শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
মুক্তাঞ্চলে নতুন জীবন গড়িতে হইবে | মুক্তিযুদ্ধ
১ম বর্ষঃ ২২শ সংখ্যা |
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
মুক্তাঞ্চলে নতুন জীবন গড়িতে হইবে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অনেক অঞ্চল মুক্ত হইয়াছে। নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হইতেছে। মুক্তাঞ্চলের মানুষ দখলদার শত্রুসেনাদের কবলমুক্ত হইয়া নিঃশ্বাস ফেলিতেছেন এবং মাতৃভূমির বাকি অংশ মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিতেছেন। কিন্তু এই সঙ্গে মুক্তাঞ্চলে দেখা দিয়াছে অনেক জটিল সমস্যা। যুদ্ধ বিধবস্ত এলাকাগুলির পুনর্গঠন, জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তোলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ জরুরী হইয়া দেখা দিয়াছে।
আমাদের প্রতিনিধি সম্প্রতি রংপুর জেলার ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, পাটগ্রাম ইত্যাদি মুক্তাঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়া এই সকল ( এখানে লিখা সলক) সমস্যার কথা জানাইয়াছেন।
পাক বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি
সর্বত্রই পিছু হটার সময় পাক বাহিনী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করিয়া সব কিছু জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ধবংস করিয়া দিতেছে। মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতির মুখে ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী থানা ত্যাগ করার সময় হানাদার শয়তানরা গ্রামবাসীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালাইয়া তিন শতাধিক লোককে হত্যা করে, বহু বাড়িঘর জ্বালাইয়া দেয়, এমন কি পেট্রোল দিয়া জমির পাকা ধানে আগুন ধরাইয়া দেয়। কয়েকটি সড়ক সেতুও পাক সেনারা যাইবার সময় ধবংস করিয়া দিয়াছে। নিজদলীয় রাজাকারদেরও পাক সেনারা গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।
এইভাবে শত্রুসেনারা পূর্ব দখলকৃত গ্রামগুলিকে যাইবার সময় শ্মশানে পরিণত করিয়াছে। মুক্তাঞ্চলে নিজ বাড়িঘরে যাহারা ফিরিয়া আসিতেছেন, তাহাদের আশ্রয় নাই, বস্ত্র নাই, ক্ষেতের ধান বিনষ্ট হওয়ায় খাদ্যও নাই।
মুক্তাঞ্চলের জনগণকে বাঁচাইবার জন্য এখনই জরুরী ভিত্তিতে রিলিফের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাহাদের ঘরবাড়ি নাই তাহাদের পুনর্বাসনের জন্য ঘর তুলিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। খাদ্য, ঔষধপত্র ও চিকিৎসকের তীব্র অভাব রহিয়াছে।
অর্থনীতি
মুক্তাঞ্চলগুলি অর্থনৈতিক দিক (দিকে) হইতে কার্যত বন্ধ এলাকাতে পরিণত হইয়াছে। স্বাভাবিক ব্যবসা-বানিজ্য নাই। এই সকল অঞ্চলের ব্যবসা বানিজ্য পূর্বে দখলকৃত এলাকার সহিত মুক্ত থাকায় এখন সরবরাহের ক্ষেত্রে দারুণ উচ্চমূল্য। লবণ, কেরোসিন, দেশলাই, আটা, চিনি ইত্যাদি প্রায় পাওয়াই যায় না। লবণ প্রতি সের কোথাও কোথাও ৫ টাকা ও কেরোসিন ৮ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। গরীব, ক্ষেত মজুর দিনমজুর ও সাধারণ কৃষকের এইগুলি ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এই শ্রেণীর জনগণের হাতে এখন কোন কাজও নাই। এই সকল এলাকায় প্রধান অর্থকরী ফসল পাট ও তামাক যাহাদের কিছু আছে তাহারাও দাম পাইতেছে না।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, মুক্তাঞ্চলে সরবরাহ ও কিছুটা স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য চালু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রতিবেশী ও মিত্র ভারতের সহিত আলাপ আলোচনা করিয়া ভারত ও মুক্তাঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা- বাণিজ্য চালুর করা। তবে, সেরূপ ক্ষেত্রে যাহাতে বিশৃঙ্খলা ও অবাধ মুনাফার প্রবণতা দেখা না দেয় তাহার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া ব্যবসা বানিজ্য সরকারী নিয়ন্ত্রণে ও কো-অপারেটিভ ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত তাহারা মনে করেন।
প্রশাসন
মুক্ত অঞ্চলসমূহে বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু হইতেছে। আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, রংপুরের মুক্তাঞ্চলগুলিতে থানা প্রশাসন চালু হইয়াছে, অসামরিক প্রশাসনের জন্য অনেক এলাকার আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করা হইতেছে। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায় শুরু হইয়াছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কিছু কিছু খোলা হইতেছে।
