শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯১। ভারতের শিবিরে অবস্থানকারী উদ্বাস্তুদের প্রতি ইয়াহিয়াঃ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ফেরার আহ্বান | দৈনিক পাকিস্তান | ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
ভারতের শিবিরে অবস্থানকারী উদ্বাস্তুদের প্রতি প্রেসিডেন্ট
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ফেরার আহ্বান
রাওয়ালপিন্ডি, ৩০শে অক্টোবর (এপিপি/পিপি আই)। – প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ, এম, ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের সকল বাস্তুচ্যুত ব্যাক্তিকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রকৃত পাকিস্তানী নাগরিকদের প্রত্যাবর্তন যাচাই করার ব্যাপারে আমাদের কাছে যে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রহণযোগ্য হবে এবং আমরা এ ধরনের সংস্থার সাহায্যকে স্বাগত জানাবো।
প্রেসিডেন্ট পুনরায় ঘোষনা করেন যে, সাম্প্রতিক গোলযোগে যে সমস্ত পাকিস্তানী পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে গেছেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সকলের প্রত্যাবর্তনকেই স্বাগত জানানো হবে। তিনি বলেন যে, এ ব্যাপারে হিন্দু-মুসলমান অথবা অন্য কোন সম্প্রদায়ের প্রশ্ন নেই, সকলেই ফিরে এসে স্বাভাবিক পেশাগত কাজ চালিয়ে যান, এটাই কাম্য।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, গত মার্চ মাসের পর বিশ লাখের কিছু বেশী লোক পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে গেছে। এই সংখ্যা যে কোন নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা তদন্ত করে দেখতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, ভারত বাস্তুত্যাগীদের সংখ্যা বেশী বাড়িয়ে বলেছে।
ভারত তার প্রদত্ত সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকলে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বাস্তুত্যাগীদের সংখ্যা যাচাই করতে দিতে ভারতের কুন্ঠাবোধ করা উচিত নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরের দুর্দশাগ্রস্থ পরিবেশে বসবাসকারী এই সমস্ত হতভাগা ব্যাক্তিদের তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসতে দেওয়া হবে বলে প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন। প্রত্যাবর্তনকারীদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাদির উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বলেন যে, তাদের মন থেকে সবরকম ভয় ও আশংকা দূর করার জন্যই সাধারন ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে।
পাকিস্তান বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে কেবল মুসলমানদের ফেরত নিতে চাইছে বলে ভারত যে অভিযোগ করেছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খন সরাসরি তার সত্যতা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন, সকল প্রকৃত পাকিস্তানীকে ফিরিয়ে আনাই পাকিস্তানের নীতি।
প্রেসিডেন্ট এর বিবৃতির পূর্ন বিবরন
রাওয়ালপিন্ডি।- প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আজ নিন্মলিখিত বিবৃতি দেনঃ
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগের পর আমাদের যে সমস্ত নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, আমি বার বার তাদেরকে ঘরবাড়ীতে ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছি। তাদেরকে পূর্ন নিরাপত্তার এবং প্রত্যাবর্তন ও পূনর্বাসন-এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সবরকম সুযোগ-সুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
এছাড়া সরকারের প্রদর্শিত সাধারন ক্ষমার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁদের মন থেকে সবরকম ভয় ও আশংকা দূর করা। আমার সরকার বাস্তুচ্যুত ব্যাক্তিদের পুনর্বাসনের কাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারে তাঁদের একজন মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিজে এই কাজে ব্যাক্তিগতভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
কার্যকরীভাবে রিলিফ ও পূনর্বাসনের কাজ চালানোর জন্য প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষের হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ দেয়া হয়েছে। পূনর্বাসনে আরো সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে যাদের প্রয়োজন তাদের সকলকেই নগদ মঞ্জুরী দেয়া হবে। যদি এজন্য অতিরিক্ত সম্পদের প্রয়োজন হয়, তবে তা দ্রুত সরবরাহ করা হবে।
আমার সরকার আন্তর্জাতিক মহলের বিভিন্ন প্রস্তাবে এমনকি সীমান্তের উভয় দিকে পর্যবেক্ষক মোতায়েন এবং এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ব্যাক্তিগত প্রভাবকে কাজে লাগানোর জন্য তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রিলিফ ও পূনর্বাসনের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ও জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশনারের প্রতিনিধিরে ইতিমধ্যেই ঢাকায় এসেছেন। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাইকমিশানারের প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ব্যাপকভাবে সফর করেছেন এবং বাস্তুচ্যুত ব্যাক্তিদের অভ্যর্থনা জানানো এবং তাদের পূনর্বাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিজেই লক্ষ্য করেছেন।
