You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.05 | কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ? | বাংলার বাণী - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ?
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ৫ অক্টোবর, ১৯৭১

কাহার সঙ্গে আপোষ, কিসের আপোষ?
রাজনৈতিক ভাষ্যকার

স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পাইতেছে, ক্ষয়িষ্ণু পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওয়া ভাড়াটিয়া হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় যতই প্রত্যাসন্ন হইয়া উঠিতেছে, বিশ্বের দশ দিগন্তে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে জনমত যতই বলিষ্টতর ভাষায় সোচ্চার হইতেহে, ইহারই পাশাপাশি ততই ঘণীভুত হইয়া উঠিতেছে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন মহলে সৃষ্ট আপোষ নামক বিভ্রান্তির ধূম্রজাল। এই বিভ্রান্তির কালো মেঘের গর্জনের জবাবে প্রলয় রাত্রির বিক্ষুদ্ধ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার সংক্ষুদ্ধ হুঙ্কারের মতই উদ্ধত প্রশ্নের ভাষায় দিকে দিকে গর্জিয়া ফিরিতেছে দশ লক্ষ শহীদের আত্না আর মুক্তি যুদ্ধে নিয়োজিত কোটি কোটি বাঙ্গালীর কন্ঠস্বর, “কিসের আপোষ, কাহার সঙ্গে আপোষ?” আর সেই সঙ্গে যেন বাতাসে বাতাসে উদ্দামবেগে ভাসিয়া বেড়াইতেছে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠঃ ‘লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর নরমুন্ড লইয়া গেন্ডুয়া খেলায় লিপ্ত জল্লাদের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে না বাংলার মানুষের রক্ত আর স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানী করিয়া আমার কারামুক্তি লাভের”।

স্বাধীন বাংলার নেতা ও জনতার এই প্রত্যয়দৃপ্ত দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠস্বরকে দুর্বিনীত নিয়তির কণ্ঠস্বর বলিয়া ধরিয়া নিয়া বিশ্ববাসী জানিয়া রাখুক, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্টার সুমহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামিবে না। মহান নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি, স্বাধীনতার স্বীকৃতি এবং জন্মভূমির বুক হইতে হানাদার শত্রু সৈন্য বাহিনী প্রত্যহারের আগে এক মুহুর্তের জন্যও স্তধ্ব হবেনা বীর বাঙ্গালীর সমরাস্ত্রের ধ্বনি। দুশমনের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বাঙ্গালী জাতির এই জীবনপণ সংগ্রামের লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করিয়া নিলেই অধিকতর রক্তপাত এড়াইবার জন্য যুদ্ধ বিরতি ঘটিতে পারে, হইতে পারে রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৭২ ঘন্টা ‘ক্র্যাস বেঙ্গলী’ প্রোগ্রাম অনুযায়ী মানবেতিহাসের নজিরবিহীন ভয়াবহ বর্বর গণহত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দাবাইয়া দিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু শক্তি প্রয়োগ আর হিংস্র বর্বরতার কাছে বাঙ্গালী জাতি মাথা নত করে নাই। বরং যতই দিন গিয়াছে, ততই জোরদার হইয়াছে বাংলাদেশের মুক্তি – শত্রুমুক্ত হইয়াছে নয়া নয়া এলাকা। ফলে বেসামাল ইয়াহিয়া দশ লক্ষ বাঙ্গালীর লাশের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজাইয়া লিপ্ত হইয়াছে তাহার জীবনকে বাজি রাখিয়া রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের তস্করসুলভ জুয়া খেলায়। কিন্তু তাতেও হতোদ্যম হয় নাই বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

