জিয়া হত্যা ও এরশাদের অভ্যুত্থান
১৯৮১ সালে ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর একটি বিদ্রোহী গােষ্ঠী কর্তৃক নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সংবিধানের নিয়ম অনুসারে ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিচারপতি আব্দুস সাত্তার স্থায়ী রাষ্ট্রপতিরূপে নির্বাচিত হন। এই নিয়মমাফিক ক্ষমতা হস্তান্তর দেখে কোনাে কোনাে পর্যবেক্ষক আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন ভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখতে সক্ষম হবে।১ কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাত্র ১২৮ দিন পর এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হুসেইন মােহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন, মন্ত্রীপরিষদ ও সংসদ ভেঙে দেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং সারা দেশে সামরিক আইন আরােপ করেন। এই অধ্যায়ে জিয়ার হত্যা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ২৪ মার্চের সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে আলােচনা করা হবে।
১. জিয়া হত্যা
১৯৮১ সালের ২৯ মে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে বিনপি নেতাদের মধ্যেকার কলহ নিরসনের উদ্দেশে সেখানে যান। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অবস্থানকালে ৩০ মে প্রত্যুষে সেনাবাহিনীর প্রায় ২০ জন অফিসার সহসা আক্রমণ চালিয়ে জিয়াকে হত্যা করেন। বিদ্রোহী অফিসারগণ স্থানীয় বেতার কেন্দ্র দখল করে সেদিন বেলা ন’টার সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সেনাধ্যক্ষ মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে একটি ৭ সদস্য বিশিষ্ঠ বিপ্লবী পরিষদ গঠনের কথা ঘােষণা করেন। ঢাকায় অবস্থানরত রাষ্ট্রপতির প্রধান স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়ােগ দানের কথাও ঘােষণা করা হয়। জেনারেল মঞ্জুর বিপ্লবী পরিষদের প্রধান হিসেবে বেতারে বক্তৃতা করে কার্যত জিয়া হত্যার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিপ্লবী পরিষদের নামে চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে ১৩টি নির্দেশ জারি করা হয়। এই সব নির্দেশের মাধ্যমে সংবিধান বাতিল,
২৩০
মন্ত্রীপরিষদ বরখাস্ত, জাতীয় সংসদ, গ্রাম সরকার ও যুব কমপ্লেক্স বাতিল, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রীচুক্তি বাতিল, সকল প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা স্থগিত, সকল রাজনৈতিক দলের তহবিল বাজেয়াপ্ত এবং দেশে সামরিক শাসন আরােপের ঘােষণা দেয়া হয়।২
চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সৈনিকবৃন্দ ও বাইরের অন্যান্য সামরিক নেতাদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন না পাওয়ায় রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জেনারেল মঞ্জুরের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং তিনি তাঁর সহযােগী বিদ্রোহী অফিসারবৃন্দ ও তাঁদের পরিবার পরিজনসহ ১ জুন তারিখের মধ্যরাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ত্যাগ করেন। ফলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস সরকারের অনুগত সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। জেনারেল মঞ্জুর ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ চট্টগ্রাম থেকে ২৫ মাইল দূরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। প্রথমে তাদেরকে ফটিকছড়ি থানায় আনা হয়। সেখানে মঞ্জুর তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করেন এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরের একটি দীর্ঘ জবানবন্দি টেপরেকর্ড করেন বলে জানা যায়। তবে তার এই রেকর্ডকৃত বিবৃতি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি; সম্ভবত সেটি নষ্ট করে ফেলা হয় অথবা হারিয়ে যায়। জেনারেল মঞ্জুর তাঁকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাের জন্যও অনুরােধ করেন। কিন্তু তা না করে পুলিশ দুজন সহযােগী অফিসারসহ মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রেরণ করে এবং সেনানিবাসে প্রবেশের পর পরই এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে তাদেরকে হত্যা করা হয়।৩
রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ সরকার ৩০ মে’র ব্যর্থ অভ্যুত্থানে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য মেজর জেনারেল মুজাম্মিল হােসেনের নেতৃত্বে একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল ও জিয়া হত্যার জন্য দায়ী সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য মেজর জেনারেল আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সামরিক আদালত (কোর্ট মার্শাল) গঠন করে। ৩০ মে’র ঘটনা তদন্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুহুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশনও গঠন করা হয়। বিচার বিভাগীয় কমিশনের কোনাে রিপাের্ট প্রকাশ করা হয়নি। সামরিক আদালতে ১৯৮১ সালের ১০ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত গােপনে ৩১ জন সামরিক অফিসারের বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁদের মধ্যে ১০ জন মুক্তিযােদ্ধাসহ ১২ জন অফিসারকে জিয়া হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে মেজর জেনারেল মীর শওকতকে (যাকে বিপ্লবী পরিষদ অস্থায়ী স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়ােগের কথা ঘােষণা করে) লে. জেনারেল পদে উন্নীত করে রাষ্ট্রদূত হিসাবে বিদেশে প্রেরণ করা হয়। ১৯৮১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযােদ্ধা সংগঠনসমূহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলাের তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের ফাঁসি দেয় হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহ ৩০ মে তারিখের ঘটনাবলির ‘নিরপেক্ষ আদালতে প্রকাশ্য বিচারের দাবি জানায়। তারা মনে করে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ পরিস্থিতির শিকার’ মাত্র। তারা অভিযােগ
২৩১
করে সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে স্বার্থবাদী মহল প্রকৃত ষড়যন্ত্রকারীদের রক্ষা করার অপচেষ্টা করছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের উৎখাত করার জন্য বিচার প্রক্রিয়াকে নস্যাত করতে চাচ্ছে। তারা আরাে মনে করে যে, সামরিক আদালতের প্রধান মেজর জেনারেল আব্দুর রহমান (যিনি পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের অন্যতম ছিলেন) মুক্তিযোেদ্ধাবিরােধী মনােভাবাপন্ন একজন অফিসার। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে ন্যায় বিচার আশা করা যায় না।৪
ক. সরকারি ভাষ্য
৩০ মে তারিখের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহী অফিসারদের বিচার সংক্রান্ত ঘটনাবলির ব্যাখ্যা দানের উদ্দেশে সরকার ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে এক ‘শ্বেতপত্র প্রকাশ করে।৫ এই শ্বেতপত্রে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ঐ অভ্যুত্থানের হােতা বলে চিহ্নিত করে বলা হয়, তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সাহায্যে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেন। সেখানে আরাে বলা হয় যে, মঞ্জুর ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্রপতি ও অধিকাংশ সিনিয়র অফিসারদের ঈর্ষা ও কঠোর সমালােচনা করতেন। তিনি মনে করতেন যে, মুক্তিযােদ্ধারাই দেশ শাসন করবে এবং জিয়া নিজে মুক্তিযােদ্ধা হয়েও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তেমন কিছু করছেন না। শ্বেতপত্রে আরাে বলা হয়, এই পর্যায়ে মঞ্জুর রাষ্ট্রপতিকে অপহরণ করে নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের দাবি দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের দাবিগুলাের মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও ঢাকা গ্যারিসনের জি ও সি (যাঁরা দুজনই ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধা) অফিসার-সহ কিছু সংখ্যক সিনিয়র অফিসারের অপসারণ, দক্ষ ব্যক্তিদের উচ্চতর পদে উন্নীতকরণ, সংবিধান ও রাজনৈতিক তৎপরতা তিন বছরের জন্য স্থগিতকরণ এবং সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিবিধান।
শ্বেতপত্রে আরাে বলা হয় যে, জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের নিয়ােগের নীতির অনুসরণ করেন। মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে তাঁর পরিকল্পিত বিদ্রোহের স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্দেশে জেনারেল মঞ্জুর এটা করেন বলে অভিযােগ করা হয়। শ্বেতপত্রে আরাে দাবী করা হয়, মুক্তিযােদ্ধাদের প্ররােচিত করার জন্য ১৯৮১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে এই মর্মে ব্যাপক গুজব ছড়ানাে হয় যে, সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে অবস্থানরত পাকিস্তান এবং ফেরৎ অফিসাররা মুক্তিযােদ্ধাদের উৎখাতের জন্য ষড়যন্ত্র করছেন। এই সময়ে (২৭ মে, ১৯৮১) মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম গ্যারিসনের জি ও সি পদ থেকে ঢাকায় মিলিটারি স্টাফ কলেজের কম্যান্ডান্ট পদে বদলি করা। হয় এবং এই বদলিকে বিদ্রোহীরা চলতি গুজবে ইন্ধন যােগানাের কাজে ব্যবহার করে। তারা বলতে থাকে যে, এটা হলাে মুক্তিযােদ্ধাদের স্বার্থের প্রতি শেষ আঘাত। শ্বেতপত্র অনুসারে, এই গুজব যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এই যুক্তি সহজেই গ্রহণ করে। বিদ্রোহীরা জেনারেল মঞ্জুরকে একজন দক্ষ সেনানায়ক বলে মনে
