শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
বিশ্ববাসী রুখিয়া দাঁড়াও | বাংলার বানী
মুজিব নগরঃ ৭ম সংখ্যা |
১২ অক্টোবর, ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
বিশ্ববাসী রুখিয়া দাঁড়াও
মস্তিস্ক বিকৃতি রোগীর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন পাগ্লামীর তীব্ররতাও বৃদ্ধি পাইতে থাকে তেমনি যতই দিন যাইতেছে মানবেতিহাসের জঘন্যতম নরঘাতক দস্যু উন্মাদ ইহাহিয়ার বণোন্মাদনাও ততই বৃদ্ধি পাইতেছে। অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপাইয়া পড়ার পরিণতি আত্মঘাতি অপমৃত্যু জানিয়াও ইহাহিয়া খান নিজের হাতে এই উপমহাদেশের একটা ভয়াল যুদ্ধের দাবানল ছড়াইয়া দিয়া একটা সর্বনাশের সূচনা না করিয়া ছাড়িবে বলিয়া মনে হইতেছে না। অবস্থাদৃষ্টে এক ধারণা পোষন না করিয়া পারা যায় না যা, ইয়াহিয়া খান আজ যুদ্ধই চায়- ‘তোটাল ওয়ার’, সে চায় সর্বাত্মক যুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্রমাগত মার খাইতে খাইতে দিশাহারা বেসামাল ইয়াহিয়া খান আজ চাহিতেছে আরও বড় যুদ্ধ- সর্ববিদ্বংসী পাক-ভারত যুদ্ধ।
ইসলামাবাদের জঙ্গীশাসক কুল চুড়ামণি ইয়াহিয়ার এই রণোন্মাদনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইবার পর উহাকে ভারতের কারসাজি বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া সে বার বার ভারতের মুন্ডুপাত করিয়াছে, বার বার ভারতের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়িয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানী, জঙ্গীশাহীর এই উন্মত্ত রণপাঁইয়তারারই দাঁতভাঙ্গা জবাব হিসাবে মাসাধিক কাল আগে স্বাক্ষরিত হয় ভারত সোভিয়েত শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা সেদিন সংগত কারণেই প্রত্যাশা করিয়াছিলেন যে এই চুক্তি রণোন্মাদ ইয়াহিয়ার যুদ্ধের খায়েশ চিরতরে মিটাইয়া দিতে সক্ষম হইবে। কিন্তু সাগরে যে ঘর বাঁধিয়াছে শিশিরে আর তার ভয় কি? যে ডুবিতেছে, অতলান্ত সমুদ্রের গভীরে কি ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করিতেছে উহা বিবেচনার অবকাশ তাহার কোথায়। তাই প্রত্যাসন্ন ভরাডুবির মুখে হিংস্র হায়েনার শেষ মরণ কামড়ের মতই নরদস্যু ইয়াহিয়া আজ পরিত্রানের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ইয়াহিয়ার রণপ্রস্তুতি চরমে উঠিয়াছে। বাংলার বাণীর বিশেষ প্রতিনিধি জানাইয়াছেন, জঙ্গীশাহী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোহর, রাজশাহী প্রভৃতি অধিকৃত শহরে ব্যপক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহন করিয়াছে। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার শহরসমূহ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইতিমধ্যেই বিমানবিধ্বংসী কামান বসানো হইয়াছে, স্থাপিত হইয়াছে দূরপাল্লার কামান, খনন করা হইয়াছে সুগভীর পরিখা। ইহারাই পাশাপাশি করোগেটেড টিন সহযোগে নির্মিত হইতেছে বাঙ্কার। চট্টগ্রাম হইতে শুরু করিয়া ফেনী, চৌদ্দগ্রাম কুমিল্লা সব খানেই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা নিজেরদের অবস্থা সুরক্ষিত করিতেছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় কারফিউ জারি হইয়াছে। সীমান্তের দশ মেইল অভ্যান্তর পর্যন্ত জনপ্রাণীশুন্য করার কাজ পুরাদমে চলিতেছে। ক্যান্টনমেন্টগুলিতে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করা হইয়াছে।
এদিকে বিদেশী বার্তা সংস্থার খবরে জানা যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পুরাদমে রণপাঁইয়তারা চলিতেছে। শহরে বন্দরে সর্বত্র ব্লাক আউটের মহড়া চলিতেছে। বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটানো হইয়াছে ভারত সীমান্তে।
শতদ্রু নদীর তীরে ভারী সামরিক যানের চাকা আর পাক সেনাদের পসঞ্চারে বাতাসে বাতাসে উঠিয়াছে ধুলা বালির ঘুর্ণাবর্ত। চম্ব সীমানে সমস্ত বেসামরিক নাগরিকদের দূরে সরাইয়া নেওয়া হইয়াছে।
কিন্তু কেন? ইহা কিসের আলামত? নিঃসন্দেহে যুদ্ধের। সন্দেহতাতীতভাবেই পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর এই রণ পাঁয়তারার লক্ষ্য হইল ভারত। আর এখানেই আসিতেছে আসল কথা। এখানেই নিহিত জঙ্গীশাহীর জঘন্যতম দূরভিসন্ধি।
সারা দুনিয়ার মানুষ জানে, বাংলাদেশের মানুষ পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ ইহাহিয়ার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে একদিকে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার সুমহান সংকল্পে উজ্জীবিত বাঙ্গালী জাতি, অপরদিকে রহিয়াছে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটিকে অস্বীকার করিয়া ইয়াহিয়া খান আগা গোড়াই চেষ্টা চালাইয়াছে ইহার মধ্যে ভারতকে টানিয়া আনিতে। ভারত বার বার সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশের যুদ্ধে, বাংলার মানুষেরই মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার এক যুদ্ধে ভারতের কোন ভূমিকা নাই। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম বলিয়াই বিশ্বের বৃহত্তর গণতন্ত্রী রাষ্ট্র ভারত সৈরতন্ত্রী উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত এই সংগ্রামে বাঙ্গালী জাতির প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাইয়াছে। ইহাতে দোষের কি আছে? চীন যদি সর্বহারা নিপীড়িত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাঙ্ঘাতকতা করিয়া উপনিবেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র যোগাইতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইয়াহিয়ার হাতে অঢেল মারনাস্ত্র তুলিয়া দিতে পারে, তবে ভারতই বা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করিতে পারিবেনা কেন?
