You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিয়ার ভারসাম্যের রাজনীতি

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখা গেছে যে, জেনারেল জিয়া তাঁর সরকারের জন্য একটা ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন ভিত্তি ও বৈধতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কতকগুলাে সাংবিধানিক সংশােধনী জারি করেন। এই সাংবিধানিক সংশােধণীসমূহ রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করে। নতুন নতুন গােষ্ঠী রাজনীতিতে প্রবেশ লাভ করে এবং বিদ্যমান আদর্শিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়। জিয়া বাম ও ডান, মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধা, ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামী, প্রভৃতি বিপরীতমুখী গােষ্ঠীসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য মধ্য পন্থা অবলম্বন করেন। কিন্তু জিয়ার এই ভারসাম্যের রাজনীতি জাতীয় একাত্মতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সরকারের সমস্যাবলী সমাধানের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অবদান রাখতে সমর্থ হয়নি।

১. জাতীয় একাত্মতার সমস্যা

আমরা দেখেছি যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ কর্তৃক আখ্যায়িত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ইসলামী ডানপন্থী ও চীন সমর্থিত বামপন্থীদের একাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা মেনে নেয়নি। একটা ব্যাপক ঐকমত্য গড়ে তােলার লক্ষ্যে জিয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে এক নতুন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। 

ক. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ 

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, জেনারেল জিয়া বাঙালি জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশি’ বলে আখ্যায়িত করেন, কিন্তু সংবিধানে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কোনাে ব্যাখ্যা দেননি। তিনি অনেক সময় নেতিবাচক অর্থে, বিদেশি আধিপত্য বা ‘বিদেশিবাদ, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ-এর অবসানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলে বর্ণনা করেন।১

তবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জিয়ার সর্বাপেক্ষা বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সভায় তাঁর বক্তৃতায়। তিনি বলেন :

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অর্থ হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশি। আমাদের পৃথক ইতিহাস রয়েছে। আমাদের দেশ এক ভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জন্মলাভ করেছে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথক। আমাদের ভাষা পৃথক, আমরা তাকে নিজের মতাে করে গড়ে তুলছি—আমরা তাকে আধুনিক করছি। আমাদের পৃথক সাহিত্য ও কবিতা রয়েছে। আমাদের পৃথক শিল্প ও চিন্তাধারা

১৯২

রয়েছে। আমাদের ভৌগােলিক অবস্থান পৃথক, আমাদের নদী ও ভূমি পৃথক, আমাদের জনগণ পৃথক। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম।…এবং আজ আমাদের জনগণের মধ্যে এক চেতনা গড়ে উঠেছে, যে চেতনা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের জনগণের থেকে ভিন্ন।২

একটা জাতি গড়ে ওঠে কোনাে জনগােষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও অন্যান্য জনগােষ্ঠী হতে পার্থক্য বােধ থেকে। স্পষ্টত জিয়া অন্যান্য প্রতিবেশী জনগােষ্ঠীর সঙ্গে পার্থক্যের ওপর অধিক জোর দিয়েছেন। একটা পৃথক ইতিহাস, পৃথক ভূখণ্ড, নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি, ইত্যাদিকে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করেন, যা থেকে আপাতত মনে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের মধ্যে তেমন কোনাে পার্থক্য নেই। কিন্তু বাস্তবে পার্থক্য রয়েছে, এবং তা খুঁজতে হবে ইতিহাসের ভিন্ন ব্যাখ্যা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলার মধ্যে ভূখণ্ডগত ও রাষ্ট্রনৈতিক বিভাজনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমগ্র ভাণ্ডারকে নিজের উত্তরাধিকার বলে গ্রহণ করে। অপর পক্ষে, বাংলাদেশি জাতীয়তবাদ বাংলাদেশের বাঙালি ও ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ওপর জোর দেয় এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে “নিজের মতাে করে গড়ে তুলতে চায়। জিয়া দাবি করেন যে, ১৯৪৭ সালে যখন বাংলা বিভক্ত হয় তখনই বাঙালি পরিচয় পরিত্যাগ করা হয়, এবং তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভারত থেকে আমদানি করেছে।৩

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে হিন্দু প্রভাবের প্রতি কটাক্ষ করে বিএনপি মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ভাষাভিত্তিক জাতীয় পরিচয় আমাদের আংশিক পরিচয়। মাত্র।৪

জেনারেল জিয়া ভাষা ও সংস্কৃতি নিজের মতাে করে গড়ে তুলতে গিয়ে আওয়ামী লীগ আমলের কিছু জনপ্রিয় বাংলা স্লোগান ও শব্দের স্থলে অ-বাংলা স্লোগান ও শব্দের ব্যবহার উৎসাহিত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ কালীন স্লোগান ‘জয় বাংলা’-এর পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এবং বাংলাদেশ বেতার’-এর পরিবর্তে রেডিও বাংলাদেশ’ প্রবর্তন করেন, যেগুলাে ছিল পাকিস্তান আমলে ব্যবহৃত ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ও ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর অবিকল অনুকরণ। তেমনি বাংলা শব্দ রাষ্ট্রপতি’ ও ‘উপাচার্য’এর স্থলে ইংরেজি শব্দ ‘প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর আমদানি করা হয়।

জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালিদের মধ্যে পার্থক্যবোেধ জোরদার করার জন্য ইতিহাসের পুনর্ব্যাখ্যা করেন। যেখানে মুজিব প্রায়শই তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে পাকিস্তানি শাসকদের শােষণ ও নিপীড়ণের চিত্র তুলে ধরতেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যে করার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানাতেন, সেখানে জিয়া দুই যুগব্যাপী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঘটনাবলি আড়াল করে কেবল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সামনে নিয়ে আসেন এবং পাকিস্তান অপেক্ষা ভারতের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করেন। তিনি জনগণকে এই বলে অনুপ্রাণিত করতেন যে, আমাদের জনগণই দেশ স্বাধীন করেছে, বিদেশ থেকে কেউ এসে নয়। যারা 

১৯৩

আমাদের কিছু সাহায্য করেছে তারা তা করেছে যখন দেখেছে যে, শত্রুর মেরুদণ্ড ইতােমধ্যে ভেঙে পড়েছে।৫

ধর্মও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম উপাদান ছিল। জিয়া ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করেন এবং কিছু প্রতীকধর্মী বিধান সন্নিবেশিত করে সংবিধানকে ইসলামী রং দেন। জিয়া নিজে বিসমিল্লাহ-হির-রহমান-আর রাহিম’ বলে তার বক্তৃতা শুরু করতেন এবং বিএনপির ঘােষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রে এবং দেশের সংবিধানে এই শব্দগুচ্ছ উত্তীর্ণ করা হয়। এভাবে জিয়া কতিপয় ইসলামী প্রতীকের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যানুভূতি সৃষ্টি এবং একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত থেকে বাংলাদেশের পার্থক্য তুলে ধরার প্রয়াস পান। তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতিরােধেও ইসলাম ধর্মকে ববহার করতে চান। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ কিছু নয়।…আজ যা প্রয়ােজন তা হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলাম আমাদেরকে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করে।৬

জিয়ার দল ও প্রশাসনে কিছু লােক ছিলেন যারা জাতীয় জীবনে ইসলামের আরাে সক্রিয় ভূমিকা কামনা করেন এবং বাংলাদেশকে ইসলামী আদর্শের নিশান বর্দার রূপে গড়ে তুলতে চান।৭

কিন্তু জিয়া পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জাতীয়তাবাদ গ্রহণে প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ তা জিয়াকে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতাে। সুতরাং তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের আস্থা লাভের জন্য ইসলামের সহনশীলতা ও উদারতাবাদকে কাজে লাগান। বিএনপির ঘােষণাপত্রে বলা হয় :

ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মপ্রিয়তা বাংলাদেশি জাতির এক মহান চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য… বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই বাস্তব সত্য (এবং ইসলামের) সুষ্ঠু ও উদার বৈশিষ্ট্য জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত ও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। ইসলামের মহান শিক্ষাকে যথাযথভাবে আত্মস্থ করে। তাকে জাতীয় জীবনের মূলে সংহত করতে সমর্থ হওয়ায় বাংলাদেশি জনগােষ্ঠী উগ্র সাম্পদ্রায়িকতার বিষ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে।৮

এভাবে জেনারেল জিয়া, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ভূখণ্ডগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় ভাবাবেগের সংমিশ্রণে ব্যাপক ভিত্তিক জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতিগত গােষ্ঠীর মধ্যে বাংলাদেশি জাতীয়তার সংজ্ঞা ও ভিত্তি সম্পর্কে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন।

খ. বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বংশ পরম্পরায় নিজেদেরকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে আসছিল। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পরেও সেই পরিচয় অক্ষুন্ন ছিল এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গােষ্ঠীসমূহে বাঙালি পরিচয় পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী বলেন : 

১৯৪

নাগরিক হিসাবে আমরা বাংলাদেশি হতে পারি, কিন্তু জাতীয়তার বিবেচনায় আমরা বাঙালি…আমাদের ভুললে চলবে না যে, বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই বাংলাদেশের জনগােষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় বাঙালি। এই পরিচয় শত শত বছরের। পাকিস্তান আমলে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই পরিচয় মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি। ভবিষ্যতেও তা করা সম্ভব হবে না।৯

উপযুক্ত রাজনৈতিক গােষ্ঠীসমূহ ধর্মনিরপেক্ষতার বিলােপ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুজ্জীবন জাতীয়তাবাদ সংগ্রামের ভিত্তি ও পটভূমিকে অস্বীকার এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল আদর্শকে নস্যাৎ করার সামিল বলে মনে করে। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতাকারী ইসলামী দলগুলাের বৈধকরণ বা পুনরুজ্জীবন, জেনারেল জিয়ার দল ও প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধে-বিরােধীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তানের প্রতি তাঁর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি, পাকিস্তানের অনুকরণে অ-বাংলা শব্দ ও স্লোগান ব্যবহারে সরকারিভাবে উৎসাহ প্রদান, ইত্যাদি তাদের নিকট জাতীয় স্বাধীনতা ও আদর্শের বিরুদ্ধে পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র বলে প্রতিভাত হয়। এই সব গােষ্ঠী বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসাবে স্বীকার করে নেয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রাখে।১০

বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশ, যারা দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনে সর্বাধিক প্রভাবশালী তারা বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের ধারণা অগ্রাহ্য করেন এবং তাদের লেখনি ও বক্তৃতায় নিজেদের ও জাতিকে বাঙালি আখ্যায় আখ্যায়িত করতে থাকেন।১১

গ. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিক্রিয়া 

ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুরা (যারা ছিল তখন মােট জনসংখ্যার প্রায় ১৩%) বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ গ্রহণ করেনি। হিন্দু সম্প্রদায় ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের (১৯৪৭) বিরােধিতা করে, এবং সারা পাকিস্তান আমলে এদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে দাবি জানায়। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ রূপে গ্রহণের ফলে তাদের মধ্যে দেশের নাগরিক হিসেবে সন্তুষ্টি ও সমতার মনােভাব সৃষ্টি হয়। জিয়ার শাসনামলে আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও সকল নাগরিকের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত সাংবিধানিক অধিকার অক্ষুন্ন ছিল, সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমূহে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ছুটি পালন করা হতাে। জাতীয় বেতার ও টেলিভিশনে তাদের ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানাদি প্রচার করা হতাে। এমনকি জিয়া নিজে সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার বিলােপ, জিয়া ও তার সহকর্মীদের ইসলামী প্রতীক ব্যবহার, সাম্প্রদায়িক ইসলামী দলসমূহের পুনরুজ্জীবন, ইত্যাদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও নিরাপত্তাহীনতার মনােভাব সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বাঙালি ও ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে পার্থক্যকরণের ব্যাপারে জিয়ার জোরালাে উদ্যোগ এবং

১৯৫

বাংলা ভাষাকে নবরূপ দানের প্রচেষ্টা বিশেষ করে হিন্দু সংখ্যালঘুদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। কারণ ভারতীয় বাঙালিদের সংগে তাদের অনেকের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল এবং তাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের গভীর অনুরাগ ও মমত্ববােধ ছিল।

ঘ. উপজাতিদের প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়করণ আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করে এবং পাশপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসাবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে শান্তি। বাহিনী’ নামের একটি সশস্ত্র দল গঠন করে। ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন আরােপের পর নিয়মতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে লারমা আত্মগােপন করেন এবং তার শান্তি বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে। উপজাতীয় বিদ্রোহীদের আর একটি সশস্ত্র গ্রুপ ও মুক্তি পরিষদ’ নাম নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অস্ত্র ধারণ করে। যদিও জিয়া বাঙালি জাতীয়তার স্থলে বাংলাদেশ নামকরণ করে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসাবে বাংলা। ভাষা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব লাঘবের চেষ্টা করেন, তিনি উপজাতীয়দের পৃথক জাতীয় গােষ্ঠী হিসাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বরং তিনি তাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য একাধারে দমন ও তােষণ নীতি অনুসরণ করেন।

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক বিরাট দলকে পাঠায় এবং সেখানে তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নির্মম অভিযান চালাতে থাকে। একই সঙ্গে সরকার উপজাতীয়দের মন জয় করার জন্য কতিপয় তােষণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল- উপজাতীয় প্রধান ও হেডম্যানের মাসােহারার ব্যবস্থা, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ উন্নয়ন বাের্ড ও সাংস্কৃতিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা, অনেক গ্রামে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ, আধা-যাযাবর উপজাতীয়দের জন্য বসতি স্থাপন, এবং পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন কাজের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ। কিন্তু এই সব পদক্ষেপ উপজাতীয়দের সন্তুষ্টি বিধানে ব্যর্থ হয়। যে বিষয়টি উপজাতীয়দের সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করে তা হলাে এই যে, বাংলাদেশ সরকার সমতল ভূমির বাঙালিদের পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের নীতি গ্রহণ করে এবং জিয়া আমলে এই নীতি আরাে জোরদার হয়। উপজাতীয় সংসদ সদস্য উপেন্দ্রলাল চাকমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের’ (বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা ১৯৬৪ সালে ছিল মােট জনসংখ্যার মাত্র ১২%; তা বেড়ে ১৯৭২ সালে হয় ২০% এবং ১৯৮১ সালে ৪০%।১২

সরকারি হিসাব অনুসারে, যেখানে ১৯৭৪ সালের তুলনায় ১৯৮১ সালে গােটা বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ২১.৭৯%, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪৬.৮৫%। এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণ হলাে দেশের অন্যান্য অংশ থেকে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসন।১৩

১৯৬

এর ফলে উপজাতীয়রা কালক্রমে নিজ আবাসভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হতাে এবং তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সুফল থেকেও বঞ্চিত হতাে। কারণ তুলনামূলকভাবে অগ্রসর বাঙালিরা অপেক্ষাকৃত ভালাে কৃষিজমি দখল করে এবং সরকারি চাকরি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধাদি লাভ করে। সুতরাং উপজাতীয়রা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ ছাড়াও প্রায়শ বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতাে, এবং এই সংঘর্ষ উপজাতীয় ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জন্য পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসবাস দুর্বিসহ করে তােলে।১৪

যা হােক, উপজাতীয়দের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সংখ্যার দিক দিয়ে তারা বাংলাদেশের জনগােষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ (এক শতাংশেরও কম)। আর্থসামাজিক দিক দিয়ে তারা ছিল খুবই অনগ্রসর এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে অসংগঠিত। সকল উপজাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও বিভিন্ন বিদ্রোহী গােষ্ঠীর কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার মতাে কোনাে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেনি। বরং বিভিন্ন উপজাতীয় গােষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং শান্তি বাহিনী ও মুক্তি পরিষদের মধ্যে শক্রতা তাদের সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।১৫

এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন শান্তি বাহিনী উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত ছিল এবং এর নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে এক প্রতিদ্বন্দ্বী উপদল কর্তৃক নিহত হন। সুতরাং উপজাতীয় সমস্যা বাংলাদেশ রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা না দিলেও, তা জাতীয় শক্তি ও অর্থনীতির ওপর এক বিরাট বােঝা হয়ে দাঁড়ায় এবং আশু রাজনৈতিক মীমাংসার দাবি রাখে।

ঙ. ইসলামী জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়া 

মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করলেও বাহ্যত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা ও আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছর তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদের সপক্ষে কোনাে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং তাদের প্রতি জিয়ার আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের একাংশকে বিএনপিতে যােগদানে আকৃষ্ট করে। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের প্রধান অংশ পুরাতন অথবা নতুন নামে তাদের নিজ নিজ দলকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে ঘােষণার দাবি উত্থাপন করে।

মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের জন্মকে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন’ বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা বলেন পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে ঐ প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি এবং ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের

১৯৭

সৃষ্টির মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তবে তারা দাবি করেন যে, লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হতাে না।১৬

তারা দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন এবং বাংলাদেশকে মুসলিম জাতি বলে আখ্যায়িত করেন। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে সমান অংশীদার হিসাবে মেনে নেননি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি উত্থাপন করেন।১৭

মুসলিম লীগ সম্ভবত বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশি’ নামকরণ পছন্দ করে, কারণ তা বাংলাদেশের বাঙালি ও ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। কিন্তু তারা জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র ভিত্তি হিসাবে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মুসলিম লীগ সভাপতি আব্দুস সবুর খান বলেন :

সমাজতান্ত্রিক বার্মা ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মাঝখানে অবস্থিত বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে আমাদের জীবন দর্শন তথা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।১৮ 

কিন্তু মৌলবাদী ইসলামী গােষ্ঠীসমূহ (যেমন ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ ও জামায়াত-ই-ইসলামী) বাংলাদেশি’ নামকরণটাও মেনে নেয়নি। তারা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ প্রধান মওলানা আব্দুর রহিম বলেন :

প্রথমে বাঙালি এবং পরে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের মুসলমানত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে।…আমরা যেহেতু বাংলা ভাষায় কথা বলি সেহেতু বাংলাভাষী কিন্তু বাঙালি নই, কেননা মুসলমান কখনাে বাঙালি হতে পারে না। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক এই অর্থে বাংলাদেশি, কিন্তু সবকিছুর ওপরে আমরা মুসলমান।১৯

তিনি জোর দিয়ে বলেন, জনগণ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত, এবং অন্য কোনাে ভিত্তিতে তাদেরকে এক জাতিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।২০

জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা মাওলানা আব্বাস আলী খান আরাে এক ধাপ এগিয়ে বলেন;

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী, আমাদের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইসলামী জাতীয়তাবাদ।২১

ইসলামী গােষ্ঠীসমূহ নিজেদের মনমতাে ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিয়ে দাবি করে যে, বাঙালি জাতীয়তার চেতনা নয়, বরং মুসলমানদের আদর্শগত সংগ্রামই বাংলাদেশের সৃষ্টি করে, এবং তারা মুসলমানদের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পার্থক্যের ওপর বিশেষ জোর দেয়। ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগের অন্যতম নেতা মাওলানা আব্দুল মজিদ খান বলেন :

ইসলামকে রক্ষা ও উপমহাদেশের মুসলমানদের পৃথক সত্ত্বা সংরক্ষণের জন্য আমরা সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান অর্জন করি, যা পৃথক ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে। অতীতে আমরা অমুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার

১৯৮

বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছি। ইনশাআল্লাহ শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।২২ 

এভাবে ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ ভূখণ্ডগত ও ভাষাগত জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখান করে এবং ইসলামী আদর্শকে জাতীয়তার একমাত্র ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ১৯১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকে একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলে স্বীকার করেনি এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে এই যুক্তি দেখায় যে, সেই যুদ্ধ ইসলামের স্বার্থে করা হয়নি, বরং কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থে তা করা হয়েছিল।২৩

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা প্রাণ বিসর্জন দেন ইসলামী গােষ্ঠীগুলাে তাদের ‘শহীদ’ বলে গ্রহণ করেনি। তারা একুশে ফেব্রুয়ারি (শহীদ দিবস), পহেলা বৈশাখ (বাংলা নববর্ষ), বিজয় দিবস (১৬ই ডিসেম্বর), প্রভৃতি জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানকে অনৈসলামিক বলে অগ্রাহ্য করে। এমন কি তারা জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করতে চায়, কারণ তাতে কোনাে ইসলামী প্রতীক ছিল না এবং জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করতে চায়, কারণ তা ছিল অমুসলিম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা।২৪ 

চ. চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের প্রতিক্রিয়া 

চীনপন্থী কম্যুনিস্ট গােষ্ঠীগুলাের অধিকাংশ বাংলাদেশকে একটি পৃথক দেশ হিসাবে মেনে নেয়। কিন্তু তাদের কেউ বাংলাদেশকে স্বাধীন জাতি বলে স্বীকার করেনি এবং জাতীয় সরকারের প্রতি আনুগত্যও স্বীকার করেনি। এমনকি তারা ‘বাংলাদেশ’ নামটি গ্রহণ না করে এ দেশকে পূর্ববাংলা’ অথবা পূর্ব পাকিস্তান নামে ডাকতে থাকে। এই বাম গােষ্ঠীগুলাে ভূখণ্ডগত, ভাষাগত, কিংবা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করত না, বরং তারা ক্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকবাদে বিশ্বাসী ছিল। পররাষ্ট্র সম্পর্কের প্রশ্নেই তাদের রাজনীতির প্রধান উপাদান ছিল। তারা মনে করতাে যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ছিল। না। তাদের মতে এটা ছিল সােভিয়েত রাশিয়া সমর্থিত ভারতীয় আক্রমণ, যার মাধ্যমে পূর্ব-বাংলা ভারতের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে রুশ ভারতের ‘পুতুল সরকার’ বলে আখ্যায়িত করে।

চীনপন্থী গােষ্ঠীগুলাে মুজিব সরকারের উৎখাত এবং পরবর্তী সরকারের ভারত-বিরােধী দৃষ্টিভঙ্গিকে রুশ-ভারতের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করে। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর চীন সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ঘটনাও ‘জাতীয়’ প্রশ্নে চীনপন্থীদের মনােভাবের পরিবর্তন সাধন করে। ১৯৭৫ সালের পর তাদের অধিকাংশই আত্মগােপন থেকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মনে নেয় ও নিজ দলের নামের আগে ‘পূর্ববাংলা’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে বাংলাদেশ’ শব্দটি যােগ করে।২৫

তবে ‘বাঙালি’ বনাম বাংলাদেশি’ বিতর্কে তারা সক্রিয়ভাবে যােগ দেয়নি।

১৯৯

২. রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা

এক দলীয় ব্যবস্থার বিলােপ, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ১৯৭১ সালের পাকিস্তানপন্থী যােগসাজশকারীদের রাজনৈতিক অধিকার (ভােটদান ও নির্বাচনে প্রার্থী হবার অধিকার) পুনর্বহালের ফলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের আওতা পরিবর্ধিত হয় এবং নতুন নতুন রাজনৈতিক গােষ্ঠী রাজনীতিতে প্রবেশ লাভ করে। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কাঠামাের মধ্যে একত্র করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা এবং বিভিন্ন। রাজনৈতিক গােষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহাসিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব বিরাজমান থাকার ফলে সুস্থ। প্রতিযােগিতা ও রাজনৈতিক শৃংখলা দারুণভাবে ব্যাহত হয়।

ক. সংসদীয় রাজনীতি ও অংশগ্রহণ 

তাঁর সরকারের বৈধতা জোরদার করার লক্ষ্যে জেনারেল জিয়া নানা কৌশলে বিরােধী দলসমূহে নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত করেন (সপ্তম অধ্যায়)। একই সঙ্গে তিনি সংসদে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারেও যত্নবান ছিলেন।২৬ ফলে, দ্বিতীয় সংসদে (১৯৭৯-১৯৮২) প্রধান প্রধান দলের নেতৃবৃন্দসহ বিরােধী দলীয় সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৭৯।২৭

সে তুলনায়, প্রথম সংসদে (১৯৭৩-৭৫) বিরােধী ও স্বতন্ত্র সদস্যদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯ জন। জিয়া এও ঘােষণা করেন যে, বিরােধী দল সংসদীয় গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ, এবং বিরােধী দলের নেতা ও উপনেতাকে যথাক্রমে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুবিধাদি প্রদান করে তিনি বিরােধী দলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দেন। ছােট খাট সংসদীয় গ্রুপের নেতাদেরকে সংসদ ভবনে ব্যক্তিগত কামরা বরাদ্দ করা হয়।

কিন্তু সংসদকে নির্বাহী বিভাগের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না দেয়ার ফলে বিরােধীদলসমূহ ক্ষুব্ধ ছিল। তারা সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সদস্যদের অধিকতর অংশ গ্রহণের সুযােগ প্রদানের দাবি অব্যাহত রাখে। অপর পক্ষে সরকার সংসদে আলােচনা ছাড়াই গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকে এবং ১৯৭৯ সালের বাজেট অধিবেশনের পর সাত মাসেরও অধিক সময় যাবৎ সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেনি। বিরােধী দলীয় সংসদ-সদস্যগণ সরকারের এই আচরণকে সংসদের প্রতি অবমাননা ও সংসদের অধিকার ক্ষুন্ন করার সামিল বলে মনে করেন।

১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে সকল বিরােধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য এক বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হন এবং সংসদ ও তার সদস্যদের ক্ষমতা ও সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২৪ দফা দাবিনামা প্রণয়ন করেন। এই দাবিসমূহের মধ্যে ছিল :

১. সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যে বিরতিকাল ৬০ দিনের বেশি হবে না। 

২. সরকারের বিদেশ নীতি এবং সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সমঝােতা অনুমােদনের জন্য সংসদে পেশ করতে হবে।

৩. সকল সরকারি বা আধাসরকারি কমিশন বা কমিটির রিপাের্ট সংসদে পেশ করতে হবে।

২০০

৪. বিরােধী দলীয় বা স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যগণকে সংসদে বক্তব্য রাখার পূর্ণ সুযােগ দিতে হবে । 

৫. সিদ্ধান্ত প্রস্তাব (Resolution), মুলতবি প্রস্তাব, ইত্যাদি যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত বাতিল করা যাবে না।

৬. সকল সংসদীয় কমিটি বিরােধী দল ও স্বতন্ত্র গ্রুপের নেতাদের সম্মতিক্রমে গঠিত ও পুনর্গঠিত হবে এবং এইসব কমিটির নিয়মিত বৈঠকের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। 

৭. সংসদ-সদস্যদের ক্ষমতা ও বিশেষ অধিকারের ব্যবস্থা সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে হবে। 

৮. নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিরােধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যদের অংশগ্রহণের পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে। 

৯. সংসদের ভিতরে ও বাইরে সংসদ-সদস্যদের প্রকাশিত মতামত সরকারি প্রচার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। 

১০. অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সকল প্রশাসনিক আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে পেশ করতে হবে। 

১১. বাজেট বরাদ্দ ছাড়া কোনাে অর্থ ব্যয় করা যাবে না।২৮

উপযুক্ত দাবিনামায় আরাে কিছু রাজনৈতিক দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়। যেমন, সকল বিল বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করা; ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল ‘কালা কানুন’ বাতিল করা; নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা; এবং সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি।

বিরােধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যগণ তাদের দাবিসমূহ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সংসদে অধিবেশন বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশন ১৯৮০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আরম্ভ হয়, এবং বিরােধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সকল সদস্য তাতে যােগদান থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বিরােধী দলীয় সদস্যদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন এবং কতিপয় সুবিধা দানের প্রতিশ্রুতি দেন। সেগুলাের মধ্যে ছিল : ঘন ঘন সংসদ অধিবেশন আহ্বান; আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ আলােচনার জন্য সংসদে উত্থাপন; বাংলায় সকল বিল প্রণয়ন; সংসদীয় ব্যাপার ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিরেধীদলীয় সদস্যদের অধিকতর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা, সংসদীয় কাজকর্মের ব্যাপারে আন্তঃদলীয় শলাপরামর্শ রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে বিরােধী দলের মতামত প্রচারের সুযােগ, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পর্যায়ক্রমক পৃথকীকরণ এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান। কিন্তু সরকার কিছু কিছু বিষয়, যেমন অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণকে সংসদের ক্ষমতা বহির্ভূত বলে প্রত্যাখ্যান করে এবং যুক্তি দেখায় যে, মুলতবী প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে এসব বিষয় সংসদে আলােচিত হতে পারে।২৯”

যাহােক, সরকার সংবিধান সংশােধন করে সংসদের ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকভাবে বৃদ্ধি করতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং বিরােধী দলীয় দাবিসমূহ সম্পর্কে কোনাে ঐকমত্যে পৌছান সম্ভব হয়নি।

২০১

কিন্তু সরকার বিরােধী দলসমূহের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করে এবং তাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে সংসদে যােগ দিতে সম্মত করে। ডানপন্থী বিরােধী দলসমূহ স্পষ্টতই ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম দলসমূহ অপেক্ষা আদর্শিকভাবে জিয়ার কাছাকাছি ছিল। সুতরাং তারা জিয়ার পতন ঘটতে পারে এমন পর্যায়ে আন্দোলনকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিল না। চীনপন্থী কম্যুনিস্টরাও আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী কম্যুনিস্টদের শাসক দল অপেক্ষা বড় শত্রু বলে মনে করতাে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডানপন্থী ও চীনপন্থী বাম দলগুলাে একই রূপ দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী ছিল। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগসহ ডানপন্থী দলগুলাে ও চীনপন্থীরা সেই সময় আফগানিস্তানে সােভিয়েত হস্তক্ষেপের তীব্র সমালােচক ছিল। বিএনপি সরকারও আফগান প্রশ্নে একই রূপ অবস্থান গ্রহণ করে এবং মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান কর্তৃক উত্থাপিত আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কিত একটি মুলতবি প্রস্তাব ২৫শে ফেব্রুয়ারি (১৯৮০) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ সভার আলােচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে। সরকারের এই কূটকৌশল সফল হয় এবং ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ডানপন্থী মুসলিম লীগ, গণফ্রন্ট এবং চীনপন্থী সাম্যবাদী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যগণ অধিবেশনে যােগদান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান), জাসদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় একতা পার্টির ৫১ জন সদস্য সেই অধিবেশনে যােগ দেননি।

