You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম

রক্তের একটা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে- এ সত্য আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে । কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও হানাদারমুক্ত হতে পারেনি আজও । সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা রাহুগ্রাসের মত বাংলাদেশ আঁকড়ে আছে ।
এই পশ্চিমা নাগপাশ থেকে জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করতে হবে সর্বাগ্রে চাই একতা । মুক্তিযোদ্ধারা যেমন আজ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে একতাবদ্ধ হতে পেরেছে তেমনি জনগণকেও একতাবদ্ধ হতে হবে । প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে একটা দেশের মুক্ত আন্দোলন তখনই সার্থক হয় যখন সে দেশের জনগণ সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারে । তার চেয়েও বড় কথা, আমরা একটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি । যে দেশের সৈন্যরা আমাদের ঘর পুড়িয়েছে, মা-বোনের ইজ্জত ছিনিয়েছে, বাবা-ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে । এক কথায় বলতে গেলে সোনার বাংলাকে ওরা শ্মশান করেছে । কাজেই সে কথা মনে রেখেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে । স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জাতীয় কর্তব্য ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজ যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল রাজনৈতিক মতানৈক্য । অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এতে আন্দোলন বিঘ্নিতই হবে । আজকে জাতির যুগসন্ধিক্ষণে দেশমাতৃকার মুক্তিই প্রতিটি দলের সমর্থকদের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত । রাজনৈতিক মতামতের সময় অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু আজকের এই পরম মুহূর্তকে যদি কোন্দলের দ্বারা অবহেলা করা হয় তাহলে আগামী দিনের বংশদররা কিছুতেই আমাদের ক্ষমা করবে না ।
কে কতটুকু ক্ষমতা আকড়ে আছে এই সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙ্গে জাতির দুর্দিনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এক কাতারে । মানুষের চেয়ে মানুষের কর্ম বড় । তাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় । ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় জাতির অঙ্গন থেকে ডাস্টবিনে, তা এই পৃথিবীর শুরু থেকে হয়ে আসছে ।
জনতাই দেশের মালিক । দেশ স্বাধীন হলে কোন দল কিংবা কোন ব্যক্তি দেশের প্রকৃত বন্ধু তার বিচার করবে দেশের জনতা, তাই আমাদের উচিত জনতার সামনে সেই দিনটি উপস্থিত করা । সেই শুভদিনটির জন্য দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হতে প্রতিটি দলের প্রতিটি সমর্থককে এগিয়ে আসতে হবে । এ সংগ্রামে যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তবে বিশ্বে বাংলাদেশেকে নিয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে অচিরেই বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করা যাবে ।
বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যুবকের মুখে শোনা যায়, “আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশী অতএব আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেব কেন?” অত্যাচার হয়েছে একথা সত্য । কিন্তু এমন ধারণা পোষণ করে এখানে যারা মুক্তিসংগ্রাম থেকে দূরে সরে আছে তাদের উদ্দেশ্যে আমরা একথাই বলব যে তারা ভুল ধারণা পোষণ করে এখনো তুচ্ছ সংকীর্ণতার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে । পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর স্বার্থবাদী শাসক চক্র হিন্দুদেরকে সংখালঘু বলে চিরদিন দাবিয়ে রেখেছে । ক্ষমতার রাজনীতিতে পাক স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে । অথচ তাঁর প্রথম থেকেই যদি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেত । আজো তেমনি ভুলের বশবর্তী হয়ে কিছু সংখ্যক যুবক নিরপেক্ষকের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, এ সত্যি দুঃখজনক ঘটনা ।
বাংলাদেশে যখনি ন্যায়ের দাবিতে জনতার কন্ঠে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তখনি স্বার্থবাদী শাসক সম্প্রদায় ভারতের সঙ্গে বিরোধ নয় তো ধর্মের নামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে জনতার কন্ঠকে স্তব্ধ করেছে । এর জন্য বার বার বলি হয়েছে নিরীহ মানুষ । বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার মাটি । কিন্তু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মুখোশ খুলে গেছে এবার । তাই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ লক্ষ লক্ষ শহীদের বেদীমূলে দাঁড়িয়ে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়েছে । পাক সাম্প্রদায়িক সরকারের সর্ব প্রকারের উস্কানি ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলার সংগ্রামী জনতা ।
বাংলার মানুষ আজ বাঙ্গালী । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নয়, তারা বাংলার মানুষ । জাতি ধর্মের উপরে যে মানব ধর্ম সেই মহান ধর্মে উদ্ধুদ্ধ আজ বাঙ্গালী জাতি । লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সে দেশ শুধু মুসলমানের নয় । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবার দেশ বাংলাদেশ ।
তাই আসুন আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হানাদার শেষ করে পূত পবিত্র করে গড়ে তুলি জননী জন্মভূমী বাংলাদেশকে ।