২৩২
করতাে এবং তাদের কাছে মঞ্জুরের বদলির আদেশটি ছিল অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত ও ঘােরতর অন্যায়।
এভাবে সরকার শ্বেত পত্রে জেনারেল মঞ্জুরের উচ্চাভিলাষ এবং মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে ৩০ তারিখের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়।
এটা সত্য যে, বাংলাদেশর বেসামরিক জনগােষ্ঠীর মধ্যে যেমন মুক্তিযােদ্ধা অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্ব ছিল তেমনি সামরিক বাহিনীর মধ্যেও তা বিরাজ করতাে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যােদ্ধাদের প্রত্যাশা ছিল যে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যান্যদের তুলনায় তাঁদের বৃহত্তর ভূমিকা ও অধিক সুযােগ-সুবিধা থাকবে। মুজিব শাসনামলে পাকিস্তান প্রত্যাগতদের তুলনায় মুক্তিযােদ্ধারা পদোন্নতি ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভােগ করতেন। অপর দিকে, পাকিস্তান ফেরৎ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা ছিল এবং তারা মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ নীতির কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন।৬
১৯৭৫ সালে মুজিবের মৃত্যুর পর মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদগুলাে থেকে ক্রমান্বয়ে অপসারণ করা হয়। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর মেজর জেনারেল এম শফিউল্লাহ ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ আর খন্দকারকে। (যারা দুজনেই ছিলেন প্রখ্যাত মুক্তিযােদ্ধা) যথাক্রমে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও বিমান বাহিনীর স্টাফ প্রধান-এর পদ থেকে অপসারণ করে কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সময় নিহত হন। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক পদ থেকে মুক্তিযােদ্ধা মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে সরিয়ে যশাের ডিভিশনের অধিনায়ক করে পাঠানাে হয় এবং তার স্থলে ঢাকা ডিভিশনের দায়িত্ব দেয়া হয় একজন অমুক্তিযােদ্ধা অফিসারকে। ১৯৭৯ সালে জেনারেল শওকতকে যশােরের অধিনায়কের পদ থেকে ঢাকায় রাষ্ট্রপতির স্টাফ অফিসারের মতাে এটি ক্ষমতাহীন পদে বদলি করা হয়। অন্যদিকে জেনারেল মঞ্জুরকে জেনারেল স্টাফ প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামের ডিভিশনের জি ও সি করে পাঠানাে হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন জিয়া সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদ ত্যাগ করেন তখন তিনি একজন অমুক্তিযােদ্ধা অফিসার মেজর জেনারেল এরশাদকে সেনাবাহিনীর এ সর্বোচ্চ পদে নিয়ােগদান করেন। একই সঙ্গে ডেপুটি স্টাফ প্রধানের পদ বিলােপ করে জিয়া সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ব্যক্তি হবার সুযােগ থেকে সিনিয়র মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের বঞ্চিত করেন। জেনারেল জিয়া কর্তৃক গৃহীত উপযুক্ত পদক্ষেপসমূহ মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অপমানবােধও করেন।
২৩৩
পাকিস্তান ফেরৎ অমুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের প্রতি রাষ্ট্রপতি জিয়ার পছন্দের কিছু কারণও ছিল। প্রথমত মুক্তিযােদ্ধাদের তুলনায় অমুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এক হিসাব অনুসারে জিয়ার মৃত্যু কালে সশস্ত্র বাহিনীসমূহে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫%। অপরদিকে পাকিস্তান ফেরৎ সদস্যদের সংখ্যা ছিল ২৫% এবং অবশিষ্ট ৬০% সদস্য ছিলেন নবাগত।৭
দ্বিতীয়ত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ রাজনীতিকদের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিক ও বিপ্লবী চেতনা লাভ করেন, যার ফলে তাঁদের মধ্যে শৃংখলাবােধের অভাব ঘটে। অপর দিকে পাকিস্তান প্রত্যাগত সদস্যরা সাধারণভাবে ছিলেন রক্ষণশীল মনােভাবাপন্ন, এবং সামরিক শৃংখলাবােধ তথা উর্ধ্বতন কমান্ডের প্রতি আনুগত্য ছিল তাদের জীবনদর্শনের পরশ পাথর।৮
তাই দেখা যায় জিয়া শাসনামলে যে ১৯টি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার খবর প্রকাশিত হয় তার সবকটিতে মুক্তিযােদ্ধারাই জড়িত ছিলেন। সুতরাং জিয়া পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের অধিক অনুগত বলে মনে করেন এবং ক্রমশ তাঁদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। জিয়ার মৃত্যুকালে সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ৫০ জন মেজর জেনারেল ও বিগ্রেডিয়ারের মধ্যে মাত্র তিন জন (মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর, মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী ও মেজর জেনারেল মইন চৌধুরী) ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা। তিনজনের মধ্যে কেবল জেনারেল মঞ্জুরই অধিনায়ক হিসেবে সৈন্য নিয়ন্ত্রণ করতেন।৯
সুতরাং এটা অস্বাভাবিক ছিল না যে, মঞ্জুরকে অধিনায়কের পদ থেকে ক্ষমতাহীন কমান্ডান্টের পদে বদলির (২৭ মে’র) আদেশকে মুক্তিযযাদ্ধারা তাদের স্বার্থের প্রতি শেষ আঘাত’ হিসেবে মনে করে এবং জেনারেল মঞ্জুর হয়তােবা অভ্যুত্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।১০
কিন্তু এটা ভাববার বিষয় যে, জেনারেল মঞ্জুরের মতাে একজন অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল অফিসার কেন রাজধানী ঢাকায় তাঁর কোনাে সমর্থন ভিত্তি তৈরি না করেই চট্টগ্রামের মতাে এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলেন। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয় যে, ষড়যন্ত্রকারীরা অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগে থেকেই ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তাদের সহযােগী মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে আসছিল কিন্তু সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা অস্বাভাবিক মনে হয় যে, বিদ্রোহীরা কেবল মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনের ওপর ভর করে ঐ দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অবতীর্ণ হবে। তাছাড়া, বিচার করার পূর্বেই চট্টগ্রাম সেনানিবাসে রহস্যময় পরিস্থিতিতে জেনারেল মঞ্জুরের হত্যা, মঞ্জুরের কথিত বিবৃতির টেপ রেকর্ড উধাও, জিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য বিচার ও তাদের স্বনিয়ােজিত আইনজীবীদের পরামর্শ লাভের দাবি অস্বীকার এবং জিয়াকে হত্যার আট ঘণ্টা পর জেনারেল মঞ্জুরকে সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ানাে, ইত্যাদি ঘটনা অনেকের মনে সন্দেহ উদ্রেক করে যে, ৩০ মে’র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টাটি ছিল এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ এবং এর সঙ্গে ঢাকার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত ছিলেন।
২৩৪
খ. জিয়া হত্যার কারণ
৩০ মে’র ঘটনাকে ঘিরে নানা ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত আছে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধ এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের রাজনীতিকরণকে জিয়া হত্যার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান নিয়মিত বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। স্বাধীনতার পর তাঁরা সনাতনী সামরিক বাহিনিকে পুনর্গঠন করে একটি গণতান্ত্রিক ও উৎপাদনমুখী সংগঠনে রূপান্তরিত করতে চান। তারা আরাে দাবী করেন যে, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মুক্তিযােদ্ধাদের একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে। ফলে, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও আনুগত্যবােধ ক্ষুন্ন হয় এবং উপদলীয় কোন্দল দেখা দেয়। সুতরাং যখনই কোনাে মুক্তিযােদ্ধার প্রত্যাশা ব্যাহত হয়েছে তখনই তিনি তাঁর বন্ধু বান্ধবের সহায়তায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে সরকার প্রধানকে হত্যা ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছেন। এভাবে মনিরুজ্জামান জেনারেল মঞ্জুরের উচ্চাভিলাস ও প্রতিশােধস্পৃহাকেই জিয়া হত্যার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং বলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াকে চট্টগ্রামে তাদের নাগালের মধ্যে পেয়ে মঞ্জুরের সহযােগিগণ তাঁকে হত্যা করেন। ১১
কার্যত এই তত্ত্বটি শ্বেতপত্রে বর্ণিত সরকারি ভাষ্যকেই সমর্থন করে। কিন্তু ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, কোনােরূপ পূর্বপরিকল্পনা বা প্রস্তুতি তথা ব্যাপক সমর্থন ভিত্তি তৈরি না করে একটা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তেমনি রাষ্ট্রপতিকে নাগালের মধ্যে পেলেই তাঁকে হত্যার ঝুঁকি নেয়াও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।
