You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.18 | মুক্তিযুদ্ধ পত্রিকার সম্পাদকীয়: ইহাহিয়া চক্রান্তের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন | মুক্তিযুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সংবাদ পত্র তারিখ
সম্পাদকীয়: ইহাহিয়া চক্রান্তের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন মুক্তিযুদ্ধ

১ম বর্ষ ঃ ২য় সংখ্যা

১৮ জুলাই ১৯৭১

 

সম্পাদকীয়
ইয়াহিয়া চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন

বাংলাদেশের জনগণ যখনই কোন অধিকারের জন্য সংগ্রাম করিয়াছেন, তখনিই পাকিস্তানের গণদুশমন শাসকবৃন্দ জনগণের উপর তীব্র দমননীতির সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি সাম্প্রদায়িক জিগির তুলিয়া গনমনে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে চেষ্টা কনিয়াছে।১৯৫২ সালে গৌরবময় গণ সংগ্রামের সময়ে গণ-বিরোধী সরকার একদিকে যেমন ঢাকার রাজপথ বরকত সালাম প্রমুখদের রক্তে রঞ্জিত করিয়াছিল তেমনি অন্যদিকে ঐ সংগ্রাম পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য হিন্দুদের কারসাজি, সীমানার অপর পার হতে উসকানির ফল প্রভৃতির জিগির তুলিয় গণমনে নানা সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করিতেও প্রয়াশ পাইয়াছিল।

১৯৫৪ সালে যখন বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হাতে শাসক মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়াছিল, ১৯৬২ সনে যখন ছাত্র সমাজের মৃত্যু-ভয়হীন সংগ্রামে শৈরাচারী আয়ুবশাহীর ভিত কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, ১৯৬৬ সনে যখন আওআমিলীগের ৬ দফা সংগ্রামে ঢাকা নারায়নগঞ্জের হাজার হাজার শ্রমিক ও শহরের গরীব বুক ফুলাইয়া সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাড়াইয়াছিল, ১৯৬৮-১৯৬৯ সনে যখন বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানে সম্মিলিত গণ-অভ্যুথানে লৌহমানব আয়ুবখান ধরাশায়ী হইয়াছিল এবং শ্রমিক কৃষকদের অনেক সংগ্রামের সময়েও গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী জনগণের উপর বিভেদ সৃষ্টির জন্য শাসকগোষ্ঠী সময়ে সময়ে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাধাইয়াছিল।

বস্তুতঃ বাংলাদেশের জনগণকে পায়ের তলায় রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী গত ২ বছর ধরিয়াই জনগণের বিরুদ্ধে প্রচন্ড দমননীতি ও ভারত বিরোধী জিগির তথা সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি- এই দুটি মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া আসিয়াছে।

মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আমাদের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও শয়তানের দোসর ইয়াহিয়া চক্র ঐ অস্ত্রগুলি প্রয়োগ করিতেছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত হতে ঐ হিংস্র পশুর দল বাংলাদেশে নজিরবিহীন গণহত্যা, ব্যাপক নারী ধর্ষন প্রভৃতি নারকীয় কার্যক্রম অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করিতে শুরু করিয়াছে যে, ভারত হইতে অনুপ্রবেশকারী দুস্কৃতিকারীরাই নাকি বাংলাদেশে গোলমাল বাধাইয়াছে।

বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যক্ষভাবে দখিতেছেন ও বুঝিতেঝছন যে, বিদ্রোহী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই,পি,আর প্রভৃতির লোকজন এবং এইদেশের বহু তরুনদের নিয়াই গঠিত হইয়াছে আজিকার মুক্তিফৌজ। বাংলাদেশের মাটি হইতেই জন্ম নিয়াছে মুক্তিফৌজ।এই মুক্তিফৌজই আজ গণ-সমর্থন নিয়া ইহাহিয়া-চক্রের দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার অসম সাহসিক সংগ্রাম চালাইতেছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই সংগ্রাম হইল এই দেশের জনগণের সংগ্রাম।

[মুক্তিযুদ্ধঃ সাপ্তাহিক। পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপাত্র পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিষ্ট পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত ও মুক্তিযুদ্ধ প্রেশ বাংলাদেশ হইতে মুদ্রিত।]

কিন্তু দুনিয়ার চোখে আমাদের এই মহান ও ন্যায্য সংগ্রামকে কলঙ্কিত করার জন্য ইহাহিয়া-চক্র আজ মুক্তিফৌজকে ভারত হইতে অনুপ্রবেশকারী এবং স্বাধীনতার গণ-সংগ্রামকে ‘ভারতের হস্তক্ষেপ’ বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করিতেছে।

ইহা ছাড়াও ঐ পশুর দল, যাহারা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জনগণকে হত্যা করিয়াছে, ধর্ম নির্বিশেষে অগনিত নারীর ইজ্জত হানি করিয়াছে, তাহারা জনগণের মুক্তির সংগ্রামের ভিতর সাম্প্রদায়িক বিষ সৃষ্টির জন্য গুন্ডা বদমায়েশদের জমায়েত করিয়া উহাদের দ্বারা কতকগুলি স্থান বাছিয়া বাছিয়া নিরীহ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করাইতেছে ও তাহাদের দেশ ছাড়া করিতেছে।ঐ দস্যুর দল তাহাদের পোষা গুন্ডাশ্রেনীর অবাঙ্গালীদের-বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধেও লেলাইয়া দিতেছ, যাহাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অবাঙ্গালী সংঘর্ষের খাতে চলিয়া যায়।

আগামী দিনে মুক্তিযুদ্ধ যখন আরো দুর্বার হইয়া উঠিবে, মুক্তিফৌজের মারের চোটে হানাদার বাহিনী যখন পরাজয়ের পর পরাজয় বরণ করিবে তখন ইহাহিয়া-চক্রের ঐসব ষড়যন্ত্র আরো বৃদ্ধি পাইবে।তাহারা আরো তারস্বরে ভারতের হস্তক্ষেপ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকিবে এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টিতে আরো বেশি করিয়া তৎপর হইবে। এমনও হতে পারে যে, মুক্তিফৌজের ও জনগণের হাতে ভরাডুবি আসন্ন দেখিয়া দস্যু ইহাহিয়া-চক্র ভারতের সশস্ত্র আক্রমনের এক মিথ্যা কাহিনী বানাইয়া পাক ভারত সংঘর্ষ বাধাইয়া গণ-মনে প্রবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রয়াসী হইতে পারে।

বাংলাদেশের জনগণকে আজ বিদেশী ও দেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের এসব চক্রান্ত সম্পর্কে হুশিয়ার হইতে হইবে।অতীতে গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিরোধে এবং পাক ভারত উত্তেজনা সৃষ্টি ও উসকানি সত্তেও বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালাইয়া গিয়াছেন। মুক্তিযুদ্ধের জনগণ অপূর্ব একতার পরিচয় দিয়াছেন।তাই আমরা দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ইহাহিয়া-চক্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিনষ্ট করার জন্য যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত হানাহানি এবং পাক ভারত সংঘর্ষ বাধাইবার জুয়াখেলায় মাতিয়াছে বাংলাদেশের জনগণ তাহাতে বিভ্রান্ত হইবেনা। আমরা বিশ্বাস করি যে, সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগী ইয়াহিয়া চক্র যত শয়তানীই করুক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের শ্রমিক কৃষক ছাত্র জনতা মুক্তিযুদ্ধে তাহাদের অটুট একতা রক্ষা করিবেন এবং দস্যুদলের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া মুক্তিযুদ্ধকে জয়ী করিবেন।

—————-