You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.28 | বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া না হইলে ইয়াহিয়ার সকল উমেদারী ব্যার্থ হইতে বাধ্য | বাংলার বাণী - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া না হইলে ইয়াহিয়ার
সকল উমেদারী ব্যার্থ হইতে বাধ্য

(নিজস্ব ভাষ্যকার)
মুক্তি সংগ্রামের ছয় মাস পূর্ণ হইয়াছে।পঁচিশে মার্চের সেই ঘন-কালো অন্ধকার রাত্রি হইতে বাংলাদেশ আজ উত্তীর্ণ হইয়াছে নতুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রক্তোজ্জ্বল সুপ্রভাতে।নবপ্রভাতের আর বিলম্ব নাই।আক্রমণকারী উপনিবেশবাদী জঙ্গীশাহীর নৃশংস হীন আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করিয়াছেন আমাদের দুর্জয় মুক্তিযোদ্ধারা।মুক্তিসংগ্রামে আত্মহুতি দিয়াছেন লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী,রক্তস্রোতে প্লাবিত হইয়াছে বাংলার পবিত্র মাটি।বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বজ্রকঠিন শপথে আজ একটি মাত্র আকাঙ্ক্ষাই সোচ্চার।এই আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার চিরন্তন মন্ত্র,এই আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি।জঙ্গীচক্র বাংলাদেশে জঘন্যতম আক্রমণ চালাইয়া ক্ষান্ত হয় নাই,লক্ষ লক্ষ নিরীহ আসহায় নর-নারীকে হত্যা করিয়াও তাহার নিবৃত্ত হয় নাই।জঙ্গী চক্রের সীমাহীন ঔদ্ধত্য সকল সম্ভাবনার সীমারেখা ছাড়াইয়া গিয়াছে। তাহারা বাংলার মানস সন্তান অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন অনুষ্ঠান করিবার দুঃসাহস প্রদর্শন করিয়াছে।কাণ্ডজ্ঞানহীন বাস্তব নীতিবিবর্জিত বিংশ শতাব্দীর জঘন্যতম নরপশু ইয়াহিয়া বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করিয়া বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার প্রহসন চালাইয়াছেন।

সাম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ‘হিজ মষ্টোরস ভয়েস’ সংবাদপত্র সমূহ একটি খবর প্রকাশ করিয়াছে।এই খবরে বলা হইয়াছে,বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত গোপন বিচার শেষ হইয়াছে।ইতিমধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়ার পশুসুলভ আচরণের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে ধিক্কার ধ্বনি উচ্চকিত হইয়া উঠিয়াছে।সাম্প্রতি কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা এক বাক্যে পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী নৃশংস গনহত্যার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন। তাহারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি তীব্র নিন্দা জানাইয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবী করিয়াছেন বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা।সাম্প্রতি নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়াছে,সে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবী করিয়াছেন।

রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন, বাঙালীদের সাহায্য করা বিশ্ববাসীর নৈতিক দায়ীত্ব।

মৃত পাকিস্তানের হত্যাকারী ইয়াহিয়া এখন মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হইয়াছে।৭২ ঘন্টার মধ্য বাঙালীদের প্রতিরোধ ভাঙ্গিয়া দিয়া বাংলার প্রাণশক্তিকে ধ্বংস করিয়া দিয়া দম্ভোক্তি ইয়াহিয়ার সেনাধ্যক্ষ টিক্কা খান করিয়াছিলেন সেই টিক্কা খান পরাজয়ের কালিমা মুখে লইয়া চোরের মত পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন।

ইয়াহিয়ার বাদশাহী খোয়াব চিরতরে মিলাইয়া গিয়াছে শুন্যে।এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কি হইবে ইতিমধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হইয়া গিয়াছে।ইসলামাবাদের সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মহলের ধারণা,শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের রায় ঘোষণা করা হইবে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া এই রায় ঘোষণার পর নাটকীয় কোন ঘোষণা করিতেও পারে।ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষেরা স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন,বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দেওয়া না হইলে এবং বাংলাদেশের মাটি হইতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের প্রত্যাহার করা না হইলে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসার কোন সম্ভাবনা নাই।আর ইয়াহিয়ার সাধের পশ্চিম পাকিস্তানও সর্বনাশের এই লেলিহান অগ্নিশিখা হইতে পরিত্রাণ পাইবে না।

