You dont have javascript enabled! Please enable it!

একদলীয় ব্যবস্থা ও সামরিক অভ্যুত্থান

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী তথা একদলীয় ব্যবস্থাকে ‘আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করে। দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘােষিত লক্ষ্য ছিল; (১) উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সকল প্রকার শােষণ ও দুর্নীতি উচ্ছেদের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, (২) জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিয়ম শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও (৩) ব্যাপক ভিত্তিক জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলা।১

এই সব লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কতিপয় উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে “দ্বিতীয় বিপ্লবের আকস্মিক অবসান ঘটে।

১. দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি 

চতুর্থ সংশােধনীর পর মুজিব সরকার যে পুর্নগঠনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন তার মধ্যে ছিল : (ক) একটি একক “জাতীয় দল” গঠন, (খ) জেলা প্রশাসন পুনর্গঠন, এবং (গ) গ্রাম সমবায় প্রবর্তন। 

ক. জাতীয় দল 

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশােধনী গৃহীত হবার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উক্ত সংশােধনীর দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক ঘােষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একক জাতীয় দল গঠন করেন। ফলে সে দিন থেকে আওয়ামী লীগসহ সকল দল আইনত বিলুপ্ত হয়ে যায়।

রাষ্ট্রপতি মুজিব স্বয়ং জাতীয় দল তথা বাকশাল’-এর চেয়ারম্যান হন এবং সেই দল সংগঠন ও পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সকল ক্ষমতা গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে উপ-রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, মন্ত্রিবর্গ এবং পূর্বতন আওয়ামী লীগ দলের সকল সংসদ-সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ‘বাকশাল-এর সদস্য নিযুক্ত হন। অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া অন্যান্য সকল কমিটিকে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে বাকশাল’-এর কমিটিরূপে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয় এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘বাকশাল’-এর অস্থায়ী কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এই ব্যবস্থা ১৯৭৫ সালের ৬

১৪৪

জুন পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ৭ জুন তারিখে রাষ্ট্রপতি বাকশাল’-এর গঠনতন্ত্র জারি করেন এবং ঐ দিন দলের বিভিন্ন কমিটিও ঘােষণা করেন।

বাকশাল কাঠামাে : দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে বাকশাল’ ছিল একটি সােপান ভিত্তিক সংগঠন।২

সাত স্তর বিশিষ্ট কমিটি ও কাউন্সিল নিয়ে এটা গঠিত হয় এবং দলের চেয়ারম্যান তথা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। দলের সাতটি স্তর ছিল নিম্নরূপ :

১. নির্বাহী কমিটি, 

২. কেন্দ্রীয় কমিটি, 

৩. দলীয় কাউন্সিল, 

৪. জেলা কমিটি,

৫. জেলা কাউন্সিল, 

৬. থানা/ আঞ্চলিক কমিটি, 

৭. ইউনিয়ন/ প্রাথমিক কমিটি।

তাছাড়া বাকশালের ৫টি অঙ্গ সংগঠন ছিল। সেগুলাে হলাে (১) জাতীয় কৃষক লীগ, (২) জাতীয় শ্রমিক লীগ, (৩) জাতীয় মহিলা লীগ, (৪) জাতীয় যুব লীগ, (৫) জাতীয় ছাত্র লীগ।

নির্বাহী কমিটি দলের চেয়ারম্যানসহ অনুর্ধ ১৫ জন সদস্য সমবায়ে গঠিত হয়। সদস্যগণ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে চেয়ারম্যান কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান দলের সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য সম্পাদক মনােনীত করতেন। নির্বাহী কমিটি ছিল দলের “সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। নির্বাহী কমিটি প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার বৈঠকে মিলিত হতাে। এই কমিটি দলের সংসদীয় অঙ্গ Parliamentary Party) ও অন্যান্য সংগঠন নিয়ন্ত্রণ এবং জেলা কমিটিসমূহ অনুমােদন করতাে, তাদের নিকট থেকে রিপোের্ট গ্রহণ করত ও তাদেরকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিতাে। নির্বাহী কমিটির সভাপতি ছিলেন দলের চেয়ারম্যান। তিনি চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই কমিটি দৈনন্দিন কার্যাবলি পরিচালনা করত।৩

কেন্দ্রীয় কমিটি দলের ‘দ্বিতীয় প্রধান অঙ্গ ছিল। নির্বাহী কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হতাে। মােট সদস্যের দুইতৃতীয়াংশ দলীয় কাউন্সিল কর্তৃক ৫ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হতেন এবং এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হতেন। তবে ৭ জুন তারিখে গঠিত প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১১৫ এবং সকল সদস্যই চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হন। গঠনতন্ত্র অনুসারে কেন্দ্রীয় কমিটি একাধারে দলীয় কাউন্সিল এবং দলের চেয়ারম্যানের নিকট দায়ী ছিল। সাধারণত কেন্দ্রীয় কমিটি বছরে দু’বার বৈঠকে মিলিত হতাে এবং নির্বাহী কমিটির কার্যকলাপ ও দলের

১৪৫

প্রাথমিক কমিটিসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু সরকারি বা আধাসরকারি অফিসে এবং বেসামরিক অথবা সামরিক বাহিনীর মধ্যে গঠিত প্রাথমিক কমিটিসমূহ সরাসরি নির্বাহী কমিটির নিকট দায়ী থাকত।৮

যদিও বাকশালের গঠনতন্ত্রে “গণতান্ত্রিক পদ্ধতি” মৌল সাংগঠনিক নীতি হিসাবে ঘােষিত হয়, বাস্তবে দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার অবকাশ ছিল খুব কম। দলের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাহী কমিটির ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু নির্বাহী কমিটি ছিল একটি মনােনীত সংস্থা এবং তা কেবল চেয়ারম্যানের নিকট দায়ী ছিল। দলীয় কাউন্সিল ছিল তত্ত্বগতভাবে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণকারী সংস্থা। কিন্তু এটাও ছিল আংশিক মনােনীত ও আংশিক নির্বাচিত, এবং পাঁচ বছর মেয়াদকালে এর মাত্র দু’টি অধিবেশনের বিধান দলীয় কাউন্সিলকে একটা বিতর্কসভায় পরিণত করে। জেলা কাউন্সিলসমূহের অবস্থাও একই রূপ ছিল। জেলা পর্যায়ে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী জেলা কমিটিগুলাে ছিল কার্যত নির্বাহী কমিটির আজ্ঞাধীন। জেলা কাউন্সিলের নিকট জেলা কমিটির দায়িত্ব ছিল নাম মাত্র। কারণ, জেলা কমিটির সকল সদস্য দলীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হতেন। দলের সংসদীয় অঙ্গ ও অন্যান্য সংগঠন প্রতিনিধিত্বশীল “দলীয় কাউন্সিল” কিংবা “কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট দায়ী না থেকে দায়ী ছিল নির্বাহী কমিটির নিকট। নির্বাহী কমিটি কেবল নিম্নতন কমিটিসমূহের সংগঠনিক কাঠামােই নির্ধারণ করত না, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযােগ যে-কোনাে কমিটি বাতিল করে দিতে পারত।৯

সুতরাং দলের প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল নির্বাহী কমিটির ওপর। কিন্তু যেহেতু নির্বাহী কমিটি ছিল চেয়ারম্যানের আজ্ঞাধীন, সেহেতু দলের চেয়ারম্যান বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন সকল ক্ষমতা আধার। তদুপরি, চেয়ারম্যানকে কতকগুলাে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়। দলের পূর্ণ সদস্য পদ’ প্রদানের ক্ষমতা নির্বাহী কমিটির ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান বিশেষ বিবেচনায় যে-কোনাে ব্যক্তিকে সদস্য পদ প্রদান করতে পারতেন। তাছাড়া, সামরিক ও বেসামরিক সরকারি কর্মচারীদের দলের সদস্য পদ প্রদানের ক্ষমতা এককভাবে চেয়ারম্যানের হাতে ন্যস্ত ছিল।১০

দলের “শৃঙ্খলা সাব কমিটি” ও পার্লামেন্টারি বাের্ড” (যা রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়ন করতাে) চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হতাে।১১

দলের গঠনতন্ত্র সংশােধনের ক্ষমতা দলীয় কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত থকালেও চেয়ারম্যান কাউন্সিলের পরবর্তী সভায় অনুমােদন সাপেক্ষে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে পারতেন।১২

কিন্তু চেয়ারম্যান দলের কোনাে সংস্থা বা অঙ্গ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন না, কিংবা কোনাে অঙ্গের নিকট দায়ীও ছিলেন না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন পদাধিকার বলে বাকশালের চেয়ারম্যান এবং একই সাথে দলীয় কাউন্সিল, কেন্দ্রীয় কমিটি ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। এ ভাবে দলকে রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করা হয়, কিন্তু সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেয়াহয়নি। বরং দলকে রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ করা হয়। তাছাড়া, তহবিল ও কর্মচারীর জন্য দল সরকারে

১৪৭

ওপর নির্ভরশীল ছিল। দলের তহবিল আংশিকভাবে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে আসত এবং সরকার দলীয় কর্মকর্তাদের সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য অর্থউপদেষ্টা, হিসাব নিরীক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী প্রেরণ করতে পারত।১৩

বাকশাল কমিটিসমূহের গঠন : বাকশালের গঠনতন্ত্রে জারির সাথে ১৯৭৫ সালের ৭ জুন তারিখে রাষ্ট্রপতি মুজিব দলের প্রথম নির্বাহী কমিটি” ও “কেন্দ্রীয় কমিটি” গঠন করেন। ১৫ জন সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সভাপতি ছিলেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এবং সদস্য ছিলেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী-স্পিকার, পাঁচজন মন্ত্রী, পাঁচজন সংসদ-সদস্য ও একজন যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি)। একজন মন্ত্রী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী) ছাড়া নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়। প্রধানমন্ত্রী (মনসুর আলী) পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। অন্য তিনজন সম্পাদকের মধ্যে একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক (জিল্লুর রহমান), একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক (আব্দুর রাজ্জাক) এবং আর একজন ছিলেন আওয়ামী যুব লীগের সভাপতি শেখ মনি)।১৪

