শিরোনামঃ ১৩১। একাত্তুরের মার্চ মাসের ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের ভাষ্য
সূত্রঃ প্রচার পুস্তিকাঃ পাকিস্তান দূতাবাস, ওয়াশিংটন
তারিখঃ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.
পাকিস্তানে ফেডারেল হস্তক্ষেপ
ক্রমান্বয়ে
পরিচিতি
.
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ,ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা লুটপাট এবং চরমপন্থি গ্রুপের অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার মুখে আইনশৃঙ্খলা দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানি ফেডারেল সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে।সামনের পাতাগুলোতে ক্রমান্বয়ে ঘটা মার্চ মাসের ঘটনাসমুহ ফেডারেল বাহিনীর পাল্টা কর্মকান্ডের সাক্ষ্য বহন করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ঘটনাগুলোর জন্ম ডিসেম্বর ৭,১৯৭০ সালে,যখন ৫৩ মিলিয়ন পাকিস্তানি গনপরিষদ নির্বাচিত করতে ভোট দিতে গিয়েছিল।ভোট প্রক্রিয়া ছিল গোপন এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার নীতি “এক ব্যাক্তি এক ভোট” এর উপর প্রতিষ্ঠিত। “দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধারের” অঙ্গীকার সফলভাবে সম্পন্ন করবার জন্য ইয়াহিয়া খান এই ভোটের আয়োজন করেন। এই অঙ্গীকারকে কাজে লাগানো হয় মার্চ ৩০,১৯৭১ সালে,লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও)(LFO),যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত ছিল নির্বাচন এবং ব্যালটিঙ্গের জন্য মেশিন বহন।
১,৫৭০ জন প্রার্থি গণপরিষদের ৩১৩ টি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। দেশের ৫টি প্রদেশের ২৫টি ভিন্ন রাজনৈতিক দল এছাড়াও দলের অনুমোদন ব্যতীত ৩১৯জন স্বতন্ত্র এলএফও(LFO) এর শর্তের অধীনে এই আসনের জন্য প্রচারণা অভিযান শুরু করেন।সকল পদ প্রার্থি এলএফও(LFO) এর এই মৌলিক নীতিতে আবদ্ধ হন যে ,নতুন সংবিধান জাতির “স্বাধীনতা,অখন্ডতা এবং জাতীয় সংহতি” তে কোনরূপেই ক্ষতি সাধন করবে না। এই সাধারণ উপলব্ধি থেকেই মানুষ নির্বাচণে অংশগ্রহণ করে।
নির্বাচনের সাফল্য ছিল অভাবণীয়।নির্বাচণের দিন উৎসবে পরিণত হয়।ভোটগ্রহণ ছিল অবাধ ও শান্তিপুর্ণ। ১১টি ভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ১৫টি স্বতন্ত্র আসন গণপরিষদে বহির্গত হয়। পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ পার্টি শেখ মুজিবুর রহমানের নেত্রিত্বে ১৬৭ আসন নিয়ে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। এবং তার পরবর্তি আসনে পাকিস্তানি পিপলস পার্টি জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেত্রিত্বে ৮১ আসনে জয় লাভ করেন।
গণপরিষদ বৈঠক নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রপতি কর্তিক মার্চের ৩তারিখে। এই অন্তর্বর্তি সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ,বিশেষ করে শেখ মুজিব এবং জুলফিকার ভুট্টো,সংবিধান তৈরিতে সকল প্রকার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তের জন্য গনপরিষদের বৈঠকের পুর্বেই সাক্ষাৎ করেন। (উদাহরণস্বরূপ,নতুন সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সাধারণ সম্প্রদায় দ্বারা গৃহীত হবে নাকি বড় এককে ইত্যাদি)।এলএফও এর অধীনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান সুনিশ্চিত করবার আদেশ দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ আলোচনার অচলাবস্থার কারণে পরিষদে সাক্ষাতের আগে সংবিধান তৈরির সমাধান প্রক্রিয়ায় যৌথ পরামর্শের জন্য জনাব ভুট্টো অতিরিক্ত সময় চেয়ে আবেদন করেন।
এই মুহুর্তে এসে মার্চের ঘটনাবলী শুরু হয়।
মার্চ ১,১৯৭১
মার্চের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই মর্মে স্থগিত ঘোষণা করে যে,সংবিধানের কার্যবিধি যুক্তিসম্মত ও গ্রহনযোগ্য করবার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সময় দেয়া প্রয়োজন। দেশব্যাপি বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন আটকে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং ২৫শে মার্চ ১৯৬৯ এ রাষ্ট্রপতি হবার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিজ্ঞা তিনি করেছেন তাঁর ঊল্লেখ করেন।এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ বলে ব্যাক্ত করেন।
মার্চ ২