ভারতীয় সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্তের মতে, জিয়া হত্যার মূলে ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, ঐ সব সামরিক অফিসার ও রাজনীতিকগণ জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুরসহ মুক্তিযুদ্ধের বীরদের উৎখাত করে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করতে চেয়েছিলেন। তারা প্রথমে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যা করার জন্য জেনারেল মঞ্জুরকে প্ররােচিত করেন এবং জিয়ার মৃত্যুর পর মঞ্জুরকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করেন, এবং এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সক্ষম হন। সেনগুপ্ত বিচার না করেই জেনারেল মঞ্জুরের হত্যা ও পরবর্তী কালে জেনারেল শওকতসহ অনেক মুক্তিযােদ্ধা অফিসারকে সামরিক বাহিনী থেকে অপসারণ, ইত্যাদি ঘটনাকে তাঁর বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হিসাবে উত্থাপন করেন।১২
তবে প্রশ্ন জাগে যে, যেখানে জেনারেল জিয়া পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার ও অমুক্তিযােদ্ধা রাজনীতিকদের জন্য সব কিছুই করেছেন সেখানে তারা জিয়াকে কেন হত্যা করবে। তাছাড়া, যেখানে মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে সেখানে জেনারেল মঞ্জুর কেন অমুক্তিযােদ্ধাদের প্ররােচনায় অভ্যুত্থানের ঝুঁকি গ্রহণ করবেন।
২৩৫
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান মুক্তিযােদ্ধা-অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্বের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান এবং ৩০ মে’র ঘটনার জন্য সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক এলিটদের একাংশের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামাের আমূল পরিবর্তন তথা সামরিক-বেসামরিক আমলা ও শিল্পপতিদের পরিবর্তে ক্ষমতার ভিত্তি হিসাবে গণমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কায়েমী স্বার্থবাদী মহল স্থিতাবস্থা বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং তারা জিয়া পরিকল্পিত “আমূল পরিবর্তন” নস্যাৎ করার জন্য জিয়াকে হত্যা করে।১৩
কিন্তু জিয়া কী ধরনের আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলেন তার কোনাে ব্যাখ্যা জিল্লুর রহমান দেননি।
১৯৮১ সালের ৩০মে’র ব্যর্থ অভ্যুত্থান সম্পর্কিত উপযুক্ত ব্যাখ্যাগুলাের কোনােটাই পূর্ণাঙ্গ বা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। কোনাে সামরিক অভ্যুত্থানকে ব্যাখ্যা করতে হলে বিরাজমান-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামগ্রিক বিশ্লেষণ প্রয়ােজন।
১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক লেবাশ ধারণ সত্ত্বেও জিয়া সরকার ছিল মূলত একটা আধাসামরিক সরকার। দেশের প্রশাসন ও রাজনীতি থেকে সামরিক প্রত্যাহার কোনােদিনই সম্পূর্ণ হয়নি। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদ ত্যাগ করেন। তিনি সম্ভবত তাঁর সামরিক সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত বঙ্গভবনে না গিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে তার পূর্বতন বাসভবনে বাস করতে থাকেন। ১৯৭৯ সালের বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরেও জিয়ার মন্ত্রীপরিষদে ছ’জন ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, যারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলাে নিয়ন্ত্রণ করতেন; অন্তত ১৬ জন সামরিক অফিসার সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন পদে সমাসীন ছিলেন; ২০টি জেলার মধ্যে ১৪টিতেই পুলিশ প্রধান ছিলেন সামরিক ব্যক্তি। তাছাড়া, জিয়া সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় প্রায় ৫০০ অবসর প্রাপ্ত সামরিক অফিসার ইন্ডেটিং, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুযােগ সুবিধা লাভ করেন।১৪
রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে লাভজনক পদসমূহের স্বাদ একবার গ্রহণ করার পর সামরিক এলিটগণ সেগুলাে পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন।
যদিও রাষ্ট্রপতি জিয়া সামরিক বাহিনীর ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব ও ঘন ঘন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্ভবত তাঁর মধ্যে এই বােধ জাগ্রত করে যে, পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে তার একটি শক্তিশালী বেসামরিক সমর্থন ভিত্তি গড়ে তােলা প্রয়ােজন। সুতরাং জিয়া বিএনপি, যুব কমপ্লেক্স, গ্রাম সরকার ইত্যাদি গ্রাম ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এবং খাল খননের কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রামীণ জনগণকে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত
২৩৬
করতে চান। জিয়ার একটি নিজস্ব বেসামরিক ক্ষমতাভিত্তি নির্মাণের এই প্রচেষ্টা সামরিক এলিটদের নিকট গ্রহণযােগ্য ছিল না। তাই দেখা যায় যে, জেনারেল মঞ্জুরের স্বল্পস্থায়ী বিপ্লবী পরিষদ এবং পরবর্তী সময়ে এরশাদের সামরিক সরকার জিয়া প্রবর্তিত গ্রাম সরকার ও যুব কমপ্লেক্স ভেঙে দেন এবং খাল খননের কর্মসূচি পরিত্যাগ করেন।
সামরিক নেতৃবর্গ আরাে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এই কারণে যে, প্রধান বিরােধী দলসমূহ দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে। জিয়া সরকারকে আধাসামরিক সরকার বলে আখ্যায়িত করে তারা জাতীয় সংসদে সামরিক বাহিনীর জন্য ক্রমবর্ধমান ব্যয়বরাদ্দের প্রতিবাদ জানায় এবং সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ প্রদান করে।১৫
তবে সামরিক এলিটদের যা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে তােলে তা হলাে, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সরকারের সম্ভাব্য পতন। অবনতিশীল মূল্য পরিস্থিতি, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, ক্রমাগতভাবে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ, এবং অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনসাধারণ, বিশেষ করে মধ্যেবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। শাসক দল বিএনপির মধ্যে উপদলীয় কোন্দল, বেসামরিক আমলাবর্গের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির অভিযােগ-এর কারণে সরকারের কর্মক্ষমতা ও বিশ্বাসযােগ্যতা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তিসমূহের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং তা দেশে এক গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
এই বিস্ফোরণামুখ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি জিয়া ক্ষমতা কাঠামােতে কিছু পরিবর্তন আনয়নে পরিকল্পনা করেন। তিনি সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে একটা ‘শােষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের প্রয়ােজনের কথা বলতে শুরু করেন।১৬
তিনি ১৯৮১ সালের ১৩ মে তারিখে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মর্তাসহ সচিবালয় ও সরকারি কর্পোরেশনের কর্মরত আটজন উচ্চ পর্যায়ের অফিসারকে তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ােজিত করেন, ২৪ মে তারিখে বিএনপির যুবসংগঠন থেকে সাত জন প্রভাবশালী নেতাকে বহিষ্কার করেন এবং ২৫মে তারিখে বিএনপির ছাত্র সংগঠন থেকে ১২ জন নেতাকে বহিষ্কার করেন।১৭
তাছাড়া জিয়া কিছু সংখ্যক উচ্চ পর্যায়ের বিনপি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি কালাে তালিকা প্রস্তুত করেন। তার মধ্যে ইসলামপন্থী রক্ষণশীল গােষ্ঠীর প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন জিয়ার ‘প্রধান লক্ষ্য বস্তু।১৮
মুক্তিযােদ্ধা সংগঠনসমূহের চাপের মুখে জিয়া ইসলামী দলসমূহের বিরুদ্ধেও আক্রমণ শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা ও ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার জন্য তাদের কঠোর সমালােচনা করেন।১৯
২৩৭
জিয়া জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধ ও জামায়াত নেতা গােলাম আযমকে দেশ থেকে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেন বলেও জানা যায়।২০
জিয়ার উপযুক্ত পদক্ষেপ ও পরিকল্পনাসমূহ বিএনপি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাবর্গের মধ্যে ইসলামী রক্ষণশীল গােষ্ঠীসমূহের স্বার্থের প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়। অপর দিকে, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহ ইতঃপূর্বে জিয়া সরকোর থেকে দূরে সরে যায়। এভাবে মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধা উভয় গােষ্ঠী জিয়ার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
১৯৮১ সালের ২০ মে জেনারেল মঞ্জুর কিছু সংখ্যক ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারসহ ঢাকায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে সামরিক নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপতি জিয়ার কঠোর সমালােচনা করেন। তারা অভিযােগ করেন যে, জিয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে “অতি গণতান্ত্রিকীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলােকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলাচ্ছেন। তারা জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি, বিএনপির দুর্নীতি এবং অবনতিশীল আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির সমালােচনা করেন। ঐ বৈঠকে সামরিক নেতৃবৃন্দ দেশে সামরিক আইন জারি করে সংবাদপত্র, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারের ওপর বাধানিষেধ আরােপের দাবি জানান।২১