দলের গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত হন। ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে ছিলেন রাষ্ট্রপতি (চেয়ারম্যান), উপ-রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, সকল মন্ত্রী (২৫ জন), ৩৪ জন সংসদ সদস্য, ১৫ জন অন্যান্য রাজনীতিক, ২১জন বেসামরিক অফিসার, সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীগুলাের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর ও জাতীয় রক্ষী বাহিনী) প্রধানগণ (পাঁচজন), ৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক (যাদের মধ্যে তিন জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য), তিনজন সাংবাদিক, দুজন। ডাক্তার (যাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল সমিতির সভাপতি) ও একজন স্কুল শিক্ষক (যিনি ছিলেন বাংলাদেশ স্কুল শিক্ষক সমিতির সভাপতি)।১৫

কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক সদস্যের অধিকাংশই ছিলেন প্রাক্তন আওয়ামী লীগার। মাত্র ন’জন সদস্য অন্যান্য দল থেকে নেয়া হয়। এই ন’জনের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন ন্যাপ (মােজাফফর) থেকে, দু’জন বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে, একজন ছিলেন জাতীয় লীগ থেকে (আতাউর রহমান খান) ও একজন ছিলেন ‘জাগমুই’ থেকে (হাজি মােহাম্মদ দানেশ) তাছাড়া একজন ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উপজাতীয় নেতা।

রাষ্ট্রপতি ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বাকশালের পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিও নিযুক্ত করেন। ২১ থেকে ৩২ জন সদস্য নিয়ে এই কমিটিগুলাে গঠিত হয়। প্রতিটি কমিটির প্রধান ছিলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত একজন সাধারণ সম্পাদক। এইসব কমিটির অধিকাংশ সদস্যই আওয়ামী লীগ থেকে নেয়া হয়। বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) এবং তাদের কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন সদস্য এই সব কমিটির অন্তর্ভুক্ত হন।১৬

১৪৮

রাষ্ট্রপতি ১৯৭৫ সালের ৩ আগস্ট জেলা কমিটিসমূহ গঠন করেন। প্রতিটি জেলা কমিটিতে একজন সম্পাদক ও পাঁচজন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন এবং এগুলােতে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য ছিল। বাকশালের নির্বাচিতব্য অঙ্গসমূহ, যেমন দলীয় কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল ও থানা কমিটি তখনাে গঠিত হয়নি।

খ. প্রশাসনিক পুনর্গঠন 

পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ চারটি আঞ্চলিক বিভাগে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় কমিশনার নামে একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনার উন্নয়ন ও রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে কেবল সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতেন। প্রতিটি বিভাগ কতিপয় জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাগুলাে ছিল প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। জেলা প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন একজন ডেপুটি কমিশনার, যিনি ছিলেন একজন উচ্চ পর্যায়ের বেসামরিক কর্মকর্তা। ডেপুটি কমিশনার জেলার অভ্যন্তরে ব্যাপক ক্ষমতা ও উচ্চ পদমর্যাদা ভােগ করতেন। আদালত ছাড়া জেলার সকল অফিস ছিল তার নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশাধীন। তিনি কেবল সরকারের নিকট দায়ী ছিলেন। প্রতিটি জেলা কয়েকটি মহকুমায় বিভক্ত ছিল। মহকুমা প্রশাসনও এস ডিও নামক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এস. ডি. ও ডেপুটি কমিশনারের মতােই ক্ষমতা ও মর্যাদা ভােগ করতেন। মহকুমার নিচে ছিল থানা প্রশাসন, যার মূল দায়িত্ব ছিল গ্রামীণ এলাকায় শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা করা। এভাবে, কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের অধীনে জেলাই ছিল দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সরকারি আমলারা ঐতিহ্যগতভাবে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং মুজিব সরকার প্রথমে জেলা প্রশাসন পুনর্গঠনের কাজ হাতে নেয়।

নতুন জেলা প্রশাসন : সরকার ১৯৭৫ সালের ২২ জুন বিদ্যমান মহকুমাগুলােকে জেলায় উন্নীত করে। ফলে জেলার সংখ্যা ১৯ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬১। এর পর ৯ জুলাই তারিখে সংসদে জেলা প্রশাসন আইন নামে একটি আইন গৃহীত হয়। এই আইনে বিধান করা হয় যে, প্রতি জেলায় একজন জেলা গভর্নর থাকবেন। গভর্নর বাকশালের সদস্যদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। গভর্নর কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট দায়ী থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী স্বপদে বহাল থাকবেন। তিনি হবেন জেলার সাধারণ ও রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান এবং আদালত ব্যতীত সকল অফিসের কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় সাধন করবেন। বিচারকগণ ছাড়া জেলার সকল কর্মচারী গভর্নরের অধীনস্থ থাকবেন। উক্ত আইনে প্রতি জেলায় একটি জেলা প্রশাসন পরিষদ”-এর ব্যবস্থা ছিল। এই পরিষদ নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হতাে (ক) গভর্নর (পদাধিকার বলে পরিষদের চেয়ারম্যান), (খ) জেলা থেকে নির্বাচিত সকল সংসদ-সদস্য, (গ) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (পদাধিকার বলে সচিব), (ঘ) জাতীয় দল তথা বাকশালের জেলা কমিটির সম্পাদক, (ঙ) পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, (চ) জাতীয় দলের চেয়ারম্যান

১৪৯

কর্তৃক মনােনীত একজন দলীয় সদস্য, (ছ) জাতীয় দলের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত দলের পাঁচটি অঙ্গ সংগঠনের একজন করে জেলা প্রতিনিধি, (জ) জাতীয় দলের চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত জেলার অন্তর্গত দলের প্রতিটি থানা ইউনিট থেকে একজন করে প্রতিনিধি, (ঝ) জেলার অন্তর্গত প্রতিটি পৌরসভার চেয়ারম্যান, (ঞ) জেলার অন্তর্গত ক্যান্টনমেন্ট বাের্ডের (যদি থাকে) একজন প্রতিনিধি (বাের্ড কর্তৃক মনােনীত), (ট) সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর ও জাতীয় রক্ষী বাহিনীর প্রধানগণ কর্তৃক মনােনীত একজন করে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার এবং (ঠ) সরকার কর্তক সময়ে সময়ে নির্ধারিত সরকারি ও স্থানীয় সংস্থাসমূহের কিছু সংখ্যক কর্মচারী। জেলা প্রশাসন পরিষদে মনােনীত যে-কোনাে সদস্যের মনােনয়ন বাতিল করে মনােনয়ন দানকারী কর্তৃপক্ষ যে কোনাে সময় তার জায়গায় অন্য সদস্য মনােনয়ন দান করতে পারতেন।

জেলা প্রশাসন কাউন্সিলের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ : 

(ক) জেলা প্রশাসন সংক্রান্ত যে-কোনাে বিষয় সম্পর্কে আলােচনা ও গভর্নরের নিকট সুপারিশ প্রদান।

(খ) জেলার অভ্যন্তরে সকল উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন কাজ তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করা। 

(গ) সরকারের অনুমােদন সাপেক্ষে, জেলার জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

জেলা প্রশাসন পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতাে, কিন্তু তার সিদ্ধান্তসমূহ গভর্নরের নিকট বাধ্যতামূলক ছিল না। পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ বিবেচনা ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গভর্নরের নিকট পেশ করতে হতাে। গভর্নর যদি পরিষদের কোনাে সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতেন তবে তিনি তা রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করতেন এবং সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হতাে। অতএব, জেলা প্রশাসন পরিষদ ছিল কার্যত একটি উপদেষ্টা পরিষদ। জেলা প্রশাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকৃত ক্ষমতা ছিল গভর্নরের হাতে, যিনি একমাত্র রাষ্ট্রপতির নিকট দায়ী ছিলেন।১৭

জেলা প্রশাসন আইনের ঘােষিত লক্ষ্য ছিল প্রশাসনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। জেলা প্রশাসন পরিষদে রাজনীতিক, বেসামরিক আমলা, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক ও মহিলা প্রভৃতি সকল স্তরের জনগণের সমাবেশ ঘটানাের একটা চেষ্টা ছিল। কিন্তু যেহেতু, পরিষদ প্রধানত মনােনীত সংস্থা ও কার্যত একটি বিতর্ক সভা, সেহেতু গণ-প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর বৈধতা বহুলাংশে ক্ষুন্ন করা হয়। তবে নতুন জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা আমলাতন্ত্রের প্রশাসনিক একচেটিয়া ক্ষমতা হ্রাস করে। এই ব্যবস্থায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ (সরকারি আমলা) গভর্নরের অধীন ছিলেন এবং গভর্নরদের অধিকাংশই ছিলেন রাজনীতিক। ১৯৭৫ সালের ১৭ই জুলাই তারিখে নিযুক্ত ৬১ জন গভর্নরের মধ্যে ৪৭ জন (৭৭%) ছিলেন রাজনীতিক (তাঁদের মধ্যে ৪৪ জনই ছিলেন আওয়ামী 

১৫০

লীগ দলভুক্ত)। অবশিষ্টদের মধ্যে ১৩ জন (২২%) ছিলেন বেসামরিক আমলা এবং একজন সামরিক অফিসার। ১৮

উল্লেখ্য যে, ১ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে গভর্নরদের স্ব স্ব জেলায় দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ফলে নতুন জেলাপ্রশাসন। ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। 

সরকার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সচিবালয়সহ সকল প্রশাসনিক স্তরে আমূল পরিবর্তন সাধনের পরিকল্পনাও গ্রহণ করে। থানা প্রশাসনকে নতুন জেলা প্রশাসনের অনুকরণে পুনর্গঠন করা হতাে। সেখানে জেলা পরিষদের মতাে থানা। প্রশাসন পরিষদ ও থানা গভর্নরের ব্যবস্থা থাকত। দ্রুত ও কম খরচে বিচার অনুষ্ঠানের উপযােগী করে বিচার বিভাগকেও ঢেলে সাজানাে হতাে।১৯

