You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.05 | জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মাহমুদ আলীর আরেকটি বিবৃতি (অংশ) | জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস - সংগ্রামের নোটবুক

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মাহমুদ আলীর আরেকটি বিবৃতি (অংশ)
সূত্রঃ – জাতিসংঘ দলিলপত্র উদ্ধৃতিঃ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস
তারিখঃ – ৫ অক্টোবর, ১৯৭১

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মাহমুদ আলীর (পাকিস্তান) বিবৃতি
৫ অক্টোবর, ১৯৭১

দেশ ভাগের সময় পাকিস্তান পুরো আয়তনের মাত্র এক পঞ্চমাংশ পেয়েছিল এবং নানা দিক থেকে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। যদিও এটা আমাদের প্রতি অবিচার হয়েছে তারপরেও ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা আলাদা হয়েছে এটাকে আমরা পুরস্কার হিসেবেই মেনে নিচ্ছি। আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যথসম্ভব সহযোগিতার কথা বিবেচনা করেছি। ১৯৪৭ এর বিভাজনের মূলনীতি ভঙ্গ করে ভারত যখন মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু দখলের প্রয়াশে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে তখন আমাদের স্বাধীনতার বয়স ২ মাসের বেশি না। পাকিস্তানের সাথে অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনার দরকার, কিন্তু যখনই এরকম কোন আলোচনা শুরু হয় ভারত কৌশলে সত্য এড়িয়ে যায় এবং আসল বিষয় থেকে সরে যাওয়ার জন্য তালবাহানা শুরু করে।
ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষের প্রধান দুইটি কারণ আমি উল্লেখ করেছি। এই সংঘর্ষ ছাড়া এবং পাকিস্তানকে দুর্বল ও ধ্বংস করে দেয়ার ব্যাপ্তিশীল ও চলমান ভারতীয় প্রচেষ্টা না থামলে বর্তমান ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব পারস্পরিক শান্তির বিরুদ্ধে অচিন্তনীয় হুমকি হিসেবে কাজ করবে। ভারতের নীতি কি পাকিস্তানের প্রতি ধ্বংসাত্মক ছিল না? প্রতিবেশি দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যার সুযোগ নেয়া কি অস্বাভাবিক ও বেমানান নয়? তারা কি আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সতর্ক হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে না? আজকে আমার দেশ ও ভারতের সীমান্তে যা হচ্ছে তা শুধু নিছক সীমান্ত সংঘর্ষ নয়, এটা জাতিসংঘের একটি সদস্য ভারত কর্তৃক জাতিসংঘের অন্য আরেকটি সদস্য পাকিস্তানের ভিতরে সশস্ত্র অনুপ্রবেশ।
গত কয়েক মাস ধরে ভারত পাকিস্তানের সাথে চোরাগুপ্তা যুদ্ধে লিপ্ত আছে এবং এখনও আছে। একটা সময় ছিল যখন পাকিস্তান সরকারের সামরিক অভিযান যে প্রকারেরই হোক না কেন তাতে ভারতের আক্রান্ত হবার কোন অনুমেয় কারণ বা ভয় ছিল না। তারা বিশাল সংখ্যার সৈন্য জড়ো করেছে, প্রায় ২০ লাখের মত, এছাড়াও আছে বিভিন্ন রকমের ধ্বংসাত্মক অস্ত্র যা পূর্ব ও পাশ্চিম পয়াকিস্তানের সীমান্তে জড়ো করা হচ্ছে। তারা নিয়মিত আমার দেশে সশস্ত্র সৈন্য প্রেরণ করে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। তারা আশ্রয় দেয়, প্রশিক্ষণ দেয়, আর্থিক ও সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করে, এবং একই রকমের আরও কিছু বাহিনীকে উৎসাহিত করে বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজ করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে। সংক্ষেপে বলা যায় ভারত আমার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ না হবার একমাত্র কারণ পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ সংযম।
সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুলি, মর্টার সেল ছুড়া সহ অন্যান্য রণলিপ্সু কার্যক্রম নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে গেছে।
আমি দুইটি শক্ত উদাহরণ পেশ করছি যাতে পরিষদের সবাই একটা ধারণা পায় বর্তমানে আমরা কি পরিস্থিতির মুখোমুখি।