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিতের সমালোচনা করেন,এবং এর প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন।তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে পরিপূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। লুটপাট,অগ্নিসংযোগ এবং সহিংসতার কিছু ঘটনা ঢাকা এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকে জানান হয়।অবাঙ্গালি ব্যাবসায়ি মালিকানাধীন দোকান লুটপাট হয়* পূর্ব পাকিস্তানে পরিবহন,ব্যবসা,শিল্প এবং আকাশ সেবা সম্পূর্নভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের অনুষ্ঠান স্থগিতের কারনে ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন চালু করবেন বলে পুনর্ব্যাক্ত করেন। তিনি মার্চের ৩ তারিখে প্রদেশ ব্যাপী হরতালের আহ্বান করেন এবং মার্চের ৭ তারিখে প্রকাশ্যে তিনি তাঁর কর্মসুচি ব্যাক্ত করবেন। ঢাকার কিছু অংশে সংঘর্ষের কারনে ইস্পাত শিরোস্ত্রান পরিহিত দাঙ্গা পুলিশের টহল চলে বিকালে এবং সন্ধ্যায় মুজিবুর রহমানের অনুগামীদের দ্বারা লুটপাটের এবং ঢাকায় আরোপিত সহিংসতার কারনে কারফিউ জারি হয়।
মার্চ ৩
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আজ সংসদীয় দলের নির্বাচিত ১২ সদস্যকে সংবিধানের অচলাবস্থা নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনার স্বার্থে জাতীয় পরিষদে সাক্ষাতের জন্য ঢাকায় মার্চের ১০ তারিখে আসবার ব্যাক্তিগত আমন্ত্রণ জানান।তিনি আরও বলেন যে ঢাকায় আমন্ত্রিত সাংসদীয় নেতাদের প্রত্যাশিত গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বানের পর জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবনায় অগ্রগতি হবে বলে তিনি মনে করেন। অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতারা আমন্ত্রন গ্রহণ করলেও শেখ মুজিবুর রহমান ,আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ মুজিবুরের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী পালিত হওয়া ধর্মঘটের জের ধরে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সাধারণ হরতাল পালিত হয় এবং কিছু জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়।দাঙ্গাকারীরা অ-বাঙ্গালী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখল। আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের দাঙ্গা থেকে বেসামরিক প্রশাসনদের বিরত করা হয়েছে।
[ ফুট নোটঃ বিহারি এবং অন্যরা যারা ৫,০০০,০০০ এর ও বেশি সংখ্যালঘুতা সৃষ্টি করে পুর্ব পাকিস্তানে]
মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে তিনি বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) জনগনের অধিকার আদায়ের জন্য সত্যাগ্রহ (অসহযোগ আন্দোলন) আয়োজন করেন।
মার্চ ৪
পাকিস্তান সরকারের সাথে অসহযোগের জন্য আওয়ামী লীগের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে ডাকা ধর্মঘটের পর্যালোচনা করা হয়। প্রদেশের অভ্যন্তর থেকে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।
মার্চ ৫
পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট অব্যহত থাকল আর বেসামরিক প্রশাসন হয়ে রইল পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দূরালাপনি অবস্থা স্থির হয়ে রইল। ঢাকা শহরে সহিংসতা নিয়ন্ত্রনে আনতে দুই দিন পূর্বে মোতায়েন করা সেনা ইউনিট কে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্যাপক সহিংসতা ও অনাচারের ভিত্তিতে রাজশাহী ও রংপুরের জনবহুল এলাকাগুলোতে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। অবাঙালী মালিকানাধীন বানিজ্যিক স্থাপনাগুলোতে বাঙ্গালিরা লুন্ঠন চালায়। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলনের সমর্থনে সমগ্র পুর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যাবস্থা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় যেন বাহিরের কোন বার্তা গ্রহণ এবং প্রেরন করা সম্ভবপর না হয়।
মার্চ ৬
জাতির উদ্দেশ্যে সম্প্রচারিত এক ভাষণে,প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন প্রথম সংবিধান তৈরির জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫শে মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জাতীয় পরিষদের ৩মার্চের অধিবেশন স্থগিত করায় আওয়ামী লিগের নেতৃত্বের অযৌক্তিকতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ই মার্চ ঢাকায় সংসদীয় নেতাদের সাথে গোলটেবিল বৈঠকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারেও তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি জানান জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপুর্ণ পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন।তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন,লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের পরিচারণায় সঙ্গতিপুর্ণভাবে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর সাথে পাকিস্তানের জাতীয় অখন্ডতা সংরক্ষনে তিনি পরমভাবে অঙ্গিকারবদ্ধ।
