You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশ সরকার ও তার ব্যপক সাফল্য

আমাদের স্বাধীন সরকার গঠন করার পর মাত্র কয়েকটি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে । দেশের মাটি থেকে একটি বিদেশী শোষকগোষ্ঠির পোষা পেশাদারী সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার কর্তব্যই আমাদের প্রাথমিক এবং মৌলিক কর্তব্য । এই কর্তব্য সম্পাদনের প্রাথমিক পর্বে আমাদের শক্তি ছিল সীমিত এবং শত্রুপক্ষের তুলনায় একেবারে নগণ্য । বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ সহ পুলিশ এবং আনসারের সামান্য শক্তিই ছিল আমাদের মুলধন । এই সামান্য শক্তি নিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো তাকে আজকের বিশ্লেষনে এক অভাবনীয় সাফল্যের সূচনার দারপ্রান্তে পৌছেছে বলে বলতে হয় । কারণ আমাদের সমস্যা ছিলো অস্ত্রের এবং অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী সুসংহত বাহিনীর । বাহিনী বলতে যে তাৎপর্যময় একটি সামরিক শক্তিকে বোঝায় তা যেমনি ছিলো না, তেমনি ছিলো না প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছাড়াও সামরিক যানবাহন এবং সামরিক প্রয়োজনে যোগাযোগের ব্যবস্থা । অপর পক্ষে শত্রু সেনাদের ছিল আধুনিক যুদ্ধোপযোগী সবকিছুই এবং কয়েকটি রাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ ও তাদের নিশ্চিত রেখেছে ভবিষ্যত্‍ সম্পর্কে ।

বস্তুতঃ এই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের অতি সামান্য সামরিক শক্তি ছাড়া ছিলো সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের নৈতিকসহ সার্বিক সমর্থন ।

এই কয়েকটি মাসের ব্যবধানে বহুমুখী সমস্যার মধ্য দিয়ে এগুতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশের জনগণকে । একদিকে যেমন সক্ষম যুবকদের এক বিরাট অংশকে যুদ্ধবিদ্যায় ট্রেনিং দিতে হয়েছে অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে । এছাড়া দ্রুত প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র সমস্যার সমাধানও করতে হয়েছে । সর্বোপরি বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে জেগে ওঠা স্বাধীনতার দুর্বার বাসনাকে রক্ষা করতে হয়েছে অতি সন্তর্পণে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরা এবং সমর্থন লাভ ।

এই সমস্ত বহুমুখী সমস্যা সত্ত্বেও আমাদের যুদ্ধ সাফল্য আজ বিশ্বের কাছে এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়িয়েছে ।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপটি যেমন চিনতে পেরেছে তেমনি সর্বক্ষেত্রে নৈতিক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেছি আমরা, অন্যদিকে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের সমর্থনকারী দেশগুলো আমাদের বক্তব্যের মৌলিকত্ব অনুধাবনের সঙ্গে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে আমাদের স্বার্থের অনুকূলে মনোভাবও প্রকাশ করেছে । আমাদের সংগ্রামের এই দিকটিতে বিশেষ সাফল্য ইয়াহিয়া চক্রকে এক বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে । প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশই আমাদের দূতাবাসের কার্যোপযোগী অফিসগুলো স্থাপিত হয়েছে । এগুলোর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সাথে বিশ্বকে পরিচিত করে তোলা সহজ হয়েছে । সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের দ্রুত সাফল্যের তথ্য এবং ইয়াহিয়ার বর্বরোচিত অত্যাচারের রূপটি বিশ্বের জনগণের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে । এক কথায় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সর্বতোভাবেই আমাদেরই সাফল্য লাভ সম্ভব হয়েছে ।

বর্তমান অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হচ্ছে আমাদের শত্রুনিধন অভিযান । একটি সামরিক বিষয় এবং সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আজ তর্কাতীতভাবে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । পাকিস্তানী সেনাদের নিহতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে গত এক মাসেই তা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশী । চলতি মাসের হিসাবে এখন দৈনিক গড়ে দু’শোর মত পাকিস্তানী সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে । সার্থক ভাবে গেরিলা যুদ্ধ কায়দা রপ্তের পর আমাদের গেরিলাদের ব্যাপক তত্‍পরতা শুরু হয়েছে এবং তা এখন তীব্রতর হয়ে শত্রুবাহিনীকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে । শত্রুবাহিনী নিজেদের নিয়মিত সৈন্যদের জীবনের ওপর ঝুঁকি না নেয়ার জন্যে যে রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলো তাও ভেঙ্গে পড়ছে । দলে দলে রাজাকাররা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করছে । অগত্যা পাক সেনাদের রাজাকারদের ওপর নির্ভরশীলতা ছেড়ে দলে নিজেদের পত্যক্ষ সংঘর্ষে এসে লড়তে হচ্ছে এটাই পাক সেনাদের বেশী হারে নিহত হবার কারণ । আমাদের সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিতেই আমাদের সাফল্য সবচেয়ে বেশী । গেরিলা তৎপরতার এতো বড় রকমের সাফল্য এর আগে অন্য কোথাও দেখা যায়নি । আমাদের বাহিনীতে সদ্য সামরিক শিক্ষা সমাপ্তকারী অফিসাররা যোগদান করেছেন এরই পত্যক্ষ ফল হিসাবে মুক্তিবাহিনী এই সাফল্য লাভ করছে ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!