সামরিক আমলাবর্গের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ ও অস্থিরতা জেনারেল মঞ্জুর এবং তার অধীনস্থ অফিসারদেরকে অভ্যুত্থান ঘটানাের জন্য উৎসাহিত করে থাকতে পারে। তারা হয়তাে মনে করেছিলেন যে, জিয়াকে খতম করতে পারলে অন্যান্য সামরিক মহল থেকে আপনা-আপনি প্রয়ােজনীয় সাহায্য মিলবে। অথবা তারা ঢাকার ক্ষমতাশালী সামরিক নেতাদের নিকট থেকে পূর্বেই সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন, কিন্তু কতকগুলাে কারণে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রথমত সেই অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন এবং তার সাফল্যের অর্থ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাধান্য স্বীকার করে নেয়া, যা করতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা প্রস্তুত ছিলেন না।
দ্বিতীয়ত : মুক্তিযােদ্ধের অন্যতম নায়ক জিয়া তখনাে সাধারণ সৈনিকদের নিকট যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর হত্যার তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিক্রিয়া থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ৩০ মে’র অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হতে চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে জেনারেল মঞ্জুরকে সমর্থন করে জিয়া হত্যার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সুতরাং সামরিক এলিটগণ সাত্তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়।
অতএব ৩০মে’র অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা তথা জিয়া হত্যাকে কেবল মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্ব কিংবা একজন উচ্চাভিলাসী জেনারেলের (মঞ্জুর) প্রতিহিংসা অথবা কোনাে ক্ষুদ্র স্বার্থবাদী মহলের ষড়যন্ত্রের ফসল বলে চিহ্নিত করা যায় না। এটা ছিল বাংলাদেশে বিরাজমান সার্বিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের প্রতি মারাত্মক হুমকির প্রতিক্রিয়া।
২৩৮
২. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৮১
রাষ্ট্রপতি জিয়ার আকস্মিক মৃত্যু একরূপ রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করে এবং অনেকে সামরিক বাহিনী কর্তৃক সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আশঙ্কা করেন। কিন্তু সামরিক নেতারা খুব সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ব্যক্ত করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন এবং এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন বলে মনে হয়। রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা পূরণের জন্য সংবিধান অনুসারে ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি ঘােষণা করেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সম্ভাবনা পুনরায় সাংবিধানিক বিতণ্ডার সৃষ্টি করে। অধিকাংশ বিরােধী দল ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদীয় শাসন্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এবং বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি সার্বভৌম সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে। এমনকি ডানপন্থী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলাে (মুসলিম লীগ, ইসলামী ডেমােক্রেটিক লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামী) যারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক প্রবণতার কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরােধী ছিল তারাও রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা বাতিল করে এক ধরনের মিশ্র শাসন পদ্ধতির দাবি করে যা যৌথ নেতৃত্ব সুনিশ্চিত করতে পারে।২২ কিন্তু ক্ষমতাসীন বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। সুতরাং সরকার সংবিধান পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়।
যা হােক বিরােধী দলগুলাে সাংবিধানিক বিতর্ককে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় নি যা দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে এবং সামরিক বাহিনীকে সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযােগ করে দিতে পারে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধান বিরােধী দলসমূহ ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চেয়েছিল সম্ভবত এই ভেবে যে, রাষ্ট্রপতি জিয়ার অবর্তমানে বিএনপি ভেঙে পড়বে এবং তারা সহজেই ক্ষমতায় যেতে পারবে।
ক. সংবিধানের ষষ্ঠ সংশােধনী
ক্ষমতাসীন বিএনপি এর নেতা জেনারেল জিয়ার হত্যাপ্রসূত সাধারণ সহানুভূতি ও আবেগের সুযােগ লাভের উদ্দেশে যথাসম্ভব শীঘ্র রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। ১৯৮১ সালের ২১ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করেন যে, ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনােনয়নের প্রশ্নে বিএনপি বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
বিএনপি দলের গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনােনয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে কোনাে স্পষ্ট বিধান ছিল না। তাছাড়া দলে এমন কোনাে ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, যিনি সকল উপদলের নিকট সমভাবে গ্রহণযােগ্য। বিচারপতি সাত্তার সকলের নিকট শ্রদ্ধেয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর বয়স এত বেশি (৭৫ বছর) ছিল যে, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বহন করা তাঁর জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। আসলে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
২৩৯
বিএনপির এই সংকট মুহূর্তে সামরিক নেতৃবৃন্দ তাদের ‘শুভ প্রভাব’ প্রয়ােগ করতে এগিয়ে আসেন। জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত হস্তেক্ষেপের ফলে অসুস্থ ও অনচ্ছিক বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে সম্মত হন।২৩
সামরিক এলিটদের সমর্থনে, বিএনপি জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি, সংসদীয় দল এক জেলা কমিটিসমূহের সভাপতি ও সম্পাদকদের যৌথ সভায় এবং গােলযােগপূর্ণ পরিস্থিতে বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনােনিত হন।২৪
বিএনপি কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তারের মনােনয়ন এক নতুন সাংবিধানিক বিতর্কের সৃষ্টি করে। সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোনাে ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার যােগ্য না হলে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারতেন না। অন্য দিকে ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, কোনাে ব্যক্তি রাষ্ট্রের কোনাে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার যােগ্য হবেন না। তবে কেবল প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর পদকে লাভজনক পদ বলে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ সকল ধরনের মন্ত্রী সংসদ সদস্য তথা রাষ্ট্রপতি পদে (এবং উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রার্থী হতে পারতেন, কিন্তু পদাসীন রাষ্ট্রপতি কিংবা উপরাষ্ট্রপতি পদত্যাগ না করে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে পারতেন না। কারণ সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতি পদকে লাভজনক পদ নয় বলে ঘােষণা করা হয় নি। যেহেতু বিচারপতি সাত্তার ছিলেন। উপ-রাষ্ট্রপতি ও একই সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সেহেতু প্রচলিত বিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে পারতেন না। সুতরাং বিরােধি দলসমূহ বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তারের মনােনয়নের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারের প্রার্থিতা বৈধকরণ উদ্দেশে বিএনপি সরকার তাড়াহুড়াে করে ১৯৮১ সালের ১ জুলাই তারিখে সংসদে সংবিধানের ষষ্ঠ সংশােধনী বিল উত্থাপন করে। অনুরূপ বিল উত্থাপনের জন্য যে সাত দিনের নােটিশ প্রদানের বিধান ছিল সে বিধান স্থগিত করে বিলটি উত্থাপিত হয়।
ষষ্ঠ সংশােধনী বিলে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির পদ ‘লাভজনক পদ’ নয় বলে ঘােষণা করা হয়, যাতে করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার তাঁর পদে সমাসীন থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। বিরােধী দলীয় সদস্যগণ বিলের ব্রি বিরােধিতা করে বলেন যে, একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংবিধানের সংশােধন করা উচিত নয়, এবং তাঁরা ঐ প্রশ্নে জনমত যাচাই-এর জন্যে ১৩ জুলাই পর্যন্ত সংসদের অধিবেশন মুলতবি করার দাবি জানান। সরকার সংসদ অধিবেশন মুলতবি করতে অস্বীকার করলে বিরােধী ও নির্দলীয় সদস্যগণ ‘ওয়াক আউট করেন এবং তাঁদের অধিকাংশ ১০ জুলাই তারিখে অধিবেশন স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ বর্জন করেন।২৫
যাহােক, ষষ্ঠ সংশােধনীটি কোনােরূপ বিতর্ক ছাড়াই এবং প্রধান বিরােধী দলসমূহের অনুপস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই তারিখে ২৫২-০ ভােটে গৃহীত হয়।২৬
২৪০
খ. নির্বাচনী প্রক্রিয়া