ভারতীয় কামান থেকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেট জেলার সীমান্তের নিকটবর্তী পাঁচটি গ্রামে প্রায় এক হাজার রাউন্ড গোলা বর্ষন করা হয়। কামানের গোলায় ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলো হল মানটালা, কমলাপুর, জয়পুর, আরামনগর এবং হারাশপুর। ১২ জন নারী ও ৮ জন শিশু সহ মোট ২৮ জন গ্রামবাসী এই হামলায় প্রাণ হারান। আহতের মধ্যে আরও আছে টেলিফোন বিভাগের কিছু কর্মচারী যারা একটা যোগাযোগ লাইনে মেরামতের কাজ করছিলেন। এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, টেলিযোগাযোগ লাইনগুলোই ভারতীয় আক্রমনের প্রধান লক্ষ্য। গোলা বর্ষনের পরে ভারতীয় সৈন্য এইসব এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। পাকিস্তান সেনা অভিযান চালিয়ে ঐ এলাকা থেকে ৩ টি হালকা মেশিনগান, ১৪৫ বাক্স গোলাবারুদ, ১০০ টি স্টিলের হেলমেট, ৪০ টি মাইন, কিছু বেতার যন্ত্র এবং ৩৮৭ টি গ্রেনেড উদ্ধার করেছে।
পাকিস্তানে খাদ্যশস্য প্রবেশের পথগুলোতে বাঁধা তৈরি এবং ধ্বংসে উৎসাহ দেয়ার মাধ্যমে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ তৈরির চেষ্টা করছে। চালনা বন্দরে খাদ্যবাহী আমেরিকান জাহাজ লাইটনিং এর উপরে হামলাকারী অন্তর্ঘাতকদের বিরুদ্ধে কিছুদিন আগে অভিযান চালানো হয়েছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ টের পেয়েছে যে ডুবুরিরা ভারতে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খাদ্য নিয়ে আশা জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেয়া। ডুবুরিদের ভারত থেকে লিমপেট মাইন (পানির নিচেও আঠার মত লেগে থাকে) দেয়া হয়েছিল এবং সেগুলো ব্যবহারের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিল। খাদ্যবাহী জাহাজে এরকম নাশকতা চালানোর মাধ্যমে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিতে চায় যাতে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হয়। যদি আন্তর্জাতিক মহল আসলেই পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের ব্যাপারে জেনে থাকেন তাহলে তাদের কর্তব্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরিতে ভারতকে বাঁধা দেয়া, তাদের কর্তব্য হচ্ছে ভারতকে এমন সব কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা যা থামিয়ে না রাখলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অস্তিত্বের সংকটে পরবে।
এটা এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিশেষ করে জাতিসংঘের দায়িত্ব আরেকটি যুদ্ধ প্রতিহত করা যার ফলাফল দক্ষিন এশিয়ার জন্য ভয়াবহ হতে পারে।
গত ২০ জুলাই মহাসচিব উ থান্ট উপমহাদেশে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে আলোকপাত করে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেছেন। মহাসচিব আরও উল্লেখ করেনএই এলাকার সার্বিক অবস্থা আস্তে আস্তে আরও অবনতির দিকে এগুচ্ছে। তিনি বলেন, “ বর্তমান সংকটপূর্ণ অবস্থার উৎপত্তি ছয় বছর আগে, যখন দীর্ঘকালীন সমস্যা ও বৈরিতা অমীমাংসিত ও অসম্পন্ন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।”
সীমান্তের আসল অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের অবস্থা বেশি গোলমেলে। সীমান্ত সংঘর্ষ, চোরাপুপ্তা হামলা ও অন্যান্য নাশকতামূলক কাজ খুব পরিচিত দৃশ্য হয়ে যাচ্ছে”।
তিনি এই অঞ্চল তথা বৈশ্বিক শান্তির প্রতি হুমকির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “জাতিসংঘের কেউই ভুলতে পারবে না যে উপমহাদেশের অন্যতম এই সংঘাত সবার মাঝেই ছড়িয়ে পরতে পারে”।
উ থান্ট সংক্ষেপে এই অবস্থাকে বৈশ্বিক শান্তির প্রতি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং নিরাপত্তা পরিষদকে এই অবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সর্বসম্মতিতে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তে আসার নির্দেশ দেন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর আমি আমার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলাম যে আমার সরকার নিরাপত্তা পরিষদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে প্রস্তুত এবং দুই দেশের মধ্যে অবস্থার উন্নয়নের উদ্দ্যেশ্যে পরিষদের এই প্রচেষ্টাকে তারা স্বাগত জানান। আমি সেই প্রস্তুত থাকার বিষয়টি এখানে পুনরাবৃত্তি করছি।