এটা দুঃখজনক যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে যারা বাড়ীঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, সে সমস্ত হতভাগ্য ব্যাক্তিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে পারে এরুপ কোন ব্যবস্থাই ভারত সরকার গ্রহণ করেনি। আমরা যখন আমাদের নাগরিকদের ফিরে পেতে ইচ্ছুক এবং আগ্রহী, ভারত তখন এই মানবিক সমস্যাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে এবং তাদের প্রত্যাবর্তনে বাধা দেয়ার জন্য সবরকম বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এই উদ্দেশ্যে ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত এলাকায় গোলযোগ বজায় রাখছে এবং নিরাপ্ততাহীনতা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল সম্প্রতি এই পরিস্থিতির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন যে অনুপ্রবেশ এবং কামান ও মর্টারের গোলাবর্ষণের ফলে সীমান্ত এলাকায় যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তা বাস্তুচ্যুত ব্যাক্তিদের শীঘ্র পূর্ব পাকিস্তানে ফেরার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোন কোন বিদেশী রাষ্ট্র থেকে নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাস্তুচ্যুত ব্যাক্তিদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশী বাড়িয়ে বলেছে।
যাঁরা স্থানীয় অবস্থানের কথা পুরোপুরিভাবে পরিচিত, তাঁরা ভারতীয় প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হবেন না। কারন এটা সবার জানা আছে যে পশ্চিম বঙ্গের অন্যান্য স্থানের বাস্তুত্যাগী শিবিরগুলো কলকাতার স্থায়ী ভবঘুরে ও বেকার লোকে ভর্তি। তাছাড়া, উদ্বাস্তু সম্পর্কে ভারতীয় হিসেবে ১৯৪৭ সালে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছে এবং কোন না কোন কারনে এখন পর্যন্ত পুনর্বাসিত হয়নি, তাদেরকেও ধরা হয়েছে।
একথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, দেশ ভাগাভাগির সময় সীমান্তের উভয় দিক থেকে ব্যাপকহারে লোক এক দেশ অন্যদেশে চলে গেছে। ভারত কিছুতেই এসব লোককে উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করতে পারে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রতিক গোলযোগের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তাদের মধ্যেও ধরতে পারে না।
আমরা বিষয়টি পুংখানুপূংখভাবে হিসেব করে দেখেছি এবং তাতে দেখা যায় যে, এ বছর মার্চ থেকে ২০ লাখের কিছু বেশী লোক তাদের বাড়ীঘর ছেড়ে চলে গেছে। উদ্বাস্তু সংখ্যা সম্পর্কে যে কোন রকমের সন্দেহ নিরসনের উদ্দেশ্যে জেলাওয়ারীভাবে বাস্তুত্যাগীদের সংখ্যা পূর্বেই প্রকাশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উদ্যোগে একটি নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে একটি জরিপ কার্য চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে যাওয়া প্রকৃত উদ্বাস্তুদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের জন্যও আমরা প্রস্তাব করেছিলাম।
ভারত যদি তার প্রদত্ত হিসাব সম্পর্কে নিশ্চিতই হয়ে থাকে, তবে এই প্রস্তাব গ্রহণে ভারতের পক্ষে কুন্ঠাবোধ করার কোন কারন নেই।
ভারত বিশ্বকে আরও বলেছে যে, পাকিস্তান বাস্তুত্যাগী ব্যাক্তিদের সংখ্যা যে ২০ লাখ বলে বর্ণনা করেছে, ভারতের মতে তার মধ্যে শুধু মুসলমানের সংখ্যাই ধরা হয়েছে এবং ভারতের বক্তব্য অনুসারেই বলা যায় বাদবাকী যারা ভারতে রয়েছে, তারা অমুসলমান।
এটা ভারতের দুরভিসন্ধিমূলক বিকৃত তথ্য এবং তাতে বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতি প্রতিফলিত হয় না। আমি এটা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, গত গোলযোগের সময় যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে গেছে তাদের মধ্যে প্রত্যেকটি পাকিস্তানীকে সে মুসলমান, হিন্দু অথবা অন্য কোন সম্প্রদায়েরই হোক না কেন নিজের বাড়ীঘরে ফিরে আসার পর স্বাভাবিক কাজকর্মে আত্মনিয়োগে স্বাগত জানানো হবে।
এই ধরনের লোকের সংখ্যা যাই হোক না কেন এবং তারা যে ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রেরই হোন না কেন সরকার জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তাদের পূনর্বাসন ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন পুনর্বাসিত হওয়ার জন্য অর্থ সাহায্যসহ সম্ভাব্য সবরকমের সাহায্য প্রদান করবেন।
প্রত্যাবর্তনকারী প্রকৃত নাগরিকদের যাচাই করার ব্যাপারে যে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করার জন্য তাদের প্রচেষ্টাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে।
আমি আশা করি ভারতীয় উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে বর্তমানে যারা অত্যন্ত করুন অবস্থায় বসবাস করছে, সেইসব হতভাগা লোকদের এবং তাদের নিজ নিজ বাড়ীঘরে ফিরে আসতে দেয়া হবে।