পূর্বে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে জিয়া বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামাের আওতায় সংসদ-সদস্যদের পূর্বাপেক্ষা অধিক আলােচনার সুযােগ দেন। সংসদ বর্জন ঘটনার পর থেকে আগের তুলনায় ঘন ঘন সংসদ অধিবেশন ডাকা হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫, এই দু’বছরের সংসদীয় আমলে প্রথম সংসদ সাতটি অধিবেশন মিলিত হয়। দ্বিতীয় সংসদ ও জিয়ার জীবিতকালে প্রায় দু’বছর সময়কালে (১৯৭৯-১৯৮১) সাতটি অধিবেশনে বসে। যেখানে প্রথম সংসদ সাতটি অধিবেশনে ১১৪ কর্মদিবসে মােট ৪০৭ ঘন্টা কার্যসম্পাদন করে, সেখানে দ্বিতীয় সংসদ সাতটি অধিবেশনে ১৯৬ কর্মদিবসে ৮৪৩ ঘণ্টা কাজ করে।৩০

আনুপাতিকভাবে, দ্বিতীয় সংসদে বিরােধী দলীয় সদস্যগণ আলােচনর জন্য সরকার পক্ষীয় সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি সময় পান।৩১

জিয়া পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা অনেক কম প্রয়ােগ করেন। যেখানে প্রথম সংসদে সাতটি অধিবেশনে পাসকৃত ১১২টি বিলের মধ্যে ৪৯% রাষ্ট্রপতি পূর্বেই অধ্যাদেশ আকারে জারি করেন, সেখানে দ্বিতীয় সংসদের প্রথম সাতটি অধিবেশনে পাসকৃত ৬৩টি বিলের মধ্যে পূর্বে জারিকৃত অধ্যাদেশের সংখ্যা ছিল ২৭%।।

উপযুক্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতিভাত হয় যে, দ্বিতীয় সংসদের সদস্যগণ আইন প্রণয়নমূলক বিষয়ে প্রথম সংসদের সদস্যদের তুলনায় অধিক সময় ও সুযােগ লাভ করেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আইন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় সংসদ কর্তৃক পাসকৃত বিলসমূহের মাত্র ২২% সংসদে সংশােধিত আকারে গৃহীত হয় এবং অবশিষ্ট

২০২

বিলসমূহ সরকার যে আকারে পেশ করে সে আকারে গৃহীত হয়। অপর পক্ষে, প্রথম সংসদে গৃহীত বিলসমূহের ৩৩% সংসদ কর্তৃক সংশােধনের পর পাস করা হয় (দেখুন সারণি ৮.১)।

তবে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাহী বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলাদি ব্যাপক পরিমাণে প্রয়ােগ করে। প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিটি ১৯৭৫ সালে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর স্থগিত করা হয়। ১৯৭৯ সালে এই পদ্ধতি পুনরায় চালু করা হয় এবং দ্বিতীয় সংসদের প্রথম সাতটি অধিবেশনে ৭২৯৪টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়। পক্ষান্তরে প্রথম সংসদের প্রথম সাতটি অধিবেশনে এরূপ প্রশ্নের সংখ্যা ছিল ৪৬৭৪। দ্বিতীয় সংসদে উত্থাপিত ও আলােচিত বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব, মুলতবি প্রস্তাব, মনােযােগ আকর্ষণ প্রস্তাব, সংক্ষিপ্ত আলােচনার প্রস্তাব, ইত্যাদির সংখ্যা প্রথম সংসদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল (দেখুন সারণি ৮.২)।

জিয়ার শাসনামলে সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ব্যাপক আলােচনা ও বিতর্কের সুযােগ প্রদান করা হলেও বিরােধী দলসমূহ সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্ত যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে পারেনি। সংসদে বিরােধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান দুঃখ করে বলেন, গণবিরােধী আইন পাস করা ছাড়া সংসদের কোনাে ক্ষমতা নেই।৩২

একজন জাসদ দলীয় সংসদ-সদস্য ১৯৮১ সালের ৩০ এপ্রিল সংসদ থেকে এই বলে ইস্তফা দেন যে, মন্ত্রীপরিষদের ওপর সংসদের কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই, সংসদকে উপেক্ষা করে প্রশাসনিক আদেশ বলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে, প্রশাসন সংসদ-সদস্যদের প্রতি সম্মান দেখাচ্ছে না এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযােগ দিচ্ছে না।৩৩

সারণি ৮.১ 

প্রথম ও দ্বিতীয় সংসদের প্রথম সাতটি অধিবেশনে উপস্থাপিত ও গৃহীত বিল ও অধ্যাদেশের সংখ্যা

  প্রথম সংসদ দ্বিতীয় সংসদ
উপস্থাপিত বিলের সংখ্যা ১১৮ ৯১
পাসকৃত বিলের সংখ্যা ১১২ ৬৩
উপস্থাপিত অধ্যাদেশের সংখ্যা ৫৫ ১৭
পাসকৃত মােট বিলের শতাংশ হিসাবে অধ্যাদেশ ৪৯ ২৭
সংশােধিত আকারে গৃহীত বিলের সংখ্যা ৩৭ ১৪
পাসকৃত মােট বিলের শতাংশ হিসাবে    
সংশােধিত আকারে গৃহীত বিল ৩৩ ২২

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যবাহের সারাংশ, ১৯৭৩-১৯৮১।

তবে সংসদে বিরােধীদলীয় সদস্যদের সংখ্যাধিক্য (প্রথম সংসদে ৯ জনের তুলনায় দ্বিতীয় সংসদে ৭৯ জন) এবং বিরােধী দলগুলাের প্রধান নেতৃবৃন্দের

২০৩

উপস্থিতি সংসদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে কিছুটা সহায়তা করে এবং বিরােধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে এমন এক আস্থার সৃষ্টি করে যে, তারা সম্মিলিতভাবে অনেক কিছুই করতে পারেন। সরকার বিরােধীদলীয় সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে কিছু ছাড় দিতে বাধ্য হয়। বিরােধী দলসমূহের আর একটি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব ছিল এই যে,

সারণি -৮.২

প্রথম ও দ্বিতীয় সংসদের প্রথম সাতটি অধিবেশনে উপস্থাপিত ও আলােচিত প্রশ্ন ও অন্যান্য প্রস্তাবের সংখ্যা

  প্রশ্ন/প্রস্তাবের নােটিশের সংখ্যা স্পিকার কর্তৃক গৃহীত প্রশ্ন/প্রস্তাবের সংখ্যা উত্তর-প্রদত্ত প্রশ্ন/আলােচিত প্রস্তাবের সংখ্যা
প্রথম সংসদ দ্বিতীয় সংসদ প্রথম সংসদ দ্বিতীয় সংসদ প্রথম সংসদ দ্বিতীয় সংসদ
প্রশ্ন (তারকাচিহ্নিত) ৭৫৭৬ ২০৯০৪ ৫৪১৩ ৭২৯৪ ৪৬৭৪ ৭২৯৪
বেসরকারি সদস্যদের ৩৪৩ ৬৩৩৭ ২৭৪ ২৭৪৩ ০৬ ৩৫
সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব            
মুলতবি প্রস্তাব ১৫ ৬৩৮ ০১ ৪৫ ০০ ২৫
মনােযােগ আকর্ষণী প্রস্তাব ২২৯ ১৫৪৬ ৫২ ২৭১ ২৭ ১৪২
সংক্ষিপ্ত আলােচনার প্রস্তাব ১৯ ১৯০ ০৫ ২৭ ০৪ ১৪

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যবাহের সারাংশ, ১৯৭৩-১৯৮১। 

সংসদের ভিতরে ও বাইরে সম্মিলিত আন্দোলনের দ্বারা তারা ১৯৮০ সালের ‘উদ্রুত এলাকা বিল’ নামে একটি দমনমূলক বিল প্রত্যাহার করতে সরকারকে বাধ্য করে।

জিয়ার এই নমনীয়তার নীতি বিরােধী দলসমূহের মধ্যে এক ধরনের অংশীদারিত্বের মনােভাব সৃষ্টি করে এবং তা সংসদের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংঘাতকে পরিসীমিত রাখে। 

খ. সংসদ বহির্ভূত রাজনীতি 

আমরা দেখেছি, ১৯৭২-৭৫ (আগস্ট) সময়কালে সরকার ও বিরােধী দলসমূহ পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। জিয়ার শাসনামলে সরকারের সঙ্গে বিরােধী দলসমূহের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়।

চরমপন্থী বাম দলসমূহ : মুজিব শাসনামলে, আত্মগােপনকারী চরমপন্থীরা এবং স্বীকৃত বামপন্থীদের একাংশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণআন্দোলনের সাথে সাথে। সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর চরম। বামপন্থীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের উৎখাত এবং পরবর্তী জিয়া সরকারের ভারতের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষার নীতিকে জাতীয় স্বাধীনতার স্বার্থে এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয় বলে মনে করে।

২০৪

পশ্চিম বাংলায় নকশালী আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং দেশে তাদের বিগত বছরগুলাের সহিংস রাজনীতির অকার্যকারিতা তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি সৃষ্টি করে যে, সশস্ত্র কার্যকলাপ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধনের জন্য যথেষ্ট নয়। বামপন্থীদের প্রতি জিয়ার তােষণ নীতি এবং আওয়ামী লীগ আমলে আটককৃত অনেক বাম নেতার মুক্তিদানও তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নমনীয় করতে সাহায্য করে। ফলে চরমপন্থী দলগুলাের অধিকাংশই সশস্ত্র সংগ্রামের নীতি পরিত্যাগ করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ গ্রহণ করে। প্রধান চীনপন্থী গােষ্ঠীর নেতা মােহম্মদ তােয়াহা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে, ১৯৭০ সাল থেকে তার দল কর্তৃক অনুসৃত ‘শ্রেণি শত্রু খতম তথা অস্ত্রের রাজনীতি ভুল ছিল। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বর্তমান অবস্থায়, গণআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার স্তর উন্নীত করে ভবিষ্যতের চূড়ান্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি করাই আশু কর্তব্য।৩৫ অন্যান্য কয়েকটি চরমপন্থী গােষ্ঠীও সশস্ত্র রাজনীতি পরিত্যাগের নীতি ঘােষণা করে।৩৬

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গী ভূমিকা পালনকারী জাসদ ও তার ‘আশু সামাজিক বিপ্লব’-এর নীতি পরিত্যাগ করে এবং বিপ্লবী গণবাহিনী ভেঙে দেয়। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃত প্রণীত এক মূল্যবান রিপাের্টে বলা হয় যে, দল কর্তৃক অতীতে অনুসৃত রাজনৈতিক কৌশল দেশে বিরাজমান বস্তুগত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।৩৭

যদিও গণবাহিনীর একটি ছােট অংশ কিছুদিন পর্যন্ত দেশের কোনাে কোনাে জায়গায় সশস্ত্র কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে, জাসদের মূল অংশটি চূড়ান্ত সামাজিক বিপ্লবের অন্তবর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনের কৌশল গ্রহণ করে।

চরমপন্থী বাম দলগুলাে কেবল সহিংস রাজনৈতিক পন্থাই পরিহার করেনি, কয়েকটি চীনপন্থী গােষ্ঠী প্রথম দিকে জিয়াকে সমর্থনও করে। তারা আওয়ামী লীগকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রু বলে মনে করে এবং তাদের উচ্ছেদ করার জন্য ডানপন্থীদের সঙ্গে জোট বদ্ধ হয়।৩৮

তারা শাসকদের সঙ্গে ঐক্য করে তাদেরকে বাম পথে নিয়ে যেতে চায় এবং সে লক্ষ্যে একটি জাতীয় সরকার গঠনের জন্য চাপ দিতে থাকে।৩৯

কিন্তু তাদের রাজনৈতিক লাইন গ্রহণে জিয়ার অস্বীকৃতির কারণে পরবর্তীকালে সরকারের সঙ্গে এই বামপন্থী গােষ্ঠীগুলাের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।৪০

১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাঁচটি চীনপন্থী বাম দল, যথা বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, (তােয়াহা) ইউ পি পি জাগমুই ন্যাপ (নূর-জাহিদ) ও গণফ্রন্ট মিলিত হয়ে ‘গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠন করে। এই জোটের ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল, ১৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে জিয়া-বিরােধী গণ-আন্দোলন গড়ে তােলা। তারা সাম্রাজ্যবাদ, ‘সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ’ ও ‘নব্য বাকশালীদের প্রতি জিয়ার নমনীয় নীতির তীব্র সমালােচনা করে।৪১

২০৫

কিন্তু তারা শক্তিশালী জিয়া-বিরােধী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ ছিল অংশত বামপন্থীদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অংশত জিয়ার পতনের পর আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের সম্ভাবনাজনিত ভীতি।

দশ দলীয় জোট : মধ্য ও নরম বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলসমূহ, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তারাই ছিল জিয়া সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিলােপ এবং জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ‘বিকৃতির জন্য জিয়ার কঠোর সমালােচনা করে এবং চতুর্থ সংশােধনী-পূর্ব ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি অব্যাহত রাখে। তারা জিয়া সরকারকে গণবিরােধী ফ্যাসিবাদী সরকার বলে বর্ণনা করে এবং গণআন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতন ঘটাতে চায়। কিন্তু একক ভাবে কোনােদলই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। আওয়ামী লীগ ছিল দেশের সর্ববৃহৎ বিরােধী দল, যার দেশব্যাপী সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল। কিন্তু উপদলীয় ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে এই দল বহুলাংশে তার কার্যকারিতা হারায়। দ্বিতীয় বৃহৎ বিরােধীদল জাসদের অবস্থাও একই রূপ ছিল।৪২

আওয়ামী লীগ ও জাসদ পৃথকভাবে কয়েকটি জনসমাবেশ, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘটের আয়ােজন করে, কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে সেগুলাের উল্লেখযােগ্য প্রভাব পড়েনি। সুতরাং ১৯৮০ সালের প্রারম্ভে ১০টি ধর্ম নিরপেক্ষ বিরােধীদল জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার লক্ষ্যে এটি জোট গঠন করে। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল : আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান), জাসদ, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (হারুন), জাতীয় একতা পার্টি, শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশ গণতন্ত্রিক আন্দোলন ও গণ আজাদী লীগ।

কিন্তু এই জোট নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক পার্থক্যের কারণে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কোনাে অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ ঘােষণা ও তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করে। কিন্তু জাসদ যেহেতু মুজিব শাসনামলে সবচেয়ে নিগৃহীত হয়, সেহেতু আওয়ামী লীগের এই দাবি মেনে নেয়নি। তাছাড়া জোটভুক্ত দলগুলাের মধ্যে ভূমি সংস্কারসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রশ্নে যথেষ্ট বিরােধ ছিল । সুতরাং তারা প্রান্তিক রাজনৈতিক প্রশ্নাবলিকে কেন্দ্র করে সরকার বিরােধী আন্দোলনে নামে।

১৯৮০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলে পুলিশের গুলিতে তিনজন কয়েদী নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়। তারা জেলে বসবাসের অবস্থাদির উন্নতি বিধানের জন্য আন্দোলন করছিল। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ১০ দলীয় জোট ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় জনসমাবেশ ও বিক্ষোভের আয়ােজন করে। তারা জেল হত্যা, বিরােধী দলের ওপর সরকারি নির্যাতন ও অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিবাদে ৯ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল পালনের ডাক দেয়। সরকার এই হরতাল প্রতিরােধ করতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে; কিন্তু ব্যর্থ হয়। হরতালের দিনে একদিকে আইন প্রয়ােগকারী বাহিনী ও বিএনপি কর্মী এবং 

