You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.27 | বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ | বাংলার মুখ - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ
সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ (১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা)
তারিখঃ ২৭ আগষ্ট, ১৯৭১

জাতিসংঘ নামে বিশ্বের বুকে একটা আন্তর্জাতিক বিশ্ব সংগঠনের অস্তিত্ব আছে-একথা সংগ্রামী বাংলার মানুষ আজ আর বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন তারা জানতো বিশ্ব মানবতার জন্য এ নামে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লীগ অব ন্যাশনস এর পরিবর্তে, সংশোধিত রূপ এই জাতিসংঘ মানব কল্যাণের জন্য অত্যচার নির্যাতন ও মানবীয় শোষণের অবসাণের জন্য কিছু করা অন্তত করার দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব হয়েছে এ বিশ্বাস বাংলাদেশের জনগণের ছিল। কিন্তু আজ আর তারা এ কথা বিশ্বাস করতে চায় না আর চাইবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

কেননা জাতিসংঘের সফলতার দিকটার চাইতে দূর্বলতার দিকটা, ব্যর্থতার দিকটা অত্যাচারিত, শোষিত, বঞ্চিত, সংগ্রামী বিশ্বের জনতার কাছে বেশি প্রকট হয়েছে। যে আশা নিয়ে , আকাংখা নিয়ে, সাহায্যের তীব্র ইচ্ছা নিয়ে সর্বোপরি মানবতার সেবা পাবার আগ্রহ নিয়ে যখনই তারা হাত বাড়িয়েছে, তখনি জাতিসংঘের সদর মহলের প্রবেশপথে কারো পর্দা ঝুলে পড়েছে। তাহা রিক্তহস্তে করুণভাবে ফিরে এসেছে। বিশ্বের এই সংগ্রামী মানুষেগুলোর সাথে বাংলার সংগ্রামী নরনারীও আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদর দরজার কাছ থেকে তেমনি ফিরে এসেছে আসছে। হয়তো এমনি আঘাত পেয়ে আরও বহুবার ফিরে আসতে হবে।

মূলতঃ কার্যদৃষ্টে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জাতিসংঘ নামে আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের গুটিকয়েক বড় শক্তির বৈঠিকখানা বিশেষ। চা খাওয়, আড্ডা দেয়া, প্রোয়জনবোধে তাস পাশা খেলার সুন্দর ব্যবস্থা বিশেষ এই জাতিসংঘের সদর দফতরটি। তার কর্মকর্তারা বৃহৎ শক্তিগুলোর হর্তা-কর্তা আড্ডাবাজদের হুকুমের কর্মচারী বিশেষ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কাছ থেকে সংগ্রামী বাংলাদেশ কি আশা করতে পারে। পক্ষান্তরে বিশ্বের দুটি ক্ষমতার রাজনীতির নেশায় এমনভাবে মজেছে যে, মানবদরদি, শোষণ-নির্যাতনের বিরোধী বলে পরিচিত এ দুই রাষ্ট্রের বিবেকের সকল অনুভুতির যেন বিলুপ্তি ঘটেছে। অন্যরা আজ মেরুদন্ডহীন প্রাণীবিশেষ। আত্নবিশ্বাস, আত্নশক্তি, ন্যায়বোধ বলতে যে তাদের কিছুই নাই।

এদিকে আজকের বিশ্বের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যার শক্তি নাই, সম্পদ নাই, আত্নবিশ্বাস নাই, সম্মান ও মর্যাদাবোধ নাই তার কদর নিজের কাছে তো নাই, পরের কাছে তো মোটেও নাই। সম্পদ ও ক্ষমতা এ দুটোই আমোঘ অস্ত্র। এ দুটোর নির্দেশেই সবাই উঠানামা-বসা-শোয়া করছে। জাতিংঘও তাই বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্রীড়নক হয়ে কাজ করুক, তাতে তাদের মেরুদন্ড বিবেকহীন অস্থিমজ্জায় বাধে না। বাধবে না।

জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর বাংলাদেশ নিয়ে খেলার অবস্থাদৃষ্টে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, নিজেদের ক্ষমতা ছাড়া তাদের মুক্তি সম্ভব নয়-স্বাধীনতা কখনো আসবে না। স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের অভিমতও তাই। ইতিপূর্বেই তারা এ কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।

অবশ্য এই ঘৃণ্য, মানবতাবিরোধী মানসিকতার বিরুদ্ধে যে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বিবেকবান মানুষ নাই, তা নয়। তারাও কাজ করছেন। করবেন। তারাই একমাত্র বাংলাদেশের জনগণের বাইরের সম্পদ।

মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমি থেকে পাক হানাদারদের একে একে খতম করেছে। করবে। তাদের শেষ অপচেষ্টা শীঘ্রই তাদের মৃত্যুমুখী আঘাতে সম্পূর্ণ নির্মূল হবে-এ দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মনিষ্ঠা তাদের রয়েছে।

সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বের বুকে কণিষ্ঠতম জাতি হবে, শোষক গোষ্ঠীকে সাম্রজবাদ ক্রীড়নক শক্তিগুলো উৎখাত করবে বিশ্বের বুক থেকে এ কামনা বাঙংলার প্রতিটি মানুষই করেছে। আর এই জন্য সার্বিক সাফল্য তাদের জন্য সুনিশ্চিত।