গ. গ্রাম সমবায় পরিকল্পনা 

বাকশাল সরকার মালিকানা পদ্ধতির কোনাে মৌলিক পরিবর্তন করেনি, এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের আপেক্ষিক ভূমিকা ও আওতা পূর্ববৎ বহাল থাকে।

মিশ্র অর্থনীতির কাঠামাের মধ্যেই সরকার উৎপাদন বৃদ্ধির ও সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাকশাল সরকার কর্তৃক গৃহীত তাৎপর্যপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছিল গ্রাম সমবায় পরিকল্পনা।

১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সরকার ঘােষণা করে যে, পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি বহুমুখী গ্রাম সমবায় সমিতি প্রবর্তিত হবে। গ্রাম সমবায় সমিতিগুলাে ভূমি মালিক, ভূমিহীন কৃষক এবং গ্রামের অন্যান্য কর্মক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে। জমির মালিকানা অক্ষুন্ন থাকবে, কিন্তু ভূমি মালিকদের বাধ্যতামূলকভাবে সমবায়ে যােগ দিতে হবে। সমবায়ে উৎপন্ন দ্রব্যাদি ভূমি-মালিক, কৃষক ও সরকারের মধ্যে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে বণ্টন করা হবে। সরকার ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে ৬০ থেকে ১০০টি গ্রামকে সমবায় পদ্ধতির অধীনে আনয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সে উদ্দেশে সংশ্লিষ্ট অর্থ বছরের বাজেটে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।২০

গ্রাম সমবায় পরিকল্পনার ঘােষিত উদ্দেশ্য ছিল, সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, “শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমবায় সমিতিসমূহের উৎপন্ন সামগ্রী ভূমি-মালিক, কৃষক, সরকার ও সমবায়ের সঙ্গে জড়িত অন্যান্যদের মধ্যে কেবল তাদের উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তিতে নয়, বরং তাদের প্রয়ােজনের দিকে দৃষ্টি রেখে বণ্টন করা হবে।”২১

গ্রাম সমবায়ের ফলে ভূমিহীন কৃষকদের কর্মসংস্থানও হতাে। তাদেরকে আর ভূমি মালিকদের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতাে না, বরং সমবায় সমিতির সদস্য হিসাবে অধিকার বলেই তারা কাজ এবং ন্যয়সঙ্গত পারিশ্রমিক পেতাে। সরকার ক্রমান্বয়ে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বসমূহ গ্রাম সমবায়গুলাের ওপর অর্পণের পরিকল্পনাও গ্রহণ করে।২২

১৫১

২. দ্বিতীয় বিপ্লবের ফল 

“দ্বিতীয় বিপ্লব”-এর ঘােষিত উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং এর ফলে বৈধতা, জাতীয় একাত্মতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সরকারের সমস্যাসমূহ আরাে জটিল হয়, যা দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করে।

(ক) বৈধতার সমস্যা 

চতুর্থ সংশােধনীটি ছিল কার্যত এক রকমের “সাংবিধানিক অভ্যুত্থান” এবং “দ্বিতীয় বিপ্লব” এর কর্মসূচি ছিল সরকার কর্তৃক গৃহীত এক পক্ষীয় সিদ্ধান্ত। “দ্বিতীয় বিপ্লব” সূচিত পরিবর্তন প্রধান সামাজিক শক্তিসমূহের নিকট সাধারণ গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

রাজনৈতিক দলসমূহ: বিরােধী দলসমূহের মধ্যে কেবল বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) চতুর্থ সংশােধনীর প্রতি স্বাগত জানায়। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই পরিবর্তন মেনে নেয়নি। চরম বামপন্থীরা, যারা শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল তারা মনে করতাে যে, আওয়ামী লীগ সামন্তবুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল এবং “শােষিতের গণতন্ত্র” তথা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি পালনে তার আন্তরিকতা বা সামর্থ্য কোনােটাই নেই। সুতরাং তারা বাকশালে যােগ দেয়নি এবং তাদের অনেকেই আত্মগােপনে চলে যায় ও সশস্ত্র কার্যকলাপ জোরদার করে।

কিছু সংখ্যক বিরােধী দলীয় নেতা, যারা বাকশালে যােগদান করেন তাদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান, জাগমুই’ সভাপতি হাজি মােহাম্মদ দানেশ এবং ন্যাপ (ভাসানী) সহ-সভাপতি আব্দুল করিম। কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে যােগদান করেন, নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নয় এবং বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে নয় বরং কৌশলগত বা সুবিধাবাদের কারণে বাকশালে যােগ দেন। পরবর্তীকালে আতাউর রহমান খান বলেন, তিনি বাকশালে যােগদান করেন, তার অর্থ এই নয় যে, তিনি একদলীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। বরং বাকশালের ভিতর থেকে বাকশাল কনসেপ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি তাতে যােগ দেন। অনুরূপভাবে হাজি দানেশও বলেন যে, তিনি কৌশলগত কারণে বাকশালে যােগদান করেন।২৩

জাসদের তিনজন সংসদ-সদস্যের মধ্যে একজন বাকশালে যােগ দেন। কিন্তু সে কারণে তাঁকে দলচ্যুত হতে হয়।

বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) সংগঠনগতভাবে বাকশালে যােগ দিলেও তাদের কিছু গুরুতর আপত্তি ছিল। চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, এই

সব মস্কোপন্থী গােষ্ঠীগুলাে “মধ্যস্তরের জনগণের যােগসাজেশে শান্তিপূর্ণ • নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করে তাকে বাম পথে টেনে আনার কৌশল গ্রহণ করে। সে উদ্দেশে তারা ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করে। কিন্তু তারা মনে করত যে, আওয়ামী লীগ মধ্যস্তরের জনগণের একটি দল হলেও সেই দলের

১৫২

মধ্যে কিছু সংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ, প্রতিক্রিয়াশীল, বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী লোেক ছিলেন যারা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে বাধা স্বরূপ। সেজন্য বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি কিছুদিন ধরে “শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান আওয়ামী লীগ সরকারের স্থলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের সমবায়ে একটি সৎ, দক্ষ, দৃঢ় ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠনের ডাক দিয়ে আসছিল।২৪

এটা ছিল মধ্য স্তরের জনগণের সাথে ঐক্য ও একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বাধাসমূহ অপসারণের আহ্বান।২৫

এভাবে তারা একটা ত্রিদলীয় জোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের “ভালাে অংশের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চেয়েছিল, যে জোটের মধ্যে অঙ্গ দলসমূহের একটা স্বাধীন ও পৃথক সত্ত্বা বজায় থাকবে। কিন্তু যখন একদলীয় । ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তখন মস্কোপন্থী দলগুলাে তাতে সমর্থন জানায়, কারণ তারা আশংকা করে যে, “দেশপ্রেমিক” শক্তিসমূহের সমর্থনের অভাবে মুজিব সরকারের পতন ঘটলে “স্বাধীনতা ও প্রগতি বিরােধী” ইসলামী ডান ও পিকিং পন্থী অতিবাম শক্তিসমূহ ক্ষমতা দখল করতে পারে।২৬

সুতরাং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) বাকশালের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্ম হয়ে যায়নি; বরং তারা বাকশালের মধ্যেই তাদের পৃথক অস্তিত্ব। বজায় রাখার চেষ্টা করে।২৭

এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখযােগ্য মতভেদ ছিল। আওয়ামী লীগের একটি অংশ সংসদীয় গণতন্ত্রকে ঔপনিবেশিক অতীতের উত্তরাধিকার বলে নিন্দা করে এবং একদলীয় ব্যবস্থাকে শােষণমুক্ত নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য উপযােগী একটি অনন্য রাজনৈতিক দর্শন বলে অভিহিত করে।২৮

দলের অপর একটি অংশ মনে করতাে যে, সংসদীয় গণতন্ত্রই দেশের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী সংসদীয় দলের সভায় যখন সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রশ্নটি আলােচিত হয় তখন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ নেতা (যেমন, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, ইত্তেফাকের সম্পাদনা পরিষদের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন, ছাত্র লীগের প্রাক্তন নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী) সাংবিধানিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জোরালাে প্রতিবাদ জানান। উক্ত সভায় উপস্থিত একজন সংসদ-সদস্যের অনুমান যে, অন্তত ৩০% সদস্য নতুন ব্যবস্থার বিরােধী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবের সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্ব এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তাজনিত আতংকের কারণে বেশির ভাগ সদস্য নিচুপ থাকেন।২৯

সংবিধান সংশােধনের প্রশ্নে তীব্র মতভেদের কারণে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ওপর ন্যস্ত করে এবং মুজিব এক দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। এর প্রতিবাদে জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন সংসদ-সদস্য পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু যারা বাকশালে যােগদান করেন তাদের অনেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই পরিবর্তনকে একটা

১৫৩

অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে কিংবা কৌশলগত কারণে মেনে নেন। এ সম্পর্কে ইত্তেফাক ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনােয়ার হােসেনের মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন : “যাহােক, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবােধের অনেক কিছুই হারিয়েছে যার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজেই সংগ্রাম করেছেন। এটা বিশ্বাস করা কঠিন নয় যে, বঙ্গবন্ধু এমন কিছুই করবেন না যা তাঁর সগ্রামী ঐতিহ্য বিরােধী। কে বলতে পারে যে, বর্তমান সংকট উত্তরণের জন্য তিনি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তা নেহায়েৎ সাময়িক নয়”?৩০

বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় : সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীসহ বুদ্ধিজীবী মহলের এক বিরাট অংশ একক দল বাকশালে যােগদানের জন্য এগিয়ে আসে। প্রায় পুরাে সাংবাদিক ও স্কুল শিক্ষক সম্প্রদায় বাকশালে যােগদান করে। ছ’টির মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ জন শিক্ষক আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দলে যােগ দেন।৩১ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক শিক্ষক বাকশাল সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করেন।৩২ তবে নবাগতরা বাকশালের প্রতি কতটুকু অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন তা ভাববার বিষয়।