২০৬

অন্য দিকে হরতাল সমর্থকদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে ঢাকায় দু’ব্যক্তি নিহত ও প্রায় ৫০০ জন আহত হয়। শত শত বিরােধী দলীয় কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির কার্যালয় ভাংচুর করা হয়।৪৩

১৯৮০ সালের ২০ অক্টোবর খুলনায় সংঘটিত জেলহত্যা এবং সরকার কর্তৃক ‘স্বাধীনতা দিবস’ কে ‘জাতীয় দিবস হিসাবে ঘােষণার প্রতিবাদে ১০ দলীয় জোট আর একটি হরতাল পালন করে। কিন্তু এই হরতাল ছিল রক্তপাতহীন। কারণ সরকার এবার হরতাল প্রতিরােধ না করার কৌশল গ্রহণ করে। হরতালের দিন আয়ােজিত ১০ দলীয় জনসভায় নেতৃবৃন্দ জিয়ার “স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের হুমকি দেন।৪৪

কিন্তু জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলাের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মতভেদের কারণে তা কোনােদিনই সফল হয়নি।

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য একটি সম্মত কর্মসূচির অবর্তমানে, এককভাবে আওয়ামী লীগ ১২ – দফা দাবির ভিত্তিতে ১৯৮০ সালের ৩ নভেম্বর সাধারণ হরতাল পালনের ডাক দেয়।৪৫ এই ১২-দফা দাবির মধ্যে ছিল :

১. ২৬ মার্চকে ‘স্বাধনিতা দিবস’ হিসাবে পুনরায় ঘােষণা করা; 

২. শেখ মুজিব এবং কারাগারে নিহত চার আওয়ামী লীগ নেতার হত্যাকারীদের বিচার অনুষ্ঠান; 

৩. সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিদান; 

৪. জিয়া সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি বন্ধ করা; 

৫. গ্রাম সমবায়ের ভিত্তিতে ভূমি সংস্কার। 

৬. একটি সার্বভৌম” সংসদ নির্বাচন।

সরকার হরতাল বানচাল করার জন্য সকল প্রকার সন্ত্রাস ও ভীতি প্রদর্শনের কৌশল অবলম্বন করে। হরতালের দিন কমপক্ষে চারজন নিহত ও শত শত ব্যক্তি আহত হয়।৪৭

১০ দলীয় জোটের অঙ্গদলগুলাে আওয়ামী লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। আওয়ামী লীগও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পারেনি।

ইসলামী দলসমূহ : পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জিয়া ইসলামী দলসমূহকে (যাদেরকে আওয়ামী লীগ সরকার নিষিদ্ধ করে) পুনরুজ্জীবনের অনুমতি দেন। এই দলগুলাে ১৯৭৭ সালের গণভােটে ও ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াকে মূলত তার সংবিধানে ইসলামী সংশােধনীর জন্য সমর্থন করে। কিন্তু তারা কেবল এই সংশােধনী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। দলগুলাে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘােষণা ও দেশে ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি করতে থাকে। যেহেতু জিয়া মৌলবাদী পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে রাজি ছিলেন না, সেহেতু ইসলামী দলগুলাে জিয়ার বিরুদ্ধে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযােগ উত্থাপন করে। মুসলিম লীগের সহসভাপতি কাজী আব্দুল কাদের বলেন :

২০৭

জিয়া বহুরূপী, কখনাে কম্যুনিস্ট, কখনাে মুসলমান। তিনি প্রয়ােজনবােধে যে কোনাে ব্যক্তিকে গ্রহণ করেন এবং প্রয়ােজন শেষ হলে তাকে পরিত্যাগ করেন।৪৮

অনুরূপভাবে, ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ ইসলামের নামে জনগণকে ধােকা দিয়েছেন বলে জিয়ার নিন্দা করে। এই দলের মাওলানা আব্দুর রহিম বলেন,

যদিও জিয়া সংবিধানে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ যােগ করেছেন, তাঁর কার্যকলাপ থেকে মনে হয় না যে, আল্লাহর প্রতি তাঁর বিশ্বাস আছে। তিনি দেশে ইসলামী আইন প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।৪৯

একই সুরে আক্রমণ করে জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা আব্বাস আলী বলেন;

মুজিব যেমন সমাজতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন, জিয়া তেমনি ইসলামের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে সব কিছুই করছেন।৫০

ইসলামী দলগুলাে রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে ইসলামীকরণের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং নারী-পুরুষের এক সঙ্গে কাজ করা, সহশিক্ষা, নৃত্য, নাটক ইত্যাদি ‘ইসলাম বিরােধী কার্যকলাপ বন্ধের দাবি জানায়। তবে প্রত্যক্ষভাবে জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলার তেমন চেষ্টা তারা করেনি।

গ. মুক্তিযােদ্ধা বনাম অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্ব

জিয়া সরকারের স্থিতিশীলতার প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি। ইসলামী দলসমূহ যদিও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী গােষ্ঠীসমূহ তাদের আনুগত্য সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করে এবং তাদেরকে ‘রাজাকার-আলবদর’ বলে ধিক্কার দিতে থাকে। ১৯৭৬ সালে তাদের পুনরুজ্জীবনের পর বছর খানেক ইসলামী দলগুলাে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসমূহরে নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের পরেই দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়।৫১ তারপর থেকে তারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে এবং ফলে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়।

প্রথম দফা সংঘাত ঘটে ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে। ইসলামী দলগুলাে। মানবমূর্তি সম্পর্কিত ভাস্কর্যকে পৌত্তলিকতা তথা অনৈসমালিক বলে মনে করে। সুতরং তারা উন্মুক্ত স্থানসমূহ থেকে সকল মানবমূর্তি সরিয়ে নেবার দাবি জানায়। মুসলিম লীগ ও জামায়াত নেতৃবৃন্দ যখন এ দাবির পক্ষে বিবৃতি প্রদান করতে থাকেন তখন ২০ আগস্ট রাতের আঁধারে কাফ্ট চলাকালীন সময়ে ঢাকার কেন্দ্রস্থল (বায়তুল মােকাররম মসজিদ ও সচিবালয়ের মধ্যবর্তী চৌরাস্তা) থেকে ক্রীড়াবিদের জ্যাভেলিন নিক্ষেপ) এক মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। সরকার এই কাজের দায় দায়িত্ব স্বীকার করেনি, আবার এর নিন্দাও করেনি। ফলে অনেকে

২০৮

মনে করেন যে, সরকারের প্রভাবশালী মহলের জ্ঞাতে এবং দেশের ভিতর ও বাইরের ইসলামী শক্তিসমূহকে সন্তুষ্ট করার মানসে মূর্তিটি অপসারণ করা হয়।

এই প্রাথমিক সাফল্য ইসলামী দলগুলােকে উৎসাহিত করে এবং তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত এক স্মারক ভাস্কর্য অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে ১৯৭৭ সালের ২৮ আগস্ট ইসলামী ছাত্র শিবির ও ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র গােষ্ঠীসমূহের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে।৫২  

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক গােষ্ঠী ইসলামী দলগুলাের এই কার্যকলাপকে বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, তথা মুক্তিযুদ্ধের অবমনাননা বলে নিন্দা করে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে নীরব থাকে।  

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ও বিপক্ষের শক্তিসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় দফা সংঘাত শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। জিয়া তাঁর সরকার ও দলে এমন কতিপয় ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেন যাঁদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী কার্যকলাপের ব্যাপক অভিযােগ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিসমূহ এটা পছন্দ করেনি। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, এবং তারা প্রথম পর্যায়ে জিয়া সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেন। কিন্তু তারা জিয়ার ইসলামী গােষ্ঠীগুলােকে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের নীতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাই মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন :

মুক্তিযােদ্ধারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াকে তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচির জন্য সমর্থন দান করে। কিন্তু সেখানে রাজাকার আলবদরদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা ছিল না। তারা (রাজাকার-আলবদর) তাদের মন্ত্রিত্ব সত্ত্বেও নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে না। তারা রাষ্ট্রপতি জিয়াকে এক ষড়যন্ত্রে আবদ্ধ করছে, এবং তাঁকে (জিয়াকে) এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করতে হবে।৫৩

তিনি সতর্ক করে দেন যে, মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অস্ত্র জমা দিয়েছেন, কিন্তু ট্রেনিং জমা দেননি। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ইসলামী দলগুলােও অনুরূপ আক্রমণাত্মক মক্তব্য প্রদান করেন। তাদের একজন নেতা (হাসান আলি) বলেন; 

মুক্তিযােদ্ধাদেরও ভুললে চলবে না যে, আমরাও ১৯৭১ সালে অস্ত্র ধারণ করেছিলাম। পরে আমরা অস্ত্র জমা দিয়েছি কিন্তু ট্রেনিং জমা দেইনি।৫৪ 

১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও ইসলামি ডেমােক্রেটিক লীগ জোট ২০টি আসন ও ১০% ভােট লাভ করে। এই ফল ইসলামী গােষ্ঠীগুলােকে আরাে উৎসাহিত করে। সাতটি ইসলামী দল কর্তৃক আফগানিস্তানে সােভিয়েত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে আয়ােজিত ঢাকায় এক জনসভায় নেতৃবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে জেহাদ’ ঘােষণা করেন এবং হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে,

২০৯

ইসলামবিরােধীদের উৎখাত করার জন্য মসজিদে মসজিদে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তােলা হবে।৫৫ 

এ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধা-অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্ব বাক যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ১৯৮১ সালের প্রারম্ভে জামায়াত-ই-ইসলামী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করলে এই দ্বন্দ্ব সহিংস সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়।

ইসলামী দলগুলাের মধ্যে জামায়াত-ই-ইসলামী ছিল সবচেয়ে সংগঠিত ও মৌলবাদী সংগঠন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের নেতা ছিলেন গােলাম আজম। এই দল মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করে। এর সশস্ত্র অঙ্গসমূহ (আলবদর ও আলসামস) মুক্তিযুদ্ধকালে প্রগতিবাদী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে গােলাম আযম বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে দীর্ঘদু’বছর কাল বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করেন। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধবিরােধী কার্যকলাপের অভিযােগে গােলাম আযমসহ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও আমলার নাগরিকত্ব বাতিল করেন। জিয়া সরকার ১৯৭৬ থেকে শুরু করে কয়েক ব্যক্তির নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করেন।৫৬

গােলাম আযম তার নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেন, কিন্তু সরকার তা মঞ্জুর করেনি। ১৯৭৮ সালে গােলাম আযম তার অসুস্থ মাকে দেখার অজুহাতে পাকিস্তানি পাসপাের্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। দেশে গােলাম আযম-বিরােধী সাধারণ অনুভূতির কারণে সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব দেয়নি; আবার দেশের ভিতরের ও বাইরের ইসলামী শক্তিসমূহের চাপে তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কারও করেনি। গােলাম আযম বাংলাদেশে থেকে যান এবং কার্যত জামায়াতের নেতা হিসাবে গােপনে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকেন। ১৯৮০ সালের মধ্যে জামায়াত নেতারা তাদের দলকে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলেন এবং সুশৃংখল কর্মী বাহিনী তৈরি করে ইসলামী বিপ্লব সাধনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। জামায়াত কর্মীদের গােপনে অস্ত্র সজ্জিত করা হয় বলেও খবর প্রকাশিত হয়।৫৭ 

জামায়াত-ই-ইসলামী গােলাম আযমকে বাংলাদেশের ইসলামী জনগােষ্ঠীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে ঘােষণা করে এবং তার নাগরিকত্ব পুনর্বহালের প্রশ্নকে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। এই দল গােলাম আজমের নাগরিকতার পক্ষে প্রচারণা চালানাের উদ্দেশে দেশব্যাপী ‘সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। ‘অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশে প্রতিরােধ কমিটিও গঠন করা হয়। দলের কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন আদায়ের জন্য জামায়াত ছােট খাটো ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িত প্রশ্নকে বেছে নেয়।

সিলেট সমাচার নামক সাপ্তাহিকীতে প্রকাশিত (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১) এক কথিত ইসলামবিরােধী প্রবন্ধের প্রতিবাদে জামায়াত ১৯৮১ সালের ৩ মার্চ সিলেটে বিক্ষোভ ও হরতালের আয়ােজন করে, যার ফলে দু’ব্যক্তি নিহত হয়। রংপুরের এক মসজিদে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের দ্বারা পবিত্র কোরান পােড়ানাের প্রতিবাদে 

২১০

জামায়াত ও তার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির রংপুরেও বিক্ষোভ ও হরতাল পালন করে। সরকার ও আধাব সরকারি সংস্থা কর্তৃক আয়ােজিত শিল্প প্রদর্শনীসূমহে নাচ, গান, থিয়েটার, সার্কাস, জুয়া, ইত্যাদির প্রতিবাদে জামায়াত দেশের বিভিন্ন স্থানে (নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কক্সবাজার) হামলা চালায়।

জামায়াত-ই-ইসলামীর এই সব আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের প্রতিরােধে মুক্তিযােদ্ধারাও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের’ কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারা গােলাম আযম ও অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের বিচার দাবি করেন এবং হুশিয়ারি উচ্চারণ করে যে, সরকার যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয় তবে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলই ‘গণ আদালতে তাদের বিচার করবে।৫৮

মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ঘােষণা করেন :

গােলাম আযম বাংলাদেশবিরােধী শক্তিসমূহের প্রতীক। তিনি আমাদের দেশে পাকিস্তানবাদ প্রবর্তনের চেষ্টা করেছেন। তাকে নাগরিকতা প্রদানের অর্থ হচ্ছে। পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতি পরােক্ষ স্বীকৃতি। কোনাে দেশপ্রেমিক নাগরিকই তা সহ্য করবে না।৫৯

জামায়াতকে স্বাধীনতার শত্রু আখ্যা দিয়ে তিনি আরাে বলেন, আমরা সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে তাদেরকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তাদের সাহায্যে করবে সেই আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।৬০

মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের রাজনৈতিক অধিকার বাজেয়াপ্ত করারও দাবি জানায় এবং ঘােষণা করে যে, জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ভবিষ্যতে কোনাে জনসভা অনুষ্ঠান করতে দেয়া হবে না।৬১

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলসমূহ (যেমন আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ) এবং তাদের ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলাে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের প্রতি সমর্থন জানায় এবং রাজাকার-আলবদরদের উৎখাতের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। কিছু সংখ্যক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীও জামায়াতের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাবিরােধীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য লেখক ও শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান।৬২

অপরদিকে, ডানপন্থী ইসলামী দলগুলাে (মুসলিম লীগ, জাতীয় লীগ) জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। এভাবে জাতি দু’টি পরস্পরবিরােধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জামায়াত-ই-ইসলামী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহের মিছিল ও জনসভায় আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। ১৯৮১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মে সাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৫০ দিনে অন্তত ৫০টি শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের আহ্বানে জামায়াতবিরােধী হরতাল পালিত হয়। জামায়াত কর্তৃক আহুত অধিকাংশ জনসভাই তছনছ করে দেয়া হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দারুণ উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়।