আওয়ামী লীগের আদেশে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট এখনো আব্যাহত। প্রশাসনেও নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজমান। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কর্মকান্ড আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। অনাচার,অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার আরও খবর দেশের অভ্যন্তর থেকে আসতে থাকে। বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি মালাকানাধীন বাড়ি –ঘর লুটপাট হতে থাকে। উৎপাদন শিল্প সংক্রান্ত কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় অবস্থিত ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ৩২৫ জন বন্দী অতিরিক্ত ক্ষমতাসীন কারাগার রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে জেল থেকে পালিয়ে যায়। সাত জন বন্দী পালাবার সময় কারারক্ষী বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরবর্তিতে,পালাতে সক্ষম হওয়া বন্দিদের ঢাকার রাস্তায় মিছিল করতে দেখা যায় এবং স্থানীয় পুলিশ এই ব্যাপারে ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে আতঙ্ক বোধ করে।
আওয়ামী লীগ একটি সম্পূর্ণ সদ্রিশ্য প্রশাসন ব্যাবস্থা গড়ে তোলে।
.
৭ই মার্চ
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায়, আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান বক্তৃতা দান কালে ঘোষনা করেন যে,তার দ্বারা প্রস্তাবিত ৪টি শর্ত পূরন করা না হলে,নির্ধারিত ২৫শে মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তিনি যোগদান করবেন না । শর্ত ৪টি হলো-
সামরিক আইনের প্রত্যাহার
ব্যারাকে সৈন্য প্রেরন
সেনা বাহিনীর গুলিতে হত্যা মামলার তদন্ত
জনসাধারনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তাৎক্ষনিক ক্ষমতা হস্তান্তর
তিনি আরো বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। দাবী মানার লক্ষ্যে, চাপ সৃষ্টির জন্য শেখ মুজিব পুর্ব পাকিস্তানের জনগনকে কর প্রদানে বিরত থাকতে বলেন এবং প্রশাষনিক ও বিচার সংক্রান্ত দপ্তর সমুহে কাজ না করার নির্দেশ জানানো হয় আওয়ামী লীগ থেকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। সরকারী বেসরকারী ভবন গুলোতে কালো প্রতিবাদ পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়া হয় । প্রেস বিজ্ঞপ্তি তে বলা হয় এই অসহযোগ আন্দোলন এবং ব্যাবসা বানিজ্যের কাজ বন্ধের ফলে কোটি কোটি ডলারের লোকসান হয়।
৮ই মার্চ
আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত। ঢাকার সামরিক আইন প্রশাষনের এক ঘোষনায় বলা হয় ৬ দিন ব্যাপী বিক্ষোভের ফলে প্রদেশে ১৭২ জন নিহত এবং ৫৮ জন আহত হয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয় যে , সেনা মোতায়েন এর ফলে হতাহতে সংখ্যা মৃত ২৩ জন এবং আহত ২৬ জন।
পূর্ব পাকিস্তান হতে এক বিদেশী সংবাদ পত্রের প্রতিবেদনে বলা হয় ২ মার্চ আওয়ামী লীগের সকাল সন্ধ্যা হরতাল আহবানে ব্যাপক দৌরাত্ন , অগ্নি সংযোগ , লুটপাট হয়।
সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আওয়ামী লীগের অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী এবং জাতীয় সমাবেশে জনগন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর ছিলো অযৌক্তিক। কারন এটি ১৯৭০ এর মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জারি কৃত আইনের কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। যার ভিত্তিতেই ডিসেম্বরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
মার্চ ৯
পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামি লীগের অবরোধ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ক্যাডার রা প্রশাষনিক কার্যক্রম ও চালিয়ে যায়। অগনিত সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের রিপোর্ট পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গা হতে গৃহীত হয়। অর্থনৈতিক অবস্থার দিনকে দিন অবনতি হতে থাকে। শিল্প ও বানিজ্য বিকল হয়ে পরে। উচ্ছৃংখল চরমপন্থীরা অবাংগালীদের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারনে, তারা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা আরম্ভ করে। আওয়ামী লীগের অবরোধের কারনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার যাবতীয় ব্যাংকিং কার্যক্রম স্থগিত হয়ে পড়ে