মনে হয় যাঁরা বাকশালের সদস্যপদ চান বা গ্রহণ করেন তাঁদের অনেকেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে নয় বরং ভয় কিংবা সুবিধাবাদের কারণে তা করেন। এমনকি তাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি বাকশালের অভ্যন্তরে থেকে গােটা ব্যবস্থাকে বানচাল করার মানসে নতুন দলে যােগদান করেন। সাংবাদিকগণ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বাকশালে যােগ দেন এবং তারা তা করেন নিজেদের স্বার্থের তাগিদেই। বাকশাল সরকার চারটি দৈনিক ও ১১২টি সাময়িকী ছাড়া সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেন এবং দৈনিকসমূহ ও অধিকাংশ সাময়িকীর মালিকানা অথবা ব্যবস্থাপনা সরকার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। সুতরাং অনেকের জন্য চাকরির নিরাপত্তাই ছিল মূল বিবেচ্য। স্কুল শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কারণ প্রযােজ্য, কারণ তাদের অধিকাংশই ছিলেন সরকারি চাকুরে।

এমন কি যে সব ব্যক্তি স্বতস্ফূর্তভাবে বাকশালে যােগদান করেন তাঁদের অনেকেই নতুন ব্যবস্থার চেয়ে নেতার প্রতিই অধিক অনুগত ছিলেন। বাকশাল সদস্যপদের জন্য যথারীতি স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে দরখাস্ত না করে বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠীসমূহ সরাসরি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আবেদন পেশ করতে থাকে এবং এই সব আবেদন ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রশংসায় ভরপুর, নতুন ব্যবস্থার জন্যে নয়।৩৩

আমলাতন্ত্র : বাকশাল গঠনতন্ত্রের বিধান ছিল যে, বিচারকগণ ব্যতীত যেকোনাে সরকারি কর্মচারী দলের সদস্য হতে পারবেন। অংশত দলীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের এই প্রথম সুযােগ এবং অংশত চাকরির স্বার্থ নতুন ব্যবস্থার প্রতি বেসামরিক কর্মচারীদের প্রচুর আগ্রহের সৃষ্টি করে। সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বিপুল সংখ্যায়

১৫৪

বাকশালে যােগদানের জন্য আবেদন করতে থাকেন। কিন্তু এই আগ্রহ নিম্নতন পর্যায়ের চাকুরেদের মধ্যেই অধিক পরিলক্ষিত হয়। যেখানে এক লক্ষ সদস্য বিশিষ্ট চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতির সদস্যগণ সমষ্টিগতভাবে দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেন,৩৪ সেখানে পূর্বতন সি এস পি ও ই পি সি এস ক্যাডারভুক্ত উৰ্দ্ধতন কর্মকর্তাদের অধিকাংশ বাইরে থেকে যান।

খ. জাতীয় ঐক্যের সমস্যা 

বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক, আমলা, শিক্ষক, পেশাজীবী, সৈনিক প্রভৃতি সকল শ্রেণির মানুষকে “জাতীয় দল” বাকশালের পতাকাতলে সমবেত করে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।৩৫ 

শত সহস্র মানুষের ব্যক্তিগত অথবা গােষ্ঠীগতভাবে বাকশালে যােগ দিতেও শুরু করেন। কিন্তু নতুন সরকার এবং দল কার্যত ছিল আওয়ামী লীগেরই বর্ধিত রূপ। রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহকে একত্রিত করে জাতীয় সমস্যাবলি আলােচনা ও সেগুলাের সমাধান সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কোনাে সযত্ন প্রচেষ্টা ছিল না। বস্তুত বিরােধী দলগুলােকে কখনও আস্থায় নেয়া হয়নি। বরং শাসকবর্গ বিরােধী শক্তিসমূহকে জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু অথবা বিদেশি শক্তির চর বলে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলা সম্ভব হয়নি।

গ. অংশ গ্রহণের সমস্যা 

বাকশাল সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। কিন্তু ক্ষমতা এক ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রপতির হাতে পুঞ্জিপূত করা হয়। ফলে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের আওতা দারুণভাবে সংকুচিত হয়। নতুন ব্যবস্থার অধীনে সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করা কিংবা ক্ষমতা কাঠামােতে পরিবর্তন আনার অবকাশ ছিল খুব কম। জাতীয় দল কর্তৃক মনােনীত না হলে কোনাে ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি কিংবা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না। নির্বাচনে প্রার্থী মনােনীত করার ক্ষমতা ছিল দলের পার্লামেন্টারী বাের্ডের হাতে। কিন্তু এই পার্লামেন্টারী বাের্ড রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত হতাে। সুতরাং ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টারী বাের্ডের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের আসনকে স্থায়ী করতে পারতেন এবং জাতীয় সংসদেও নিজের পছন্দমতাে লােক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারতেন।

দলের অভ্যন্তরে অসন্তোষের চাপ এবং বাইরে থেকে সমালােচনার কার্যকারিতা হ্রাসের লক্ষ্যে এক ধরনের প্রতিযােগিতা মূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়। একদলীয় ব্যবস্থার অধীনে যে সব উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেগুলােতে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল দুই থেকে পাঁচ। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে অংশগ্রহণের আগ্রহ সমুন্নত রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে যেখানে ভােটারদের উপস্থিতি ছিল ৪০% সেখানে ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে তা ছিল মাত্র ২৪% (সারণি ৬.১ দ্রষ্টব্য)।

১৫৫

সারণি ৬.১ 

রাজশাহী-১৪ নির্বাচনী এলাকায় ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত

উপনির্বাচনে ভােটারদের উপস্থিতির তুলনামূলক হার

বছর নিবন্ধনকৃত ভােটারদের সংখ্যা প্রদত্ত ভােটের সংখ্যা শতকরা হার
১৯৭৩ ১,১৬,৭৫৯ ৪৬৭১৪ ৪০
১৯৭৫ ১,১৬,৭৫৯ ২৮১০২ ২৪

উৎস : বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, Report on the First General Election to Parliament in Bangladesh, ঢাকা, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১০৫; The Bangladesh Times, ২২ জুলাই, ১৯৭৫।

সংসদীয় রাজনীতিতেও অংশগ্রহণের হার ছিল তুলনামূলকভাবে কম। একদলীয় ব্যবস্থার অধীনে সংসদের একটি মাত্র অধিবেশন (১৯৭৫-এর বাজেট অধিবেশন) অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে সংসদ ২০ দিনে ৪৭ ঘণ্টা কর্মরত ছিল এবং সেই সময়ে মােট ৪২টি বিল পাস করে। অপরপক্ষে ১৯৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনে সংসদ ৩৭ দিনে ১২৯ ঘণ্টা কর্মরত ছিল এবং এই অধিবেশনে ৩২টি বিল পাস হয়। সুতরাং ১৯৭৫ সালের বাজেট অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনের তুলনায় অনেক বেশি আইন প্রণয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়। এর অর্থ হলাে এই যে, ১৯৭৪ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে সংসদ-সদস্যগণ আলােচনার জন্য কম সময় ও সুযােগ লাভ করেন। বস্তুত এক-দলীয় ব্যবস্থায় অধিকাংশ বিলই বিতর্ক ছাড়াই গৃহীত হয়।

১৯৭৫ সালের বাজেট অধিবেশনের মােট ৪২টি বিলের মধ্যে মাত্র তিনটি অর্থাৎ ৭% সংশােধিত আকারে গৃহীত হয়। অথচ ১৯৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনে সংশােধিত আকারে গৃহীত বিলের সংখ্যা ছিল ৭টি, অর্থাৎ মােট বিলের ২২%। ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের অনুপাতও ১৯৭৪ সালের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ১৯৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনে গৃহীত ৩২টি বিলের মধ্যে ২৩টি অর্থাৎ ৬০% ছিল মৌলিক এবং নয়টি, অর্থাৎ ৪০% অধ্যাদেশ আকারে পূর্বেই জারি করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের বাজেট অধিবেশনে গৃহীত ৪২টি বিলের মধ্যে মাত্র আটটি, অর্থাৎ ১৯% ছিল মৌলিক এবং ৩৪ টি অর্থাৎ ৮১% ছিল অধ্যাদেশ। পূর্বে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সংসদ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সংসদে প্রশ্ন জিজ্ঞাসার নিয়ম স্থগিত করা হয়। তত্ত্বগতভাবে যদিও সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতি (প্রস্তাব উত্থাপন) বহাল থাকে, কার্যত সেগুলাের কোনাে প্রয়ােগ হয়নি। এর ফলে সংসদের মূল্য ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এবং সংসদে সদস্যদের উপস্থিতির গড়ও হ্রাস পায়। যেখানে ১৯৭৪ সালের বাজেট অধিবেশনে সংসদে দৈনিক উপস্থিতির গড় ছিল ২৩৭.৬৫, সেখানে ১৯৭৫ সালের বাজেট অধিবেশনে সে গড় কমে দাঁড়ায় ২২৬.৬৫ (দেখুন সারণি ৬.২)।

১৫৬

সারণি ৬.২

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কর্মকাণ্ড : ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালের বাজেট অধিবেশনের তুলনামূলক চিত্র

  ১৯৭৪ ১৯৭৫
১। মােট কর্ম দিবস ৩৭ ২০
২। মােট কর্ম ঘণ্টা ১২৯ ৪৬.৫৪
৩। সদস্য উপস্থিতির দৈনিক গড় ২৩৭.৬৫ ২২৬.৬৫
৪। উত্থাপিত বিলের সংখ্যা : ৩২ ৪২
(ক) মৌলিক বিল ২৩(৬০) ৮৪(১৯)
(খ) অধ্যাদেশ ৯(৪০) ৩৪(৮১)
৫। বিলের সংখ্যা : গৃহীত ৩২ ৪২
(ক) সংশােধিত আকারে ৭(২২) ৩(৭)
(খ) সংশােধনী ছাড়া ২৫(৭৮) ৩৯(৯৩)
৬। মুলতবী প্রস্তাব :    
(ক) প্রাপ্ত নােটিশের সংখ্যা  
(খ) সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবের সংখ্যা
৭। সংক্ষিপ্ত আলােচনার প্রস্তাব :    
(ক) প্রাপ্ত নােটিশের সংখ্যা  
(খ) সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবের সংখ্যা  
৮। দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রস্তাব :    
(ক) প্রাপ্ত নােটিশের সংখ্যা ৪৮  
(খ) সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবের সংখ্যা  
৯। সিদ্ধান্ত প্রস্তাব :    
(ক) প্রাপ্ত নােটিশের সংখ্যা ১১৯  
(খ) সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবের সংখ্যা  

