জীবনচিত্র নামঃ ডা. মফিজ উদ্দিন খান
Dr. Mofiz Uddin Khan
ডাকনামঃ মফিজ
পিতার নামঃ হাজী মো. ইসমাইল খান
পিতার পেশাঃ মসজিদের ঈমাম, বিশিষ্ট ভাষাবিদ
মাতার নামঃ শরিয়তুন্নেছা
ভাইবোনের সংখ্যাঃ সাত ভাই, এক বোন; নিজক্ৰমঃ যষ্ঠ
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-বড়বাড়ি, ডাকঘর-উস্থি(জায়দাবাদ)
গফরগাঁও, উপজেলা-গফরগাঁও, জেলা-ময়মনসিংহ
শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খান
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ বাড়ি-১০৬, সড়কঃ জাহানারা ইমাম সড়ক (পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড), ডাকঘরঃ নিউমার্কেট, থানাঃ ধানমণ্ডি, জেলা-ঢাকা
জন্মঃ ১ জানুয়ারি, ১৯২৭
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ ১৯৪৩, ধলা হাইস্কুল, ময়মনসিংহ
আইএসসিঃ ১৯৪৫, আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
এলএমএফঃ ১৯৫২, লিটন মেডিকেল স্কুল, ময়মনসিংহ
এমবিবিএসঃ ১৯৫৬-৫৭. ঢাকা মেডিকেল কলেজ
Post-graduate Training Certificate in Eye and ENT, King Edward Medical College, Lahore 1956.
শখঃ মঞ্চনাটক। যেমন-নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ফুটবল খেলা, বাঁশি বাজানো
চাকরির বর্ণনাঃ
১৯৫২ : মেডিকেল অফিসার, বিসিজি টিম, পূর্ব পাকিস্তান স্বাস্থ্য বিভাগ
১৯৫৬ মেডিকেল অফিসার, চক্ষু বিভাগ, Mayo Hospital, Lahore, West Pakistan
১৯৫৮-৬২ : ইন্সট্রাকটর, পাবলিক হেলথ, এমডিটিআই, তেজগাঁও, ঢাকা
১৯৬৪ : সহকারী সার্জন, ইপিএইচএস
১৯৬৯ : মেডিকেল অফিসার, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
১৯৬৯-মৃত্যু পর্যন্তঃ রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট, মেডিকেল রিসার্চ সেন্টার, ডায়াবেটিক সমিতি, সেগুনবাগিচা, ঢাকা
হত্যকারীর পরিচয়ঃ পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক বিমান হামলার বোমাবর্ষণে নিহত
নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকেল ৪টা
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ বাড়ি-১০৬, সড়ক, জাহানারা ইমাম সড়ক (পুরনো এলিফ্যান্ট রোড)
ডাকঘরঃ নিউমার্কেট, থানাঃ ধানমন্ডি, জেলাঃ ঢাকা
প্ৰাপ্তি তারিখঃ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
দাফনের স্থানঃ আজিমপুর পুরনো কবরস্থান
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ
স্ত্রীর নামঃ হালিমা আক্তার খাতুন
সন্তান-সন্ততিঃ তিন পুত্র ও তিন কন্যা
মো. মোছলেমউদ্দিন, আই.এ, পর্দা বিতান, ১১৫/এ, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা
ডা. নাজিমুননেছা মুকুল, এমবিবিএস, এমপিএইচ, জিগাতলা জিওডি, ঢাকা
সেলিমা, এমএ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
ইঞ্জিনিয়ার মো. ছালাহউদ্দিন খান, বিএসসি, BETS
মো. ইকবাল খান, এমএ, ১১৫/এ, নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা
লুৎফুন নাহার, এমএ, ন্যাশনাল ব্যাংক, দিনাজপুর
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ
মিল্টনঃ শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খানের পুত্র
গোলাপঃ শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খানের শ্যালক
তথ্য প্রদানকারী
ডা. নাজিমুননেছা মুকুল
শহীদ চিকিৎসকের বড় কন্যা
বাড়ি-২৭, রোড-৫, ফ্ল্যাট-৪/এ
কেন্ডেলউড), ধানমণ্ডি আ/এ, ঢাকা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৩৯
আমার বাবা
শহীদ ড. মফিজ উদ্দিন খান
ডা. নাজিমুননেছা মুকুল
স্মৃতিচারণ করা কখনও সুখকর, কখনও বেদনাময়। এ মুহুর্তে বেদনাময় স্মৃতিচারণ করার জন্য যাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছি তিনি হলেন একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন নির্ভীক, মানবদরদি ও দেশপ্রেমিক শহীদ। তিনি আমার পিতা। যিনি আজ শুধুই স্মৃতি। আমার স্মৃতির ক্যানভাসে লালিত অবিস্মরণীয় একটা দিন- একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। স্বাধীন হওয়ার ঠিক দু’দিন আগে।
