হয়ে গিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বিয়ের প্রথম রাতেই ডা. মোর্তজা আমাকে আত্মপরিচয় ব্যক্ত করে বললেন, এই
২৫২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
সমাজের নানা অন্যায়ের সাথে আপোস করে বেঁচে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এই সমাজকে ভেঙে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। আমি যেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা রক্ষার চেষ্টা করি। শোষণের রাজনীতি বিলোপ আর শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার রাজনীতি-এসব কিছুই বুঝতাম না আমি। তবে মানুষকে কষ্ট দেয়া, অন্যায় করা দেখলে আমার খুব খারাপ লাগতো। তাই তাঁর কথা সেদিন মন দিয়ে শুনেছিলাম।
পরবর্তীকালে সংসার করতে গিয়ে কর্মজীবনের উন্নতি নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখে মাঝে মধ্যে মন খারাপ করেছি। আমি উচ্চাভিলাষী নই। তবু সাধারণ, স্বাভাবিক একটা জীবনের ছবি তো ছিল মনে। আমার সেই সাধারণ, স্বাভাবিক জীবনের ছবি বাস্তবায়নে সামান্য প্রশ্ৰয়ও দিতেন না। উপরন্তু সমাজের প্রচলিত ভোগ, ঐশ্বর্যকে ঘৃণা করতে শেখার অভ্যাস তৈরি করার কথা বলতেন সবসময়। তাঁর কাছ থেকেই আমি প্রথম জানতে পারলাম সমাজের অসম বিকাশ মানুষের সৃষ্টি এবং একমাত্র সাম্যবাদী সমাজই পারে সত্যিকার মানুষ ও সুন্দর সমাজ সৃষ্টি করতে এবং সব শ্রেণীর মানুষের প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে।
প্রথম জীবনে তিনি ভাবতেন সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়গুলো তুলে ধরবেন। তাই বাংলা, ইংরেজিসহ বিশ্বসাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতেন; সেই সাথে লিখতেনও। এক সময় তিনি বার্নার্ডশর একনিষ্ঠ ভক্ত হন। পরবর্তীকালে দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন জীবনের মূল সত্যকে জানার জন্য। মার্কসবাদী অর্থনীতি পড়ে তাঁর জীবন-দর্শন পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। তিনি বলতেন, মার্কসবাদই আমাকে সত্যের সন্ধান দিয়েছে। ছেলেবেলা থেকে তাঁর পারিবারিক, বিশেষ করে ধর্মীয় পরিমণ্ডলের মধ্যে তিনি যে বৈষম্য দেখতে পেয়েছিলেন তা-ই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তখন থেকেই ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বরের বিরুদ্ধে তিনি মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। আত্মার-ধর্ম তিনি তাদের মধ্যে দেখেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ও ইচ্ছে ছিল বিধান রায়ের মতো ডাক্তার হওয়ার। সেভাবে পড়াশোনাও শুরু করেছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্রথম দু’বছর প্রথম হওয়ায় শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে তাঁকে নিজ দেশ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে চলে আসতে হয়। ডা. টি. আহমেদ কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন এবং তিনিই উদ্যোগী হয়ে ডা. মোর্তজাকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন।
এই সময়কার কথা মনে করে তিনি বলতেন, ঢাকায় এসে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় অত্যন্ত মানসিক কষ্টে ভুগতে হয়েছে তাঁকে। সবাই ছিল তখন ওপারে। তখন থেকেই তিনি সমাজ নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করেন। ভাবতেন, কেন তাঁকে নিজের জন্মস্থান ছাড়তে হলো, কেন মানুষে মানুষে দাঙ্গা বাধে? এই সময়
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫৩
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
থেকেই তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা আস্তে আস্তে কমে অন্যান্য বিষয়ে পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পেল। মেডিকেল কলেজে থাকাকালে কবিতা, গল্প লিখতেন, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজের লেখা নাটক মঞ্চায়ন করতেন। ছেলেবেলা থেকে ভেবেছিলেন ডাক্তার হয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করবেন, মানুষের দুর্দশায় তাদের পাশে থাকবেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে এসে হাসপাতালে ডিউটি করে রোগীদের ইতিহাস নিতে গিয়ে দেখেন, সমাজের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন না করলে ডাক্তার হয়ে মানুষের প্রকৃত দুৰ্দশা মোচন করা যায় না। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই দারিদ্র্যের শিকার। কাজেই ডাক্তার হয়ে তাদের পথ্য নির্বাচন করলেও এই মানুষদের প্রকৃত রোগের সমাধান হয় না। ডাক্তাররা হয়তো সামগ্রিকভাবে রোগের উপশম করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই চিকিৎসা অর্থহীন। এই সমাজের প্রকৃত চিকিৎসা না হলে ডাক্তার হয়ে কোনো লাভ নেই।
ডাক্তার হয়ে সমাজের প্রয়োজনে লাগার স্বপ্ন বিলীন হয়ে যেতে থাকে। কাজের পড়া শেষ হলে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ ছেড়ে দিয়ে তিনি কাজ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে দিনের অর্ধেক সময় ডাক্তারি করতেন আর বাকি সময়টা ব্যয় করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।
বিবাহিত জীবনে দেখেছি তিনি রাত ২-৩টার আগে ঘুমাতে যেতেন না। ঘুম কাটানোর জন্য তৈরি করেছিলেন লেকচার-স্ট্যান্ডের মতো উঁচু টেবিল-যেখানে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে পড়তেন।
‘৭০-এর শেষের দিকে চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনেক আগে থেকেই যাই যাই করছিলেন। রাজাক সাহেব তাঁকে বলেছিলেন যে, টঙ্গীতে বাড়ি করে দেবেন, যাতে সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে পারেন। তাই আর ঢাকা ছাড়া হলো না। তাছাড়া সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাড়িতে সবসময় সমাজবাদের ক্লাস নিতেন তিনি। এজন্যও বাড়ি ছাড়া হলো না| সাংবাদিক হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন একসময়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজের বিশ্লেষণ করে আমাদের দেশের জন্য সঠিক পন্থা গ্রহণের ওপর লেখা প্রকাশের উদ্দেশ্যে ‘গণশক্তি’ পত্রিকা প্রকাশের কাজে অত্যন্ত বাস্ত হয়ে পড়েছিলেন। জনাব বদরুদ্দীন উমর হয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। কিন্তু এডিটোরিয়াল থেকে আরম্ভ করে পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যায় ২-৩টি লেখা তার থাকতো। চাকরির জন্য তাঁর ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হতো। তবে ‘দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ’ কলামে তিনি লিখতেন স্বনামে। আমাকে বলতেন, ‘মানবজাতির প্রত্যেকটি মানুষ একটা চেইনের মতো। তাই প্রত্যেকের উচিত তার পরবর্তী চেইনে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাওয়া। আমি আমার উত্তরপুরুষের জন্য উত্তম কিছু করে অজ্ঞাত ও অখ্যাত হয়েই মরে যেতে চাই। অর্থ উপার্জন করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানোটা একটা জীবের মতো ব্যাপার।’ দেশ, সমাজের চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতেন সবসময়। তাই দেখেছি নিজের মনেই একটা স্বর্গ তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। সারাক্ষণ কাজ, পড়াশোনা, লেখালেখি, ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার ঊর্দ্ধে দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবা-এসবই ছিল
২৫৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