মার্চ ১০-১৪
আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত। বেসামরিক প্রশাষন পঙ্গু হয়ে পরেছে। আদালতের কাজ স্থগিত। ভয়ে, আওয়ামী লীগের আহবানে সাড়া দিয়ে জনগন পশ্চিম পাকিস্তান কে বকেয়া যুক্ত রাষ্ট্রীয় কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। ঢাকা বিমান বন্দরে ভীত সন্ত্রস্ত অবাংগালী লোকদের পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে পূর্ব পাকিস্তানের জনাকীর্ন ফ্লাইটে প্যাসেজের দাবীতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান এবং পাশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে টেলি যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। চরমপন্থীরা বিশাল আকারে অনেক স্থানের বানিজ্যিক ব্যাবস্থাপনা ও ব্যাবসায়ে লুটপাট শুরু করে। ক্রম বর্ধ্মান অরাজকতার জন্যে বিদেশী নাগরিক এবং জাতিসংঘের কর্মীরা সবাই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা শুরু করে। সেনাবাহিনী সাধারন জনতার সাথে সংঘর্ষ গুলো এড়িয়ে চলে এবং ফেডারেল সরকারের নির্দেশানুযায়ী সাড়া দিয়ে সেনানিবাসেই অবস্থান করে নিজেদের কঠোর সংবরন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের মধ্যকার ব্যাংকিং ও বানিজ্যিক লেনদেনে বাতা প্রদান করে এবং আন্ত টেলিযোগাযোগ ব্যাবস্থার অনুপস্থিতিতে শিল্প ও বানিজ্য ব্যাবস্থা পঙ্গু হয়ে যায়। অবাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা ও অনাচার ছড়িয়ে পড়ার প্রতিবেদন গুলো সমস্ত পুর্ব পাকিস্তান হতে গৃহীত হয়। অনেক জায়গায় আসামীরা জেইল থেকে পালিয়ে যায়।
মার্চ১৫-২০
শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলাপ করতে ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন ,যাতে শেখ মুজিব জাতীয় পরিষ্পদের অধিবেশনে যোগদান করেন এবং অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ মুজিবের সাথে আলাপ করেন। পরবর্তীতে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ( বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস) সহ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের একটি দল কে মনোনীত করা হয়, শেখ মুজিবর রহমান কতৃক নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী একটি দলের সাথে আলোচনা পরিচালনা করার জন্য সেই সাথে ৪টি পূর্ব শর্ত গ্রহন পুর্বক শেখ মুজিব কে জাতীয় সমাবেশে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হবে। শেখ মুজিব আবারো দাবী করেন ছয় দফার কর্মসূচির আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাষন ব্যাবস্থা। তার সাথে আলাপের পর, সেনা বাহিণী ) পুলিশের গুলিবর্ষনের অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সশস্ত্র বাহীনীর প্রতিনিধি, সিভিল প্রশাষন এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু শেখ মুজিব ঘোষনা দেন তিনি এই তদন্ত কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট নন তাই তিনি সহিযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট এবং মুজিবর রহমান এবং তাদের সংশ্লিষ্ট দল গুলোর মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের আর অনেক জায়গা থেকে সহিংসতা ও লুন্ঠনের খবরা খবর নিশ্চিত হয়। সৈন্য বাহিনী তাদের ব্যারাকেই অবস্থান করে বেরিয়ে আসে যতক্ষন না বড় ধরনের সহিংসতার সূত্রপাত হয়। বিদ্রোহী ছাত্রদল গুলো ঘোষনা করে “বাঙ্গালী “ এবং আগামী মোংগলবার থেকে স্কুল, কলেজ, সরকারী বেসরকারী ভবন গুলোতে পাকিস্তানের পতাকা উড়বে না। লুটপাট, অরাজকতা ও সন্ত্রাস পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পরে এবং বেসামরিক প্রশাষন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের অব্যাহত কর্ম সূচির কারণে।
বানিজ্য ও শিল্পে ছত্রভঙ্গ অবস্থা , বিশাল অর্থনৈতিক লোকসান অব্যাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আলাপ ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত সাংবিধানিক আইন এর আলোকে আলোচনার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংসাদীয় দল সমূহের নেতাদের ঢাকায় আসার আমন্ত্রন জানান।
পুলিশ অস্ত্রাগার ও অস্ত্রের দোকান গুলো থেকে বন্দুক লুটপাট এর প্রতিবেদন গ্রহন করা হয়।
.