দ্রষ্টব্য : বন্ধনীর মধ্যেকার সংখ্যা শতকরা হারের সূচক। সূত্র : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যবাহের সারাংশ, পঞ্চম (১৯৭৪ বাজেট) ও অষ্টম (১৯৭৫ বাজেট) অধিবেশন।

ঘ. সরকারের কৃতি 

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখা গেছে যে, আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, গভীর অর্থনৈতিক সংকট এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযােগ শাসকবর্গের জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। “দ্বিতীয় বিপ্লব” বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে তাৎক্ষণিক সাফল্য দেখাতে পারেনি।

আইনশৃংখলা পরিস্থিতি : ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আরােপিত জরুরি অবস্থায় কড়াকড়ি সত্ত্বেও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। সরকারি স্থাপনাসমূহের ওপর সশস্ত্র হামলা, গােপন রাজনৈতিক হত্যা, হাট-বাজার-ট্রেজারি ও

১৫৭

গুদাম লুট, সশস্ত্র ডাকাতি, ছিনতাই, ইত্যাদি কারণে নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি অব্যাহত থাকে। চতুর্থ সংশােধনী গৃহীত হবার পর প্রথম দু’মাসে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সরকারি বাহিনী ও চরমপন্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫টি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ১২ জন সদস্য প্রাণ হারান। এ সময়ের মধ্যে একজন সংসদ সদস্যসহ ১৩ জন আওয়ামী বাকশাল নেতা নিহত হন, তিনজন সংসদ-সদস্যের জীবন নাশের চেষ্টা করা হয়, একজন সংসদ-সদস্যের বাড়িতে আগুন। ধরিয়ে দেয়া হয় এবং ঢাকা ও দেশের বহু স্থানে বােমাবাজির ঘটনা ঘটে।৩৭

অর্থনীতি : বাকশাল শাসন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও উল্লেখযােগ্য উন্নতি বিধানে ব্যর্থ হয়। শিল্প ও কৃষি উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদন হ্রাস পায়। ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে খাদ্য শস্যের মােট উৎপাদন ছিল ১১.৫ মিলিয়ন টন, অথচ ১৯৭৩-৭৪ সালে এই পরিমাণ ছিল ১১.৮ মিলিয়ন টন। এভাবে ১৯৭৪-৭৫ সালের খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭৩-৭৪ সালের তুলনায় ৩% এবং ১৯৭৪-৭৫ সালের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১২.৬% কম ছিল। ১৯৭৪-৭৫ সালে শিল্প উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ১০% বেশি, কিন্তু বাস্তবে শিল্প উৎপাদন ১০% হ্রাস পায়।৩৮

তবে, ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ নতুন ফসল উঠা ও আমদানির ফলে খাদ্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। একশত টাকার নােট বাতিল, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক ঋণের ওপর কড়াকড়ি আরােপ এবং অর্থ সরবরাহ হ্রাস, ইত্যাদি পদক্ষেপ অর্থনীতির ওপর কিছুটা শুভ প্রভাব ফেলে। নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য সামান্য হ্রাস পায়। জীবন যাত্রার ব্যয়ের সূচক সর্বোচ্চ ৪৫৮.৫ (জানুয়ারি, ১৯৭৫) থেকে জুন মাসে ৪০৯.৭-এ নেমে আসে। তবুও ব্যয়ের এই সূচক দুর্ভিক্ষ-কবলিত ১৯৭৪ এর জুনের তুলনায় ৩৫% বেশি ছিল। সুতরাং জনসাধারণ তখনাে দুঃসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। তাছাড়া বিদ্যমান মূল্যমানের স্থিতিশীলতা সম্পর্কেও কোনাে নিশ্চয়তা ছিল না। মধ্যবিত্তের জীবন যাত্রার ব্যয় ১৯৭৫ সালের মে মাসে ৪০৭.৮-এ নেমে আসে। কিন্তু জুলাইএ আবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৪.৮ (সারণি ৬.৩ দ্রষ্টব্য)।

সারনি ৬.৩ 

১৯৭৪ ও ‘৭৫ সালে ঢাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার ব্যয়ের সূচক

(ভিত্তি : ১৯৬৯-‘৭০ = ১০০)

মাস ১৯৭৪ ১৯৭৫
জানুয়ারি ২৪৯.৬ ৪৫৮.৫
ফেব্রুয়ারি ২৫৯.২ ৪৪৮.০
মার্চ ২৬৭.২ ৪২৭.৭
এপ্রিল ২৭৮.২ ৪১৬.৯
মে ২৮৪.৪ ৪০৭.৮
জুন ৩০৩.৭ ৪০৯.৭
জুলাই ৩১৬.১ ৪১৪.৮
আগস্ট ৩৫২.৪ ৪০৫.৯
সেপ্টেম্বর ৩৮৪.৬ ৩৯৩.৫
অক্টোবর ৪১৬.৫ ৩১৯.১
নভেম্বর ৪২২.৬ ৩৮২.১
ডিসেম্বর ৪৩০.৩ ৩৭৬.১

১৫৮

উৎস : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা কমিশন, Economic Review, ১৯৭৪-৭৫, পৃষ্ঠা ২৩ ও ১৯৭৫-৭৬, পৃষ্ঠা ৩১-৩২।

বাধ্যতামূলক গ্রাম সমবায় পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। কিন্তু এটা ছিল একটা দীর্ঘমেয়াদী পাঁচশালা পরিকল্পনা। ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের মধ্যে মাত্র ৬০ থেকে ১০০টি গ্রাম এই পরিকল্পনার আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সুতরাং দূরবর্তী ও অনিশ্চিত ফলের কারণে এই পরিকল্পনা জনসাধারণের মধ্যে উল্লেখযােগ্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। গরিব ও প্রান্তিক কৃষকগণ যারা এই পরিকল্পনার দ্বারা সর্বাধিক উপকৃত হতে পারতেন তাদেরকেও এই ব্যাপারে সচেতন বা উদ্বুদ্ধ করা হয়নি। অপরপক্ষে উদ্বৃত্ত ও মধ্যস্তরের কৃষকগণ, যারা কৃষি জমির মালিক ছিলেন এবং ক্ষেতমজুর কিংবা বর্গাদারদের দ্বারা জমি চাষ করাতেন তাঁদের স্বার্থ এই পরিকল্পনার দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়। বর্গা প্রথার অধীনে সাধারণত জমির ফসল মালিক ও চাষিদের মধ্যে আধা-আধির ভিত্তিতে ভাগ হতাে এবং ভূমিহীন শ্রমিকদের মজুরি। বহুলাংশে ভূমি মালিকদের মর্জির ওপর নির্ভর করত। নতুন পরিকল্পনার অধীনে, ভূমি মালিক শ্রেণি, বিশেষ করে উদ্বৃত্ত কৃষকরা কেবল তাদের প্রাপ্য ফসলের ব্যাপারেই উৎকণ্ঠিত ছিলেন না, এর দ্বারা তাদের সামাজিক মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হয়। গ্রামীণ গরিব কৃষকদের যদি সমবায় সমিতির সমান অংশীদার হিসেবে কাজ করার অধিকার দেয়া হতাে তাহলে গ্রামীণ সমাজে ধনীদের আধিপত্য ক্ষুন্ন হতাে। সুতরাং বড় জোতদারগণ, যারা গ্রামীণ এলাকায় শাসক দলের প্রধান সমর্থন ভিত্তি। ছিলেন, তারা সমবায় পরিকল্পনাকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি। রাষ্ট্রপতি মুজিব সমবায় পরিকল্পনার বিরােধীদের বিরুদ্ধে উন্মা প্রকাশ করেন।৩৯ কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তিনি জনগণকে সমবায় পরিকল্পনার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হন।

আমলা ও রাজনীতিকদের সম্পর্ক : জাতীয় দল তথা বাকশাল গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আমলা ও রাজনীতিকদের সমবায়ে একটা মিশ্র কাঠামাে নির্মাণ করা। কিন্তু, একই সঙ্গে শাসকবর্গ আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। মুজিব তখনাে বিশ্বাস করতেন “একজন সার্কেল অফিসার (সরকারি কর্মচারী) অপেক্ষা যে-কোনাে রাজনৈতিক কর্মী উত্তম, যদি সেই রাজনৈতিক কর্মী

১৫৯

আন্তরিক হন। যদি রাজনৈতিক সংগঠন শক্তিশালী না হয়, তবে কেবল সরকারি কর্মচারীদের ওপর নির্ভর করে দেশের মঙ্গল করা যেতে পারে না। অবশ্যই একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। জনগণকে অবশ্যই সংগঠিত করতে হবে।৪০

বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সরকারি কর্মচারীদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব (প্রায় ১৯%) দেয়া হয়। কিন্তু তারা সরকারি কর্মচারীগণ কর্তৃক নির্বাচিত না হয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাঁর বিশ্বাসভাজনদের মধ্য থেকে মনােনীত ছিলেন। এর ফলে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে একরূপ অবহেলা বা বঞ্চনার মনােভাব সৃষ্টি হয়। তার চেয়ে বড় কথা ছিল এই যে, সরকারি কর্মচারীগণ যেখানে পূর্বে ডেপুটি কমিশনার বা মহকুমা অফিসার হিসেবে জেলা ও মহকুমা প্রশাসনে একচেটিয়া ক্ষমতা ভােগ করতেন, সেখানে নতুন ব্যবস্থায় তাদেরকে জেলা গভর্নরদের অধীনস্থ করা হয়, আর এই জেলা গভর্নরদের অধিকাংশই ছিলেন রাজনীতিক। সুতরাং উচ্চ স্তরের আমলারা তাঁদের ক্ষমতা ও বিশেষ অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার কারণে ক্ষুব্ধ হন এবং আমলা ও রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সরকারি কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে জাতীয় সংসদে আলােচনা এবং সে প্রসঙ্গে একজন সংসদ সদস্যের মন্তব্য থেকেই তাদের তিক্ত সম্পর্ক সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সংসদে বিতর্ককালে কামরুল ইসলাম মােহাম্মদ সালেহ উদ্দীন (এম. পি) বলেন :