আমরা দেখেছি, প্রধান বিরােধী দলসমূহ সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য বরাবর চাপ দিয়ে আসছিল। এর অন্যতম কারণ এই যে, প্রত্যক্ষ ও সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সফলভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতাে সম্পদ বা সংগঠন কোনােটাই তাদের ছিল না। যেখানে ক্ষমতাসীন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি প্রশাসন ও প্রচারযন্ত্র একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করেন, সেখানে বিরােধী দলীয় প্রার্থীগণ স্পষ্টতই ভয়ানক অসুবিধাজনক অবস্থায় পতিত হন। তাড়াহুড়াে করে ষষ্ঠ সংশােধনী গ্রহণ বিরােধী দলগুলাের এই আশঙ্কা বৃদ্ধি করে যে, ক্ষমতাসীন দল সরকারি সুযােগ-সুবিধার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে। সুতরাং নির্বাচনী প্রচারণার স্বাধীনতা ও সুযােগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে বিরােধী দলসমূহ কিছু দাবি উত্থাপন করে। এই সব দাবির মধ্যে ছিল জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দিদের মুক্তি, সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে নভেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠান, নতুন ভােটার তালিকা প্রণয়ন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও সরকারি প্রচার মাধ্যমসমূহে সকল প্রার্থীকে সমান সুযােগ প্রদান এবং ক্ষমতাসীন প্রার্থী সরকারি যানবাহন ও প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করবেন না এই মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান।২৭
বিরােধী দলসমূহের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার নির্বাচনের তারিখ সরিয়ে ১৫ই নভেম্বর নির্ধারণ করে, নতুন ভােটার তালিকা প্রণয়ন করে, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে, কতিপয় রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়, এবং সকল প্রার্থীকে সরকারি প্রচার মাধ্যমে সুবিধা এবং নিঃখরচায় টেলিফোন ও সরকারি যানবাহন ব্যবহারের সুযােগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়।
প্রায় সকল বিরােধী দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মােট ৮৩ জন প্রার্থী মনােনয়নপত্র দাখিল করেন এবং তাদের মধ্যে শেষ অবধি ৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাত্র ১৩ জন প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়; অবশিষ্ট প্রার্থীরা ছিলেন নির্দলীয়।
ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের গােষ্ঠীসমূহ, বিশেষ করে ১০ দলীয় জোট বিএনপির বিরুদ্ধে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা একজন অভিন্ন প্রার্থী মনােনয়নে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত চারটি ছােট ছােট জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় একতা পার্টি ও মিজান সমর্থিত আওয়ামী লীগের একটি উপদল নিয়ে গঠিত একটি জোট আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হােসেনকে প্রার্থী মনােনীত করে। দ্বিতীয় জোটটি গঠিত হয় জাসদ, শ্রমিক- কৃষক সমাজবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টি (পূর্বতন বাংলাদেশ গণআন্দোলন) সমম্বয়ে। এই জোটের প্রার্থী ছিলেন জাসদ নেতা মেজর (অবসর প্রাপ্ত) এম এ জলিল। তৃতীয় জোটের মধ্যে ছিল ন্যাপ (মােজাফফর), ন্যাপ (হারুন) ও বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি। এই জোটের প্রার্থী ছিলেন জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী। তিনি তথাকথিত ‘নাগরিক জাতীয় কমিটি কর্তৃক মনােনীত হন এবং তাকে সমর্থন করে তাঁর দল জাতীয় জনতা পার্টি এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল
২৪১
(জাসদের একটি দলছুট অংশ) ও মিজান আওয়ামী লীগের একটি উপদল। অপর পক্ষে, প্রধান ইসলামী দলগুলাে (মুসলিম লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামী) আওয়ামী লীগকে ঠেকানাের লক্ষ্যে বিচারপতি সাত্তারকে সমর্থন দান করে।২৮
ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ (জামায়াত-ই-ইসলামী বের হয়ে যাবার ফলে যা একটি ছােট গােষ্ঠীতে পরিণত হয়। অবশ্য নিজস্ব প্রার্থী দেয় এবং অভিযােগ করে যে, বিএনপির কোনাে নীতি বা আদর্শ নেই।২৯
১৯৮১ সালের মে মাসে ১৬টি ছােট ছােট ডান ও বামপন্থী দল সমবায়ে গঠিত তথাকথিত ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনাে প্রার্থী দেয়নি। এই দলগুলাের ঐক্যসূত্র ছিল ভারতবিরােধী ও আওয়ামী লীগ বিরােধী মনােভাব এবং সেই মনােভাব থেকে তারা বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি সাত্তারকে সমর্থন দেয়। চীনপন্থী বাম দলগুলাের মধ্যে কেবল বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল) নিজস্ব প্রার্থী দেয় এবং ভারত বিরােধিতার কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
গ. নির্বাচনী ইস্যু
প্রধান বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে সংবিধানকে প্রধান নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন করে এবং তাদের অধিকাংশই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়। জেনারেল ওসমানী ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সবচেয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন।৩১
অপরদিকে, আওয়ামী লীগ বহুদলীয় গণতন্ত্রের অধীনে ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের (বাকশালের) প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ আনয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়।৩২
জাসদ, শ্রমিক- কৃষক সমাজবাদী দল ও ওয়ার্কাস পার্টি সমম্বয়ে গঠিত। ত্রিদলীয় জোটও সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারা ‘গােটা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে বলে যে, শ্রমিক শ্রেণির জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সংসদে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।৩৩
এই জোট বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে ‘একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করে, কিন্তু তারা বিএনপি অপেক্ষা আওয়ামী লীগেরই কঠোর সমালােচনা করে।৩৪
ন্যাপ নেতা ও রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী মােজাফফর আহমদ জনগণের আর্থসামাজিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেন।
অপরদিকে, ক্ষমতাসীন বিএনপি দল তার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘গণতন্ত্র, শান্তি ও প্রগতিকে মূল বিষয় রূপে উপস্থাপিত করে। এই দল বিদ্যমান রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিকে সংসদীয় পদ্ধতির মতােই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে দাবি করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা জিয়া সূচিত ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। অন্যান্য বিরােধী দলীয় প্রার্থীকে অবজ্ঞা করে, বিএনপি আওয়ামী লীগের ড. কামাল হােসেনকে তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে স্থির করে এবং
২৪২
ভােটারদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয়ের অর্থ হবে একদলীয় বাকশাল শাসনে ফিরে যাওয়া এবং দেশকে বিশৃঙ্খলা ও স্থিতিহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া। বিএনপি নেতৃবৃন্দ আরাে অভিযােগ করেন যে, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা প্রচার করছে এবং ঐ দল ক্ষমতায় গেলে সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম মুছে ফেলবে।৩৫
ঘ. নির্বাচনী ফল
সরকারি হিসাব অনুসারে তালিকাভুক্ত ভােটারদের প্রায় ৫৬% ভােটদান করে। বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ৬৫.৫২% ভােট পেয়ে বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগের কামাল হােসেন ২৬% ভােট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এই নির্বাচনে যাঁরা কমপক্ষে এক শতাংশ ভােট পান তাঁরা হলেন রাজনৈতিক পরিচিতিহীন একজন ধর্মীয় নেতা মওলানা মােহম্মদুল্লাহ, জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম এ জি ওসমানী, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এম এ জলিল ও অধ্যাপক মােজাফ্ফর আহমদ (সারণি ৯.১ দ্রষ্টব্য)।
বিরােধী দলসমূহ অভিযােগ করে যে, নির্বাচনে বিএনপি ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি ও কারচুপি করেছে।৩৬
বিরােধী দলের অভিযােগগুলাে ভিত্তিহীন ছিল না। যদি নির্বাচনী সভায় জনসমাগমকে জনসমর্থনের সূচক হিসেবে গণ্য করা হয় তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে সমান বলা যেতে পারে। উভয়ের সভায় প্রচুর জনসমাগম হয়। ফলে অনেক পর্যবেক্ষক ধারণা করেন যে, কারাে পক্ষে বিপুল বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না।”
সারণি ৯.১
১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল
প্রার্থীর নাম | দলের নাম | প্রাপ্ত ভােট সংখ্যা | শতাংশ |
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার | বিএনপি | ১,৪২,০৩,৯৫৮ | ৬৫.৫২ |
ড. কামাল হােসেন | আওয়ামী লীগ | ৫৬,৩৬,১১৩ | ২৬.০০ |
মাওলানা মােহম্মদদুল্লাহ | স্বতন্ত্র | ৩,৮৮,৭৪১ | ১.৮০ |
এম এ জি ওসমানী | জাতীয় জনতা পার্টি | ২,৯৩,৬৩৭ | ১.৩৫ |
এম এ জলিল | জাসদ | ২,৪৮,৭৬৯ | ১.০৩ |
মােজাফফর আহমদ | ন্যাপ (মােজাফফর) | ২,২৪,১৮৮ | ১.১৫ |
মােহাম্মদ তােয়াহা | সাম্যবাদী দল (এম.এল) | ৩৭,১৫১ | ০.১৭ |
মওলানা আব্দুর রহিম | ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ | ১৫,৫৬৪ | ০.০৭ |