ভারত অবশ্যই এটাকে ভিন্ন ভাবে দেখছে। তাদের সরকার বুঝানোর চেষ্টা করছে যে এটা ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়। তাদের মতে যা হয়েছে সবকিছুই পাকিস্তানের কারণে হয়েছে এবং ভারত সেসকল কর্মকান্ডের শিকার মাত্র যারা অসংখ্য এবং ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তুর বোঝা মাথায় নিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু আসল সত্যটা কি? আমাদের ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপ একদম স্পষ্ট এবং সেগুলো আমি আগেই উল্লেখ করেছি।
গত কয়েক মাসে দুনিয়া পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছে যার বেশির ভাগই বলা হয়েছে বাইরের মানুষ দ্বারা। তাদের সবার বক্তব্য বাস্তবতার সাথে ক্ষাপ খায় না। তাদের মধ্যে অনেকেই অহংকারী মনোভাব বজায় রাখে ও প্রকাশ করে। কিন্তু আমি যদি ব্যক্তিগত ভাবে ভাবি, তাহলে আমি এসেছি পূর্ব পাকিস্তান থেকে। আমি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মত না। ভুয়া বিবৃতি ও সমালোচনা আমার সাজে না। এই অধিবেশনের পরে আমি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাব। আমার বাঁচতে হবে, সহ্য করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে এবং আমার জনগণের মাঝেই থাকতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের অসহয় জনগণের জন্য যদি কোথাওনোংরা রাজনীতির থাবা মুক্ত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে থাকে তাহলে তাকে আমরা সর্বদাই স্বাগত জানাই। একই সাথে আমি দুঃখ প্রকাশ করে বলতে চাই, আমার জন্মভূমিকে পৃথিবীর সামনে বিকৃত করা হয়েছে। সব কিছু ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এমন ভাবে বলা হচ্ছে যেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একটি পূর্ব পাকিস্তানি কণ্ঠ জেগে উঠতে দেয়া হোক, যাতে করে বিশ্ব বুঝতে পারে যে এই দুই দেশের বন্ধন এত সহজে ছিন্ন করা যাবে না এবং এরা একত্রিত হয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ গঠনের দিকে এগুচ্ছে। এটা সত্যি যে আমাদের মাঝে আঞ্চলিক সামঞ্জস্য কম এবং সম্পদের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ন্যায় বিচার করা হবে। কোন দেশ, কোন বহুজাতিক বা বহুভাষিক রাষ্ট্রে এরকম সমস্যা নেই? এসব সমস্যাকে অন্যান্য গুলোর থেকে প্রাধান্য দেয়ার দরকার নেই। পাকিস্তানে আমরা একটা বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। আমরা চরম দুর্দশা মোকাবিলা করেছি। আমরা একটা অগ্নিপরীক্ষা পার করে এসেছি। কিন্তু এত কিছুর ভিতরেও আমরা বুঝতে পেরেছি যে বিভাজন ও রাষ্ট্রসত্ত্বার ভাঙন, সর্বোপরি আমাদের একাত্মতার সমাপ্তি আমাদের জন্য কোন সুবিধাজনক কিছু না বরং অন্যদের জন্য।
আমাদের জন্য আসলেই এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এই অবস্থা একটা সহিংস পরিস্থিতির জম্ন দিয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভারতের সাথে সম্পর্কের দিকগুলো মাথায় না রাখলে এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণগুলো বুঝা যাবেনা। পূর্ব পাকিস্তানের সমান অধিকারের দাবিকে দমিয়ে রাখার ফলেই এই আন্দোলন হচ্ছে এরকম ভাবা আসলেই অনেক সহজ। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার থেকে কোন দিক থেকে পিছিয়ে আছে যেখানে তারাই সংখ্যাগুরু এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে? ভুল গুলোকে সঠিক করার বা ভারসাম্য ঠিক রাখার ক্ষমতাসংখ্যাগুরুদের থাকে বা তারা আদায় করে নিতে পারে। সংখ্যাগুরুরা অপসৃত হতে চায় এটা একরকম অবিশ্বাস্য কথা। বইয়ের ভাষায় মতে অপসৃতদের চাহিদা মানে হচ্ছে সংখ্যালঘুদের চাহিদা। আমি আবারও বলছি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংখ্যালঘু বা কোন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয় এবং এটা থেকে বুঝা যায় তাদের মাঝে থাকা কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে স্বাধীন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনা। যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী তারা স্বঘোষিত সংখ্যালঘু। তাদের অবস্থানই বলে দেয় তারা সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে নেতৃত্বের ব্যার্থতা বা বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্র যা দেশের সংহতিকে নষ্ট করে দিতে চায়। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্ষেত্রে দুই কারনই সমান দায়ী।
ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে আন্দোলনের পরিধি অবিলম্বে আরও বাড়বে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর যেসব অংশ নদী, পাহাড়, বোন বা জলাভূমি দ্বারা ঘেরা সেসব অংশ দিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই এলাকাগুলোতে যুদ্ধ সরঞ্জাম জড়ো করছে এবং সেটা সীমিত সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থা যখন সংকটাপন্ন তখন ভারত তার উপর দিয়ে বিমান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তারা এমনটা করেছে একটি ভারতীয় বিমান অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার প্রতিহিংসায়। কিন্তু বিচারকদের রায়ে এটা প্রমাণিত যে এই অপহরণের ঘটনা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর মস্তিষ্ক প্রসূত যাতে তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা অবৈধ ও ভারতের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির পরিপন্থি। এরপরেও, এমনকি মিটমাটের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারত এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অপরাগ। যখন এই সংকট বিরাট আকার ধারন করছে এবং পাকিস্তান কঠিন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তখন ভারত আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে সৈন্য জড়ো করেছে।
দেশে বিদ্রোহ ও বাইরের হুমকির মুখে দেশকে নৈরাজ্য, বিভাজন ও ভারতীয় আধিপত্য থেকে রক্ষা করতে পাকিস্তান সরকারের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে আমার প্রশ্ন, অন্যান্য আইনি সরকার এই অবস্থায় কি করত?
পূর্ব পাকিস্তানে আমরা যে ধরণের দ্বন্দ্ব সহ্য করেছি তা আসলেই দুঃখজনক। কিন্তু পুরো বিশ্ব এখনও সঠিকভাবে জানেনা এই অবস্থা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের কারণে তা কিভাবে আরও কঠিন রূপ নিয়েছে। যদি উদ্বাস্তু মানুষগুলোর প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি একটুও মানবিক হত তবে তারা নিশ্চিতভাবেই অন্য পন্থা অবলম্বন করত। উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পাকিস্তান সরকারের আবেদনকে তার পৌছে দিতে পারত। উদ্দেশ্য সাধনের আমাদের ও জাতিসংঘের সম্মিলিত চেষ্টায় সাথে যা সহযোগিতামূলক হত। যা পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশের সাথে আলোচনার পথ খুলে দিত। এখন এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ক্ষমতার রাজনীতি না থাকলে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে তাদের নিজ আবাসে ফিরে যেতে দেয়ার দাবি জানাত।
একটানা প্রচারণা ও কর্মের দ্বারা ভারত বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে তাদের দেশে নিজ আবাসে ফিরতে দিতে চায় না, এই মুহূর্তে সব থেকে দুঃখের বিষয় এটাই। সীমান্ত সংঘাত তৈরি, কামান থেকে গোলা বর্ষণ করে আমাদের দেশীয় জনগণকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দিচ্ছে না। তারা সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় তথাকথিত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের নাম করে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৈরি করে তাদের ব্যবহার করছে।
এটাই হল ভারত সরকারের কূটনীতি যা এখন পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরিয়ে আনার সকল চেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এবং তার প্রতিনিধি দলের সম্মতি, পাকিস্তান রাষ্ট্রপতি কতৃক বার বার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সহ এমন বিবিধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা আমাদের দেশীয় জনতাকে ফিরিয়ে আনতে উদ্বিগ্ন। গত ১৯ জুলাই মহাসচিব উ থান্ট ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশকেই প্রস্তাব করেন সীমান্তের দুই পাশেই সীমিত সংখ্যক U.N.H.C.R.প্রতিনিধিউপস্থিতথাকবেন।আমরা কোন সংকোচ ছাড়াই এ প্রস্তাবে সম্মতি জানাই, যদিও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে।
উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরতে না দেয়ার পিছনে ভারত লোকদেখানো যে কারণ দেখায় তা হল দেশের পরিস্থিতি তাদের ফিরে যাওয়ার মত নিরাপদ না। প্রথমত, ভারত নিজেরাই পরিস্থিতি অনিরাপদ করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত, এই অধিবেশনে দেয়া ভাষণে সম্মানিত ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মতে“নিরাপদ পরিস্থিতি” বলতে ভারত আসলে যা বুঝাতে চায় তা একটি জটিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতারা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে শুধুমাত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হলেই তারা উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরতে দেবেন। যা অন্য ভাবে বললে যখন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে এবং ভারতীয় আধিপত্য মেনে নেবে।
এক দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের এর থেকে ভয়ানক উদাহরণ আর কি হতে পারে? মাত্রই গত বছর ভারত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি বিষয়ক ঘোষণায় যোগ দিয়েছিল যেখানে সবাই সর্বসম্মতিক্রমে শপথ নিয়েছিল এবং জাতিসংঘ দলিল উদ্দেশ্য ও নীতির নিঃশর্ত বৈধতা পেয়েছিল। যার মধ্যে জাতিগত সম্পর্ক, আকার, ভৌগলিক অবস্থান, উন্নয়নের ধারা, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা যেরকমই হোক, অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিও ছিল। এবং আরও বলা ছিল এই নীতিমালার লঙ্ঘন কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া হবে না।
ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়টি শুধু পাকিস্তানের একার জন্য চিন্তার বিষয় নয়, নিজস্ব সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় ইচ্ছুক যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই চিন্তার বিষয়। যদি হস্তক্ষেপ নীতি একপেশে বা আপোষ করা হয় তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তুলনায় দুর্বল বা ছোট যেকোনো রাষ্ট্র বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের আক্রমনের শিকার হবে। আমি এই অধিবেশনে আবেদন জানাচ্ছি যাতে ভারতকে এই হস্তক্ষেপমূলক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হোক। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা ভারতের দখলদারি মনোভাব প্রতিহত করা ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর, যা আমাদের টিকে থাকার জন্য আবশ্যক।
ভারত যাতে মনে না করতে পারে তারা উপমহাদেশে আর কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ভারত চেষ্টা করেছিল নাগা-দের ক্রীতদাস করতে। যারা ছিল এই উপমহাদেশের অভারতীয় অধিবাসী এবং জন্ম থেকেই তারা ভারত শাসনের সুদীর্ঘ সময়ে তাদের উপরে চালানো অনুচ্চারিত কষ্ট তারা বয়ে বেড়াচ্ছে। ভারতের নিজস্ব ভূমিতে এমন অনেক ঘটনা আছে যা সরাসরি ক্ষুদ্র ভাষাগত ও জাতিগত ভাবে আলাদা জাতিগোষ্ঠীকে শোষণ ও নিপীড়নের ফলাফল;যেমন দ্রাবিড়, শিখ এবং বাঙ্গালি। কিন্তু আমরা এগুলোকে ভারতের নিজস্ব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কারণ হিসেবে ব্যবহার করিনি। আমরা শুধু আশা করছি, ভারত বুঝবে এই নৈরাজ্য ও বিভাজন শুধু আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে না, তাদের জন্যও আনবে।
যদি আমি সংক্ষেপে বলি, ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি দুই দেশের শান্তির জন্য স্পষ্ট হুমকি যা খুব দ্রুত নিরসন করা দরকার, যদি এই দুই দেশের জনগণ স্বাধীনভাবে উন্নত জীবন যাপন করতে চায়। আমরা ভারতের জনগণকে আমাদের শত্রু ভাবি না। আসলে আমরা মনেকরি,পাকিস্তানের প্রতি তাদের কঠোর ও লাগাতার শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব প্রকাশের দ্বারা দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা স্থায়ী করার মাধ্যমে ভারত সরকার তার নিজের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আমরা আশা করি ভারত সরকার বুঝবে দক্ষিন এশিয়ার শান্তি নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী পাকিস্তানের আবশ্যকতা কতখানি। একইভাবে, আমরা আশা করবো বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত শক্তিরা পাকিস্তানকে দুর্বল ও আলাদা করে দেয়ার অপচেষ্টা প্রতিহত করে এই অঞ্চলে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে এনে শান্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।