দখলকৃত এলাকার পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটির উপর মারাত্মক পাল্টা আক্রমণ শুরু করিয়াছেন বাংলার তরুন যোদ্ধারা।গেরিলা আক্রমণের হাত হইতে রাজধানী ঢাকা শহরও আজ আর নিষ্কৃতি পায় না।প্রতিদিন হানাদার যোদ্ধারা তাহাদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করিতেছে।মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যর্থ বুলেট স্থির লক্ষ্যে ছুটিয়া যাইয়া নরপশুদের বক্ষভেদ করিয়া চলিয়াছে প্রতি মুহূর্তে।

ইয়াহিয়ার সংকট আজ সীমাহীন। এই মারাত্মক সংকট হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য ইয়াহিয়া ও তাহার সহচরেরা মস্কো, ওয়াশিংটন, তেহরানসহ বহু রাজধানী পরিক্রমা করিয়াছে।কিন্তু আসার আলো কোথাও নাই।

এক্ষণে আপোষমূলক আলোচনা চালাইবার জন্য ইয়াহিয়া ধর্না দিয়াছে ইরানের শাহের দরবারে। সাম্প্রতি তেহরানে গিয়া ইয়াহিয়া খান নিজে এই আপোষের অভিমত ব্যক্ত করিয়াছে।কিন্তু ইরানের শাহ ইয়াহিয়াকে কোন আশার বাণী শোনাইতে পারেন নাই।

বাংলাদেশের নেতারা সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান না করিলে আলোচনার কোন প্রশ্নই উঠে না।

কূটনৈতিক মহলের ধারণা,ইয়াহিয়ার সকল উমেদারী ব্যর্থ হইতে বাধ্য,যদি না বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।

জানা গিয়াছে,ভারত ইরানের শাহকে জানাইয়া দিয়াছে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের নির্বাচিত গননেতারাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। ভারত এই ব্যাপারে কিছুই করিতে পারেনা।অতএব, ইয়াহিয়া যদি সত্যই আপোষ চায় তবে তাহাকে বাংলাদেশ সরকারের সহিত আলোচনায় বসিতে হইবে।বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করিয়াছেন, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের বাস্তব সত্য।এই সত্যকে স্বীকার না করিয়া কোন আলোচনা হইতে পারে না।

পাকিস্তানের মারাত্মক আর্থিক সংকট, ধ্বংসোন্মুখ অর্থনীতি, বেলুচিস্তান,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুর ব্যাপক গন অসন্তোষ এবং সম্ভাব্য সশস্ত্র গন অভ্যুত্থান আজ অক্টোপাসের মত ঘিরিয়া ধরিয়াছে ইসলামাবাদের সাধের সিংহাসনকে।

ইরান অথবা পাকিস্তানের অন্যান্য তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্র এই দুর্দিনে জঙ্গীশাহীকে বাস্তব সাহায্য দিতে সক্ষম নয়।চীনের ভূমিকা আরো অস্পষ্ট।

জানা গিয়াছে,ইরান জানাইয়া দিয়াছে ইয়াহিয়ার পক্ষে এখন নতি স্বীকার করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়া কোন ফল হইবে না।

জাতিসংঘের চলিত অধিবেশনে বাংলাদেশ সমস্যা প্রধান আলোচ্য বিষয় বলিয়া কূটনৈতিক মহল আশা প্রকাশ করিয়াছেন। এবং বলাবাহুল্য ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হইবে।

এই অবস্থায় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলিয়া জেনারেল ইয়াহিয়া ছটফট করিয়া মরিতেছেন। কিন্তু ইতিহাসের রায় ইয়াহিয়ার পাঠ করা উচিত। দেওয়ালের লিখন আজ সুস্পষ্ট-স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ এই শতাব্দীর ঘটনাবহুল ইতিহাসের আর একটি বাস্তব সত্য।
——————————–