অন্যান্য | … | ৬,২৯,৪৩৯ | ২.৯১ |
মোট | ২,১৬,৭৭,৫৬০ | ১০০ |
উৎস : বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, ঢাকা।
২৪৩
সুতরাং বিচারপতি সাত্তারের বিজয় নয়, বরং ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে তাঁর ভােটের বিপুল ব্যবধান অনেকের নিকট যুক্তিসংগত মনে হয়নি। বিচারপতি সাত্তারের জয়লাভের পিছনে যথেষ্ট কারণও ছিল।
প্রথমত ক্ষমতাসীন প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাত্তার সরকারি যানবাহন, প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যাপকভাবে তার নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ব্যবহার করেন। ফলে প্রার্থীকে প্রচারমাধ্যমে সমান সুযােগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বাস্তবে পালিত হয়নি।
দ্বিতীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই তাদের নিজ নিজ প্রয়াত নেতার। ভাবমূর্তির সদ্ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু যেহেতু জেনারেল জিয়া অতি সম্প্রতি নিহত হন সেহেতু তাঁর শাহাদতের’ আবেদন অধিক ফলপ্রসূ হয়।
তৃতীয়ত আওয়ামী লীগ একই সঙ্গে বাকশালের কর্মসূচি ও বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মতাে বাহ্যত দুই বিপরীতমুখী কর্মসূচি হাজির করে, যা ভােটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযােগ করে দেয়।
চতুর্থত যেখানে ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী দলগুলাে বিচারপতি সাত্তারের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী দলগুলাে বিভক্ত থেকে যায়। তারা শাসক দলের বিরুদ্ধে সমভাবে আক্রমণ না চালিয়ে পরস্পরের মধ্যে কাদা ছােড়াছুড়ি করে।
পঞ্চমত আওয়ামী লীগ ও বাম বিরােধী দলগুলাে অবনতিশীল আর্থসামাজিক অবস্থার জন্য বিএনপি সরকারের ওপর দোষারােপ করে, কিন্তু তারা জনগণের দূরবস্থা দূরীকরণের লক্ষ্যে কোনাে সুনির্দিষ্ট বিকল্প কর্মসূচি হাজির করতে ব্যর্থ হয়।
শেষত ভােটারগণ শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে জনগণ বহুবার রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার শিকার হয়েছে। নির্বাচনী ফল ক্ষমতাসীন প্রার্থীর বিপক্ষে গেলে অনুরূপ সহিংসতা বা স্থিতিহীনতা যে ঘটতে পারে সেরূপ আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণও ছিল।
জেনারেল এরশাদ এক সাক্ষাৎকারে আভাস প্রদান করেন যে, ড. কামাল হােসেন (যিনি ছিলেন বিচারপতি সাত্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী) সশস্ত্র বাহিনীসমূহের নিকট গ্রহণযােগ্য নন এবং বিচারপতি সাত্তারের পরাজয় দেশে রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”৩৯
যদিও এরশাদ পরে তার উপযুক্ত বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেন, ভােটারদের ওপর তার কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ঠিকই পড়ে। তাছাড়া, বিএনপি নেতৃবৃন্দ কর্তৃক বারংবার উচ্চারিত অনুরূপ সতর্কবাণী ভােটারদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাকে গভীরতর করে।৪০
২৪৪
৩. ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাত্র ১২৮ দিন পর, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। অন্যান্য সামরিক নেতার মতােই জেনারেল এরশাদ তাঁর ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে বলেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতি, প্রশাসনিক স্থবিরতা, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক ও খাদ্য পরিস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তােলে।৪১
এরশাদ কথিত সংকটময় রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু এগুলাে তার ক্ষমতা দখলের অজুহাত মাত্র। জাতীয় নিরাপত্তা বা স্বাধীনতা বিপন্ন হবার চেয়ে সামরিক এলিটদের সামগ্রিক স্বার্থ বিপন্ন। হবার আশংকাই সম্ভবত তাঁকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে প্রবৃত্ত করে। ১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের সুযােগ ও মনােবৃত্তি সম্পর্কে পৃথকভাবে আলােচনা করা হলাে।
ক. ক্ষমতা দখলের সুযােগ
প্রথমত ক্ষমতাসীন বিএনপি দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দলজনিত রাজনৈতিক বিশৃংখলা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের সুযােগ করে দেয়। বিচারপতি সাত্তার ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু দলীয় কোন্দলের কারণে নতুন মন্ত্রীপরিষদ নিয়ােগ করতে তাঁর এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। একই কারণে পরবর্তী চার মাসের মধ্যে তাকে দু’বার মন্ত্রীপরিষদ পুনর্গঠন করতে হয়। এইসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ডানপন্থী ইসলামী গােষ্ঠী প্রাধান্য লাভ করে। ক্ষমতা কাঠামােতে শাহ আজিজ উপদলের এই প্রাধান্য লাভ বিএনপি দলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ গােষ্ঠীকে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করে তােলে। এই ‘বিদ্রোহী গােষ্ঠী অভিযােগ করে যে, দলের চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়ার ‘ভারসাম্যের নীতি’ পরিত্যাগ করেছে এবং দল থেকে জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলােকে উৎখাতের চক্রান্ত করছে।৪২
বিএনপি’র ছাত্র ও যুব সংগঠনের একাংশ বিভিন্ন দলীয় সমাবেশে শাহ আজিজুর রহমান ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের দালাল’ বলে শ্লোগান দিতে শুরু করে।৪৩
দ্বিতীয়ত ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্কলহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বিরাজমান দুর্নীতিসমূহ ব্যাপকভাবে জন সমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অল্পদিন পর দুর্নীতি দমন বিভাগ এক বেনামী প্রচারপত্রের ভিত্তিতে ২৬ জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত আরম্ভ করে।৪৪
২৪৫
বিএনপি ছাত্র সংগঠন দলের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে দল থেকে তাদের বহিষ্কারের জন্য প্রকাশ্যে দাবি উত্থাপন করে।৪৫
সরকার কতিপয় পদচ্যুত মন্ত্রির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয় এবং ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তিনজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রুজু করে।৪৬
সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে দুর্নীতি তদন্তের জন্য গঠিত এক সংসদীয় কমিটি ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রদত্ত এক রিপাের্টে বলে যে, তারা যে ৬৩টি প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করেছে তার সবকটাতেই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা দেখতে পেয়েছে।৪৭
তৃতীয়ত আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে উপদলীয় কোন্দলের কারণে প্রশাসনিক নিয়ম-শৃংখলা ও দক্ষতা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সচিবালয়ের উচ্চতর পদসমূহে পদোন্নতি লাভের জন্য বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিযােগিতা আরম্ভ হয়। এ প্রসঙ্গে একটি প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিকীতে মন্তব্য করা হয় যে,
সচিবালয়ে বিভিন্ন পদের জন্য প্রয়ােজনীয় মেধা, যােগ্যতা, মানসিকতা ও অভিজ্ঞতার প্রতি তােয়াক্কা না করে প্রত্যেকে পদোন্নতির জন্য নিজনিজ অধিকার দাবি করছেন। এদের কাছে জাতীয় সচিবালয় যেন একটি খােলা বাজার যেখানে বিভিন্ন পদ বেচা কেনা হয়।৪৮
বিভিন্ন কর্মচারী সমিতি কেবল সরকারের নিকট তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দাবি পেশ করেনি, সংবাদপত্রে বিবৃতি ও সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়।
চতুর্থত আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। ছিনতাই, দাঙ্গা, হত্যা, ইত্যাদি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমাজবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চালিত পুলিশ অভিযান থেকে দেখা যায় যে, দুষ্কৃতকারীদের অনেকেই ছিল বিএনপি’র যুবসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সদস্য।৪৯
বিএনপি সরকার ও দলের জন্য যে ছিল সবচেয়ে বিব্রতকর তা হলাে এই যে, স্বয়ং যুব মন্ত্রির বাসভবন থেকে একজন কুখ্যাত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে আবার যুবদলেরও একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিল।৫০
তাছাড়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ঘন ঘন সহিংস সংঘর্ষ আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিকে আরাে জটিল করে তােলে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সংঘর্ষ একপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী ইসলামী ছাত্র শিবির এবং অন্য পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনসমূহ জড়িত থাকায় সেগুলাে মুক্তিযােদ্ধা বনাম অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্বের রূপ লাভ করে।
পঞ্চমত অর্থনৈতিক অবস্থারও বিপজ্জনক অবনতি ঘটে। ১৯৮১-৮২ অর্থ বছরে মােট জাতীয় উৎপাদন পূর্ববর্তী বছরের ৬.১ শতাংশের তুলনায় মাত্র ০.৯১ শতাংশ (১৯৭২-৭৩ সালের স্থির মূল্যে) বৃদ্ধি পায় এবং মাথাপিছু আয় ১.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে মাত্র ৭৬০ টাকায় দাঁড়ায়।৫১
২৪৬