বরং অধিকতর শক্তি ও উদ্যম লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে হানাদার দুশমনের উপর। ক্রমাগত পর্যুদস্ত হইতে হইতে নিশ্চিত পরাজয়ের ভয়াল বিভীষিকায় আতঙ্কগ্রস্ত-জল্লাদ ইয়াহিয়া আপোষের চোরাবালিতে পথ হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া খুঁজিয়া ফিরিতেছে পরিত্রাণের উপায়। মৃত পাকিস্তানে প্রাণসঞ্চার, পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের বিলীয়মান সৌধটিকে কোন মতে টিকাইয়া রাখা এবং নিজের জঙ্গি মসনদ খাড়া রাখার জন্য সে আপোষের আর্জি লইয়া ইরান তুরানের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিয়াছে, দূত পাঠাইয়াছে তারই ভাষায় “দেশদ্রোহী এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে বিচারাধীন” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে। কিন্তু পূর্ববর্তী খবরেই বলা হইয়াছে, বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু এই আপোষ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করিয়া দিয়া বলিয়াছেন, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর নরমুন্ডু লইয়া গেণ্ডুয়া খেলায় লিপ্ত জল্লাদের সঙ্গে আপোষের কোন প্রশ্নই ওঠেনা। এ,কে ব্রোহীর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব পাঠাইয়াছিলেন যে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরতি ঘোষনা করিয়া পাকিস্তান এক রাখিতে সম্মত হইলে শেখ সাহেবেকে মুক্তি দেওয়া হইবে। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়া একটি বিদেশী বার্তা জানাইয়াছে, “বঙ্গবন্ধু জল্লাদী দূতের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন যে, “বাঙ্গালীর রক্ত আর স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানী করিয়া আমার কারা-মুক্তিলাভের কোন প্রশ্নই ওঠেনা।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিগত মার্চ মাসের ১ তারিখ হইতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনার প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হইলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু সংখ্যক ছাত্র জনতা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু সেই সময় সর্বাত্নক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই ন্যায়তঃ আইনতঃ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন বলিয়া মানিয়া নিয়া প্রতিটি ব্যাপারে অক্ষরে অক্ষরে তাঁহার নির্দেশ পালন করিতে থাকে। ৬ ই মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ১০ ই মার্চ ঢাকায় নেতৃত্ব সম্মেলন আহ্বান করেন। ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষনে উহার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলনে, ‘কার সঙ্গে বৈঠক, কিসের বৈঠকে বসিব? যে আমার মানুষের বুকে গুলি চালাইয়াছে তার সাথে?’ সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়াছি রক্ত আরও দিব, কিন্তু বাংলার মানুষকে এবার মুক্ত করিয়া ছাড়িব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

তারপর বহুদিন গত হইয়াছে, পরস্থিতি, প্রেক্ষিত সবকিছুই আমূল পাল্টাইয়া গিয়াছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙ্গালী জাতি লিপ্ত হইয়াছে মুক্তিযুদ্ধে। বাঙ্গালীর আত্নপ্রতিষ্টার আন্দোলন বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খান হিংস্র বর্বরতায় হত্যা করিয়াছে দশ লক্ষ মানুষ, নিরাশ্রয় গৃহহারা দেশান্তরী করিয়াছে লক্ষ লক্ষ নর নারী – শিশুকে। এই হত্যাকান্ড ও রক্তপাতের তুলনায় ৭ ই মার্চের পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিমা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। তবু সেদিনের সেই বীর শহীদের চাপ চাপ রক্তের উপর দিয়া হাটিয়া গিয়া বঙ্গবন্ধু জল্লাদের সঙ্গে বৈঠকে বসিতে রাজী হন নাই। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং ক্ষতিপূরণ দানের আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে সম্মত হন নাই। আজ দশ লক্ষ বাঙ্গালীর রক্তের নদী সাতরাইয়া বঙ্গবন্ধুরই মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙ্গালী জাতি এবং তাঁহার অনুসারীরা জল্লাদ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপোষ করিতে যাইবে এমন কথা যারা চিন্তা করেন, বা এমন বিভ্রান্তিকর ধারণাকে যারা ক্ষনিকের তরেও মনে ঠাই দেন, তারা আহম্মকের স্বর্গেই বাস করিতেছেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যে কোন মতেই আপোষ হইতে পারে না, বাংলাদেশ সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইহা জানাইয়া দিয়াছেন। বিগত ৬ই সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক বাংলার বাণীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁহার পূর্ব ঘোষনার পুনরাবৃত্তি করিয়া বলেন – ইয়াহিয়া খানকে ‘সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের মুক্তি দিতে হইবে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হইবে, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়া নিতে হইবে এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে’। এই সব দাবী পূরণের পরই বিবেচনা করা হইবে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আমরা আলোচনায় বসিব কি না! গত ২৫ শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষনেও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন। একই দিনে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘আমাদের কথা অতি সুস্পষ্ট। বৃহৎ শক্তিবর্গের গোষ্টীগত স্বার্থরক্ষা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে বাংলাদেশের মানুষের রক্ত স্রোতকে ব্যবহার করিতে দেওয়া হইবে না। পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য”। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মহল বিশেষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমাদিগকে যদি বাঁচিয়া থাকিতে কিছু দিতে না পারেন, তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদিগকে মরিতে দিন”।

নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের চার্চ সেন্টারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাকালে গত শুক্রবার জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষ হইতে সমগ্র বিশ্বকে জানাইয়া দিয়াছেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং দখলদার বাহিনীর অপসারণ ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধানই বাংলাদেশের জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হইবে না।

এ দিকে গত শনিবার সৈয়দ নজরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত বাংলাদেশ মন্ত্রী সভার এক বৈঠকের পর ঘোষণা করা হইয়াছে যে, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা বিশ্ব বাসীর সাহায্য ও সহযোগীতা চাই’।

সুতরাং এ ব্যাপারে কোন জল্পনা কল্পনা বা সন্দেহের অবকাশ নাই যে মৃত পাকিস্তানকে জীবিত করিয়া বাঙ্গালী জাতি কোন অবস্থাতেই ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোনও আপোষে রাজী হইবে না। ইহার পরে আসে রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন। এ ব্যাপারেও বাঙ্গালী জাতির বক্তব্য অতি সুস্পষ্ট।

রাজনৈতিক সমাধান বলিতে তারা বোঝে অধিকতর রক্তপাত এড়াইয়া আলোচনার টেবিলে বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন। ইয়াহিয়া যদি রক্তপাত এড়াইতে চাহে, সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি পূর্ব শর্ত পূরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের দারোদঘাটিত হইতে পারে না। ইহা ছাড়া রাজনৈতিক সমাধানের নামে অন্য কোন গোজামিল বাংলার মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হইবে না।

ইহা কিসের আলামত
আর হইবে না জানিয়াই, মৃত পাকিস্তানকে কবর খুড়িয়া উঠাইয়া আনিয়া আবার উহাতে প্রাণসঞ্চারে বাঙ্গালী জাতি রাজী হইবে না বলিয়া স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করিয়াই ইয়াহিয়া খান আবার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অস্ত্র শাণাইতে শুরু করিয়াছে। একটি বিদেশী বার্তা প্রতিষ্টান জানাইয়াছেন, বঙ্গবন্ধুকে বিচার প্রহসনের মাধ্যমে যে শাস্তি দেওয়া হইবে উহা যাতে বিশ্বজনমতকে বিক্ষুদ্ধ করিতে না পারে তজ্জন্য প্রবল প্রচারণা চালাইবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিদেশস্থ উহার কূটনৈতিক মিশনগুলিকে নির্দেশ প্রদান করিয়াছে। এক সার্কুলারে জঙ্গীশাহী সংবাদপত্র জগতকে এ ব্যাপারে প্রভাবান্বিত করার জন্য মিশনগুলির প্রতি নির্দেশ দিয়াছে। সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানে ঢাকা হইতে ৪ জন সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষক, ২ জন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দিয়াছে। খবরে প্রকাশ, ঢাকা ত্যাগের আগে এই সব “সাক্ষীকে” তালিম দেওয়া হইয়াছে। সাক্ষ্যদানকালে তাদের বলিতে হইবে যে শেখ মুজিব নিজেই অবাঙ্গালীদের হত্যা করার হুকুম দিয়াছিলেন। ‘সাক্ষীদের’ কেহ কেহ ইতিমধ্যেই ঢাকা ফিরিয়া আসিয়াছে, অন্যরা এখনও পশ্চিম পাকিস্তানে সুরক্ষিত বন্দিশালায় আটক রহিয়াছে। ইহারা কোথায় আছে, সে কথা তাদের পরিবার পরিজনকেও জানিতে দেওয়া হয় না।