মার্চ ২১-২২
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সহ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এসেছেন রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনার জন্য।
রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ইয়াহিয়া খানের সাথে মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর যৌথ সাক্ষাত হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব,যা জুলফিকার আলী ভুট্টো নাকচ করে দিয়েছিলেন তা হলো জাতীয় সংসদ দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া উচিত,একটি কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রেস রিপোর্ট নির্দেশ করে সমস্যার আপোষে সমাধান এর একটি উপায় বের করা হচ্ছিল।
মার্চ ২৩
২৩ মার্চ,১৯৪০ তারিখে উপমহাদেশের মুসলিম লীগ নেতাদের পাকিস্তান সংকল্প গ্রহণকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনকে “সংগ্রাম দিবস” হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন।
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল আয়োজন করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল গণমিছিলে উপস্থিত ছিলেন যেখানে সবুজ-সোনালী এবং লাল রঙের বাংলাদেশী পতাকাটি উন্মোচন করা হয়। তিনি সেখানে ঘোষণা দেন যে “বাংলাদেশক” অর্জন করতে হলে এখনো আত্মত্যাগ করে যেতে হবে।আওয়ামীলীগ এর ক্যাডাররা এবং ছাত্র প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সোভিয়েত এবং ব্রিটিশ মিশন সহ কিছু বিদেশী কার্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উগ্রবাদী আওয়ামীলীগ সমর্থক এবং প্যারা-মিলিটারি বাহিনী কাষ্ঠখন্ড এবং শটগান নিয়ে পাকিস্তান জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতা কায়েদ এ আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পদদলিত করে এবং অস্ত্রের দোকান ও অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে মিছিল করে যায় “বাংলাদেশ” লাভ এর জন্য।
মার্চ ২৪
জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সরাসরি কথা বলার দাবী জানান কিন্তু শেখ মুজিব সম্মত হননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত আওয়ামী নেতৃবৃন্দের একটি দল রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাদের সাথে চূড়ান্ত আলোচনায় বসেন। সেই দলের নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ ঘোষণা দেন যে রাত এগারোটার পর আর কোন আলোচনা হবে না।
সহিংসতা এবং আইনিহীনতার আরো রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। সৈন্যদল একটি বিশাল দলের উপর গুলিবর্ষণ করে যারা শেখ মুজিব এবং রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাদের মিটিং এর সময়ে ঢাকার নিকটে অবস্থিত একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় হামলা করতে এসেছিলো। আওয়ামী লীগ এর মনোভাব আরো কঠোর হল। আওয়ামী লীগের আপোষহীন মনোভাব এর কারণে সাংবিধানিক আলোচনাগুলো বারবার ভেঙে যাচ্ছিল।
.
২৫ মার্চ
আওয়ামীলীগ নেতারা ২৭শে মার্চ নতুন ধর্মঘটের ডাক দেন। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আওয়ামীলীগ নেতারা কোন ধরেনের ছাড় অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের দাবি ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা এবং পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতায়ন। এই পরিস্থিতিতে ঐ দিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি করাচী ফিরে যান।
পরের রাতে, সামরিক বাহিনী আওয়ামীলীগ চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। মধ্যরাতের কিছু পরেই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঢাকার বাসভবনে গ্রাফতার হন।
২৬শে মার্চ
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ঢাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্থান্তরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সমঝোতায় আসতে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন তার একটি সারসংক্ষেপ দেন। তিনি বলেন, আওয়ামীলীগের বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর উপর নির্দেশ ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করা। আওয়ামীলীগের অবাধ্যতা বন্ধ করতেই সামরিক ব্যাবস্থা নেয়া হয়। সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয় কিন্তু জাতিয় এবং প্রাদেশিক সমাবেশ বাতিল করা হয় নি। রাষ্ট্রপতি বলেন যে তার উদ্দেশ্য হল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের ব্যাবস্থা তিনি নেবেন।