২১১

জিয়া তাঁর ভারসাম্যের রাজনীতির অনুসরণে মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরােধীদের দ্বন্দ্বে তাঁর সরকারকে প্রথমে জড়াতে চাননি। কিন্তু দ্রুত অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা হ্রাসের প্রেক্ষিতে, জিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের বিরােধিতাকারীদের সমালােচনা করতে শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন : 

কিছু সংখ্যক লােক বিদেশের ইঙ্গিতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করতে চাচ্ছে। আমি তাদের চিনি। তারা আমাদের স্বাধীন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, বরং বিরােধিতা করেছে।…আমাদের জনগণ তাদের ধ্বংস করে দেবে।…প্রয়ােজন হলে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তারা অস্ত্র ধারণ করবে। এবং এইবার বিএনপি জনগণকে নেতৃত্ব দিবে।৬৩

কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সরকার মুক্তিযােদ্ধা-অমুক্তিযােদ্ধা প্রশ্নে সুস্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় এবং গােলাম আযমের নাগরিকতা প্রশ্ন। অমীমাংসিত থেকে যায়। ইতিমধ্যে কমান্ড কাউন্সিল এক ৭ দফা দাবিনামা ঘােষণা করে ও সেগুলাে বাস্তবায়নে বাধ্য করার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ১৬ মে তারিখে হরতাল পালনের ডাক দেয়। এ দাবিগুলাে ছিল :

১. জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণ; 

২. প্রশাসনের ভিতর ও বাইরে স্বাধীনতার শত্রুদের বিচার ও শাস্তি প্রদান; 

৩. মুক্তিযােদ্ধা ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহার; 

৪. পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর ও পাকিস্তানে অর্থ পাচারের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান; 

৫. প্রশাসনের মধ্যেকার দুর্নীতিবাজদের শাস্তিবিধান; 

৬. সরকারের বর্তমান ভুল অর্থনৈতিক নীতি’সংশােধন; এবং 

৭. জাতীয় স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।৬৪

মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে বিক্ষুব্ধ হন এবং দেশকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেরাই জামায়াত-ই-ইসলামী ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘােষণা করেন।৬৫

তারা জিয়া সরকারকে রাজাকারদের সরকার বলে নিন্দা করেন এবং সরকার ভেঙে দেয়ার দাবি জানান।৬৬

মুক্তিযােদ্ধাদের শান্ত করার জন্য জিয়া ১৯৮১ সালের ১ মে সংস্থাপন মন্ত্রির নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। কমিটির দায়িত্ব ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের দাবিসমূহ পরীক্ষা ও সে সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করা। এই পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ইতঃপূর্বে আহূত সাধারণ হরতালের তারিখ ১৬মে থেকে ১৯ জুন পুনঃনির্ধারণ করে। কিন্তু বিক্ষোভ, মিছিল ও সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতির এত ভয়াবহ অবনতি ঘটছিল যে, জিয়াকে প্রকাশ্যে গৃহযুদ্ধ হবে না বলে আশ্বাস দিতে হয়।৬৭ 

২১২

জিয়া সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে দেশকে রক্ষা করতে সমর্থ হন, কিন্তু ৩০ তারিখে। একদল বিদ্রোহী সেনার আক্রমণ থেকে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারেননি। মুক্তিযােদ্ধা বনাম অমুক্তিযােদ্ধা দ্বন্দ্বের সঙ্গে জিয়া হত্যার সম্পর্ক পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হবে।

৩. সরকারের কৃতি 

রাষ্ট্রপতি জিয়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু তাঁর এই নীতি সকল মহলকে খুশি করতে পারেনি। বরং তা বিভিন্ন স্বার্থগােষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার বিরােধ আরাে বৃদ্ধি করে এবং সরকারের কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযােগ্যতা হ্রাস করে।

ক. দল গঠন

জিয়া তাঁর ‘বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে, জাগদল ও ন্যাপ (ভাসানী) এবং মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি, ইউ পি পি ও তফশীল জাতি ফেডারেশন এর দলছুট অংশ নিয়ে বিএনপি গঠিত হয়। পরে অন্যান্য দল থেকে ছােট-খাটো গােষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গ বিএনপিতে যােগদান করে। 

বিএনপি অভিন্ন রাজনৈতিক মূল্যবােধ বা কর্মসূচির ভিত্তিতে নিম্নস্তর থেকে গড়ে ওঠেনি বরং একটি সামরিক সরকারের সমর্থনভিত্তি হিসাবে ওপরতলা থেকে সংগঠিত হয়। ১৯৭৭ সালের গণভােটের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্তৃক ঘােষিত ১৯ দফা কর্মসূচিটি বিএনপি গ্রহণ করে। বাংলাদেশি জাতীয়তবাদ, জনগণের গণতন্ত্র, জাতীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি’, ‘সামাজিক সুবিচার’, প্রভৃতি সাধারণ ও অস্পষ্ট ভাষায় দলের লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যাবলি বর্ণিতহয়, কিন্তু লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি কিংবা নীতির প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় নি।৬৮

ফলে পরস্পরবিরােধী স্বার্থ ও বিশ্বাসের ব্যক্তিগণ এই দলে যােগদান করে, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল জিয়াকে সমর্থনের বিনিময়ে সরকারি ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপােষকতা ভােগ করা। মুসলিম লীগ ও ন্যাপ (ভাসানী) বিএনপি দলে যােগদানের সময় জিয়া এবং তার শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে, কিন্তু তারা দাবি জানায় যে, নতুন দল ও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তাদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে।৬৯

এভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক গােষ্ঠী নতুন দলের মধ্যে তাদের পূর্বর্তন গােষ্ঠীচেতনা বজায় রাখে, যা বিএনপিকে উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত করে।

বিএনপি সংসদীয় দলের গঠন থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, দলের প্রায় ৫৩% সদস্য পূর্বে কোনাে না কোনাে দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, প্রায় ৬% ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ৪০% ছিলেন রাজনীতিতে নবাগত। রাজনীতির সঙ্গে পূর্বে জড়িত ৫৩ শতাংশের মধ্যে ১৬% আসে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ থেকে, ১৫% ন্যাপ (ভাসানী) থেকে, ৯% আওয়ামী লীগ থেকে, ৩% ইউ পি পি থেকে এবং অবশিষ্টরা

২১৩

আসে অন্যান্য কয়েকটি দল থেকে (দেখুন সারণি ৮.৩)। নবাগতরা বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্তর থেকে আসেন এবং তাঁদের কোনাে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল না; ব্যক্তিগত কিংবা সংকীর্ণ গােষ্ঠীগত স্বার্থই তাদের প্রধান বিবেচ্য ছিল। কিন্তু দলের পুরানাে রাজনীতিকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক ও আদর্শিক পার্থক্য ছিল, যার ফলে বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্নে সঙ্গতিপূর্ণ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি।

বিএনপি একটি স্বশাসিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাও লাভ করতে পারেনি। কারণ, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশের জন্য যেরূপ স্বাধীনতা ও ক্ষমতার প্রয়ােজন জিয়া দলের হাতে সেরূপ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামাে এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এটা জিয়ার ইচ্ছানুসারী একটা যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। জিয়া দলের চেয়ারম্যান হিসাবে সকল ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ সকল কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের নিয়ােগ করতেন। দলের প্রধান কেন্দ্রীয় সংস্থাসমূহ (জাতীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টারী বাের্ড) নির্বাচিত না হয়ে চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হতাে। তত্ত্বগতভাবে সর্বোচ্চ সংস্থা জাতীয় কাউন্সিল অংশত নির্বাচিত, অংশত পদাধিকার ভিত্তিক ও অংশত চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত ছিল। কিন্তু এর দায়িত্ব ছিল স্ট্যান্ডিং কমিটি কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়িত করা।৭০

দলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে জিয়া সকল কমিটির ওপর কর্তৃত্ব’ প্রয়ােগ করতেন এবং যে-কোনাে কমিটি ভেঙে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজে কোনাে দলীয় সংস্থার নিকট দায়ী ছিলেন না। চেয়ারম্যানকে একটি নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে অপসারণ করা যেতাে, কিন্তু এই নির্বাচকমণ্ডলীর গঠনপদ্ধতি ছিল অনেকটা অস্পষ্ট এবং কেবল চেয়ারম্যানের সম্মতি ক্রমেই তারা অধিবেশনে বসতে পারত।৭১

বিএনপি সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক পটভূমি (মার্চ, ১৯৮১)

পূর্বতন রাজনৈতিক সম্পর্ক সদস্য সংখ্যা শতাংশ (প্রায়)
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪০ ১৬
ন্যাপ (ভাসানী) ৩৭ ১৫
আওয়ামী লীগ ২২
ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউ.পি.পি)
ডেমােক্রেটিক লীগ
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)
ন্যাপ (মােজাফফর)
অন্যান্য দল১ ১৫
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন২ ১৫
অরাজনৈতিক ব্যক্তি৩ ১০০ ৪০
অজানা
মােট ২৫০ ১০০

১. অন্যান্য দলের মধ্যে ছিল জাতীয় লীগ, ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি ও কৃষক-শ্রমিক পার্টি। 

২. ছাত্র সংগঠনগুলাের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ ও জাসদ-সমর্থিত দুই ছাত্র লীগ এবং বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়ন। 

৩. অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলিম লীগের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন। 

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্ত, ঢাকা, ১৯৮১; মােস্তফা হারুন (সম্পাদক) Who’s who in the Parliament (ঢাকা, সৌখিন প্রকাশনী), ১৯৭৯।

এভাবে সরকার ও বিএনপির প্রধান হিসাবে প্রশাসন ও দলের যেকোনাে ব্যক্তিকে মনােনয়ন দান ও অপসারণ করার সাংবিধানিক ক্ষমতা জিয়ার হাতে ন্যস্ত ছিল, এবং স্বভাবতই তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দলের ভূমিকা ছিল গৌণ।৭২

বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্রের অবর্তমানে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের প্রাতিষ্ঠানিক সুযােগের অভাব দলীয় সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি সংসদ-সদস্যগণ দলের অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং দলের মধ্যে তাদের পর্যাপ্ত ভূমিকা ও অধিকারের অভাব সম্পর্কে প্রকাশ্যে অভিযােগ উত্থাপন করতে শুরু করেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বিএনপি পার্লামেন্টারী পার্টির এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকতর অংশগ্রহণ ও দলের গণতন্ত্রায়নের দাবি সম্বলিত কতিপয় প্রস্তাবও আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।৭৩

রাষ্ট্রপতি জিয়া দলের মধ্যে অসন্তোষ দূর করার জন্য একাধারে দমন ও তােষণ নীতি অনুসরণ করেন। বিএনপি ‘বিদ্রোহী’ গ্রুপের নেতা বলে চিহ্নিত উপ-প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদকে ১৯৮০ সালের ২ জানুয়ারি তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। মওদুদ আহমদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী নূর মােহাম্মদ খানকেও পরের দিন বিদায় নিতে হয়। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে জিয়া তার মন্ত্রীপরিষদ দু’বার পুনর্গঠন করে অবাধ্যদের শাস্তি প্রদান ও নির্ভরযােগ্যদের পুরস্কৃত করেন। তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ একটি থেকে তিনটিতে বৃদ্ধি করেন।

অসন্তুষ্টদের খুশি করার উদ্দেশে মন্ত্রীপদ ছাড়াও কিছু নতুন সুযােগ সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। বিদেশে চারি এবং সরকারি পণ্য বিক্রেতা (ডিলার) ও বণ্টনকারী নিয়ােগের জন্য সংসদ-সদস্যদেরকে নাম সুপারিশের ক্ষমতা দেয়া হয়। বিশজন বিএনপি সংসদ সদস্যকে ২০টি জেলায় জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়ােগ করে তাদেরকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযােগ সুবিধা প্রদান করা হয়। সমন্বয়কারীদের দায়িত্ব ছিল উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে সাহায্য করা এবং জনগণের অভিযােগ শ্রবণ ও তার প্রতিবিধান। করা। ত্রিশজন বিএনপি সংসদ-সদস্য ও ২৩ জন দলীয় নেতা সমবায়ে একটি ৫৩ সদস্যের দূত পুল’ গঠন করা হয়। দূত পুলের সদস্যগণ বিদেশি অর্থ সাহায্য ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি উপলক্ষে বিদেশ সফর করতেন, এবং এই দায়িত্ব পালনকালে তাঁরা কুটনৈতিক প্রতিনিধিদেরকে দেয়া সুযােগ-সুবিধা ভােগ করতেন।৭৪

২১৫

কিছু সংখ্যক বিএনপি সদস্যকে জাতীয়করণকৃত ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসেবে নিয়ােগ করা হয়, কিন্তু তাদেরকে সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এভাবে জিয়া অসন্তুষ্ট দলীয় নেতাদের খুশি করার জন্য প্রশাসনিক নির্দেশে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা ও প্রতীকী মর্যাদাদানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এগুলাের জন্য কোনাে স্থায়ী ভিত্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে গড়ে তােলা হয়নি।

জিয়া সকল প্রকার ব্যক্তির জন্য তার দলের দরজা উন্মুক্ত রাখেন। এমন কি, তিনি যে সব দলকে (আওয়ামী লীগ, জাসদ) দুর্নীতিগ্রস্ত বা জাতীয় স্বার্থবিরােধী বলে প্রকাশ্যে সমালােচনা করতেন সেই দল থেকে আগত ব্যক্তিদেরকে ঘটা করে নিজ দলে গ্রহণ করতেন এবং দলের পুরানাে সদস্যদের ডিঙ্গিয়ে নবাগতদের দল ও প্রশাসনের উচ্চাসনে আসীন করতেন। এর ফলে বিএনপির মধ্যে অসন্তোষ ও উপদলীয় কোন্দল আরাে বৃদ্ধি পায় এবং এ বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে, জিয়া রাজনৈতিক উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে বিরােধী দলসমূহের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভাঙন সৃষ্টি করছেন।৭৫

এভাবে জিয়া সাংগঠনিক ঐক্য ও আদর্শিক সংহতির বিনিময়ে দলের কলেবর বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং সুযােগ-সুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেন। ফলে দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল ও দুর্নীতির প্রসার ঘটে। বিএনপি সংসদ সদস্যগণ প্রকাশ্যে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতির অভিযােগ উত্থাপন করেন। সংসদ সদস্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে সরকার কতিপয় মন্ত্রির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ অনুসন্ধানের জন্য একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়।৭৬

খ. স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ 

নিজের রাজনৈতিক সমর্থন-ভিত্তি সম্প্রসারণের প্রচেষ্টায় জিয়া কতকগুলাে গ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এগুলাে ছিল গ্রাম সরকার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ও যুব কমপ্লেক্স। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলাে নতুন দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র তৈরি করে।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি নাগাদ প্রায় প্রতিটি গ্রামে একটি করে গ্রাম সরকার গঠন করা হয়। গ্রাম সরকার একজন গ্রাম প্রধান ও অন্য ১০ জন সদস্য সমবায়ে গঠিত হয়। গ্রাম প্রধান ও সদস্যগণ গ্রাম সভায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে মনােনীত হতেন। গ্রাম সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি না থাকায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপসমূহের মধ্যে অসংখ্য সংঘর্ষ ঘটতে থাকে এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সার্কেল অফিসারগণই অনেক ক্ষেত্রে সম্মত প্রার্থী নির্ধারণ করতেন।৭৭