১৯৮১-৮২ অর্থ বছরের প্রথম ন’মাসে (জুলাই, ১৯৮১ থেকে মার্চ, ১৯৮২) মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন যাত্রার ব্যয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৪.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৯-৭০ সালকে ভিত্তি = ১০০ ধরে এই ব্যয়ের সূচক দাঁড়ায় ৭০৪.৮৬।৫২
১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক মুদ্রা সমস্যা প্রকটতর হয়। ঐ বছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রকৃত রফতানি আয় ১৬ শতাংশ হ্রাস পায়।৫৩
বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে খাদ্যশস্য ও সার ছাড়া সকল দ্রব্যের “আমদানি কমিয়ে আনা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মূল্য পরিস্থিতি ও দেশজ উৎপাদনের ওপর।
১৯৮১-৮২ সালে অর্থনীতির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক ছিল খাদ্য ঘাটতি, যা দেশকে একটা দুর্ভিক্ষাবস্থার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। ঐ বছর খাদ্য শস্য উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ১৬২ লক্ষ টন কিন্তু প্রকৃত উৎপাদন হয় ১৪৩ লক্ষ টন, যা ছিল পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৪ লক্ষ টন কম।৫৪ ফলে ১৯৮২ সালের প্রারম্ভে চালের দাম বাড়তে শুরু করে এবং প্রথম তিন মাস প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে যেখানে চালের দাম ছিল সের প্রতি ৫.৭৩ টাকা, সেখানে ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় সের প্রতি ৭.৪১ টাকা।৫৫
খ. সামরিক বাহিনীর মনােবৃত্তি
১৯৭৫ সালের আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে দেশের প্রশাসন ও রাজনীতিতে প্রভূত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও সামরিক এলিটগণ তাদের প্রাধান্য বজায় রাখার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। যদিও জিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তােলার প্রচেষ্টা সামরিক এলিটদের ক্ষুব্ধ করে, সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জিয়ার জনপ্রিয়তা এবং নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহের কারণে সামরিক এলিটগণ জিয়া হত্যার পরপরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেননি। তাঁরা দৃশ্যের আড়াল থেকে কাজ করার কৌশল অবলম্বন করেন এবং যথাসময়ে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে নিজেদেরকে সুসংহত করার প্রয়াস পান।
জেনারেল জিয়া ও মঞ্জুরের মৃত্যুর পর জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে পাকিস্ত নি প্রত্যাগত অফিসারগণ সামরিক বাহিনীতে পূর্ণ প্রাধান্য লাভ করে এবং তারা শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০ জন মুক্তিযােদ্ধা অফিসারকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ করেন। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর শত শত সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। এই শুদ্ধি অভিযানের পর জেনারেল এরশাদ ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে ঘােষণা করেন :
দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে (সামরিক বাহিনীতে) যারা ভাঙন ধরাতে চেয়েছিল তাদের কবল থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। আমরা এখন ঐক্যবদ্ধ।৫৬
২৪৭
সামরিক বাহিনীতে তাঁর অবস্থান মজবুত করার পর জেনারেল এরশাদ দাবি উত্থাপন করেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সশস্ত্র বাহিনীর সাংবিধানিক অধিকার থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রায় এক মাস আগে তিনি প্রকাশ্যে বলেন :
আমার সেনাবাহিনী (রাজনীতিতে) জড়িয়ে পড়েছে। এটা আমার দায়িত্ব। অবশ্যই এ ব্যাপারে আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতির নিকট যেতে হবে। যে কোনাে উন্নয়নশীল দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনাবাহিনী একটা উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।৫৭
জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু কিছু অসন্তোষ সত্ত্বেও সামরিক এলিটগণ জিয়াকে তাঁদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী একজন সামরিক ব্যক্তি বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তারের বেলায় তাদের অনুভূতি ছিল ভিন্ন রূপ। তারা মনে করতেন যে, তাদের সম্পর্কে সাত্তারের একই রূপ জ্ঞান বা সহানুভূতি ছিল না।৫৮
তবুও তারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারকে সমর্থন করেন। কারণ, শাসক দল বিএনপি’র বিকল্প শক্তি আওয়ামী লীগ সামরিক বাহিনীর প্রতি সন্ধিগ্ধ এবং সামরিক বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তাছাড়া, বিচারপতি সাত্তার ছিলেন একজন অসুস্থ বৃদ্ধ ব্যক্তি, যার নিজস্ব কোনাে রাজনৈতিক সমর্থন ভিত্তি ছিল না। সামরিক এলিটগণ হয়তাে ভেবেছিলেন বিচারপতি সাত্তার নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন; পর্দার আড়াল থেকে তাঁরাই ক্ষমতার কলকাঠি নাড়বেন।
কিন্তু ন্যায়বােধ বা আত্মমর্যাদা অনেক সময় দুর্বল ব্যক্তিকেও শক্ত অবস্থান গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তাই নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি সাত্তার তার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পূর্ণ প্রয়ােগে ব্রতী হন, যার ফলে তাঁর সঙ্গে সামরিক আমলাদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। তাঁর নির্বাচনােত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি সাত্তার স্পষ্ট করে বলেন যে, দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা ছাড়া সামরিক বাহিনীর অন্য কোনাে ভূমিকা নেই।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতিবাদে জেনারেল এরশাদ এক দীর্ঘ সংবাদ বিবৃতিতে বলেন, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক-সামরিক সমস্যা সমাধান তথা রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হলে সাংবিধানিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে রাষ্ট্রপরিচালনার সুনির্দিষ্ট অধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, সামরিক চাকরি যে কেবল একটা চাকরি এই ঔপনিবেশিক ধারণা ত্যাগ করে জাতি গঠন ও দেশরক্ষামূলক ভূমিকাকে একত্রিত করে একটি সামগ্রিক জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি দাবি করেন, এই শিক্ষা তিনি জেনারেল জিয়ার কাছ থেকেই পেয়েছেন এবং প্রস্তাব দেন যে, জাতীয় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ওয়াকেবহাল ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করতে হবে। এই পরিষদ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং সর্বোচ্চ জাতীয় স্তর থেকে নির্বাহী বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করবে।৫৯
২৪৮
বিরােধী দলসমূহ রাজনৈতিক-সামরিক সমস্যার’ বিদ্যমানতা স্বীকার করে, কিন্তু তারা এর সমাধানের পন্থা সম্পর্কে একমত হতে পারেনি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ভূমিকা প্রদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ঐতিহ্যগত সামরিক রীতি-নীতি ভঙ্গ করে জেনারেল এরশাদ যেভাবে বিষয়টি জনসমক্ষে এনেছেন তাতে আপত্তি উত্থাপন করে।৬০
কিন্তু তারা এরশাদের এই তৎপরতা প্রতিরােধের কোনাে চেষ্টা করেনি।
ক্ষমতাসীন দলও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই প্রশ্নে কোনাে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। সুতরাং বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামাের মধ্যে সামরিক আমলাদের দাবি পূরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সাত্তার ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এবং অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, চারজন মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানত্রয়। নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব ছিল জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সকল প্রশ্নে সরকারকে সাহায্য ও পরামর্শ দান। তাছাড়া পরিষদ সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রয়ােজন সম্পর্কে বিবেচনা করবে এবং সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশ গ্রহণের পন্থা ও উপায় উদ্ভাবন করবে।
কিন্তু সামরিক নেতাদের নিকট এই ব্যবস্থা গ্রহণযােগ্য ছিল না। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদ ছিল একটি পরামর্শসভা মাত্র, একে নীতিনির্ধারণী কোনাে ক্ষমতাই দেয়া হয়নি।
সামরিক নেতাদের সন্তুষ্টি বিধানের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রপতি সাত্তার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠন করেন। পুনর্গঠিত পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ জন। সদস্যরা হলেন রাষ্ট্রপতি (চেয়ারম্যান), উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানগণ।