তাঁর শেষদিকের জীবনপ্রণালি। ’৬৮-এর এপ্রিলে আমাদের মেয়ে দ্যুতি অরণির জন্ম হলো। মনে আছে, ওর বয়স যখন আট-নয় মাস, তখন একদিন সকালে মেয়েকে কমলা খাওয়াচ্ছি। তিনি এলেন বাইরে থেকে। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তোমার মেয়েকে দুধ খাওয়ালে, ডিম খাওয়ালে, এখন আবার কমলা খাওয়াচ্ছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছো এই মুহুর্তে এই পৃথিবীতে কত অসংখ্য শিশু রয়েছে জন্মেই যারা এক ফোঁটা বিশুদ্ধ পানিও পাচ্ছে না?’ একবার তাকে আমি তিন টাকা গজের কাপড় দিয়ে শার্ট করে দিয়েছিলাম। শার্ট তো কোনোদিন পরেনইনি, উপরন্তু এ নিয়ে আমাকে প্রচুর তিক্ত কথা শুনিয়েছেন। ঈদে-পরবে আমাদের বাসায় কাজের লোক থাকলে তাদের জামা-জুতো সবই হতো। কিন্তু নিজেদের জন্য কখনও এসব হতো না। দেখেছি, অনেক উচ্চপদস্থ লোকের ‘কল’ প্রত্যাখ্যান করতে, কিন্তু রাত-দুপুর কোনো সাধারণ কর্মচারী কিংবা অসুস্থ ছাত্রের জন্য তুরিত গতিতে চলে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি হলেই চলে যেতেন গ্রামে-পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, কোথায় যে থাকতেন খুঁজেও পাওয়া যেত না। ফ্রি স্যাম্পল ওষুধ বিলি করে দিতেন গ্রামের মানুষদের চিকিৎসার জন্য। মানুষের ঘাড়ের ওপর আয়েশ করে চলাকে ভারি অপমানের বিষয় মনে করতেন বলে তিনি কখনো রিকশায় চড়তেন না।
‘৭১-এ আমাদের ছেলে (অর্ণব নীলিম) জন্ম হলো। ২৭ মার্চ আমাদের নিয়ে গ্রীন রোডে আমার এক ভাইয়ের বাড়ি গেলেন। সপ্তাহ দেড়েক পরে আবার বাসায় ফিরে এলাম। একে একে আবার সবাই পাড়ায় আসা শুরু করল। আমি ভয় পেতাম পাড়ায় থাকতে। কিন্তু তাঁর কোনো ভয় ছিল না। রসিকতা করে গান গাইতেন, ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’। ভালো গাইতেন। ডা. মোর্তজা ছেলেবেলার কথা একবার বলেছিলেন, গ্রামের বাজারে মাঝে মধ্যে গান গেয়ে গ্রামের গরিব বাসিন্দাদের ঘর মেরামত করা কিংবা মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পয়সা উঠাতেন। তাঁর নানার মুখে পরে শুনেছি, ছেলেবেলায় তিনি ভারি ডানপিটে ছিলেন। ওর পেছনে সবসময় একদল ছেলে থাকত সারাদিন খেলাধুলা, হৈচৈ করে বেড়াত। কিন্তু পড়তে বসলে যেন ভীষণ মনোযোগী। ভয়-ভর ছিল না একবিন্দুও।
‘৭১ এর ডিসেম্বরে যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলো তখনও তাঁর কোনো ভয় ছিল না। আমাকে বলত, ‘যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫৫
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
একটা জাতীয় প্রয়োজন। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির চরিত্র তৈরি হয়। তাই আমি যুদ্ধ চাই। এ যুদ্ধে আমি মরে যাব, আমার ছেলে প্রাণ দেবে, তার ছেলে এভাবে একদিন সত্যিকারের মানুষ হবে। আমি বলতাম, ‘তোমার আকাশ-কুসুম চিন্তা কোনোদিন বাস্তবে রূপ পাবে না।’ তাঁর বড় আশা ছিল ভবিষ্যৎ বংশধরদের ওপর। ’৭১-এর মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে পাকবাহিনী বাসা থেকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে। আমি ভীষণ ভয় পেলাম, তাঁকে বাসা ছাড়তে বললাম। তিনি বললেন, দেখা যাক, ওদের ছেড়ে দেয়। কিনা। নইলে চলে যাব। কয়েকদিন পর শিক্ষকরা ছাড়া পেলেন। তাই ওর পাড়ায় থাকার সাহস আরও বাড়ল । বললেন, ‘হয়তো এখন পাকবাহিনী যা ইচ্ছে করবে না। শিক্ষকদের ভালোভাবে ছেড়ে দিল দেখে মনে হচ্ছে ওরা পলিসি পরিবর্তন করেছে।’ পাড়াতে তখন মৌলবাদীদের চরম দৌরাত্ম্য। একদিন বিকেলে ক্লাবে শিক্ষকদের আড্ডা থেকে ফিরে আমাকে জানালেন, ‘আমার পাড়া ছেড়ে যাওয়া উচিত-না হলে মনে হচ্ছে ওরা আমাকে মেরে তাড়াবে।’ আমি অভিমানে বলেছিলাম, ‘সেদিনের অপেক্ষাতেই তুমি আছ—আমার কিছু বলার নেই।’ তিনি বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার থাকার উদ্দেশ্যই ছিল কী করতে চাই তার প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এখন আমার নিজেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। তুমি আমাকে আর বিরক্ত করবে না। আমি কী বলতে চাই তা আমি জানি। এখন আমি শুধু লিখব।’