গ্রাম সরকারের ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য গ্রামের সকল সম্পদের সমাবেশ এবং গ্রাম এলাকায় আইন-শৃংখলা রক্ষা করা। প্রধানত শান্তি-শৃংখলা রক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজে সাহায্য করার জন্য প্রতি গ্রামে ১৫০ থেকে ১৬০ সদস্যের গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করা হয়। যাহােক, গ্রাম সরকারগুলােকে সুনির্দিষ্ট আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়া হয়নি, এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে তাদের 

২১৬

সম্পর্কও সুস্পষ্ট ছিল না। যেহেতু ইউনিয়ন পরিষদ ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শান্তি-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে আসছিল, সেহেতু এর সদস্যরা গ্রাম সরকারের প্রবর্তনকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি।৭৮

১৯৮০ সালে নবসৃষ্ট যুব মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছােট শহর ও গ্রামঞ্চলে যুব কমপ্লেক্স গঠন করা হয়। যুব কমপ্লেক্সের ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল বেকার যুবকদের কর্মের সুযােগ সৃষ্টি করা। এই প্রতিষ্ঠানগুলােকে কিছু কমিশনের বিনিময়ে গ্রামীণ হাটবাজার ও ফেরিঘাটের টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর ফলে নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিল ও যুব কমপ্লেক্সগুলাের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কারণ, এই হাট-বাজার ও ফেরীঘাটগুলাের ব্যবস্থাপনা নির্বাচিত কাউন্সিলগুলাের ওপর ন্যস্ত ছিল। যুব কমপ্লেক্সগুলাে বহুলাংশে বিএনপির যুব সংগঠন জাতীয়তাবাদী যুব দলের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এগুলাের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সমর্থনের বিনিময়ে যুবশক্তিকে কিছু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা। সুতরাং সন্দেহভাজন চরিত্রের অনেক যুবক এই সব যুব কমপ্লেক্সে যােগদান করে, এবং তারা অচিরেই অর্থ আত্মসাৎ ও আত্মকলহের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করে।৭৯ যুব কমপ্লেক্সের অনেক নেতা রাজনৈতিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে বলে অভিযােগ উত্থাপিত হয়।৮০

গ. আমলাতন্ত্র 

আওয়ামী লীগ শাসনামলে আমলাবর্গ বাংলাদেশ সমাজের সর্বাপেক্ষা অসন্তুষ্ট গােষ্ঠীগুলাের অন্যতম ছিল। সুতরাং নতুন সামরিক সরকার আমলাবর্গের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন লাভ করে এবং তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রথমত ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৯ নম্বর আদেশ (যাতে কোনােরূপ কারণ প্রদর্শন না করেই যেকোনাে বেসামরিক কর্মচারিকে বরখাস্তের বিধান ছিল) রহিত করা হয়, এবং ঐ আদেশের অধীনে বরখাস্তকৃত অনেক কর্মচারিকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।৮১

দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠান ও পাবলিক কর্পোরেশনে নিয়ােগকৃত রাজনৈতিক কর্মী বা অপেশাদারদের সরিয়ে। পেশাদার আমলা নিয়ােগ করা হয়। তৃতীয়ত জেলা প্রশাসন পুনর্গঠন ও জেলা গভর্নর নিয়ােগের পরিকল্পনা বাতিল করে জেলা ও মহকুমা প্রশাসনে আমলাদের সনাতনী কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা হয়। এভাবে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের হস্তগত ছিল।৮২

‘বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরেও বাংলাদেশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাদের প্রাধান্য বহাল থাকে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর জিয়া কর্তৃক মনােনীত ৪২ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীপরিষদে ২১ জন ছিলেন বিশেষজ্ঞ আমলা (যাদের ছ’জন সামরিক ও দু’জন বেসামরিক চাকরি থেকে আসেন) ও বাকি ২১ জন। রাজনীতিক। কিন্তু জিয়ার শীর্ষস্থানীয় উপদেষ্টারা প্রায় সবাই ছিলেন প্রাক্তন সামরিক বা বেসামরিক আমলা। রাজনীতিকদের কখনাে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

২১৭

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময়ই জেনারেল জিয়ার হাতে ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রথমে কিছুদিন ছিল প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. এম এন হুদার হাতে এবং পরে একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট সাইফুর রহমানের হাতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল এ এস এম মােস্তাফিজুর রহমানের হাতে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একজন প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর শামস-উল-হকের হাতে, কৃষি মন্ত্রণালয় একজন ইঞ্জিনিয়ার ড. ফসিউদ্দিন মাহতাবের হাতে, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ছিল একজন অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাজেদুল হকের হাতে, শিল্প মন্ত্রণালয় ছিল চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট জামাল উদ্দিন আহমদের হাতে, খাদ্য মন্ত্রণালয় ছিল অবসরপ্রাপ্ত আমলা আব্দুল মমিন খানের হাতে এবং তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী শামসুল হুদা চৌধুরীর হাতে। দু’জন প্রাক্তন সামরিক অফিসার যারা বিএনপিতে যােগদানের পূর্বে অপর একটি দলের (ইউ পি পি) সাথে জড়িত ছিলেন তাদেরকে স্থানীয় সরকার ও পেট্রোলিয়ামের মতাে কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর দেয়া হয়। উপযুক্ত মন্ত্রীদের মধ্যে চারজন এমনকি বিএনপি দল কিংবা সংসদের সদস্য ছিলেন না। আরাে উল্লেখ্য যে, স্টাফ কলেজে আমলাদের অধীনে মন্ত্রীদের প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতাে।৮৩

যাহােক, বেসামরিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক এলিটগণ আমলাদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন এবং প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু আমলাবর্গ নিজেদের একচেটিয়া ক্ষমতা পরিত্যাগ করে রাজনীতিকদের প্রাধান্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। উপ-প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ তাই অভিযােগের সুরে বলেন :

প্রশাসনের এক বড় অংশ মনে করে যে, রাজনীতিকদের ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং তারা সরকারের আদেশ অমান্য করছে। বর্তমান মুহূর্তে আমলাদের একাংশ চিন্তা করছে যে, এই সরকারের পতন ঘটলে সম্পূর্ণ ক্ষমতা তাদের হাতে ফিরে যাবে।৮৪

বিএনপির ছাত্র সংগঠন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, প্রতিবাদ করে যে, সরকার দলীয় কর্মীদেরকে আমলাদের অধীনস্ত করার চেষ্টা করছে।৮৫

বিএনপি সংসদীয় দলের সভায়ও আমলাদের আচরণ সম্পর্কে উত্তপ্ত আলােচনা হয় এবং কিছু সংখ্যক সদস্য জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আমলাসুলভ ব্যবহারের জন্য তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।৮৬

রাষ্ট্রপতি জিয়া অসন্তুষ্ট রাজনীতিকদের খুশি করার চেষ্টায় তদের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী, দূত অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসাবে নিয়ােগদান করেন। কিন্তু আমলাদের নিকট এই সব নিয়ােগ তাঁদের সনাতনী প্রশাসনিক অধিক্ষেত্রে অন্যায় হস্তক্ষেপ বলে প্রতিভাত হয়। এভাবে মর্যাদা সচেতন রাজনীতিক ও শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের মধ্যে সংঘাত আরাে তীব্র ও প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে।৮৭

আমলারা রাজনীতিকদের অবজ্ঞা প্রদর্শন ও অবমাননা করতে থাকেন। একজন সরকার দলীয় সংসদ-সদস্য জনৈক পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেন :

২১৮

এ ব্যাপারে যে কোনাে ব্যক্তির নিকট, এমন কি রাষ্ট্রপতির নিকট, যেতে পারেন।… আপনি সংসদে যাচ্ছেন না কেন? আমি দেখতে চাই আপনি আমার বিরুদ্ধে কী করতে পারেন। এই সেদিন নির্বাচিত হয়ে আজ আমাদেরকে কর্তব্য শেখাতে এসেছেন!৮৮

উপযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার আচরণ নিয়ে সংসদে তুমুল হৈ চৈ হয়, কিন্তু তাতে করে আমলাদের প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হয় বলে ধরা যায় না।

রাষ্ট্রপতি জিয়া রাজনৈতিক এলিটদের আমলাতন্ত্রের ওপর প্রাধান্য চাপ অগ্রাহ্য করতে সমর্থ হন, কিন্তু সামরিক এলিটদের অনুরূপ প্রধান প্রতিষ্ঠার চাপ উপেক্ষা করার সামর্থ্য বা ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তিনি সচিবালয়, কুটনৈতিক মিশন, পুলিশ বিভাগ, পাবলিক কর্পোরেশন, ইত্যাদি বেসামরিক সংস্থায় ক্রমান্বয়ে সামরিক কর্মকর্তাদেরকে নিয়ােগের নীতি অনুসরণ করেন। সরকারি হিসাব মতে, ১৯৮০ সালের প্রারম্ভে বেসামরিক বিভাগমূহে কমপক্ষে ৪১ জন সামরিক কর্মকর্তা নিয়ােজিত ছিলেন। সেই বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭৯। ১৯৮০ সালের জুন মাসে প্রায় ১৬ জন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, যারা অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও পাবলিক কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের মতাে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে ২০টি জেলার মধ্যে ১৪টি জেলাতেই পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন সামরিক ব্যক্তি।৮৯

বেসামরিক প্রশাসনকে সামরিকীকরণের এই নীতি প্রশাসনিক সােপানে বেসামরিক কর্মচারীদের পদমর্যাদা তথা পদোন্নতির প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয় এবং তা বিশেষ করে উচ্চ স্তরের বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেতন, স্তরবিন্যাস ও পদোন্নতি সংক্রান্ত সরকারি কিছু নীতি তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি করে।৯০

ঘ. অর্থনীতি 

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, জিয়া মূল সংবিধানে সন্নিবেশিত ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পরিত্যাগ করে ধনবাদী পথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই প্রধান শিল্পসমূহ জাতীয়করণ করে বেসরকারি খাতের ভূমিকা সীমিত করা হয়। জিয়া সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নীতি অনুসরণ করেন, যেমন বেসরকারি খাতে বিনিয়ােগের সর্বোচ্চ সীমা তিন কোটি টাকা থেকে দশ কোটি টাকা বৃদ্ধি (১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে) এবং পরে (১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে) এই সীমারেখা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার; ছ’প্রকার মূল শিল্প সরকারি খাতের জন্য সংরক্ষিত রেখে বাকি সকল ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজি বিনিয়ােগের অনুমতি প্রদান; যে কোনাে শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা প্রদান; অপেক্ষাকৃত অলাভজনক শিল্প ইউনিটগুলাে থেকে

২১৯

ক্রমান্বয়ে পুঁজি প্রত্যাহার; ঢাকা স্টক একচেঞ্জ-এর পুনরুজ্জীবন; করমুক্ত রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা; ওয়েজ আর্নার পরিকল্পনার অধীনে আমদানির ক্ষেত্রে অধিকতর সুযােগ সুবিধা প্রদান; উদারমুখী ঋণদান নীতি; এবং বিনিয়ােগ অনুমােদন ও ঋণ বণ্টন পদ্ধতি সহজীকরণ, ইত্যাদি।৯১

সরকারের এই উদার নীতির ফলে, অনুমােদিত বার্ষিক বিনিয়ােগের পরিমাণ ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৩২.৫ কোটি টাকা থেকে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ৩২৬.৭ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পায়।৯২

কিন্তু বেসরকারি গবেষকদের মতে, সরকার কর্তৃক অনুমােদিত অর্থের এক বড় অংশ শিল্প খাতে বিনিয়ােগ করা হয়নি। দ্রুত ও অধিকতর মুনাফা অর্জনের। উদ্দেশে এই অর্থ ইন্ডেন্টিং ও অন্যান্য ফটকা ব্যবসায় খাটানাে হয়।৯৩

যাহােক, জিয়া আমলে শিল্প খাতে ক্রিয়াকাণ্ডের অনেকটা প্রসার ঘটে। শিল্প উৎপাদনের সূচক ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৮৫.৯৮ থেকে ১৯৭৯-৮০ অর্থ বছরে ১১১.৮৬-এ বৃদ্ধি পায় (দেখুন সারণি ৮.৪)। কিন্তু মােট জাতীয় উৎপাদনে (জি.এন.পি) শিল্পের অবদান খুব সামান্যই বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯-৭০ সালে জাতীয় উৎপাদনের ৮.২৬% আসে শিল্প থেকে। সে তুলনায় ১৯৮০-৮১ সালে জাতীয় উৎপাদনে শিল্পের অবদান ছিল ৮.৪৫%।৯৪

সারণি ৮.৪ 

বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদনের সূচক (১৯৭৪-৭৫ থেকে ১৯৭৯-৮০ সাল)

(ভিত্তি : ১৯৬৯-৭০ সাল = ১০০)

অর্থ বছর সূচক
১৯৭৪-৭৫ ৮৫.৯৮
১৯৭৫-৭৬ ৯৩.৯৬
১৯৭৬-৭৭ ৯৯.৬৯
১৯৭৭-৭৮ ১০৬.৫২
১৯৭৮-৭৯ ১০৮.৪৭
১৯৭৯-৮০ ১১১.৮৬

উৎস : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Economic Indicators of Bangladesh, নভেম্বর, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯।

জিয়া আমলে বাকশাল আমলের গ্রাম সমবায় পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং দেশের কৃষিকাঠামাে অপরিবর্তিত থেকে যায়। তবে জিয়া জনসাধারণের অর্থনৈতিক মঙ্গলের জন্য শান্তিপূর্ণ বিপ্লব’-এর আহ্বান জানান এবং কৃষি, শিক্ষা, প্রশাসন, শ্রম ও আইনের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের ওপর জোর দেন।

কিন্তু বিএনপি কোনাে বিপ্লবী দল ছিল না। বিএনপি দলীয় অধিকাংশ সংসদ সদস্যসমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসেন (দেখুন সারণি ৮.৫)। তাঁরা প্রধানত 

২২০

ভূমিমালিক, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। সুতরাং জিয়া কোনাে অর্থপূর্ণ আর্থসামাজিক সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তাঁর “বিপ্লব” সেচের জন্য খাল খননমূলক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে সহযােগিতা ও সমম্বয়ের অভাবে এই কর্মসূচি আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়।

সারণি ৮.৫ 

বিএনপি সংসদ সদস্যদের পেশাগত পটভূমি (১৯৮১ সালের মার্চের অবস্থা)

পেশা সদস্যদের সংখ্যা শতাংশ হার
আইনজীবী১ ৫৫ ২২
কৃষি ৩৫ ১৪
কৃষি ও ব্যবসা ২২
ব্যবসা ও শিল্প ৫১ ২০
শিক্ষকতা ১৫
সামরিক-বেসামরিক চাকরি ১৫
শ্রমিক ইউনিয়ন
অন্যান্য পেশাজীবী২ ২২
গৃহস্থালি (মহিলা সদস্যগণ) ১৬
অজানা ১৪
মােট ২৫০ ১০০