ভূরুঙ্গামারী ও নাগেশ্বরী এলাকায় সরকারী হাট-বাজার হইতে তোলা আদায় করিতেছেন। প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের নাম করিয়া কোন কোন স্থানে উচ্চহারে তোলা হইতেছে বলিয়া কৃষকরা অভিযোগ করিতেছেন। এই বিষয়ে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি ( এখানে সৃষ্টি) দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় শুধু সচ্ছল ব্যবসায়ীর নিকট হইতেই তোলা আদায় করা উচিত বলিয়া মুক্তাঞ্চলের মানুষ মনে করেন।
প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
মুক্তাঞ্চলের বহুমুখী জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত ও সুষ্ঠু প্রশাসন গড়িয়া তোলা। ইহার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ শরিক সকল দলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। হানাদার পাকিস্তানীরা বিতাড়িত ( এখানে বিতারিত) হওয়ার পর কোন এলাকায় যাহাতে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা না দেয় তাহার জন্য প্রশাসনকে জনগণ ও সকল গণতান্ত্রিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ সমভব করিয়া তুলিতে হইবে।
পুনর্গঠনের কঠিন কাজকে সমভব করিয়া তোলার জন্য সর্বদলীয় ভিত্তিতে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করান প্রয়োজন।
কিন্তু এ যাবৎ যে সকল জোনাল, সাব- জোনাল, থানা ও ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হইয়াছে, সেগুলি কোনটি সর্বদলীয় ভিত্তিতে গঠিত হয় নাই। শুধু অফিসারদের বড়জোর অফিসার ও আওয়ামী লীগের লোকজন লইয়া গঠিত হইয়াছে। অথচ সব জায়গাতেই স্থানীয় জনসাধারণ দলমত নির্বিশেষে তাহাদের বিশ্বাসভাজন নেতৃবৃন্দকে এই প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত দেখিতে চান।
মুক্তাঞ্চলের থানাগুলিতে পুলিশ ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায়শই নগণ্য। এ ক্ষেত্রে সকল সংগ্রামী দল ও গণসংগঠন হইতে যুবকদের নিয়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা মুক্তাঞ্চলের মানুষ অনুভব করিতেছেন। পুনর্বাসন, খাদ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে তীব্র অভাব রহিয়াছে, সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠন করিয়া উহার কাজের সহিত সরকারী প্রশাসনের সমন্বয় সাধন করিয়া তাহা মোকাবিলা করিতে হইবে। ইতিপূর্বে ফুলবাড়ীর মুক্তাঞ্চল সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠনের সংবাদ “মুক্তিযুদ্ধে” প্রকাশিত হইয়াছে। এইরূপ রিলিফ কমিটি সকল মুক্তাঞ্চলে গড়িয়া তোলা দরকার।
জনগণের মনোবল অটুট আছে
আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, মুক্তাঞ্চলের সর্বত্রই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করিতেছেন। মুক্তাঞ্চলের যুবকরাও মাত্রিভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুকবল করার সংকল্প লইয়া ট্রেনিং গ্রহণ করিতেছেন এবং জনগণ মুক্তিবাহিনীর সহিত পূর্ণ সহযোগিতা করিতেছেন।
রংপুর রয়াঙ্গনে পলায়নপর জনৈক পাকিস্তানী অফিসার তাহাকে নদী পার করিয়া দেওয়ার বিনিময়ে কয়েকজন গ্রামবাসীকে ১৩শত টাকা দিতে চায়। গ্রামবাসীরা পাক অফিসারকে সাহায্য করার ভান করে এবং তাহাকে পোশাক বদলাইয়া লুঙ্গি পরিতে বলে। অফিসারটি হাতের অস্ত্র মাটিতে রাখিয়া গ্রামবাসীদের দেওয়া লুঙ্গি পরিতে শুরু করিলে এই সুযোগে তাহারা অফিসারটিকে পাকড়াও করিয়া মুক্তি বাহিনীর হাতে সমর্পণ করে।
অপরিসীম দুঃখ, কষ্ট ও চূড়ান্ত ত্যাগের মধ্য দিয়া সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাংলাদেশে নবজীবনের স্বপ্ন দেখিতেছেন। তাহাদের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হইবে তাহা বোঝা যাইবে মুক্তাঞ্চলগুলি দেখিয়া। তাই সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় মুক্তাঞ্চলগুলিকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আদর্শ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। ইহা হইতে শত্রুকবলিত অঞ্চলসমূহের জনগণও মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রতর করিতে অনুপ্রাণিত হইবেন। মুক্তাঞ্চলের জনগণের আশা কি জন প্রশাসন কি অর্থনৈতিক কি সামাজিক কাঠামো কোন ক্ষেত্রেই যেন পূর্বতন পাকিস্তান দুর্ণীতি অসাম্য আর শোষণের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।