কিন্তু বর্বর পশুশক্তির কাছে যুক্তির কোন মূল্য নাই। তার আজ প্রয়োজন যে কোনভাবেই হউক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাঞ্চাল করিয়া দিয়া সারে সাত কোটি বাঙালীকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখা। আর এই জঘন্য উদ্দেশ্য হাছিলের জন্যি ইয়াহিয়া আজ ভারতের বিরুদ্ধে রণপাঁয়তারা চালাইতেছে। একথা একটা বালকেরও বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয় যে যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার সাধ্য পাকিস্তানের নাই। কিন্তু তবু ইয়াহিয়া খান লাফাইতেছে কেন? কাহার ইঙ্গিতে, কিসের জোরে সে নর্তন-কুর্দন করিতেছে?
উত্তরঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্যঃ বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন নস্যাৎ করিয়া দেওয়া। এই উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মার্চ মাসের পরে ইয়াহিয়ার হাতে পৌনে সাত কোটি টাকার মার্কিন অস্ত্র তুলিয়া দিয়াছে। আর এই চৌর্যবৃত্তির পাপকে ঢাকা দেওয়ার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের কন্ঠে উচ্চারিত হইতেছে দুরভিসন্ধিমূলক ‘সংযমের’ ললিত বাণী।
ইয়াহিয়া খান জানে, তার ভাড়াটিয়া বাহিনী ভারত আক্রমন করিলে উহার সমুচিত জবাব দিতে এতটুকু দ্বিরুক্তি করিবে না। এক যুদ্ধ হইবে সত্য সত্যি এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। দাবানলের মত এই যুদ্ধ দ্রুত ছড়াইয়া পড়িলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। আর সে ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবন্ধ করার জন্য সম্ভবতঃ সবার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই জাতিসংঘকে পাঠাইবে শান্তি ও সন্ধির প্রস্তাব লইয়া। হয়তো বা যুদ্ধ বিরতি ঘটিবে। আলোচনা বৈঠকে সামনা-সামনি বসিবে ভারত ও পাকিস্তান। দুর্ভাগা বাংলা তার স্বাধীনতার দুর্বার স্বপ্ন বুকে লইয়া অবহেলায় পড়িয়া থাকিবে একান্তে। বাংলাদেশের উপর হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরিয়া থাকিবে পাক-ভারত সংঘর্ষের উপর। আর এই ভাবেই চাপা পড়িবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম। ইয়াহিয়া খান জানে তার ভাড়াটিয়া সেনাবাহিনী যুদ্ধ করিয়া বাংলাদেশ দখলে রাখিতে পাইবে না। তাই সে আজ উপরোক্ত কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পদানত রাখিতে চায়। আর সে জন্যই চলিতেছে ভারতে বিরুদ্ধে তার চুরান্ত রণসজ্জা।
কিন্তু শান্তিকামী বিবেকবান বিশ্ববাসী কি রণোন্মাদ ইয়াহিয়ার এই মানবতা-বিরোধী রণপাঁয়তারার নীরব দর্শক হইয়া থাকিবে? পাক ভারত যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য, বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতার নিশ্চিত করার জন্য তাদের কি কিছু করণীয় নাই?
এখনও সময় আছে। বিশ্বের শান্তিকামী বিবেকবান সমস্ত মানুষকে আজ এক যোহে বর্বর ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। ভারতের উপর আঘাত হানিবার আগেই সজোরে তার রক্তাক্ত হাত চাপিয়া ধরিতে হইবে- প্রচন্ড চাপে বন্ধ করিয়া দিতে হইবে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ। আর শান্তি, প্রগতি, সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী মানবসমষ্টিকে আজ সর্বশক্তি লইয়া মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত বাঙ্গালী জাতির পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে। কারণ, ইয়াহিয়ার এই সর্বশেষ দুরভিসন্ধির বিজয়ের একমাত্র অর্থ হইবে সুসভ্য মানব জাতির চূড়ান্ত পরাজয়।