শিরোনাম: ভিয়েতনাম পদ্ধতিতে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া খান বিশেষ জল্লাদ বাহিনী গড়ে তুলেছে
সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা (১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা)
তারিখঃ ২৭ আগস্ট,১৯৭১
সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন বেলুচিস্তানের কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করেছে। এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। দক্ষ হত্যাকারী গড়ে তোলার জন্য এই বিদেশী হত্যা বিশেষজ্ঞদের আমদানি করা হয়েছে উত্তর ক্যারোলিনা থেকে ।
যুগে যুগে যেসব জল্লাদ সম্রাট ও রাষ্ট্রনায়ক বিশ্বের বুকে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, নৃশংস হত্যার স্বীকার সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে বর্বর শাসনের ইমারত গাঁথুনি দিয়েছে পিণ্ডির ইয়াহিয়া তাদের সমগোত্রীয় ।অতীতের নির্যাতনকারী হত্যার নায়কদের ব্যতিক্রম তিনি নন। ২৫ মার্চের বহু পূর্বে থেকেই এই মানব সভ্যতা বিরোধী হত্যাবাজ জেনারেল অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্রমে ক্রমে রুদ্ধদ্বার ভেদ করে অবিশ্বাস্য হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে।
সব জানোয়ারকে যেমন পোষ মানানো যায় না, তেমনি সব মানুষকে দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না। সে জন্যই রক্ত পিপাসু ও পশু প্রকৃতির সেনাদের বাছাই করে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে বাছাই করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এদের বিশেষ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিকামী ভিয়েতনামী নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যেমন করে গুপ্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিল । যার নাম সরকারী ভাবে “গ্রিন ব্যারেট” । ইয়াহিয়া সরকারও ঠিক তেমনি করে গোপন ট্রেনিং দিয়ে একটি বিশেষ হত্যাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। ব্যাপক গণহত্যা , বেছে বেছে জীবন নাশ, হিটলারের এস এস অফিসারদের পদ্ধতিতে নির্যাতন, ধ্বংস ও অগ্নিকান্ড সম্পর্কে এদের বিশেষজ্ঞ করে তোলা হয়েছে। জেনারেলদের ফাইলে একে “বিশেষ বাহিনী” বা স্পেশাল ফোর্স বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার কাছাকাছি অঞ্চলে যে স্থানটিতে ব্রিটিশ আমল থেকেই সামরিক ছাউনি রয়েছে তার নাম কাকুন। সাধারণ প্রশাসনিক কাজে কাকুন নামটির উল্লেখ থাকে না। এই বিশেষ ছাউনিতে সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এই নিচ্ছিদ্র কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করে।
বিদেশী তথ্য অনুযায়ী, কাকুনে প্রায় এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। দক্ষ হত্যাকারী গড়ে তোলাই এই বিদেশী বিশেষজ্ঞদের কাজ । বেতনভুক্ত এই হত্যা বিশেষজ্ঞদের আমদানি করা হয়েছে উত্তর ক্যারোলিনা থেকে।.আইয়ুব খাঁর আমলে ১৯৬৪ সাল থেকেই এই ধরনের একটা বিশেষ বাহিনী গঠনের চেষ্টা চলছিল। আর সে সময় জেনারেল মুসা আর বর্তমানে জেনারেল ইয়াহিয়া উক্ত বাহিনীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধানত পাঞ্জাবী ও আরও কয়েকটি রেজিমেন্ট থেকে বাছাই করা পাঁচ শত অস্বাভাবিক চরিত্রের সেনাকে পাঠানো হয় আমেরিকায় হত্যা বিশেষজ্ঞদের ট্রেনিং লাভ করতে। এই ব্যবস্থাকে এতই গোপন করা হয়েছিল যে , ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দুরের কথা অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাপ্রধানও তা জানতেন না। এই সমস্ত হত্যা ও ধ্বংসের সেনাদের সমন্বয়ে যে হত্যাকারী নরপিশাচের দল গঠন করা হয় তার নাম “স্পেশাল ফোর্স” । দশজনের এক একটি দল করে তাদের পঞ্চাশটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়।
আমেরিকার উত্তর ক্যারলিনাস্থ “ফোট ব্র্যাগ” এ মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ট্রেনিং ক্যাম্পটিতে এই ধরনের বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত হত্যা বাহিনী তৈরি করা হয়ে থেকে। ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স প্রথমে “ফোট ব্র্যাগ” ক্যাম্পেই লালিত হয়েছে। বর্তমানে কোয়েটাস্থ “কাকুন” পশ্চিম পাকিস্তানী উন্মাদ জেনারেলদের “ ফোট ব্র্যাগ” আর কাকুন থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা প্রাপ্ত হত্যাকারী বাহিনীই হচ্ছে তাদের “ গ্রিন ব্যারেট”।
জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের তথ্য অনুযায়ী , অতিতে ও বর্তমানে ট্রেনিং-প্রাপ্ত হত্যা বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশে নরহত্যা ও ধ্বংসের অবিশ্বাস্য অভিযানে যুক্ত রয়েছে। কাকুন গুপ্ত শিবিরে এদের তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়া হয়ে থাকে। ট্রেনিং-প্রাপ্ত জল্লাদদের সংখ্যা দিন দিন এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে যে , ভবিষ্যতের দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন বিদ্রোহ স্থানে এদের পোস্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে।
২৫ শের রাত্র থেকে মেজর জেনারেল মিঠার উপর দায়িত্ব পরেছিল ইয়াহিয়ার গেরিলা বাহিনীর। আর রক্ত পিপাসু স্পেশাল বাহিনী তারই সামগ্রিক নেতৃত্বের আওতায় আসে। এ রাত্র থেকে এবং পরবর্তী কালে এই বাহিনীই ইয়াহিয়ার গণহত্যার পরিকল্পনা কার্যকরী করেছে।
কিন্তু সেই স্পেশাল বাহিনীর রক্ত লালসা শেষ হবার পূর্বেই তারা নিজেদের রক্ত প্রবাহ দেখে আঁতকে উঠে । আর নিজের সঙ্গীর মৃত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠেছে পরবর্তী ভয়াবহ মুহূর্তের কথা ভেবে।
ভিয়েতনামে যেমন গ্রিন ব্যারেট দের পালিয়ে যেতে হয়েছে , বাংলাদেশের মাটিতে ঠিক তেমনিভাবে ইয়াহিয়ার স্পেশাল বাহিনীকে বিলীন হয়ে যেতে হচ্ছে। নৃশংস হত্যা আর ধ্বংসের স্বীকার দেশপ্রেমিক সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যেকটি রক্ত কণিকা থেকে আজ জন্ম নিচ্ছে মুক্তি সেনা। তাদের দুর্জয় অভিযানের মুখে , তাদের প্রতি আক্রমণের তীব্রতার ঝলকে হত্যাকারী হায়েনাদের জীবনে বিভীষিকার হাতছানি। মৃত্যু , উচ্ছেদ আর পরাজয়ের কালিমা তাদের আজ কলঙ্কিত ইতিহাসের ধিক্কৃত জীব বলে চিহ্নিত করেছে।