২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
গত মঙ্গলবার জঙ্গীশাহীর এক ঘোষণায় বলা হয় যে, শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনে এ পর্যন্ত মোট ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হইয়াছে এই ঘোষনার উদ্ধৃতি দিয়া রাওয়ালপিন্ডি হইতে এ,পি, এ, জানান যে, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন চলিতেছে। ঘোষণায় বলা হয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার অভিযোগে বিগত ৭ ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু গোপন বিচার পুনরায় শুরু হইয়াছে। জঙ্গীশাহী জানায় যে, জনাব এ, কে, ব্রোহী, তিনজন সহকারী মেসার্স গোলাম আলি, আকবর মির্জা এবং গোলাম হোসেনের সহায়তায় শেখ সাহেবের পক্ষ সমর্থন করিতেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদপত্রে শেখ মুজিবের মুক্তির সম্ভাবনা সমপর্কে জল্পনা কল্পনা চলার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সরকারী ঘোষণা প্রচারিত হয়। শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া জনাব ব্রোহী পিণ্ডি ফিরিয়া ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করার সাতদিন পরে ৭ই সেপ্টেম্বর বিচার প্রহসন পুনরাম্ভ হয়। ঘোষণানুসারে দেখা যায় ১১ই আগস্ট হইতে ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন মুলতবী ছিল। কিন্তু উক্ত সময়ে জাতিসঙ্ঘে জঙ্গি শাহীর প্রতিনিধি আগাশাহীসহ সরকারী কর্মকর্তারা বলিয়াছিল যে, “বিচার চলিতেছে”। শেখ সাহেব কোথায় আছেন ঘোষণায় সে সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। তবে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী তিনি লায়লাপুর জেলে আটক আছেন।

গুজব
এদিকে লন্ডন হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, সেখানে এই মর্মে জোর গুজব চালু হইয়াছে যে, শেখ সাহেবকে শিগগিরই মুক্তি দেওয়া হইবে। এমন কি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে আলোচনার আগেই তাহাকে মুক্তি দেওয়া হইতে পারে। অপর এক খবরে বলা হয়, ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অশীতিপর পিতামাতাকে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হইতে পারে।

বিচার বন্ধ করো
সোভিয়েত সাংবাদিক ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানাইয়াছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানেরও আহ্বান জানান। সোভিয়েত শান্তি কমিটি এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ হইতেও অনুরূপ আহ্বান জানানো হইয়াছ।

সিংহলী এম,পি,র উদ্যোগ
কলম্বো হইতে ডি,পি,এ জানান, সিংহলের ক্ষমতাসীন বামপন্থী যুক্তফ্রন্টভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ ভি, গুনবর্ধন জানাইয়াছেন যে, তিনি শেখ মুজিবের দাবীতে পার্লামেন্ট সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করিতেছেন।

বিচার প্রহসন
“প্রাভদায়” প্রকাশিত সোভিয়েত আফ্রো-এশিয়ান সংহতি কমিটির এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের বিচারকে বিচারের নামে প্রহসন বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়। প্রাভদায় বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানও দাবী করা হয়।