মেডিকেল সায়েন্স রেখে দীর্ঘ ১৬ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন দেশের সামাজিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনে কিছু অবদান রাখবেন বলে। অথচ ভাগ্যের নির্মমতার শিকার হলেন তিনি। সমাজের অসুস্থ, অশুভ, বিকৃত শক্তির কাছে তাঁর মতো একজন সচেতন, জ্ঞানী, সাধক লোকের মৃত্যু হলো ১৪ ডিসেম্বর ‘৭১-এ শুধু একটি বুলেটে। তাঁর একটি অমূল্য কথাই এখনও বুকে লালন করে বেঁচে আছি, ‘একজন মানুষ ক্ষয় হয়ে যাবে; কিন্তু তাঁর চিন্তার কোনো ক্ষয় নেই, চিন্তার কোনো মৃত্যু নেই।’
(*প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা থেকে সঙ্কলিত)
২৫৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার বাবা
শহীদ ড. মোহাম্মদ মোর্তজা
অর্ণব নীলিম
বাবা সম্পর্কে আমি কখনো কোথাও লিখিনি বা কোথাও কোনো স্মৃতিসভায় বক্তৃতা বা স্মৃতি রোমস্থানও করিনি। বাবা সম্পর্কে এ লেখাই আমার প্রথম। তবে বাবার স্মৃতি বলতে যা বোঝায় তা আমার নেই। কারণ আমার দশ মাস বয়সে বাবা শহীদ হন। বাবা সম্পর্কে সবকিছুই আমার মা, আমার আত্মীয়-স্বজন, বাবার ছাত্র-বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা। তবে বাবার সংগ্রহের বই, তাঁর লেখা বই এবং সবার কাছ থেকে শুনে আমি বাবার সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও প্রগাঢ় ধারণা পাই। বাবা ছোটবেলা থেকেই কঠোর জীবন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। আমার দাদা কলকাতা কেমবেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় রাসটিকিট পান। ফলে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং বাবার দু’মাস বয়স থাকা অবস্থায় দাদা একা দেশত্যাগ করেন এবং মিসরের কায়রোতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার জন্য চলে যান। মিসরে যাওয়ার পর দাদার সাথে বাবা ও দাদির তেমন একটা সম্পর্ক থাকে না। তাই ছোটবেলা থেকেই চরম অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে বাবাকে বড় হতে হয়েছে। তাঁর সাত মাস বয়সে মা মারা যান। এরপর তিনি নানার বাসাতে পড়ালেখা করতে থাকেন। দাদি গ্রামের অতি সাধারণ মহিলা হলেও মনের দিক দিয়ে তিনি খুব উন্নত মানের ছিলেন। তিনি সবসময় চাইতেন তাঁর ছেলে বড় হয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করুক। খুব অল্প বয়সে মারা গেলেও বাবার মনে তিনি গভীর একটা প্রভাব রেখে গিয়েছিলেন। তাই নানা মারা যাওয়ার পর বাবা পড়ালেখায় খুব মনোযোগী হন ও ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়ালেখায় তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। পড়ালেখার ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব গোছালো ছিলেন। পড়ালেখার সাথে সাথে তিনি গান-বাজনাতেও বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অনেক সময় টাকার অভাবে তিনি তাঁর এক চাচার সাথে গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। দাদা দীর্ঘ ১০ বছর পর উচ্চতর পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরলেও বাবার দায়িত্ব খুব একটা নিলেন না। তিনি তাঁর সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন এবং বাবাকে পড়ালেখাতে তিনি কখনোই
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫৭
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
