সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলার স্বাধীনতা
অশ্রু আর রক্তে
তাজউদ্দীন
অশ্রু আর রক্ত । এরই বিনিময়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারী স্বাধীনতা সংগ্রামে । কালের গতির সাথে সাথে স্বাধীনতার সোনালী সূর্যের ক্ষণটি নিকটতর হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য চাই আরো রক্ত, আরো অশ্রু, আরো আত্মত্যাগ, আরো জীবন ও কষ্ট ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গত বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে এই অভিমত ব্যক্ত করেন । আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল সংগ্রামী প্রতিটি নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি । এই পর্যায়ে শত্রুসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চাই শহীদদের রক্তের উপযুক্ত মর্যাদার বিনিময়ে সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আত্মপণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদের উত্খাত এবং অসাম্য ও সুবিধা ভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম । আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো । সমাজের যে ভবিষ্যত্ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন সেখানে সকলে সমাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবে ।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হিসাবে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়ার কথা বলেন । জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানবো আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখোমুখি হবেন ।
জনাব তাজউদ্দীন বক্তৃতায় এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তির কথা উল্লেখ করেন । তিনি বলেন, মনে হয় মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখনো তাঁরা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশী, এটা শোচনীয় । কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উথ্থাপন করেন তখন আমরা শিউরে না উঠে পারি না । এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেয়া হয়েছে । পর্বত প্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও তার ব্যপক বাস্ত্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে । পাকিস্তানী সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাঁদেরকে হাতবদল করা হবে । সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন । আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশী দেরী নাই ।
প্রসঙ্গত জনাব তাজউদ্দীন আমেরিকার কথা উল্লেখ করেন । বাংলাদেশের এই চরমতম ক্ষণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন উপমহাদেশের তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান, এই হলো তাঁর জিজ্ঞাসা । তিনি বলেন, তাঁর দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমনকি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক ? লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তাঁর প্রশাসন নিন্দা করেনি । এমন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তাঁরা লাভ করতে চান, জানি না । তবে এতে আমাদের সঙ্কল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না । সে সঙ্কল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ।
জনাব তাজউদ্দীন মুক্তিসংগ্রামের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সেকথা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন । মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে, এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে । জলে স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর । নদী পথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত । ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে । আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনোবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে ।
তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাক সামরিক হুঙ্কার দিশাহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করেন । তিনি বলেন ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা নিজেদের ভবিষ্যত্ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতিগ্রস্ত । বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাঙ্গনের দিকে । এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে । তারা আশা করে যে, এমন একটি যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবন্ধ হবে । মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে । কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না । এবং এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পাকিস্তানের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে ।
সর্বশেষে জনাব তাজউদ্দীন জনগণকে মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চুড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলার আহবান জানান । যেসব সরকারী কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাদেরকে সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযোগ নেয়ার আহবান জানান । শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছে তাদের শেষবারের মত তিনি জানিয়ে দেন যে, বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন । অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণতি এক হবে আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু ।