You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদপত্রঃ স্বদেশ
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১

লন্ডনের চিঠি
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে রাজনৈতিক সমাধান জলের উপর আল্পনা কাটার নামান্তর
(মাহমুদ হোসেন প্রদত্ত)

পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশিষ্ট ইংরেজী ‘দৈনিক মর্নিং নিউজের’ করাচী সংস্করণের অন্যতম সহকারী সম্পাদক মিঃ এন্টনী মাসকারেনহাস সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে সপরিবারে এখানে চলে এসে সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বিবরণী দিয়েছেন তাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ত্যাগী পাকিস্তানী সাংবাদিক মিঃ মাসকারেনহাস- তোমাকে জানাই অভিনন্দন।

কালজয়ী নির্ভীক সাংবাদিক বন্ধু মিঃ মাসকারেনহাস প্রদত্ত ‘সানডে টাইমসের’ সেই স্টোরি পাকিস্তানী কাগজে ছাপবে না এ জানি। কিন্তু সকল দেশের স্বাধীন পত্র-পত্রিকা তা ছাপিয়েছে; ভারতীয় পত্র-পত্রিকাও তা ছাপাতে কুন্ঠিত হয়নি। এখানে বন্ধু মিঃ মাসকারেনহাসের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি তার দেশের (পাকিস্তান) অন্যান্য প্রত্যক্ষ করেছেন ধ্বংসলীলা। বিরাট জনপদগুলো দেখে কান্না পেয়েছে তাঁর। এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের যে সব জনপদ ছিল প্রাচুর্যে ভরা, হাসি গানে মুখরিত; সে সব জনপদে এখন কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অধিকাংশ ঘরবাড়ীতে মানুষ নেই এমন কি নেই জানালা-দরজা। দোকানপাট খা খা করছে। সরকারী অফিসগুলো দরজা খোলা থাকলেও কোন কর্মচারী দেখেননি তিনি। যে সব উর্দুভাষী মানুষ তাঁর চোখে পড়েছে তাদের দেহ অনশন ক্লিষ্ট বা রোগাজীর্ণ। আর দেখেছেন অগণিত মানুষের ফসিল। কলকারখানার চাকা বন্ধ, মাঠে মাঠে ফসল নেই, আছে ঘাস ও অন্যান্য তৃণের সমাহার। আর দেখেছেন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শুধু সেনাবাহিনীর অশুভ পদচারণা, যাদের চোখ বাজপাখীর মত সর্বত্র শিকার খুঁজছে। সে শিকারটি কি তা আর বলে দিতে হয় না। যদিও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার সফরকারী সাংবাদিককে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী বাসিন্দাদের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম স্বাভাবিক পরিবেশ দেখানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা দিয়ে বিভীষিকাকে ঢাকা যায়নি, যায় না। তবে মাসকারেনহাস আপ্রাণ প্রচেষ্টায় খুব গোপনে এবং সতর্কতার সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হয়েছিলেন।

তাদের সাথে আলাপ করে তিনি জানতে পেরেছেন কোন আপোষ নয়, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। মাসকারেনহাসের মন্তব্যঃ এই তো কথার মত কথা। তেতো বলে অপবাদ থাকলেও বাঙ্গালীরা সত্যিই বীরের জাত। অধিকার সচেতন বাঙ্গালীরা নিজেদের মৌলিক দাবী প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের এ ব্যাপারে কাউকে তোয়াক্কা রাখে না।

মাসকারেনহাসের রিপোর্ট বিশ্বে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এই বিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতার ইতিহাসে এখানে তা অনুভব করা যায়। এখন আর কিছুই লুক্কায়িত নেই। বাংলাদেশের চলমান ঘটনাবলীর কাছে মাইলাইর হত্যাযজ্ঞ তুচ্ছ বলে এখানে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অবশ্যি ঘটনার শুরুতে ভারতের বার্তা সরবরাহ প্রতিষ্ঠান পি,টিআই বাংলাদেশের জনৈক হাই পারসোনালিটির বরাত দিয়ে এ ধরনের একটি খবর ক্রিড করেছিলেন। তা আজ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে এটা কখনই পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হতে পারেনা। এমনি বাংলাদেশের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিঘোষিত স্বাধীনতা মেনে নিয়ে কোন রাজনৈতিক মীমাংসা হওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। এটা বিশ্বের জনমত। কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ভৌগলিকভাবে এবং অনেক দিক থেকে সম্পূর্ণ সামনজ্যহীন। সুতরাং এ দুটোকে এক সুতোয় বেঁধে রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করান যায় না। আর যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশী সে ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রশাসনিক ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে না। এবং তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে জলের উপর আল্পনা কাটার নামান্তর।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!