১. আইনজীবীদের অনেকেই ভূমি মালিক ছিলেন। 

২. অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে ছিলেন : ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, ব্যবসা-নির্বাহী, সাংবাদিক ও লেখক। 

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, সদস্যদের জীবন বৃত্তান্ত, ঢাকা, ১৯৮১; মােস্তফা হারুন (সম্পাদক), Who’s who in the Parliament (ঢাকা : সৌখিন প্রকাশনী), ১৯৭৯।

জিয়ার ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, যাতে করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পরেও বিদেশে খাদ্য রফতানি করা যায়।

মােট খাদ্য উৎপাদন ১৯৭৬-৭৭ সালে ১১৮.১৪ লক্ষ টন থেকে ১৯৮০-৮১ সালে ১৪৭.৩৮ লক্ষ টনে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বৃদ্ধি প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক কম ছিল। ফলে প্রতি বছর বিরাট পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় (সারণি ৮.৬ দেখুন)।

২২১

সারণি ৮.৬

খাদ্যশস্যের বার্ষিক উৎপাদন ও আমদানীর পরিমাণ

১৯৭৬-৭৭ থেকে ১৯৮০-৮১

(লক্ষ টনের হিসাবে)

অর্থ বছর মােট উৎপাদন মােট আমদানী
১৯৭৬-৭৭ ১১৮.১৮ ৮.১০
১৯৭৭-৭৮ ১৩১.০৬ ১৬.৪৫
১৯৭৮-৭৯ ১৩১.৩২ ১২.৯৮
১৯৭৯-৮০ ১৩৩.৩৯ ২৭.৩২
১৯৮০-৮১ ১৪৭.৩৮ ১০.৬২

উৎস : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার,অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জরীপ, ১৯৭৯ – ৮০, পৃষ্ঠা; ৩; ১৯৮০ – ৮১, পৃষ্ঠা ৬; ১৯৮১ – ৮২, পৃষ্ঠা ৭ ও ৩৫৬।

পঞ্চম অধ্যায়ে (সারণি ৫.২) দেখা গেছে যে, ১৯৭৪ – ৭৫ সালে মাথা পিছু আয় ১৯৬৯-৭০ সালের ৭৪৯ টাকার তুলনায় ৬৪৫ টাকায় (১৯৭২-৭৩ সালের স্থির মূল্যে) নেমে আসে। ১৯৮০-৮১ সালে মাথা পিছু আয় অবশ্য ৭৫৯ টাকায় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তা ছিল ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় মাত্র ১০ টাকা বেশি।৯৭

অপরদিকে অর্থ সরবরাহের অতিরিক্ত বৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির কারণে জনসাধারণের, বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের জনগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক দুর্দশা বৃদ্ধি

এর তুলনায় ১৯৭৫-৭৬ সালে ৩৮০.১৪ তে হ্রাস পায়। কিন্তু তারপর জীবনযাত্রার ব্যয় অনবরত বাড়তে থাকে এবং ১৯৮০-৮১ সালে ব্যয়ের সূচক বৃদ্ধি পেয়ে ৬২৮.২৮-এ দাঁড়ায় (সারণি ৮.৭ দ্রষ্টব্য)।

সারণি ৮.৭

ঢাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার ব্যয়ের বার্ষিক সূচক

১৯৭৪-৭৫ থেকে ১৯৮০-৮১ সাল

(ভিত্তি : ১৯৬৯-৭০ = ১০০)

অর্থবছর ব্যয়ের সুচক
১৯৭৪-৭৫ ৪০৭.৫৮
১৯৭৫-৭৬ ৩৮০.১৪
১৯৭৬-৭৭ ৩৮২.৪৬
১৯৭৭-৭৮ ৪৪০.৪৬
১৯৭৮-৭৯ ৪৮৫.৮৬
১৯৭৯-৮০ ৫৬১.১১
১৯৮০-৮১ ৬২৮.২৮

উৎস : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, 1981 Statistical Yearbook of Bangladesh, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪১৫।

২২২

যদিও জাতীয় উৎপাদন (G.D.P) ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ৫% বৃদ্ধি পায়, ১৯৮০ – ৮১ সালে মাথা পিছু আয় ছিল চলতি মূল্যে মাত্র ২০১৫ টাকা (প্রায় ১৩০ ডলার)।৯৮

জনসংখ্যার চার-পঞ্চমাংশের বেশি দারিদ্র রেখার নিচে জীবনযাপন করত, এবং প্রতি ১০,০০০ ব্যক্তির জন্য মাত্র একজন ডাক্তার ছিল।৯৯

দুই ‘দুর্দশাগ্রস্ত জনসমুদ্রের মধ্যে কতিপয় ভাগ্যবান উচ্চবিত্ত ব্যক্তিকে নিয়ে একটা প্রাচুর্যের দ্বীপ’ গড়ে ওঠে, যাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন সবার চোখে পড়ার মতাে ছিল।১০০

এই নব্য ধনিক শ্রেণি স্বাধীনতার পরপরই তার যাত্রা শুরু করে, কিন্তু জিয়া বেসরকারি খাতকে লালন ও প্রশ্রয়দানের যে নীতি অনুসরণ করেন তার ফলে তারা অতি দ্রুত বিকশিত হয়। ১৯৭৪ সালে যেখানে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র দু’জন, সেখানে ১৯৭৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৪ জনে।১০১ ১৯৮১ সালের। প্রারম্ভে এই সংখ্যা আরাে বৃদ্ধি পেয়ে ১২০ জনে পৌছে।১০২

এইভাবে জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সামান্য প্রবৃদ্ধি সাধিত হয় তা একটি ছােট সমৃদ্ধিশালী চক্র আত্মসাৎ করে এবং তার ফলে ধনী দরিদ্রের মধ্যেকার পার্থক্য আরাে বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জীবন যাত্রার মানের অধােগতি নির্দিষ্ট আয়ের জনগােষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্ট করে এবং বিভিন্ন পেশাজীবী গােষ্ঠীর ধর্মঘট ও বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে দেশব্যাপী এই অসন্তোষের প্রকাশ ঘটে। ১৯৮০ সালে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট পালন করে এবং সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হয়। এই ধর্মঘটকারী গােষ্ঠীগুলাের মধ্যে ছিল সরকারি কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, সরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্রসমূহের সাংবাদিকবৃন্দ, নন-গেজেটেড সরকারি কর্মচারীবৃন্দ, (যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লক্ষ), ইউনিয়ন পরিষদসমূহের কর্মচারীবৃন্দ (প্রায় ৫০,০০০) মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, প্রাথমিক স্কুলসমূহের শিক্ষকবৃন্দ (প্রায় ১,৭১,০০০) এবং পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীবৃন্দ (প্রায় ৩০,০০০)।১০৩

যদিও মাছ, মাংস, দুধ, চিনি, সাবান, কাপড়, সিগারেট, ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধির জন্য শহুরে মধ্যবিত্ত ও শিল্প-শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়, গ্রামীণ জনসাধারণের মৌলিক সামগ্রী অর্থাৎ চালের দাম তুলনামূলকভাবে কম ছিল। ১৯৮০৮১ সালে মােটা চালের গড় মূল্য ছিল সের প্রতি ৫.১৩ টাকা যা ১৯৭৪-৭৫ সালে ছিল ৬.৩১ টাকা।১০৪ সাধারণত গবির শ্রেণির ব্যবহার্য পুরানাে কাপড়-চোপড়ের দামও কম ছিল। সুতরাং দারিদ্র সীমার নিচে জীবনযাপনকারী জনসাধারণের মুজিব শাসনামলের তুলনায় জিয়া শাসনামলে অধিকতর সন্তুষ্ট ছিল বলে মনে হয়।

ঙ. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি 

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে উগ্র বামপন্থী গােষ্ঠীসমূহের অধিকাংশই তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে। তার ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাধারণ উন্নতি ঘটে। তাছাড়া, জিয়া আইন

২২৩

প্রয়ােগকারী সংস্থাসমূহের শক্তিবৃদ্ধির জন্য কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০,০০০। ১৯৮০ সালে তা বুদ্ধি পেয়ে প্রায় ৬৮ হাজারে দাঁড়ায়। জিয়া আনসার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেন (প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার) এবং প্রায় এক কোটি সদস্য বিশিষ্ট গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন।১০৫

এভাবে জিয়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি সাধনে সক্ষম হন। পুলিশের নিকট এজাহারকৃত অপরাধের সংখ্যা ১৯৭৫ সালে ছিল ৭৪.২৯১। ১৯৭৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৬২,৭৮৩।১০৬ ১৯৮০ সালে অপরাধের সংখ্যা আরাে হ্রাস পেয়ে ৫৮,১৫৫তে দাঁড়ায়১০৭, এবং গ্রামাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিরতার কারণে শহরাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য ধর্মঘট, সশস্ত্র সংঘর্ষ, বােমা বিস্ফোরণ ও পুলিশ কর্তৃক গুলি চালানাের ঘটনা ঘটে, যার ফলে রাজনৈতিক সমাবেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত, কারাগার, এমনকি হাসপাতালে বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিহত হয়। এই সব দেখে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ১৯৮০ সালকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পূর্ববর্তী ‘দুঃস্বপ্নের দিনগুলাের সঙ্গে তুলনা করেন।১০৮

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী তৎপরতাও ১৯৮০ সালে বৃদ্ধি পায় এবং সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। ঐ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত চারটি বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে বহু সংখ্যক সৈন্য, পুলিশ ও বেসামরিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে এবং বহুসংখ্যক ঘরবাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিদগ্ধ হয়।১০৯

১৯৮১ সালের প্রথমার্ধে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরাে অবনতি ঘটে। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিসমূহের মধ্যেকার সহিংস সংঘর্ষ দেশে প্রায় গৃহযুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে। প্রকাশ্য দিবালােকে খুন, ডাকাতি, অপহরণ, ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। জনসাধারণের মধ্যে এক রকমের নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয় এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে অসংখ্য প্রশ্ন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়। সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত উত্তর থেকে দেখা যায় যে, ১৯৮১ সালের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে অন্তত ৯৪ ব্যক্তি দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হয় এবং ঐ সময়ে ঢাকা নগরীতে মহিলাদের ২৫টি ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাই হয়। ১৯৮১ সালের প্রথম চার মাসে দেশে ৪৪৭টি ডাকাতি সংঘটিত হয়, অথচ ১৯৮০ সালে ঐ সময়ে সংঘটিত হয় ৩৬৫টি ডাকাতি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেন যে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রায় ৫০% দুর্নীতি ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল।১১০

১৯৮১ সালের এপ্রিল ও মে মাসে আরাে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে ভয়ানকভাবে দূষিত করে তােলে।১১১

ছাত্রদের একাংশ ও বহিরাগত ব্যক্তিগণ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্র ব্যবহার ও ভীতি প্রদর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দকে ধর্মঘট পালন ও মিছিল করতে বাধ্য করে।

দ্রুত অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি দলনিরপেক্ষ ইংরেজি সাপ্তাহিকীর সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয় :

২২৪

স্পষ্টত এখনই ভেবে দেখার সময় যে, বর্তমান প্রশাসন দেশকে অযােগ্যতা, বিশৃঙ্খলা ও খুনখারাবি ছাড়া অন্য কিছু দিতে সমর্থ কিনা। আওয়ামী লীগবাকশাল সরকার আমাদের যা দিয়েছিল এই সরকার জাতিকে কার্যত তাই দিচ্ছে। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পাঁচ বছর পর আমরা কেবল পাঁচ বছর পিছিয়ে যাইনি, আরাে বেশি পিছিয়ে গেছি।১১২

একাধিক জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তেও অনুরূপ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।১১৩

সূত্র ও টীকা

১. দেখুন রাষ্ট্রপতি জিয়ার বক্তব্য, সংবাদ, ৫ মে, ১৯৭৮। 

২. ঐ, ৫ নভেম্বর, ১৯৭৮। 

৩. ঐ, ২৮ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৪. ঐ, ২৬ জানুয়ারি ও ২৫শে এপ্রিল, ১৯৮১। 

৫. ঐ, ৫ নভেম্বর, ১৯৭৮। 

৬, ঐ, ৫ এপ্রিল ১৯৭৮। 

৭. প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও উপ-রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের বক্তৃতা দেখুন, সংবাদ

২২ নভেম্বর, ১৯৭৯ ও ১১ নভেম্বর, ১৯৮০। 

৮. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদীদল, ঘােষণাপত্র, আগস্ট, ১৯৭৮। 

৯, সংবাদ, ১৯ নভেম্বর, ১৯৭৭। 

১০. ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জাতীয়তাবাদী গােষ্ঠীসমূহের মনােভাবের জন্য দেখুন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিগত কাউন্সিল অধিবেশন-সভায় গৃহীত প্রস্তাবাবলি, মে ১৯৭৭; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঘােষণাপত্র, মে, ১৯৭৭; বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি, সংবাদ বুলেটিন ১৮ মে, ১৯৭৭; বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সাংবাদিক সম্মেলন, সংবাদ ১৪ জুন ১৯৭৭; ইউ পি পি কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবাবলি ও সাংবাদিক সম্মেলন, নয়াযুগ, ৮মে, ১৯৭৭ ও সংবাদ, ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৭৬ ও ৭ এপ্রিল, ১৯৭৭; জাসদের আব্দুল জলিল ও আব্দুর রবের সাংবাদিক সম্মেলন, সংবাদ ১১ মার্চ, ১৯৮১; জেনারেল ওসমানীর বিবৃতি, সংবাদ ২৭ জানুয়ারি, ১৯৮০। 

১১. উদাহরণ হিসাবে দেখুন, মাহমুদ শাহ কোরাইশী (সম্পাদিত), ঐতিহ্য সংস্কৃতি সাহিত্য | (রাজশাহী ১৯৭৯), পৃষ্ঠা ১-৪৩। 

১২. সংবাদ, ২ এপ্রিল ১৯৮০। 

১৩. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, The Primary Report on Bangladesh Population Census, ১৯৮১ পৃষ্ঠা ২ ও ৩। 

১৪. দেখুন উপেন্দ্রলাল চাকমার সাংবাদিক সম্মেলন, সংবাদ, ২ এপ্রিল, ১৯৮০ ও ১৯৮১; জগলুল আলম, “Hostility in the Hills.” Holiday, ৩০ মার্চ ১৯৮০। 

১৫. দেখুন কাজী মন্টু, The Situation in the Hill Tracts, Holiday, ৩০ মার্চ, ১৯৮০। 

১৬. দেখুন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বিবৃতি, সংবাদ, ২৪ নভেম্বর, ১৯৭৬ ও ১০ নভেম্বর, ১৯৭৯; আব্দুস সবুর খানের বিবৃতি, সংবাদ ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৬ , ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৯ ও ১৬ জুন, ১৯৮০। 

১৭. মুসলিম লীগের প্রস্তাব দেখুন, আজাদ, ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। 

