শিরোনাম | সংবাদ পত্র | তারিখ |
সম্পাদকীয়: মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের স্বার্থে | স্বাধীনবাংলা
১ম বর্ষ: ৩য় সংখ্যা |
২৫ জুলাই ১৯৭১ |
সম্পাদকীয়
মুক্তিসংগ্রামের বিজয়ের স্বার্থে
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চার মাস পূর্ণ হইল।চব্বিশ ঘন্টা, আটচল্লিশ ঘন্টা বা এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশকে পদানত করা সম্ভব হইবে, এই হিসাব নিয়া যাহারা বাংলাদেশের সামরিক অভিযান শুরু করিয়াছিল ইসলামাবাদের সেই জঙ্গী শাসকদের মুখে ছাই দিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ দৃঢপণ লড়াই চালাইয়া যাইতেছে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে একের পর এক গৌরবময় বিজয় অর্জন করিয়া চলিয়াছে।বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ ও আপোষহীন এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত।ইহাহিয়ার দস্যুবাহিনীর অবর্নণীয় অত্যাচার ও নৃশংস গণহত্যা স্বত্বেও দেশবাসীর মনোবল অটুট রহিয়াছে- অত্যাচার উৎপীড়ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঘৃনা ও প্রতিরোধের সংকল্পকে আরো সুদৃঢ় করিতেছে মাত্র। পক্ষান্তরে ইহাহিয়া দস্যুদলের সামনে খুন ও লুন্ঠন ছাড়া কোন উদ্দেশ্য নাই- ইহাদের শৃঙ্খলা ও মনোবল একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং শোচনীয় পরাজয় অবধারিত হইয়া উঠিয়াছে।প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের হাতে মার খাইয়া ইহারা দিশাহারা হইয়া পালাইবার পথ পাইতেছেনা।আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রবর্গ, বিশ্ব কমিউনিষ্ট আন্দোলন এবং দুনিয়ার অন্যান্য গনতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি বাংলাদেশের সমর্থনে ক্রমেই অধিক হইতে অধিকতর সোচ্চার ও সক্রিয় হিইয়া উঠিতেছে।
কিন্তু ইহা সত্তেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সামনে কোন সমস্যা নাই একথা বলা আত্মসন্তুষ্টি ও আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর হইবে।এই সমস্যাগুলিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং উহাদের সমাধানের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরী। সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করিয়া নয়, উহাদের যথাযধ সমাধানের মাধ্যমেই মুক্তিসংগ্রামকে দ্রুত চুড়ান্ত ও নিশ্চিত সাফল্যের পথে অগ্রসর করিয়া লওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের সংগ্রামী শক্তিগুলির সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠিত না হওয়ার দরুন যুদ্ধপ্রয়াসে যেসব বিঘ্ন সৃষ্টি হইতেছে, সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে মুক্তিযুদ্ধে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হইয়াছে।
মুক্তিফ্রন্ট গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে আওআমিলীগ দলীয় পরিষদ সদস্যবর্গ ছাড়াও যাহাতে অন্যান্য সংগ্রামী দলের দায়িত্যশীল কর্মকর্তাদের সুপারিশ পত্র লইয়া মুক্তিফৌজে যোগ দেওয়া যায় উহার ব্যবস্থা অবিলম্বে করা দরকার। দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোপন সংগ্রাম কমিটিগুলো যাহাতে সকল সংগ্রামীদলের প্রতিনিধিদের লইয়া ঐক্যবদ্ধ সংগঠন হিসেবে গড়িয়া উঠিতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার।
বাংলাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র যুবক মুক্তিবাহিণীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগাইয়া আসিতেছে তাহাদের ট্রেনিংয়ের সুযোগ সুবিধা আরও উন্নত ও সম্প্রসারিত করিতে হইবে এবং রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কারণে কাহারো বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরন করা চলিবেনা।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইহাহিয়া চক্রকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করার যে নির্লজ্জ নীতি অনুসরন করিয়া চলিয়াছে উহার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক নীতির পূর্ণমূল্যায়ন আবশ্যক। মানবতার নামে আবেদন জানাইয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হৃদয় পরিবর্তন করা যাইবে এইরুপ চিন্তা বাংলাদেশ সরকার কিংবা গণতান্ত্রিক শিবিরের কোন অংশে এখনও থাকিয়া থাকিলে অভিলম্বে উহা দুর করা দরকার।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু অস্ত্র সরবরাহই নয়, প্রযয়াজন হইলে ভিয়েতনামের এই খুনি যে বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের স্বপক্ষে অস্ত্র ধারন করিতেও দ্বিধা করিবেনা উহার ইঙ্গিত ইহাহিয়া খানের সাম্প্রতিক হুমকিতেও স্পষ্ট।পক্ষান্তরে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিবর্গ বাংলাদেশের সমর্থনে উত্তর উত্তর আগাইয়া আসিতেছেন এই পটভূমিকায় বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ণীতিকেও ঢালিয়া সাজাইতে হইবে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হৃদয় পরিবর্তনের চেষ্টার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিগুলিকে বাংলাদেশের স্বপক্ষে আরো সক্রিয়ভাবে টানিয়া আনার জন্য সচেষ্ট হইতে হইবে।
————