জীবনচিত্র নামঃ ডা. মমতাজ হোসেন
Dr. Momtaz Hossain
পিতার নামঃ হাজী ওসমান আলী
পিতার পেশাঃ কৃষিজীবী
মাতার নামঃ মরিয়ম বেগম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ দুই ভাই ও এক বোন; নিজক্ৰম-কনিষ্ঠ
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম- ইসলামপুর, ওয়ার্ড নং-১৫,
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, ডাকঘর/জেলা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ
শহীদ ডা. মমতাজ হোসেন
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্মঃ ১৯২৭
শিক্ষাগত যোগ্যতা
ম্যাট্রিকঃ বাসুদেবপুর হাইস্কুল, গোদাগাড়ি, রাজশাহী
আইএসসিঃ এলএমএফ, লিটন মেডিকেল স্কুল, ময়মনসিংহ
শখঃ অশ্বচালনা
চাকরির বর্ণনাঃ প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
হত্যকারীর পরিচয়ঃ রাজাকার ও কতিপয় অবাঙালি সহযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী
নিহত হওয়ার তারিখঃ ২০ এপ্রিল, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ
প্ৰাপ্তি তারিখঃ ২০ এপ্রিল, ১৯৭১
কবরস্থানঃ নতুন হাট গোরস্তান, নামশঙ্করাবাটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বি.এম.এ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ জাহানারা বেগম
বিয়েঃ ১৯৫৬
সন্তান-সন্ততিঃ তিন পুত্র, তিন কন্যা
মাহবুবা খাতুন, অষ্টম শ্রেণী, বাবার সাথে ২০ এপ্রিল শহীদ
মাহমুদা খাতুন, এইচএসসি, গৃহিণী
জাফর আহমেদ ওসমানী, বিএ (অনার্স), এমএ ব্যবসা
জাকী আহমেদ ওসমানী, বিএ, অস্ট্রিয়া, ভিয়েনায় কর্মরত
মাসতুরা খাতুন, বাবার সাথে শহীদ (পরদিন ২১ এপ্রিল)
জামিল আহমেদ ওসমানী, বিএ, ব্যবসা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়
মাহবুবা খাতুন (বড় মেয়ে)
মাসতুরা খাতুন (ছোট মেয়ে)
তথ্য প্রদানকারী
জাফর আহমেদ ওসমানী
শহীদ চিকিৎসকের ছেলে
তাজ ফার্মেসি, বড় ইন্দিরা মোড়,
চাঁপাইনবাবগঞ্জ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৪৫
আমার বাবা
শহীদ ডা. মমতাজ হোসেন
মাহমুদা খাতুন
বাবা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। পবিত্র হজ আদায় করেছিলেন চিকিৎসা সেবাসহ আরো কিছু সমাজকর্মের বাইরে ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। শান্তিপ্রিয় জীবনযাপন পছন্দ করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় সব বাঙালিই ভারতে শরণার্থী হলো। বাবা গেলেন না। তাঁর ধারণা ছিল, তিনি চিকিৎসক, ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন; তাই তাঁকে কেউ হত্যা করবে না। প্রায় সবাই চলে গেলেও বাবা সপরিবারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাড়িতে থেকে গেলেন। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। কিছু কিছু এখনো মনে আছে, বাকিটা মার কাছ থেকে শুনেছি।
ঘটনার কয়েকদিন আগে ফাইজার ওষুধ কোম্পানির একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ (নাম মনে নেই) রাজশাহী থেকে এসে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। রাজশাহীতে জীবন বিপন্ন হওয়ায় এক ভাগ্নেসহ আমাদের বাসায় এসে উঠলেন। ঘটনাটা জানাজানি হওয়াতেই বাবা পাকসেনাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল কিনা সংশয় হয়!
২০ এপ্রিল ১৯৭১। সকাল ১০-১১টার দিকে আমাদের বাসায় সজোরে কড়া নাড়ার শব্দ। বাবা তখন কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। কোরআন শরিফ বন্ধ করে দরজা খুলে দিলেন। কয়েকজন পাকসেনাসহ বাঙালি রাজাকার এবং অবাঙালিদের (বিহারি) প্রায় ১৫ জনের একটি দল ঘরে ঢুকে পড়ল। তাদের মধ্যে একজন মাথাব্যথার জন্য বাবার কাছে ওষুধ চাইলো। বাবা ওষুধ দিলেন। হঠাৎ ওদের একজন জোর করে বাবার হাতঘড়িটা খুলে নিয়ে নিল। তারপর ওরা বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়ল। সমস্ত স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিল। লুটপাট শেষে তারা চলে যাচ্ছিল। বাবা সহজ-সরলভাবে বললেন, ‘তোমাদের মেজর (পাকিস্তানি) সাহেবের সাথে আমার ভালো পরিচয়; তোমরা চিন্তা করো না, কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলো।’ বোধহয় এই কথাটাতেই টনক নড়লো। ওদের-বাবা যদি মেজরকে এই লুটপাটের কাহিনী বলে দেয়!