সহায়তা করেননি। কিন্তু বাবা তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় পড়ালেখা চালিয়ে যান। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেন। এরপর তিনি কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সে সময় মুসলমান ছেলেরা খুব কমই সায়েন্স পড়ত। বাবা ইন্টারমিডিয়েটেও স্ট্যান্ড করেন। এরপর কলিকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মেডিকেল কলেজেও বাবা তার শিক্ষাগত সাফল্য অক্ষুন্ন রাখেন ও কলকাতা মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট এমবি (ফাস্ট প্রফেশনাল) পরীক্ষায় তিনি ফার্স্ট হন। কিন্তু সে সময় কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তিনি কলকাতা ছেড়ে ঢাকা চলে আসেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষের দিকে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি ছোটবেলা থেকেই বিধান রায়ের মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং ভাবতেন, ডাক্তার হয়ে সমাজের অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু নানা বিষয়ে পড়ালেখা করে তিনি বুঝলেন ডাক্তার হিসেবে হয়তো ব্যক্তিবিশেষের উপকার করা যায়। কিন্তু সমাজের দারিদ্র্য, শোষণ, বৈষম্য, অপরাধ, অনাচার যা এ সমাজের ব্যাধিস্বরূপ তা থেকে এ সমাজকে মুক্ত না করলে সত্যিকারের শোষণ ও রোগমুক্ত সমাজ পাওয়া সম্ভব নয়। আর এর জন্য দরকার সুস্থ ও কল্যাণকর রাজনীতি। তাই তিনি এম.বি. ডিগ্রি নেয়ার পরে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ পেয়েও তা গ্ৰহণ করলেন না, দেশে থেকে গেলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল অফিসারের চাকরি নেন এবং অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য নিয়ে প্রচুর লেখাপড়া চালিয়ে যান। প্রথম জীবনে তিনি ভাবতেন সাহিত্যের মাধ্যমে অন্যায়গুলোকে তুলে ধরবেন। তাই তিনি বাংলা, ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে প্রচুর পড়ালেখা করতে থাকেন। তাঁর আলমারিতে আমি বার্নাড শয়ের প্রচুর বই দেখেছি। আমি সব বই পড়িনি; কিন্তু বইতে দেখেছি অসংখ্য আন্ডারলাইন করা লাল-নীল কালির দাগ। তিনি বাৰ্নাডশকে নিয়ে এক সময় গবেষণামূলক পড়ালেখা চালিয়ে যান। বাসায় দেখেছি শেকসপিয়রের রচনাসমগ্ৰ। পরবর্তীকালে তিনি দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি নিয়ে আরও গভীরভাবে পড়ালেখা করতে থাকেন-জীবনের মূল সত্যকে আবিষ্কার করার জন্য। তিনি অর্ধেক দিন ডাক্তারি করতেন ও বাকি অর্ধেক সময় পড়ালেখা করতেন। তিনি ঘুমাতেন খুব কম ও লেকচার স্ট্যান্ডের মতো উঁচু টেবিলে দাঁড়িয়ে পড়ালেখা করে যেতেন। তিনি কখনো টাকা নিয়ে চিকিৎসা প্ৰদান করেননি। বরং গরিবদের ফ্রি স্যাম্পল ওষুধ বিলাতেন ও ছুটি পেলেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। বাবার ডাক্তার বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকেই শুনেছি, তিনি ডাক্তার হিসেবে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিলেন। তাঁর সময় ছিল ডাক্তারদের জন্য সুবর্ণ যুগ। সে সময় অতি সাধারণ রেজাল্ট করা ডাক্তাররাই প্রচুর অর্থ উপার্জন করতো। কিন্তু তিনি কখনও অর্থ উপার্জন করতে চাননি। তিনি তার সব মেধা, শ্রম আমাদের সমাজের অসহায় নিপীঁড়িত মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি কোনোদিনও বিলাসিতা করেননি। বরং তিনি ভাবতেন, রিকশাওয়ালাকে পশুর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তিনি তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে যত্নবান ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জাতীয় চরিত্র তৈরি হবে। ‘৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন তাঁকে আলবদররা ধরে নিয়ে যায় তখনও তিনি একটু বিচলিত হননি। তখন আমার বয়স দশ মাস, বোনের তিন বছর। ১৪ ডিসেম্বরের সকালে ফুলার রোডের বাসার সামনে এসে থামে একটি বাস। সাত-আটজন অস্ত্ৰধারী যুবক বাসায় প্রবেশ করে। আমার বোনের শাড়িতে তাঁকে চোখ বেঁধে একটি বাসে করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর… মিরপুরের বধ্যভূমিতে আরও অনেক শহীদের