তখন আমরা ঢাকায় ১০৬, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় থাকি। সকাল থেকে কার্ফু। ফজরের নামাজ আদায় করে আব্বা সকাল ৮টায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে নাশতা করছেন। আর গল্প করছেন স্বাধীনতা নিয়ে। বলছিলেন, ‘এই তো আর বেশি বাকি নেই দেশ স্বাধীন হওয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাবে।’ আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। পুরো ঘটনাটি মনে হয় সেদিনের কথা। কাজের খুব তাড়াহুড়া ছিল না বলে আব্বা কার্ফুর ভেতরেই পাড়ার বন্ধুদের বাসায় ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে বাসায় ফিরে আসেন। এরপর জোহরের নামাজ আদায় করে খাওয়া-দাওয়া সেরে ছেলেমেয়েদের সবাইকে নিয়ে বিশ্রাম নিতে যান। বিকেল চারটার দিকে চারদিকে শোনা যাচ্ছিল শুধু গুলির আওয়াজ। সবাই বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে চলে যাই দেখতে, যে কী হচ্ছে? আব্বাও পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে যান। ভেবেছিলেন তিনিই টার্গেট কিনা? চারদিক থেকে প্রচণ্ডভাবে বিমান হামলা চলছে, বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ হচ্ছে। আব্বা সবাইকে ঘরে আসার জন্য বললেন, আর আম্মাকে বললেন, ‘হালিমা এবার মনে হয়। আর রক্ষা নেই।’ বলতে বলতে আমার ভয় পাওয়া ছোট ভাই ইকবাল আর ছোট বোন তুলতুলকে কোলে নেন। আর তখুনি আব্বার মাথায় শেলের আঘাত লাগে। আব্বা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন; দুই ভাইবোন দুই দিকে ছিটকে পড়ে। আম্মা আর আমার গায়েও বোমা এসে লাগে। চরমভাবে আহত হই। আমি ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছিলাম। তখনও জানি না আব্বা ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছেন। মনে হচ্ছিল আব্বা কেন এখনো আসে না!
২৪০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খান
নিশ্চয় ওষুধের দোকান থেকে ওষুধপত্র আনতে গেছেন। আম্মাকে দেখি সারা গায়ে রক্ত নিয়ে আলমারি থেকে টাকা বের করছেন। এরই মধ্যে বাসার আশপাশ থেকে লোকজন এসে ভিড় করে। কেউ রক্ত মুছছে, কেউ পানি খাওয়াচ্ছে, কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে। আম্মাকে বলছিলাম, ‘আব্বাকে ডাকো… আমি তো মরে যাচ্ছি…, আমার ভীষণ ব্যথা হচ্ছে।’ আম্মা কান্নাস্বরে বলেছিলেন, ‘তুই আর ডাকিস না; তোর আব্বা আর নেই।’ কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না-আব্বা নেই! বিকেল পাঁচটার দিকে অ্যাম্বুলেন্স এসে আমরা জারা আহত হয়েছিলাম সবাইকে মরণাপন্ন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার সবচেয়ে বড় ভাই (তখন বয়স ১৪ বছর) সব ব্যবস্থা করছিল। স্পষ্ট মনে আছে, অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা যখন বলছে, ‘আগে যারা আহত হয়েছে তাদের নামানো হোক।’ তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আব্বার সাথে আমার এটাই শেষ দেখা। আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে যাওয়া হয় সোজা অপারেশন থিয়েটারে আর বাকি দুই ভাইবোনকে নিয়ে যাওয়া হয় এগারো নং শিশু ওয়ার্ডে। অপারেশন থিয়েটার থেকে এগারো নং ওয়ার্ডে আসার পর বিছানায় অর্ধচেতন অবস্থায় যখন ‘আব্বা! আব্বা!!’ বলে চিৎকার করে ডাকতাম, তখন নাকি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স সবাই কাঁদত আর বলতো, ‘এ মেয়েকে বোধহয় বাঁচানোই যাবে না’। পাশের বিছানায় ছিল আমার মা। হাসপাতালে আমরা চার ভাইবোন আর আম্মা প্রায় সাতদিন জ্ঞানহারা ছিলাম। আম্মার চেহারা এমনভাবে ঝলসে গিয়েছিল যে কান্নাকাটি করলেও চেহারা দেখার জন্য আম্মাকে কেউ আয়না দিত না। বড় ভাই ১৫ ডিসেম্বর গোলাগুলি ও বোমাবর্ষণের মাঝেও আমাদের জন্য ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে এলো। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলাম, দেখছিলাম-মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার ছোট ভাই মিল্টন বিছানায় মরে পড়েছিল। কিছুদূর যেতেই দেখেছিলাম, আব্বার ক্লিনিকের ছাদে গুলি খেয়ে নিচে মাটিতে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছে আমারই মামা গোলাপ| তাদেরও হাসপাতালে আনা হয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর সকালে মামা মারা যান।
সেই যে মারাত্মক আহত অবস্থায় আম্মা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বড় ভাইয়ের হাতে টাকা দিয়েছিলেন তা দিয়ে বড় ভাই প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় ১৭ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় আজিমপুর পুরনো কবরস্থানে আব্বাকে দাফন করেন। আমার ভাই মিল্টন এবং মামা গোলাপেরও দাফন হয় সেখানে।