নিরাপত্তা পরিষদে সামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দের সংখ্যাসাম্য সামরিক এলিটদের দাবি আংশিকভাবে পূরণ করে এবং ১৯৮১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পরিষদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে অদক্ষতা ও অসততার অভিযােগে ৪২ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীপরিষদ ভেঙে দিয়ে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট নতুন মন্ত্রীপরিষদ গঠন করা হয়। এভাবে নিরাপত্তা পরিষদ একটি শক্তিশালী সংস্থা হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ সেখানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ছিল না এবং রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাংবিধানিক সংশােধনীর মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে স্থায়ী রাজনৈতিক ভূমিকা প্রদান করে নিজে একজন নামসর্বস্ব রাষ্ট্র প্রধান হতে প্রস্তুত ছিলেন না।
অপরদিকে, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে সামরিক এলিটদের বাস্তব কর্তৃত্বও হুমকির সম্মুখীন হয়। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল, বিশৃংখলা, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযােগ এবং দ্রুত
২৪৯
অবনতিশীল অর্থনৈতিক ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সরকারকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলে। প্রধান বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে এবং তাদের কেউ কেউ গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের হুমকি প্রদান করে। মুক্তিযােদ্ধা বনাম অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরাে জটিল করে তােলে। পাকিস্তান প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে গঠিত সামরিক এলিট গােষ্ঠী তাদের কর্তৃত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। টলায়মান সাত্তার সরকারের ওপর নির্ভর করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুতরাং ক্ষমতা কাঠামােতে তাদের আধিপত্য অক্ষুন্ন রাখার জন্য তারা সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়।
সূত্র ও টীকা
১. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫৬; ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২৭।
২. দেখুন ইত্তেফাক, ২ জুন, ১৯৮১।
৩. ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৩১৮-৩১৯; তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests, প্রাগুক্ত, চতুর্দশ অধ্যায়; সংবাদ ও ইত্তেফাক, ৩১মে, ১, ২, ও ৩ জুন, ১৯৮১।
৪. তিনটি মুক্তিযােদ্ধা সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিবৃতি দেখুন, সংবাদ, ৩১ জুলাই ও ৭ আগস্ট, | ১৯৮১; The Bangladesh Observer, ৭ আগস্ট, ১৯৮১।
৫. শ্বেতপত্রের পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন The Bangladesh Observer, ৫-৮ আগস্ট, ১৯৮১। y
৬. জিল্লুর রহমান খান বলেন, “Bangladesh in 1981 : Change, Stability and Leadership,” Asian Survey, খণ্ড ২২, সংখ্যা ২ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২), পৃষ্ঠা ১৬৮-১৬৯।
৭. মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১১।
৮. লরেন্স লিফশুজ “Abu Taher’s Testament : Bangladesh: The Unfinished Revolution,” Economic and Political Weekly, আগস্ট ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৩৩৯।
৯. মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১১।
১০. এক ভাষ্য অনুসারে, জেনারেল মঞ্জুর ঐ অভ্যুত্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু তার অধীনস্থ অফিসারগণ যখন জিয়াকে হত্যা করে ফেলেন তখন তিনি সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেখুন জিল্লুর রহমান খান, Martial Law… প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৭।
১১. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২।
১২. দেখুন, জ্যোতি সেনগুপ্ত, Bangladesh: In Blood and Tears (নয়াদিল্লী : নয়া প্রকাশ পাবলিশার্স), ১৯৮১।
১৩. জিল্লুর রহমান খান, Martial Law, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৯।
১৪. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৭।
১৫. বিরােধী দলীয় সদস্যদের বক্তৃতা দেখুন মিজানুর রহমান চৌধুরী (আওয়ামী লীগ মিজান), সংবাদ, ২১ জুন, ১৯৮০; কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শওকত আলী (আওয়ামী লীগ), ঐ; সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (জাতীয় একতা পার্টি), ঐ, ২৩ জুন, ১৯৮০; রাশেদ খান মেনন (বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন), নতুন কথা, ২৭ জুন, ১৯৮০; আব্দুস সবুর খান (বাংলাদেশ মুসলিম লীগ), সংবাদ, ১২ এপ্রিল, ১৯৮১।
১৬. রাষ্ট্রপতি জিয়ার বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ, ২২ ও ২৭ এপ্রিল এবং ৩ মে, ১৯৮১।
১৭. দেখুন সংবাদ, ১৪ ও ২৫ মে, ১৯৮১; The Bangladesh Times, ২৬ মে, ১৯৮১।
২৫০
১৮. দেখুন মার্কাস, ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩০; আরাে দেখুন, “BNP Power Struggle keys up,” Holiday, ১২ এপ্রিল, ১৯৮১।
১৯. সংবাদ, ২৮ এপ্রিল, ১৯৯১।
২০. মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) নুরুজ্জামানের বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ, ২৬ আগস্ট, ১৯৮১।
২১. মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩০৮-৩০৯।
২২. সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিমতের জন্য দেখুন সংবাদ, ১১, ১২, ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭ জুন,১৯৮১।
২৩. গার্ডিয়ান পত্রিকার রিপাের্টার পিটার নেসওয়ান্ডের সঙ্গে জেনারেল এরশাদের সাক্ষাৎকার, উদ্ধৃতি দেখুন Holiday ১৮ অক্টোবর, ১৯৮১।
২৪. কাজী মন্টু “War of Two Trends in BNP,” Holiday, ২৮ জুন ১৯৮১।
২৫. জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী দেখুন, সংবাদ, ৫ জুলাই, ১৯৮১।
২৬. ৮ জুলাই তারিখে মাত্র ১৩ জন বিরােধী দলীয় সদস্য সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই ইসলামী ডানপন্থী দলগুলাের সদস্য।
২৭. দেখুন সংবাদ, ১১, ১৩, ১৬, ১৮ ও ১৯ জুলাই, ১৯৮১।
২৮. জামায়াত ও মুসলিম লীগ নেতাদের বিবৃতি দেখুন, সংবাদ, ৫ ও ২১ অক্টোবর, ১৯৮১।
২৯, দলনেতা মওলানা আব্দুল রহিমের বিবৃতি দেখুন, সংবাদ, ৬ অক্টোবর, ১৯৮১।
৩০. দেখুন সংবাদ, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১।
৩১. দেখুন, সংবাদ, ৪ ও ১৩ অক্টোবর, ১৯৮১।
৩২. আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ড. কামাল হােসেনের নির্বাচনী বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ, ২৮ সেপ্টেম্বর এবং ৩, ৪, ৫ ও ১৭ অক্টোবর, ১৯৮১; আওয়ামী লীগ-এর নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য দেখুন, সংবাদ, ২০ অক্টোবর, ১৯৮১।
৩৩. জোট নেতৃবৃন্দের নির্বাচনী বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ, ৩ ও ২১ অক্টোবর, ১৯৮১; এবং জোটের নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য দেখুন, সংবাদ, ২২ অক্টোবর, ১৯৮১।
৩৪. দেখুন সংবাদ, ১৭, ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর, ১৯৮১।
৩৫. রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও বিএনপির অন্যান্য নেতার নির্বাচনী বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ ও The Bangladesh Observer, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৩ ১৮ ও ১৯ অক্টোবর এবং ১৩ ও ১৪ নভেম্বর, ১৯৮১।
৩৬. বিরােধী প্রার্থীদের নির্বাচনােত্তর সাংবাদিক সম্মেলন দেখুন, সংবাদ ১৬, ১৭, ১৮ ও ২০ নভেম্বর, ১৯৮১।
৩৭. দেখুন “Landslide for BNP,” Holiday, ২২ নভেম্বর, ১৯৮১।
৩৮. দেখুন “Presidential Poll Worries,” Holiday, ১ নভেম্বর, ১৯৮১; আরাে দেখুন লন্ডনের বিবিসি-এর মন্তব্য, সংবাদ, ১৪ নভেম্বর, ১৯৮১।
৩৯. দেখুন Holiday, ১৮ অক্টোবর, ১৯৮১।
৪০. দেখুন সংবাদ, ১৯ অক্টোবর, ১৯৮১।
৪১. জেনারেল এরশাদের বিবৃতি দেখুন, The Bangladesh Observer, ২৫ মার্চ, ১৯৮২।
৪২. সংবাদ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৮১।
৪৩. দেখুন মাহমুদ রশিদ, “1971 Debate Cripples BNP,” Holiday, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮২; সংবাদ, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৮১ ও ২ জানুয়ারি, ১৯৮২।
৪৪. সংবাদ, ২২ নভেম্বর, ১৯৮১।
৪৫. সংবাদ, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৮১।
৪৬. সংবাদ, ১৯ ও ২০ মার্চ, ১৯৮২।
২৫১
৪৭. The Bangladesh Observer, ও সংবাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২।
৪৮. The Battle of Services, Holiday, ২৫ অক্টোবর, ১৯৮১।
৪৯. দেখুন এনায়েতুল্লাহ খান, “An Explosive Mix,” Holiday, ৭ মার্চ, ১৯৮২।
৫০. দেখুন The Bangladesh Observer, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২।
৫১. বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা কমিশন, Economic Review, ১৮৯১-৮২, পৃষ্ঠা ১৫৭।
৫২. বাংলাদেশ সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জরীপ, ১৯৮১-৮২, পৃষ্ঠা ১৫৭।
৫৩. বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা কমিশন, Economic Review, ১৯৮১-৮২, পৃষ্ঠা ৩৭।
৫৪, ঐ, পৃষ্ঠা ৩৮।
৫৫. ঐ, পরিশিষ্ট ৭, পৃষ্ঠা ৩২।
৫৬. Holiday, ১৮ই অক্টোবর, ১৯৮১।
৫৭. ঐ।
৫৮. দেখুন জেনারেল এরশাদের সাক্ষাৎকার, উদ্ধৃতি Holiday, ১৮ অক্টোবর, ১৯৮১।
৫৯. The Bangladesh Observer, ২৯ নভেম্বর, ১৯৮১।
৬০. দেখুন সংবাদ, ৩০ নভেম্বর এবং ১, ২ ও ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১; Holiday, ৩ জানুয়ারি, ১৯৮২।
২৫২
Reference – বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক