You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানের বিধ্বস্ত অর্থনীতি
স্বদেশ
১ম বর্ষঃ ১ম সংখ্যা
১৬ জুন, ১৯৭১

পাকিস্তানের বিধ্বস্ত অর্থনীতি

যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই করাচীর কাগজগুলি বিদ্রোহীদের খবরাখবর পুরো চেপে যায় এবং তার ফল এতো পরিষ্কার হয়েছিল যে রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে রাওয়ালপিন্ডি সরকার যবনিকার সামান্য অংশ তুলে যখন দেখালেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তার অংশটুকু মাত্র দেখে স্তম্ভিত এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন।

তাঁরা প্রথম এই খবর জানলেন যখন মুহম্মদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বিদেশী চারশো কোটি পাউন্ড ঋণ ছ’মাসের জন্যে বিদেশী শক্তিগুলির কাছে আপতকালীন স্থগিতের জন্য আবেদন জানালেন এবং জ্বালানী তেলের দাম শতকরা ৮ থেকে ১০ ভাগের ওপর বাড়িয়ে দিলেন; তাছাড়া ৪৬টি জিনিষের ওপর দুই থেকে তিন গুণ কর স্থাপনও ছিল এর মধ্যে। ফলে জনগণের কাছে এই ঘটনাগুলি এলো এক ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস হিসাবে। পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদরা বললেন, পূর্বদিকে সামরিক সরকারের যুদ্ধক্ষেত্রের জয়লাভ যদিও সম্ভব, জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ দুর্গতির সূচনা।

এই তত্ত্বের সমর্থনে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসাপত্র গোটাতে শুরু করেছেন, কারণ তাদের তৈরী জিনিষপত্রের দুই-তৃতীয়াংশের বাজার ছিল পূর্বাঞ্চল। কিন্তু সে বাজার আপাতত বন্ধ। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব পাকিস্তানী বাঙালী ব্যাপকহারে ভারতে শরণ নেওয়ার ফলে চা শিল্পের পক্ষে তা এক চরম বিপদের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে- পাকিস্তানকে তারও বিকল্প রপ্তানির কথা চিন্তা করতে হবে। অবশ্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পাট রপ্তানির ক্রমবর্ধমান হার কমে যাওয়ায়। পাকিস্তানের কাছে এই পাট ছিল বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় সূত্র। কেবলমাত্র গত সপ্তাহের গোড়ার দিকেই কিছু রপ্তানি করা গেছে। সব মিলে যুদ্ধের দরুন দৈনিক মূল্য দিতে হচ্ছে ২০ লক্ষ পাউন্ড করে যে জাতির যুদ্ধের আগে জমা মোট টাকা ছিল ৮ কোটি২০ লাখ পাউন্ড তার পক্ষে এটা একটা বেশ ভারী ধরণের বোঝাই বলতে হবে।

নিকট ভবিষ্যতে এই অবস্থার খুব একটা উন্নতির আশা নেই। অফিসার মহল থেকে বলা হচ্ছে, পূর্বাঞ্চলে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে, কিন্তু অন্যেরা বলছেন যে, অবস্থা এখনও অনেকখানিই বিপ্লবীদের পক্ষে রয়ে গেছে। সেখানে জাতীয় করের ৪০ ভাগ কর দেওয়া বন্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক স্থৈর্যও ফিরে আসেনি। গেরিলাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি এবং সরকারী কর্মচারীদের প্রতি কাজে যোগদানের আদেশ প্রদান- সামরিক জান্তার এই বড়শির টোপে অল্প বাঙালিই ধরা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, পূর্বাঞ্চলের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ১৬৭ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র দুইজন তাঁদের স্বাধীনতার আন্দোলন আঞ্চলিকভাবে পরিত্যাগ করেছেন।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং পূর্বের নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ পশ্চিমেও রাজনৈতিক ধাক্কা বয়ে এনেছে। প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের অপরাধে উত্তর পশ্চিম সিন্ধু প্রদেশের ১২ জন নেতাকে সাম্প্রতিককালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তাছাড়া পশ্চিমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁর অনুগামীদের কাছে সামরিক শাসন অবসানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হওয়ায় মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছেন। সর্বোপরি মুদ্রাস্ফীতি এবং বাঙালীদের প্রতিরোধ সংগ্রামই ইয়াহিয়ার কাছে ব্যক্তিগতভাবেই পতনের পূর্বাভাস হয়ে দেখা দিয়েছে। করাচীর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আমায় বলেছেন, ইয়াহিয়া খানকে ছ’মাসের মধ্যে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে হবে। অতঃপর সৈন্যবাহিনী বুঝবে যে, রাষ্ট্রপতি যতটুকু না চিবোতে পারেন তার চেয়ে বেশী মুখে পোরেন। ফলে তারা নতুন নেতা খুঁজতে চাইবে। ইয়াহিয়াকে বাতাসের অনুকূলে আসতেই হবে- অবশ্য সময়ও দ্রুতগতিতে বয়ে যাচ্ছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!