সাথে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি; বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে একটি প্রশ্ন জাগে, আমরা আমার বাবার মতো অনেকেরই আত্মত্যাগের কতটুকু মূল্য দিতে পেরেছি? যে সোনার বাংলার কল্পনায় এত আত্মত্যাগ সে সোনার বাংলা কি আমরা গড়তে পেরেছি, না পেরেছি এই কলঙ্কজনক বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার করতে? বরং স্বাধীনতাবিরোধীরাই দাপটের সাথে বিচরণ করছে। তাই প্রশ্ন জাগে, কবে স্বাধীনতার মূল আদর্শ বাস্তবায়িত হবে? কিছুটা দুঃখ হয় যে বাবার সঙ্গ থেকে আমি আশৈশব বঞ্চিত। কিন্তু যখনই ভাবি বাবা এ দেশের জন্য, এ দেশের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য, এ দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তখন অনির্বাচনীয় গর্ববোধ ও দেশপ্রেমের আবেগ এ দুঃখবোধকে ম্লান করে দিয়ে আমাকে অভিভূত করে।
(*আমিরুল ইসলাম ও আসলাম সানী সম্পাদিত আমার বাবা-শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের কথা থেকে সঙ্কলিত)
২৫৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৬৩২, ৭০৭ ।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ১ম পর্যায়; ১৯৯১ । (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম খণ্ড, ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ১৪৩ ।
চ. *মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইফতিখার কাজল; প্রকাশনাঃ রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃ. ২২ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্ৰী।
জ. চারিতাভিধান; সম্পাদনাঃ সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় সংস্করণ; প্রকাশকালঃ মাঘ ১৪০৩, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭; পৃ. ৩২৬।
ঝ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ পৌষ ১৪০০, জানুয়ারী ১৯৯৪; পৃ. ২৯, ১২১ ।
ঞ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার, প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী, প্রকাশকালঃ আগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ৭৯ ।
ট. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ১৩, ৩৫।
ঠ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস; সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ; প্রথম খন্ড।
ড. একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়; সম্পাদনাঃ ড. আহমদ শরীফ, কাজী নূর-উজ্জামান এবং শাহারিয়ার কবির; প্রকাশনাঃ মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা বিকাশ কেন্দ্র; ৪র্থ সংস্করণ প্রকাশকালঃ ফাল্গুন ১৩৯৫, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯; পৃ. ১৩৪।
ঢ. সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ‘হানাদার বাহিনীর সহযোগী আলবদরদের হত্যার শিকার কয়েকজন’ জাতীয় দিবস সংখ্যা-১৯৭৩।
ণ. বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা; লেখকঃ রফিকুল ইসলামঃ প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; প্রকাশকাল; ২৮ অগ্রহায়ণ, ১৩৮০, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩; পৃ. ১৬১।
ত. *আমার বাবা-শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানের কথা; সম্পাদনাঃ আমিরুল ইসলাম ও আসলাম সানী; প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন; প্রকাশকালঃ ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯১; পৃ. ৬৫।
থ. দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা; লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল কাদির; প্রকাশনাঃ মুক্ত প্রকাশনী, ঢাকা; ৯ম সংস্করণ, প্রকাশকালঃ ১৩ মে ২০০২; পৃ. ৩৫৭।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৫৯
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