সংবাদপত্রঃ স্বদেশ ১ম বর্ষঃ ৩য় সংখ্যা
তারিখঃ ১৪ জুলাই,১৯৭১।
স্বাধীনতার দাবি করে মুজিব অন্যায় করেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি করে শেখ মুজিবুর রহমান কোন অন্যায় করেননি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি দেশের স্বাধীনতা চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি রাজনৈতিক অপরাধী হতে পারেন না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে তাই আমাদের একমাত্র দাবী, মুজিবুর রহমানের মুক্তি চাই।
কলাসীম, গাইঘাটা, বনগাঁ ও বাগদার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের পর কানাডার সরকারী দলের নেতা শ্রী জর্জ ল্যাচেন্স সাংবাদিকদের কাছে তার এ অভিমত ব্যক্ত করেন ।
বুধবার নয়াদিল্লী থেকে দমদম বিমানঘাঁটিতে নেমে তাঁরা সোজা সীমান্ত শিবিরগুলি পরিদর্শনে যান। পথের দুপাশে অগণিত জনতার মিছিল তাদের বারবার জিজ্ঞাসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দোভাষীকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করান , কোথায় তাদের ঘর, কত দূর থেকে তাঁরা এসেছে। সেই একই বেদনাময় কাহিনী। মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সন্তানকে, সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীকে হত্যা করেছে, ইয়াহিয়ার রক্তলোলুপ বাহিনীর রক্তের তৃষ্ণা তাতেও মেটেনি। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার পথেও হিংস্র কুকুরের মত তারা ঝাপিয়ে পড়েছে যুবতী কন্যাদের লুণ্ঠন আর কিশোরীদের হত্যা- ওপার বাংলা থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের সবারই একই কাহিনী। কানাডিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আর দেশে ফিরে যাবে না ? হ্যাঁ, যাবো, যদি মুজিব আমাদের ডাক দেয়। সবার মুখে একই উত্তর।
আবেগআপ্লুত কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা মিঃ এন্ড্রু ব্রেউইন, কনজারভেটিভ দলের নেতা মিঃ হিথ ম্যাকোয়ারি ও লিবারেল পার্টির নেতা মিঃ জর্জ ল্যাচেন্স বলে উঠেনঃ পাকিস্তানে গিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হবে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবী তোলা।
গণতান্ত্রিক কাঠামোয় কেউ যদি স্বাধীনতার দাবী করে তাহলে সে অন্যায় কিছু করবে না। কানাডায় এমন গণতান্ত্রিক দল আছে যারা কুইবেকের স্বাধীনতার দাবী তুলেছে। তাদের বিচ্ছিন্নতাকামি বলে তো জেলে তোলা হয়নি। কিংবা তাদের দেশদ্রোহী বানিয়ে পৃথিবীর সামনে হেয় করবার কোন চেষ্টা হয়নি। নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা শ্রী এন্ড্রু ব্রেইউন তাদের সফরের উদ্দেশ্য ঘোষণা করে বলেন, দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ভারতে এসেছেন। একটি মানবিক কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব। অপরটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা। মানবিকতার দিক থেকে ভারতের কাঁধে সবচেয়ে বেশি বোঝা এসে পড়েছে। কানাডা তার কতটুকু সহজ করে দিতে পারে সেদিকে তাদের প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান না হলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে বলে তাদের বিশ্বাস। কারণ আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের উপর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাই ভয় হয়,রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত না হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, মাত্র ছ’মাস শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার জন্য প্রায় চল্লিশ কোটি ডলার খরচ হবে। কানাডা ইতিমধ্যেই কিছু অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠিয়েছে। শরণার্থীদের দেখে যাবার পর তারাও সরকারের কাছে দাবী তুলবেন, কত বেশি সাহায্য শরণার্থীদের দেওয়া সম্ভব সেদিকে নজর দিতে।
লিবারেল পার্টির নেতা শ্রী জর্জ ল্যাচেন্স বলেন, অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য পাকিস্তানকে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই এমন পরিকল্পিত গণহত্যা করার আগে তারা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরামর্শ গ্রহণ করত তবে তা অনেক বেশি বাস্তব ও বুদ্ধিমানের কাজ হত।