১৮. সংবাদ, ২৬ নভেম্বর, ১৯৭৮। 

১৯. ঐ, ৪ এপ্রিল, ১৯৮১। 

২০. ঐ, ২৩ এপ্রিল, ১৯৮১।

২২৫

২১. ঐ, ২ মার্চ, ১৯৮১। 

২২. ঐ, ২৩ আগস্ট, ১৯৭৭। 

২৩. দেখুন মাওলানা আব্বাস আলী খানের সাংবাদিক সম্মেলন, সংবাদ, ৩০ মার্চ, ১৯৮১। 

২৪. দেখুন, মার্কস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২৫। 

২৫. পূর্ব-বাংলার সাম্যবাদী দল-এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল করা হয়, পূর্ব-বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির নাম হয় “বাংলাদেশের কমুনিস্ট লীগ” এবং পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির নাম হয় বাংলাদেশের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি। তুবে আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টির একটি উপদল এবং পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি তাদের পুরানাে নাম অপরিবর্তিত রাখে এবং তারা আত্মগােপন থেকে যায়। 

২৬. ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযােগ সত্ত্বেও এটা মনে করা হয় যে, বিরােধী দলসমূহের নেতস্থানীয় সদস্যরা যাতে পরাজিত না হন সে ব্যাপারে জিয়া সচেতন ছিলেন। সংসদে বিরােধী দলীয় কোন কোন সদ্যস্যের প্রতি কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বলেন, সরকার চেয়েছিল বলেই তারা সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। দেখুন বিতর্ক, খণ্ড ৩, সংখ্যা ২৫ (১৭ মার্চ, ১৯৮০), পৃষ্ঠা ২০৮৭। 

২৭. এই ৭৯ জনের মধ্যে পাঁচ জন ছিলেন নির্দলীয় সদস্য। মােট ১৬ জন নির্দলীয় সদস্যের মধ্যে ১১ জন পরে বিএনপিতে যােগদান করেন। 

২৮. ইত্তেফাক, ৫ জানুয়ারি ১৯৮০। 

২৯, বিতর্ক, খণ্ড ৩, সংখ্যা ৮ (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০), পৃষ্ঠা ৪৭১ – ৪৭৫। 

৩০. বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যবাহের সারাংশ, ১৯৭৩ – ১৯৮১। 

৩১. Holiday, ২৭ জুলাই, ১৯৮০। 

৩২. সংবাদ, ২৯ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৩৩, ঐ, ৬ মে ১৯৮১। 

৩৪. এই বিলে আইন প্রয়ােগকারী সংস্থাসমূহের হাতে কোনাে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, আটক, এমনকি গুলি করার অসীম ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়। বিলের পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন, সংবাদ, ২ ডিসেম্বর, ১৯৮০। 

৩৫. ইত্তেফাক, ১১ জুলাই, ১৯৭৬; গণশক্তি, ২৫ জুলাই, ১৯৭৬; সংবাদ, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৬। 

৩৬. পাঁচটি ছােট কম্যুনিস্ট উপদল সমবায়ে গঠিত “গণফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্য দেখুন, সংবাদ, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭৮। 

৩৭. সংবাদ, ১৫ জুলাই, ১৯৭৯। 

৩৮. বিশদ বিশ্লেষণের জন্য দেখুন, আবুল ফজল হক, Contemporary Politics and the Radical Left in Bangladesh. The Journal of the Institiute of Bangladesh Studies, খণ্ড ৩; ১৯৭৮। 

৩৯. পাঁচটি কম্যুনিস্ট গােষ্ঠীর যৌথ বিবৃতি দেখুন, The Bangladesh Times, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭; আরাে দেখুন মােহম্মদ তােয়াহার সাংবাদিক সম্মেলন, দৈনিক বাংলা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭। 

৪০. ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর কাজী জাফর আহমদ ও এনায়েতুল্লাহ খান প্রমুখ বাহপন্থীকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু নভেম্বর মাসে তাদেরকে পদত্যাগ করতে হয়। 

৪১. দেখুন, সংবাদ, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯ ও Holiday ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯। 

৪২. বিরােধী শিবিরে অন্তর্দলীয় ও আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্বের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের জন্য দেখুন, আজিজুল হক, “Bangladesh in 1980; Strains and Stresses Opposition in the Doldrams”. Asian Survey, খণ্ড ২১ সংখ্যা ২ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১), পৃষ্ঠা ১৯৫-১৯৬। 

২২৬

৪৩. দেখুন সংবাদ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০। 

৪৪. ঐ, ২৯ অক্টোবর, ১৯৮০। 

৪৫. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর চারজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত হন। সেই সূত্রে আওয়ামী লীগ প্রতি বছর ৩ নভেম্বরকে জেলহত্যা দিবস রূপে পালন করে থাকে। 

৪৬, সংবাদ, ৩ নভেম্বর, ১৯৮০। 

৪৭, ঐ, ২, ৩ ও ৪ নভেম্বর, ১৯৮০। 

৪৮. ঐ, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯। 

৪৯. সংবাদ, ১০ সেপ্টেম্বর ও ৭ অক্টোবর, ১৯৭৮। 

৫০. ঐ, ২ মার্চ, ১৯৮১। 

৫১. ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইউনিয়ন পরিষদ ও আগস্ট মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সব নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত না হলেও প্রার্থীদের দলীয় পরিচয় ভােটারদের নিকট মােটামুটি জানা থাকে। এক নমুনা জরিপে দেখা যায় যে, ইউনিয়ন পরিষদসমূহে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে প্ৰয় ৪৭% আওয়ামী লীগের এবং প্রায় ২৩% ছিলেন মুসলিম লীগ ও অনুরূপ ডানপন্থী দলের সঙ্গে জড়িত; বামপন্থী দলগুলাের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রায় ২১% (এম, রশিদুজ্জামান, Bangladesh in 1977″, Asian Survey, খণ্ড ১৮, সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮)। ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে দেশের ৭৭টি পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, ৭৭ জনের মধ্যে ৫২ জন চেয়ারম্যানই আওয়ামী লীগের। কিন্তু মুসলিম লীগ মুখপত্র দাবি করে যে, আওয়ামী লীগ থেকে ২৭ জন ও মুসলিম লীগ থেকে ২৪ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বাকি ২৬ জনের মধ্যে ন্যাপ (ভাসানী) থেকে ৫ জন, ন্যাপ (মােজাফফর) থেকে ৩ জন, ইউ পি পি থেকে ৩ জন, ডেমােক্রেটিক লীগ থেকে ২ জন, আই ডি এল থেকে ১ জন, জাসদ থেকে ১ জন ও নির্দলীয় ১১ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন (আজাদ, ১৬ আগস্ট ১৯৭৭)। 

৫২. দেখুন ইত্তেফাক, ২৯ আগস্ট, ১৯৭৭। 

৫৩. ঐ, ৩১ জুলাই, ১৯৭৮। 

৫৪. সংবাদ, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। 

৫৫. ঐ, ১১ নভেম্বর, ১৯৭৯। 

৫৬. সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবহিত করেন যে, ১৯৮১ সালের এপ্রিল নাগাদ মােট ২৬৩১ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৬৪ ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিকতা প্রদান করা হয়। দেখুন সংবাদ, ২৩ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৫৭. জামায়াত-ই-ইসলামীর সাংগঠনিক কাঠামাে ও রণকৌশলের বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন “গােলাম আজম ও জামায়াতের রাজনীতি, বিচিত্রা, খণ্ড ৩, সংখ্যা ৪৪, ১৭ এপ্রিল, ১৯৮১;

নতুন কথা, ২৭ মার্চ, ১৯৮১; মুক্তিবাণী, ২১ অক্টোবর, ১৯৭৯। 

৫৮. দেখুন, মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কাজী নুরুজ্জামানের সাংবাদিক সম্মেলন, সংবাদ, ২২ মার্চ ১৯৮১। 

৫৯. Holiday ৫ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৬০. ঐ। 

৬১. সংবাদ, ৮ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৬২. ঐ, ৩০ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৬৩. ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ, ১৯৮১। 

৬৪. সংবাদ, ২৭ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৬৫, ঐ।

২২৭

৬৬. ঐ, ৮ মে, ১৯৮১। 

৬৭. ঐ, ২৪ মে, ১৯৮১। 

৬৮. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ঘােষণাপত্র, আগস্ট, ১৯৭৮। 

৬৯. দেখুন ন্যাপ (ভাসানী) কাউন্সিল সভার প্রস্তাবাবলী, সংবাদ, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮; মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব, সংবাদ, ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। 

৭০. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, গঠনতন্ত্র (১৯৮০), ধারা ৬। 

৭১. ঐ, ধারা ৭। 

৭২. দেখুন মাকার্স ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৩; Holiday, ৩১ আগস্ট, ১৯৮০। 

৭৩. কাজী মন্টু, “Discontented Outburst”, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৯। 

৭৪. সংবাদ, ২৪ এপ্রিল, ১৯৮০। 

৭৫. দেখুন কাজী মন্টু “Factionalism in BNP:, Holiday, ডিসেম্বর, ১৯৮০। 

৭৬. দেখুন সংবাদ, ১৫ মে ও ১ জুলাই ১৯৮০; Holiday, ৬ ও ৭ ই জুলাই ১৯৮০। 

৭৭. গ্রাম সরকার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, স্বনির্ভর গ্রাম সরকার ম্যানুয়েল, ঢাকা, ১৯৮০। 

৭৮. দেখুন, কুদরত-ই-খুদা, “An Extension of Existing Power Structure in Bangladesh: The Institution of Gram Sarker”, Asian Affairs, she 8, rast. S, মার্চ ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭১। 

৭৯. Holiday, ২৪শে আগস্ট, ১৯৮০। 

৮০. ঐ, ২৯ জুন, ১৯৮০। 

৮১. দেখুন মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রগােক্ত, পৃ.৬৯-৭০। 

৮২. দেখুন, এমাজ উদ্দিন আহমদ, Dominant Bureaucratic Elites in Bangladesh,” মােহাম্মদ মহব্বত খান ও হাবিব মােহম্মদ জাফরুল্লাহ (সম্পাদক), Politics and Bureaucracy in a New Nation: Bangladesh, ঢাকা, ১৯৮০। 

৮৩. দেখুন Holiday, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৯; সংবাদ, ৭ মে, ১৯৮০। 

৮৪. সংবাদ, ১৫ নভেম্বর, ১৯৭৯। 

৮৫. কাজী মন্টু Gaping Hiatus, “Holiday”, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৯। 

৮৬. Holiday, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৯। 

৮৭. দেখুন আবুল ফজল হক, “Bangladesh: Constiution, Politics and Bureaucracy”, The Rajshahi University Studies. (Part A) XI, 1980-83. 

৮৮. সংবাদ, ২৮ এপ্রিল, ১৯৮১। 

৮৯. সংসদে সংস্থাপন মন্ত্রীর বিবৃতি দেখুন, সংবাদ, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৬ জুন ও ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৮০। 

৯০. দেখুন তালুকদার মনিরুজ্জামান, “Administrative Reforms and Politics Within Bureaucracy in Bangladesh”, The Journal of Commonwealth and Comparative Politics, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৬; এনায়েতুল্লাহ খান, “The Casulty of Syndrom”, Holiday, ১, ৮ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১; No Banana for Deputy Secretaries, Holiday, ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১। 

৯১. দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, প্ল্যানিং কমিশন, The Second Five Year Plan, 1980-85, ঢাকা ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪। 

৯২. সংসদে উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহমেদ বিবৃতি দেখুন, সংবাদ, ২৬ জুলাই ১৯৮০। 

৯৩. দেখুন মােজাফফর আহমেদ, “বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?” সংবাদ, ৯ মে, ১৯৮১; | New Nation, ২৩ আগস্ট, ১৯৮১।

৯৪. অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জরীপ, ১৯৮১-৮২, পৃষ্ঠা ৩৮৬।

২২৮

৯৫. দেখুন সংবাদ, ২০ ও ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯; ইত্তেফাক ১৩ ও ১৪ নভেম্বর, ১৯৭৯; The Bangladesh Observer, ১৯ নভেম্বর, ১৯৭৯। 

৯৬. দেখুন জাতির উদ্দেশে জিয়ার ভাষণ, The Bangladesh Observer, ১৯ নভেম্বর, ১৯৭৯। 

৯৭. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, 1981 Statistical Yearbook of Bangladesh, ঢাকা,

১৯৮২, পৃষ্ঠা ৩৫৬। 

৯৮. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৫৭। 

৯৯. বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, The Second Five Year Plan, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১ ও ২। 

১০০.দেখুন মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪৬-২৪৯। 

১০১. “দরবার-ই-জহুর”, সংবাদ, ৬ জুন, ১৯৮০ (বাংলাদেশ ব্যাংক বুলেটিন, অক্টোবর, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৪৮০ থেকে উদ্ধৃত) 

১০২. দেখুন নতুন কথা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১। 

১০৩. দেখুন সিরাজুল হােসেন খান, “Action-Paced Bangladesh”, Holiday, ১৬ই মার্চ, ১৯৮০; সংবাদ, ৩ ও ৭ ফেব্রুয়ারি, ৮, ১৮ ও ২০ মার্চ, এবং ৫ ও ২৯ এপ্রিল, ১৯৮০; নতুন কথা, ১৩ জুন, ১৯৮০। 

১০৪. বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, Economic Review, ১৯৮০-৮১, সারণি ২, পৃষ্ঠা ২৯-৩০। 

১০৫.দেখুন, তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests…, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯; সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতি, জতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ৬, সংখ্যা ৭ (২২ এপ্রিল, ১৯৮১), পৃষ্ঠা ৭১৩। 

১০৬. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, 1979 Statistial Yearbook of Bangladesh ১৯৮০, সারণি ১২.১০, পৃষ্ঠা ৪১৫।

 ১০৭. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, 1981 Statistical Yearbook of Bangladesh ১৯৮২, সারণি ১২.২৭, পৃষ্ঠা ৪৯৩। 

১০৮.আজিজুল হক, “Bangladesh in 1980…” Asian Survey, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯; আরাে দেখুন সিরাজুল হােসেন খান, “March of Murderers”, Holiday, ২২ জুন, ১৯৮০; কাজী মন্টু, Normal Life Under Assault, Holiday, ১৯ অক্টোবর, ১৯৮০। 

১০৯. দেখুন আজিজুল হক, Bangladesh in 1980. ” প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০-৯১। 

১১০. দেখুন সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি, জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ৬, সংখ্যা ৭ (২২ এপ্রিল, ১৯৮১), পৃষ্ঠা ৭১৩-৭৩৯; ঐ, খণ্ড ৭, সংখ্যা ৪(২৬ মে, ১৯৮১), পৃষ্ঠা ২৮১-২৮৫। 

১১১. এই সব ঘটনার মধ্যে ছিল আদমজী পাটকল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, সাভারে পুলিশ ও যুব কমপ্লেক্স সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ, কুষ্টিয়া শহরে পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ, একজন বিচারকের ওপর দুষ্কৃতিকারীদের হামলা, খন্দকার মােশতাক আহমেদের জনসভায় বােমা বিস্ফোরণ এবং কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী, একজন সাংবাদিক ও একজন শ্রমিক নেতাকে প্রকাশ্য দিবালােকে হত্যা। দেখুন, “The Mafia”, (Editorial), Holiday, ১০ মে ১৯৮১; সংবাদ, ৫, ১২ ও ২৯ এপ্রিল, এবং ৮ ১৪, ২৪ ও ২৯ মে, ১৯৮১। 

১১২. Holiday, ১৯ এপ্রিল, ১৯৮১। 

১১৩. আজাদ, ৬ এপ্রিল, ১৯৮১; সংবাদ, ১০ মে, ১৯৮১।

২২৯

Reference: বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!