২৪৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মমতাজ হোসেন
তখনই ওরা আমাদের সবাইকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে বন্দি করলো: বাবা-মা, আমরা ছয় ভাইবোন, সেই মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ, তাঁর ভাগ্নে সবাইকে। ঘরের একটা দরজা ছাড়া সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। মেঝেতে পেট্রোল ঢেলে দিল। তারপর গর্জে উঠলো বন্দুক; আমাদের দিকে ব্রাশফায়ার করলো ওরা কাগজে আগুন লাগিয়ে মেঝেতে ফেলল। তারপর একমাত্র খোলা দরজাটাও বাইরে থেকে বন্ধ করে ওরা চলে গেল।
আল্লাহ রাব্বুল আলমীনের ইচ্ছা। আগুনের কাগজটা এমনিতেই নিভে গেল। আগুনটা পেট্রোলে ছড়াল না। কিন্তু আমার বড় বোন মাহবুবার মাথায় ও বুকে গুলি লেগেছিল। সে তখনই মারা গেল। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের ভাগ্নেও তৎক্ষণাৎ মারা গেল। আমার গুলি লাগলো পায়ে। ছোট ভাই সিলার লুকিয়ে ছিল চেয়ারের পেছনে; সে-সহ অন্য দুই ভাইও অক্ষত থাকল। বাবার গুলি লাগলো বাম হাঁটুর ওপরে উরুতে ছোট বোন মাসতুরার গুলি লাগলো পেটে।
ঘণ্টাখানেক পর পাকসেনারা আবার ফিরে এলো। এসে বলল, ‘যে ক’জন বেঁচে আছো এখনই এখান থেকে পালিয়ে যাও; না হলে একটু পর অন্যরা এসে তোমাদেরও হত্যা করবে।’
গুলিবিদ্ধ বাবা ও ছোট বোনসহ অন্যদের নিয়ে মা পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। এদিকে গ্রামের মানুষজন ঘটনাটা ততক্ষণে জেনে গেছেন; তাদের অনেকেই ছিলেন বাবার রোগী; অসুখে-বিসুখে বাবার চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন। এদেরই কয়েকজন গরুর গাড়ি নিয়ে বাবাকে নিতে চলে এলো। মা-বাবা সবাইকে নিয়ে ওরা ওই গরুরগাড়িতে করে নামশঙ্করবাটি গ্রামের একটা বাড়িতে নিয়ে এলো।
বাবা নিজেই নিজের চিকিৎসা শুরু করলেন। একজন কম্পাউন্ডার ছিলেন সাথে। তাকে চিকিৎসা শিখিয়ে দিচ্ছিলেন। গুলিবিদ্ধ উরু থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। একজন ডাক্তার পেলে হয়তো রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যেত এবং বাবাকেও বাঁচানো যেত। বাবা মারা গেলেন ওইদিনই মাগরিবের কিছু পর।
ছোট বোন মাসতুরা বেঁচে থাকলো আরও কিছু সময়। মৃত্যুর সাথে আরো খানিকটা লড়ে পরদিন ২১ এপ্রিল ১৯৭১ সেও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো।
বাবা আর বড় বোন মাহবুবাকে কবর দেয়া হলো নামশঙ্কর বাটি গ্রামেই; আর ছোট বোন মাসতুরাকে দাফন করা হলো গোদাগাড়ির বাসুদেবপুর নানাবাড়িতে|
প্রায় অর্ধেক সদস্য নিয়ে শুরু হলো আমাদের পরিবারের নতুন জীবন-সংগ্রাম। বড় কঠিন এ লড়াই। নতুন দেশ, স্বাধীন দেশ। তবু কঠিন! ভীষণ কঠিন!
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৪, ৯, ৩৫, ৩৯।
ঘ. একাত্তরের বধ্যভুমি ও গণকবর, সম্পাদনা; সুকুমার বিশ্বাস; প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারী ২০০০; পৃ. ২৬৯।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৪৭
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