মিল্টন ভালো কবিতা লিখত। তখন সে ক্লাস সেভেনে পড়তো। তার লেখা অনেক কবিতা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপা হতো। মিল্টন নানাকে লিখেছিল, ‘নানা, আব্বাকে বুঝিয়ে বলো আমাদের দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। নয়তো আমরা একদিন ঢাকার মাটিতে হারিয়ে যাবো। কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না’। সত্যিই আমাদের হাসপাতালে থাকা অবস্থায় কোথায় যে ওর কবর হয় তা আজও জানি না। আমার ভীষণ কষ্ট হয় ওর কথা মনে হলে। আব্বা বলতেন, ‘গ্রামের বাড়ি চলে গেলেই কি বেঁচে যাবে? মৃত্যু এলে যে কোনো জায়গায় হতে পারে।’
প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে থাকার পর আমরা যখন বাসায় আসি দেখি আমাদের বাসাটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সহায়-সম্বলহীন হয়ে গিয়েছিল আমাদের সমস্ত পরিবারটি। কোনোমতে আব্বারই করা ক্লিনিকের পেছনে দুটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে শুরু হয় আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। বিজয়ের অনেক কয়টা মাস পরেও আম্মা কারো সাথে কথা বলতে পারতেন না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আর বিড়বিড় করে হয়তো বলতেন, ‘দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বামী নেই, ছেলে নেই, ভাই নেই।’ এরপর আমাদের নম্র, শান্ত মা বাস্তবের জটিল জগতে ফেললেন তাঁর অদম্য মনোবল আর আশা নিয়ে। ছেলেমেয়েদের ওদের বাবার মতো মানুষ করতে হবে এটাই ছিল আম্মার সাধনা| আব্বার খুব ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তারি পড়ানো। আজ আমি ডাক্তার, দুই জামাই ডাক্তার, ভাই প্রকৌশলী, অন্যান্য ভাইবোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছেন। আব্বা থাকলে কত খুশি হতেন তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। জীবনে সুখ কী জিনিস তা আম্মা পায়নি। বিধবা হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের বুকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সবাইকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন হারালেন স্বাধীনতার জন্য। যেভাবে হারিয়েছেন আরো হাজারো মা-বোন।
এমন হাজারো স্মৃতি একাত্তরকে ঘিরে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো। নিখুঁত শিল্পীর মতো সেসব স্মৃতি
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৪১
শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খান
হৃদয়ে আঁকা আছে। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এলে আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা। যেদিনটি আমাদের পরিবারের সব সদস্যের জীবনে সবচেয়ে শোকাবহ দিন। পিতৃহারা মনের বেদনা ভূক্তভোগী ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারে না। আমার সামনে কেউ বাবা বলে ডাকলে আমার মন নীরব বেদনায় কেঁদে ওঠে।
এরপর বলি আব্বার আরো কিছু কথা। আব্বা জীবনের প্রথমদিকে সরকারি চাকরি করতেন এবং পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতেন। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, নীতিতে অটল। মনুষ্যত্ববোধ, দেশপ্রেম আর মানুষের উপকার করার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য স্পৃহা| দেখতাম রাতের অন্ধকারে মো. হাবিব, শহীদসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করতো, আব্বার কাছ থেকে চিকিৎসা নিতো। আব্বাও লুকিয়ে লুকিয়ে ঢাকার আশপাশে বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে তাদের খোঁজখবর রাখতেন। আব্বা প্রায়ই বলতেন ‘দশজনের উপকার করলে আল্লাহও তোমার উপকার করবেন।’ যারা একটু ডাক্তার দেখাতে আর্থিকভাবে অসমর্থ ছিল, দেখতাম আব্বা নিজ গাড়িতে করে ডাব নিয়ে তাদের দেখতে যেতেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। আপনজন, বন্ধুবান্ধব, ধনী-গরিব সবার সাথে প্রাণখুলে হাসিমুখে কথা বলতেন। অন্যায়, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবাদী হয়ে যেতেন। ক্ষতি হয়েছে তবু তিনি নতজানু নীতি গ্রহণ করেননি। আব্বার কাছ থেকে শিখবার ছিল অনেক। নানা ব্যস্ততার কারণে তিনি সময় নিতে পারেননি; তবু দেখতাম প্র্যাকটিস করে প্রায়ই রাত বারোটা-একটার দিকে আমাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। কখনও কখনও পড়াতেন। তাও আবার ইংরেজি। বাক্য গঠন, ভাষার ব্যবহার-সেই শৈশবকালে আব্বা যা শিখিয়েছিলেন তা দিয়েই এতদূর পথ পার করেছি। দ্রুতগতি সম্পন্ন মানুষটি কখনও কাজে-কর্মে, চলনে-বলনে চিলেমি পছন্দ করতেন না। সংসারের খুঁটিনাটি কাজ থেকে শুরু করে অফিসের কাজ পর্যন্ত পুরো সময়টাই যন্ত্রের মতো করতেন। সাংসারিক জীবনে গোছানো ব্যক্তি ছিলেন তিনি। চলতে-ফিরতে অগোছালো
২৪২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মফিজ উদ্দিন খান
জিনিস তিনি গুছিয়ে রাখতেন। যখন কেবল আমরা পড়তে শিখেছি তখন দেশ-বিদেশের কোথায় কী ঘটেছে। তা জানার জন্য বিভিন্ন বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা, পড়তে দিতেন। প্রাতাহিক জীবনের কথা বলতে গেলে বলতে হয়—আব্বার পুরো জীবনটাই একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত। কাকড়াকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়া, শেভ করা, খবর শোনা ছিল প্রতিদিনের কাজ। সারা পৃথিবীর রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। প্রতি শুক্রবার নিজের ক্লিনিকে তিনি গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। বাসায় আত্মীয়-স্বজন এলে খুশি হতেন। এমনি অনেক স্মৃতি… তা লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁর আদর্শ, ধ্যান-ধারণা আমার সর্ব অস্তিত্বে। প্রতিমুহুর্তে তাঁর উপস্থিতি আমাকে আকুল করে দেয়। তাই মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম, বাবার আদর্শে গড়ে উঠবো, আব্বার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবো আমাদের কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।
আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তাক্ত পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। মাঝে মধ্যে চিন্তা করি আমরা কী পেলাম? বছরের পর বছর দেশের অগণিত শহীদ পরিবার নীরবে মানসিক কষ্ট নিয়ে দিন কাটাচ্ছে তার খবর কে রাখে? বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের প্রতিটি রাষ্ট্ৰীয় অনুষ্ঠানে শাসক, আমলাদের আমন্ত্রণ। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে কার বসার কথা! তাঁরা তো কখনও খোঁজ নেন না কীভাবে সেই পরিবারের সদস্যদের দিন কাটছে? কী সমস্যা রয়েছে তাঁদের? দেশের সব শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিবেকমান মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখি, বাঙালিদের যে বৃহত্তর স্বার্থে আমার বাবার মতো আরও লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন সেই কারণগুলো কি বাংলাদেশে আজও বাস্তবায়িত হয়েছে? ব্যক্তিগতভাবে যখন ভাবি, যে সম্পদ আমরা হারিয়েছি তা কি কোনোদিন ফিরে পাবো? পাব না জানি। তবুও বাবা, মামা, ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশ পেয়েছি। এর চেয়ে বড় সম্পদ, বড় গৌরব আর কী হতে পারে? তাঁরা সবাই বেঁচে আছেন আমার মধ্যে, আমার মায়ের মধ্যে, আমার ভাইবোনের মধ্যে। বেঁচে আছেন অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আর জাতির ইতিহাসের মধ্যে। এখন শহীদদের সন্তান হিসেবে এটাই আমাদের সান্ত্বনা ও একমাত্র পাওয়া। স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে আমরা যেন আত্মমর্যাদা নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। এর জন্য যেন আর রক্ত না দিতে হয়।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে(তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১; জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৫৯২, ৭০৭ ।
ঘ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৭ম খণ্ড, ১ম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ কার্তিক ১৪০৬, নভেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ৩৮ ।
ঙ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৮; পৃ. ৯, ৪৩ ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৪৩
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