You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.24 | জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়: ইয়াহিয়ার ইরান সফর | জয় বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়: ইয়াহিয়ার ইরান সফর
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ২০শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ইয়াহিয়ার ইরান সফর

একদিনের জন্য ইয়াহিয়া খানের আকস্মিক ইরান সফর সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যমূলক। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী অপরদিকে যুদ্ধপরিস্থিতির দরুন এবং ঘাতক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের ফলে দখলীকৃত বাংলাদেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় বিব্রত সামরিক কলকারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে সত্যিকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হওয়ায় খাস পশ্চিম পাকিস্তানেও রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের সাক্ষী ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের ৮৫ লক্ষ শরণার্থী। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর জন্যে বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মুখ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের কৈফিয়তও খাটছে না। এইভাবেই তৈরী হয়েছে তাদের সংকটের বেড়াজাল।

এই সংকটের জাল এড়াবার জন্য পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে ইরানের হৃদ্যতামূলক সম্পর্কের সুযোগে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ইরানকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে যায়। বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারতের মধ্যে ইরানকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে চায়। বাংলাদেশ সমস্যাকে এড়িয়ে বর্তমান সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধের রুপ দেয়ার এই পাকিস্তানী আগ্রহ নতুন নয়। বাংলাদেশে সামরিক এডভেঞ্চার শুরু করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নিজেদের সৃষ্ট সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। তারপর থেকেই ইয়াহিয়ার সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একজন মধ্যস্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে । ইতিপূর্বে আমরা মধ্যস্থ হিসেবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়ার টেংকু আব্দুর রহমান প্রভৃতির নাম শুনেছি। আবার বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েন করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিরোধকে পাক-ভারত বিরোধ রূপান্তরিত করার প্রয়াসও আমরা লক্ষ করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটাই সফল হয়নি। এক্ষণে পাকিস্তানের হইয়ে এই কাজটি করে দেয়ার জন্যে ইয়াহিয়া খান ইরানের শাহের দ্বারস্থ হয়েছে।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বর্তমান সংকটটি বাংলাদেশ সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যা। একে এড়িয়ে গিয়ে সমস্যার প্রকৃত কারণ হতে পারে না। ইরানের শাহ সত্যিই যদি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে প্রকৃত বিবদমান পক্ষকেই বেছে নিতে হবে। এই বিরোধের বিবদমান পক্ষ পাকিস্তান ও ভারত নয়, আসল বিরোধ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে । এটাকে এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যে ৮৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সরাসরিভাবে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সংকটের শিকার। কাজেই এই সংকটের সমাধানো নির্ভর করছে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে, পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার মধ্যে নয়।

কিন্তু এই বাস্তব সত্য কি ইরানের শাহ স্বীকার করে নেবেন? ইয়াহিয়া-শাহ আলোচনার পর যে সংক্ষিপ্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ সমস্যার ক্ষীণতম ইঙ্গিতও নেই। বরং যা আছে তা প্রকারান্তরে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর প্রতি পরোক্ষ সমর্থন বলা চলে। উক্ত যুক্ত ঘোষণায় পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সমর্থনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কাজেই এই কথিত মধ্যস্থতার চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে এর পরে আর কারো মনেই মোহ থাকবার কথা নয়। অবশ্য ইরানের কাছ থেকে সত্যিকারের কোন গণতান্ত্রিক ভূমিকা আশা করা চলেনা। ইরানের পূর্বাপর ভূমিকা আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইরানের রাজতন্ত্র এ পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও গণমুখী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি ইরান কোনদিন সক্রিয় সমর্থন তো দূরের কথা, নৈতিক সমর্থনও জানাইনি। বরং আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ারে পাছে ইরানের রাজতন্ত্র বিপন্ন হয় সেই ভয়ে ইরানের রাজতন্ত্র বারবার পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরোধিতাই করেছেন। এমন কি ইরানের মহান জাতীয়তাবাদী নেতা ডঃ মোসাদ্দেককে পর্যন্ত ইরানী রাজতন্ত্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ডঃ মোসাদ্দেকই ইরানের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইরান আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে এখনও একটি মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ায় নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার ফলে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও শক্তির ভারসাম্য বিপন্ন হতে বসেছিল, ইরানের রাজতন্ত্র পেছন দুয়োর দিয়ে সেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিশ্বস্ত প্রহরী হিসেবে কাজ করে আসছে।
বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরও ইরান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানী জান্তাকে অর্থ ও সমর সম্ভার যুগিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিনিধিদেরকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ইরানের শাহ নির্বাচনের পূর্বেও একবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সেসময় ইসলামাবাদ হয়ে ইরানের শাহ আকস্মিকভাবে ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। কিন্তু শেখ সাহেব যে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হননি, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণ ও জাতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযান ও ঘৃণ্যতম গণহত্যার ইতিহাস থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও সাম্রাজ্যবাদী সরকারসমূহের নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে পরোক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ দানের ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইরানের শাহ বা করিম আগা খানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীরা কোন স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

আমরা অবশ্য জানি যে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার প্রয়াসও তাদের ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নির্ভর করে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান, বাংলাদেশ সরকারের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ এবং হানাদার বাহিনীর অপসারণের ওপরে। অন্যথায় নয়। ইরানের শাহের সত্যই যদি এই সমস্যা সমাধানের কোন সদিচ্ছা থাকে তাহলে ইয়াহিয়া সরকারের ওপরেই তিনি প্রভাব বিস্তার করুন।

এই সংখ্যা হতে ‘জয় বাংলা’ সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।