“আমাদের জনগণের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য যখন তাঁদেরকে (সরকারি কর্মচারীদের) যানবাহনের কথা বলি তখন আমাদের বলা হয় পুলে গাড়ি নাই। কিন্তু তাঁদের স্ত্রী ও চাকরদের বাজার করার জন্য গাড়ি দেয়া হয়। আজ প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের এই সম্পর্ক। 

“জরুরি অবস্থা ঘােষণার পর এবং বিশেষ করে বাকশাল গঠনের পর আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, আমলাদের একটি অংশ—যারা দেশে আমলাতান্ত্রিক শাসন বজায় রাখতে চান, যাঁরা আইয়ুব আমলে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তারা রাজনীতিক, জনগণ এবং আমলাদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির জন্য আবার তৎপর হয়ে উঠেছেন। আজ তারা বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান এবং তাঁকে আইয়ুব খান বানাতে চান। এটা কোনাে মতেই হতে দেয়া যাবে না।”৪১

জাতীয় সংসদে স্পিকারও অভিযােগ করেন যে, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মানসিকতাসম্পন্ন কিছু লােক রয়ে গেছে যারা এখনাে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি; তারা জানে না কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়।৪২

এই সব বাকবিতণ্ডা রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যেকার সম্পর্ক আরাে তিক্ত করে তােলে এবং আমলাদের মনােবল তথা প্রশাসনের দক্ষতা দারুণভাবে ক্ষুন্ন করে।

জাতীয় দলের মধ্যে ঐক্যের অভাব : পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদলীয় ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে এই দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়। আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল অংশ বহুদলীয়

১৬০

সংসদীয় ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষপাতী ছিল। এই অংশ ১৯৭৫-এর সাংবিধানিক পরিবর্তনকে বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে একটা সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা গ্রামীণ সমবায়ের অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচিও পছন্দ করেনি। তাছাড়া, তারা বামপন্থীদের (বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ) সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্যের বিরােধী ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত একটি দৈনিকের সম্পাদক আব্দুল গাফফার চৌধুরী সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের ঐক্যের উদ্যোগ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে ক্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখল করার পুরাতন কৌশলেরই অংশ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সেই ফাঁদে পা না দেবার পরামর্শ দেন।৪৩

আনােয়ার হােসেন (যিনি পরে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনােনীত হন) বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও মােজাফফর ন্যাপের আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং তাদের নিয়ে জাতীয় দল বাকশাল গঠনের বিরােধিতা করেন।৪৪

অন্যদিকে মস্কোপন্থী কম্যুনিস্টরাও (বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ) নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হতে পারেনি। তারা বাকশালের অভ্যন্তরে নিজেদের পৃথক অবস্থান বহাল রাখে এবং ক্ষমতার অধিকতর বখরার জন্য মুজিবের ওপর চাপ দিতে থাকে। মুজিবও রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের কার্যকারিতা সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সম্ভাব্য সাংগঠনিক শূন্যতার কারণে তিনি আওয়ামী লীগকে পরিহার করতে পারেননি। সুতরাং তিনি প্রাথমিকভাবে আওয়ামী লীগ সহকর্মীদের নিয়ে সরকার ও জাতীয় দল গঠন করেন। কিন্তু তিনি অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের জায়গায় আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে ভালাে লােক নিয়ে ধীরে ধীরে তার সরকার ও দলকে পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।৪৫

এই পরিকল্পনা দলের রক্ষণশীল সদস্যদের মধ্যে অনিশ্চয়তার মনােভাব সৃষ্টি করে এবং দলের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

৩. ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান

বাকশাল সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি কার্যকর হওয়ার পূর্বেই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে সংঘটিত এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। অভ্যুত্থানকারীরা মুজিব মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম সদস্য খন্দকার মােশতাক আহমদকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত করে। সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অধিনায়ক নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে এই পরিবর্তনকে মেনে নেন। 

এটা মনে করা হয় যে, সেনাবাহিনীর তিনজন পদচ্যুত অফিসারসহ ২০ থেকে ৩০ জন মেজর ও ক্যাপ্টেন গােলন্দাজ বাহিনীর প্রায় ১৪০০ সৈন্যের সমর্থনে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ঘটান।৫৬

সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসার এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।

১৬১

তারা এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হতে চাননি, কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করেও দেননি। তাছাড়া, খন্দকার মােশতাকসহ কিছু সংখ্যক মার্কিনপন্থী রক্ষণশীল আওয়ামী লীগ নেতাও এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন বলে মনে করা হয়।৪৭

অধ্যাপক এস ই ফাইনারের মতে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে সামরিক অভ্যুত্থানের মূল কারণ হচ্ছে দুটি, (১) সশস্ত্রবাহিনীর মনােবৃত্তি ও (২) সুযােগ।৪৮ সামরিক এলিটদের ব্যক্তিগত, গােষ্ঠীগত বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ বিঘ্নিত হলে কিংবা তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটদের অনুসৃত নীতি জাতীয় স্বার্থ বিরােধী বলে মনে করলে তাদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্রবৃত্তি জন্মে। আর জনগণের রাজনৈতিক কৃষ্টি নিম্নমানের হলে, অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি জনগণের গভীর আনুগত্য না থাকলে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের সুযােগ পায়। তবে এস পি হান্টিংটন জোর দিয়ে বলেন যে, সামরিক হস্তক্ষেপের প্রধান কারণ সামরিক নয়, বরং রাজনৈতিক।৪৯ অর্থাৎ দেশে শক্তিশালী ও কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবর্তমানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের সুযােগ পায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মনােবৃত্তি ও সুযােগ ঘটে থাকে। বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের কারণসমূহের নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে।

ক. মনােবৃত্তি

আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক লে. কর্নেল ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতি মুজিবকে হত্যা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সপক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তি প্রদর্শন করেন :৫০

১. আওয়ামী লীগের লােকেরা একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা করলে সামরিক এলিটগণ তার বিচার চান, কিন্তু শেখ মুজিব তা না করে তাঁর “দলীয় অনুচরদের প্রশ্রয় দেন। 

২. ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও খেয়ালের কারণে মুজিব গােটা জাতিকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করেন, যে জাতি তাকে স্বেচ্ছায় জনকের আসনে আসীন করেছিল। 

৩. যখন দেশের মানুষ না খেয়ে মরছিল তখন তার আওয়ামী লীগ ও দুর্নীতিবাজ আমলারা দেশের সম্পদ লুট করে। 

৪. তাঁর “দুর্নীতিপরায়ণ ও অথর্ব প্রশাসন” দেশকে বিদেশি শক্তির হাতে তুলে দেয়। 

৫. মুজিব ইসলাম ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন, যে ধর্ম জাতিকে অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে আদর্শিক প্রেরণা যােগাতে পারত। 

৬. মুজিবের হাতে সশস্ত্র বাহিনী অপমানিত ও ভয়ানকভাবে অবহেলিত হয়।

ওপরের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অভ্যুত্থানকারীদের কিছু ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত ক্ষোভ এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কিছু আদর্শিক এবং নীতিগত মতভেদ ছিল, যা তাদেরকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে প্ররােচিত করে। সশস্ত্র বাহিনীর

১৬২

সদস্যদের মধ্যেও সাধারণ অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল, যার ফলে তারা ১৫ আগস্টের পরিবর্তনকে মেনে নেয়। 

লে. কর্নেল ফারুক রহমান কথিত ধর্ষণ ও হত্যার নিশ্চিত প্রমাণ না থাকলেও একথা সম্ভবত সত্য যে, আওয়ামী লীগের একজন সদস্য একজন সামরিক অফিসারের স্ত্রীকে অপমানিত করেন এবং তার প্রত্যাশিত বিচার হয়নি।৫১ ফলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয়ত ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বে-আইনি অস্ত্র উদ্ধার এবং দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ রােধের উদ্দেশে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। এর ফলে কেবল সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিকট সরকারের দুর্বলতা উন্মােচিত হয়নি, তাদের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কারণ, ১৯৭৪ সালের অভিযানে যখন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন মাঝপথে তাঁদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এবং বাড়াবাড়ির অভিযােগে কয়েকজন অফিসারকে পদচ্যুত করা হয়। উল্লেখ্য যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের নায়কদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বরখাস্তকৃত সামরিক অফিসার।

তৃতীয়ত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ক্ষোভের সবচেয়ে বড় ও সাধারণ কারণ ছিল সামরিক বাহিনীর প্রতি ক্ষমতাসীনদের অবহেলামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে সামরিক আমলাদের প্রাধান্য ও নিপীড়ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটদের মধ্যে সামরিক বাহিনীর প্রতি গভীর ঘৃণা ও অবিশ্বাসের মনােভাব সৃষ্টি করে।৫২ সুতরাং বাংলাদেশের নতুন শাসকবর্গ রাজনীতিতে সামরিক প্রাধান্য দূর করতে চান। তারা ঘােষণা করেন যে, “রাষ্ট্র পরিচালনায় জাতীয় সংসদ ও জনগণের সরকারের প্রাধান্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের জাতীয় আদর্শ।৫৩

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দল আরও বিশ্বাস করতাে যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক অভিন্ন লক্ষ্য ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অতএব, “আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য”।৫৪ ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত ২৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির দ্বারা এই বন্ধুত্বকে আরাে সুদৃঢ় করা হয়।৫৫

ক্ষমতাসীন দল হয়তাে মনে করত যে, প্রায় চতুর্দিক বেষ্টনকারী ভারতের মতাে একটা বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে সমরযন্ত্র নির্মাণ করা অর্থহীন। সুতরাং মুজিব একটা বড় ধরনের সামরিক বাহিনী গড়ে তােলার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বলেন,

সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বেশি অর্থ ব্যয়ের প্রয়ােজন নেই। আমি সেনাবাহিনীকে জনগণের বাহিনী হিসেবে দেখতে চাই। আমি চাই না আমার সেনাবাহিনী অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুক। কিন্তু আমি চাই, আমার সেনাবাহিনী নিজের দেশকে রক্ষা করুক এবং সেই সঙ্গে (দেশ গড়ার) কাজ করুক।৫৬ 

যেখানে পাকিস্তান আমলে সামরিক খাতে রাজস্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হতাে সেখানে বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ছিল মাত্র ১৮.৩%। এবং ১৯৭৫-৭৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২.৫%। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুযােগ-সুবিধা

১৬৩

ছিল নগণ্য এবং তাদের সম্প্রসারণ ভয়ানকভাবে ব্যাহত হয়। অপরপক্ষে, ১৯৭২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী” নামক আধা সামরিক বাহিনী দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে।”৫৭ ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরের তুলনায় ১৯৭৫৭৬ অর্থ বছরে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হয় প্রায় ৮৭%। কিন্তু এই সময়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় ১৯০% (সারণি ৬.৪ দ্রষ্টব্য।)

এভাবে প্রতিরক্ষা খাতে স্বল্প বরাদ্দ যেমন সামরিক বাহিনীর আর্থিক সুখসুবিধা সীমিত করে, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী হিসাবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সম্প্রসারণ তাদের পেশাগত গর্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক সত্তার প্রতি হুমকির সৃষ্টি করে।

চতুর্থত পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০%) অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ তাঁরা স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে আটক থাকাকালীন ১৮ মাসের বেতন পাননি। তাছাড়া পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের দু’বছরের জ্যেষ্ঠ্যত্ব দেয়ার কারণে তাঁরা ক্ষুব্ধ হন।

পঞ্চমত অনুন্নত দেশসমূহের সামরিক বাহিনী কেবল বেতন ও পদোন্নতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, সামগ্রিকভাবে সমাজের মধ্যে ক্ষমতা ও মর্যাদা বণ্টনের ব্যাপারেও আগ্রহী থাকে।৫৮ একদলীয় শাসন প্রবর্তনের ফলে যেমন সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়, তেমনি সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসনও হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানকে। বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হলেও সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বাকশালের প্রাথমিক কমিটিগুলাে রাজনীতিকদের নিয়ে গঠিত বাকশাল নির্বাহী কমিটির নিকট দায়ী ছিল। সামরিক বাহিনীর অনেকে এ ব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ দলীয় নিয়ন্ত্রণ আরােপের চেষ্টা বলে মনে করেন।৫৯

সারণি ৬.৪ 

১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৫-৭৬ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ও জাতীয়

রক্ষীবাহিনীর জন্য বাজেট বরাদ্দ কোটি টাকার অংকে)

অর্থ বছর মােট বাজেট বরাদ্দ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর খাতে বরাদ্দ
পরিমাণ শতাংশ পরিমাণ শতাংশ
১৯৭২-৭৩ ২১৮.৪৩ ৪০.০০ ১৮.৩০ ৭.৭৮ ৩.৫০
১৯৭৩-৭৪ ২৯৫.৩০ ৪৭.০০ ১৬.০০ ১৫.০০ ৫.০০
১৯৭৪-৭৫ ৪৭০.২৩ ৭১.০০ ১৫.০০ ১৫.১২ ৩.২০
১৯৭৫-৭৬ ৫৯৯.১৩ ৭৫.০০ ১২.৫০ ২২.৬৯ ৩.৮০

উৎস : বাংলাদেশ সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জরিপ, ১৯৭১-৭৩, পৃষ্ঠা ৪৮; ১৯৭৩-৭৪; পৃষ্ঠা ৯৮; ১৯৭৪-৭৫ পৃষ্ঠা ১৪১; ১৯৭৫-৭৬, পৃষ্ঠা ৪; মঞ্জুরী ও বরাদ্দের দাবীসমূহ, ১৯৭৩-৭৪, পৃষ্ঠা ৯০ ও ২২৯; ১৯৭৪-৭৫, পৃষ্ঠা ৯২ ও ২২৯; ১৯৭৫-৭৬, পৃষ্ঠা ১১৭ ও ২৬৩।

১৬৪

তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনারা মনে করতেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে তাদের একটা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা থাকবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নীতি অনুসরণ করলে তারা ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মনােবৃত্তি সৃষ্টি হয়। 

সশস্ত্র বাহিনীর একাংশ মুজিব সরকারের বিদেশ নীতি, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী নীতির বিরােধী ছিল। ঐতিহাসিক কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাধারণভাবে ভারত-বিদ্বেষী ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনীর অংশ হিসাবে। বাঙালি সেনারা সেই মনােভাবের অংশীদার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য এবং বাঙালি ও ভারতীয় সেনাদের সম্মিলন সেই বৈরী মনােভাবকে মুছে ফেলতে পারেনি। বরং বাঙালি অফিসার ও সেনাদের অনেকেই মনে করেন যে, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মূল লড়াইটা তাঁরাই করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধে একক বিজয়ের গৌরব থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে।৬০

তাছাড়া পাকিস্তান বাহিনীর কাছ থেকে আটককৃত সমরাস্ত্র ভারতে পাচার, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের ভারতে প্রশিক্ষণদানের ব্যবস্থা, ইত্যাদি কারণেও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারত-বিরােধী মনােভাব বৃদ্ধি পায়। এই ভারতবিরােধী মনােভাব মুজিব-বিরােধী মনােভাবে রূপান্তরিত হয়, এবং মুজিব সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের মনােবৃত্তি সৃষ্টি করে।

বাঙালি অফিসার ও সেনারা অন্যান্য জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের মতাে পাকিস্তানি শাসন ও শােষণের কারণে বিক্ষুব্ধ ছিলেন, এবং ১৯৭১ সালের মার্চ। মাসে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর আক্রমণের মুখে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। কিন্তু মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ সম্পর্কে তাদের কোনাে সম্যক উপলব্ধি ছিল না। পাকিস্তান বাহিনীর অংশ হিসাবে তাদের অনেকেই রক্ষণশীল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেন।৬১

তাদের প্রত্যাশা ছিল জাতীয় জীবনে ইসলাম ধর্মের একটা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা থাকবে। মুজিব কর্তৃক ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রবর্তনকে তারা ইসলামের প্রতি অবমাননা বলে মনে করেন এবং তাঁর সরকারকে উৎখাত করতে চান।

খ. সুযােগ 

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে জনগণের একাত্মতার অভাব সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযােগ করে দেয়। কিন্তু জনগণের এই একাত্মতা নির্ভর করে মূলত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে একটা সাধারণ ঐকমত্য, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিস্তৃতি এবং সরকারের কৃতির ওপর।

১৬৫

১৯৭২ সালে প্রবর্তিত সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে যে ঐকমত্য ছিল তা একদলীয় শাসন প্রবর্তনের ফলে ভেঙে পড়ে। বহুদলীয় সংসদীয় পদ্ধতির অধীনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ প্রকাশ্য বিতর্ক ও পর্যাপ্ত আলােচনা ছাড়াই সেই পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে। অনেকে এই পরিবর্তনকে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত গণরায় ভঙ্গকারী অবৈধ পদক্ষেপ বলে মনে করেন। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গােষ্ঠীসমূহের এক ব্যাপক অংশের নিকট এই নতুন পদ্ধতি গ্রহণযােগ্য ছিল না।

একদলীয় রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযােগ সীমিত করে তার নিজের সাফল্যের সুযােগকেও সীমাবদ্ধ করে ফেলে। বিরােধী দলসমূহ সংসদীয় পদ্ধতির অধীনে যেটুকু অংশগ্রহণের সুযােগ লাভ করত তা থেকেও বঞ্চিত হয়। তাদের বেশির ভাগই আত্মগােপন করে এবং সরকারকে উৎখাত করার জন্য সহিংস কার্যকলাপ জোরদার করে। যেহেতু বাকশালই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন যার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি স্বার্থ জ্ঞাপন করতে পারত, সেহেতু বিভিন্ন স্তরের লােকজন তাতে যােগদান করে। কিন্তু অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রের অবর্তমানে বাকশাল তার সদস্যদের পূর্ণ আনুগত্য লাভে ব্যর্থ হয়। এই ব্যবস্থায় এক ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম করার অবকাশ ছিল। যেখানে একজন রাষ্ট্রপতির অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্ষমতার থাকার অবকাশ থাকে, সেখানে রাষ্ট্রপতির পদাকাক্ষী অন্যান্যরা তাকে অবৈধভাবে উৎখাত করার সকল উদ্যোগ গ্রহণ করবে।৬২

সরকারের বাস্তব কার্যকলাপও জনগণের সন্তুষ্টি ও আস্থা অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি হিসেবে অব্যাহত থাকে। রাজনৈতিক হত্যা, সশস্ত্র ডাকাতি, পুলিশ ফাঁড়ি, ব্যাংক ও বাজার লুট নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। দুর্নীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন হ্রাস পায় এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ফলে জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে কমপক্ষে ২৭০০০ লোেক দুর্ভিক্ষে মারা যায়। ১৯৭৫ সালে খাদ্য পরিস্থিতি ও সাধারণ মূল্যস্তরের কিছুটা উন্নতি ঘটে। তবুও জনসাধারণ এক দুঃসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কালাতিপাত করতে থাকে। গ্রামীণ সমবায় পরিকল্পনা তার অনিশ্চিত ফলাফলের কারণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। বরং এই পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান সমর্থন ভিত্তি বলে পরিচিত ভূমি মালিকদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। 

রাষ্ট্রপতি মুজিব স্বীকার করেন যে, দেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি বিরাজমান এবং বলেন, জনগণের দুঃখ দুর্দশার ৩০% দূর হতে পারে যদি দুর্নীতি বন্ধ করা যায়।৬৩ কিন্তু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টা কেবল সতর্ককরণ ও উপদেশ প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ

১৬৬

ছিল। দুর্নীতির দায়ে কয়েকজন সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত বা আটক করা হলেও সন্দেহভাজন রাজনীতিকদের গায়ে হাত দেয়া হয়নি। একদলীয় ব্যবস্থার অধীনে নিযুক্ত মন্ত্রীপরিষদও নতুন আশার সঞ্চার করতে পারেনি। কারণ, কার্যত এটা ছিল পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পুনঃঅধিষ্ঠান, যে মন্ত্রিসভার অনেকেই অক্ষমতা, অপশাসন ও দুর্নীতির জন্য সমালােচনার পাত্র ছিলেন।৬৪ 

ক্ষমতাসীন এলিটগণ নতুন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্যও তেমন চেষ্টা করেনি। তার কারণ সম্ভবত এই যে, ঐ ব্যবস্থার জনগণ কিংবা দল নয়, বরং নেতা মুজিবই ছিলেন ক্ষমতার উৎস। মুজিব নিজে আত্মতৃপ্ত ছিলেন এই ভেবে যে, জনগণ তাকে ভালােবাসে এবং তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাও তারা মেনে নিয়েছে।৬৫ 

সম্ভবত নতুন ব্যবস্থার প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকারও ছিল না। তিনি একদলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন কোনাে আদর্শিক বিশ্বাস থেকে নয়, বরং বিরাজমান সংকট থেকে উত্তরণের শেষ চেষ্টা হিসাবে। সেই জন্য তিনি একদলীয় ব্যবস্থাকে সংবিধানে স্থায়ী রূপ দেননি। একজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক প্রকাশ করেন যে, নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন : এটা না করে কোনাে উপায় ছিল না, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।৬৬ নেতার এই দোদুল্যমানতা নতুন ব্যবস্থার পক্ষে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের চেষ্টা না করার অন্যতম কারণ।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি কেবল জনসমর্থনের অভাবই ছিল না, নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের কারণে তাদের কার্যকারিতাও ক্ষুন্ন হয়। আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং বাকশালের মধ্যে বিরাজমান আদর্শিক ও উপদলীয় কোন্দল শাসকদল তথা সরকারকে দুর্বল করে ফেলে। 

এভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত, গােষ্ঠীগত অথবা সমষ্টিগত স্বার্থ এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিকদের সঙ্গে আদর্শিক ও নীতিগত মতভেদ সামরিক এলিটদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের মনােবৃত্তি সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা তাদেরকে প্রয়ােজনীয় সুযােগ ও সাফল্য এনে দেয়।

সূত্র ও টীকা 

১. দেখুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ২ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৬৭-৮১; ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ, ১৯৭৫। 

২. বাকশাল’-এর গঠনতন্ত্রের পূর্ণ বিবরণ দেখুন, The Bangladesh Gazette | Extraordinary, ৬ জুন, ১৯৭৫।

৩. বাকশাল গঠনতন্ত্র, ১০ নম্বর ধারা। 

৪. ঐ, ১১ ও ১২ নম্বর ধারা। 

৫. ঐ, ১২ নম্বর ধারা। 

৬. ঐ, ১৪ নম্বর ধারা।

১৬৭

৭. ঐ, ১৩ নম্বর ধারা। 

৮. ঐ, ১৬ নম্বর ধারার ৯ নম্বর উপধারা। 

৯, ঐ, ২০ নম্বর ধারার ৮ নম্বর উপধারা। 

১০. ঐ, ৬ নম্বর ধারার ১০ নম্বর উপধারা। 

১১. ঐ, ১০ নম্বর ধারার ৫ ও ৬ নম্বর উপধারা। 

১২. ঐ, ২২ নম্বর ধারা। 

১৩, ঐ, ২১ নম্বর ধারা। 

১৪. ঐ, নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নামের তালিকার জন্য দেখুন, ইত্তেফাক, ৭ জুন ১৯৭৫। 

১৫. কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা দেখুন, ইত্তেফাক, ৭ জুন, ১৯৭৫। 

১৬. দেখুন, ইত্তেফাক, ৭ জুন, ১৯৭৫। 

১৭. জেলা প্রশাসন আইন (১৯৭৫ সালের ৬ নম্বর আইন)- এর পূর্ণ বিবরণ দেখুন, The Bangladesh Gazette, ১০ জুলাই, ১৯৭৫। 

১৮. জেলা গভর্নরদের নাম ও পদবী দেখুন, ইত্তেফাক, ১৭ জুলাই, ১৯৭৫; The Bangladesh Gazette, ১৮ জুলাই, ১৯৭৫। 

১৯. দেখুন, রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমনের বক্তৃতা, ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ও ২০ জুন, ১৯৭৫। 

২০. দেখুন, রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা, ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ, ১৯৭৫; অর্থমন্ত্রীর বাজেট  বক্তৃতা, জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১ (২৩ জুন, ১৯৭৫) পৃষ্ঠা ২৭। 

২১. অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা, ঐ। 

২২. রাষ্ট্রপতি মুজিবের বক্তৃতা, ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ও ২০ জুন, ১৯৭৫। 

২৩. দেখুন, আতাউর রহমান খান ও হাজি মােহাম্মদ দানেশের বিবৃতি, যথাক্রমে ইত্তেফাক, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৬ ও সংবাদ, ২৮ নভেম্বর, ১৯৭৬। 

২৪. দেখুন, ইত্তেফাক, ১৮ নভেম্বর, ১৯৭৪। 

২৫. দেখুন, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পাদকের রিপাের্ট, একতা, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭৪। 

২৬. বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি, রাজনৈতিক রিপাের্ট, জুন, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ২৩। 

২৭. আনােয়ার হােসেন, “পরিবর্তন: সতর্কতা”, ইত্তেফাক, ১৩ মার্চ ১৯৭৫। 

২৮. দেখুন, শেখ ফজলুল হক মনির বিবৃতি, ইত্তেফাক, ৯ জুন ১৯৭৫; প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর বক্তৃতা, The Bangladesh Observer, ২০ জুন, ১৯৭৫। 

২৯, সংসদ সদস্য আব্দুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, মে ১৯৭৫। 

৩০. ইত্তেফাক, ২৩ মার্চ, ১৯৭৫। 

৩১. দেখুন ইত্তেফাক, ২৪, ৩, ৫ ও ৯ জুন এবং ৮ ও ১২ জুলাই, ১৯৭৫। 

৩২. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদ্বয়কে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনােনীত করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ২৭ জন কর্মকর্তাসহ ২৫ জুন তারিখে শালে যােগ দেন। কষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ৯০ জন শিক্ষক ১৮ জুলাই তারিখে বাকশালে যােগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক শিক্ষকের বাকশালে যােগদানের আবেদন পত্র ১৫ আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রপতি মুজিবের কাছে জমা দেবার কথা ছিল। 

৩৩. উদাহরণস্বরূপ দেখুন ঢাকার দৈনিক সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাসমূহের ৯ জন সম্পাদকের বিবৃতি, ইত্তেফাক, ৩ জুন, ১৯৭৫। 

৩৪. দেখুন, ইত্তেফাক, ২৮ জুলাই, ১৯৭৫। 

৩৫. দেখুন, রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভাষণ, ইত্তেফাক, ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৩৬. দেখুন, ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ও ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৩৭. পরিসংখ্যানগুলাে, ইত্তেফাক, ২৬ জানুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ, ১৯৭৫ থেকে সংগৃহীত।

১৬৮

৩৮. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পরিকল্পনা কমিশন, Economic Review, ১৯৭৪ ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ২ ও ৩; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Economic Indicators of Bangladesh, ডিসেম্বর, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৯। 

৩৯. ইত্তেফাক, ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৪০. ঐ। 

৪১. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৭ (২ জুলাই, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ১৬৮। 

৪২. ঐ, খণ্ড ২, সংখ্যা ১৯ (১৯ জুলাই, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৬৮২। 

৪৩. জনপদ, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৫। 

৪৪. উপ-সম্পাদকীয়, ইত্তেফাক, ৩১ মার্চ, ১৯৭৫। 

৪৫. খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস (একজন মস্কোপন্থী তাত্ত্বিক বলে পরিচিত, যিনি বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন)-এর সঙ্গে সাক্ষাতকার, সেপ্টেম্বর, ১৯৮০। 

৪৬. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Bangladesh in 1975″, Asian Survey, খণ্ড, ১৬ সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬। পৃষ্ঠা ১২২। 

৪৭. লরেন্স লিফসুজ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০২-১০৩। 

৪৮. ফাইনার, প্রাগুক্ত। 

৪৯. হান্টিংটন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৪-১৯৬। 

৫০. Sunday Times, ৩০ মে, ১৯৭৬। 

৫১. মার্কাস ফ্রান্ডা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯। 

৫২. এমাজ উদ্দীন আহমদ, Dominant Bureaucratics Elites…”, The Journal of Social Studies, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০১-১০২। 

৫৩. সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ২ (১০ এপ্রিল, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৪০। 

৫৪. কলকাতায় গণসম্বর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী মুজিবের বক্তৃতা, ইত্তেফাক, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। 

৫৫. বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির পূর্ণ বিবরণের জন্য দেখুন, মওদুদ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৪-২৭৫। 

৫৬. ইত্তেফাক, ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৫৭. ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫৫০০০। তার মধ্যে ২৮০০০ জন ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং অবশিষ্টরা ছিলেন প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিয়মিত সদস্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে সংগৃহীত সৈন্য। অপরদিকে

১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১৯৭৫ সালে ছিল ২৫০০০। 

৫৮. হান্টিংটন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৪। 

৫৯. জিলুর আর খান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৬। 

৬০. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Bangladesh in 1975 প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২২। 

৬১. দেখুন, কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুক, মুক্তির পথ, ঢাকা, ১৯৮৩। ৬২. হান্টিংটন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২১। 

৬৩. ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ও ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৬৪. একদলীয় ব্যবস্থার অধীনে ২৬ জানুয়ারি তারিখে গঠিত মন্ত্রিসভার প্রায় সকল সদস্য পূর্বতন আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। একমাত্র সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য না করে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করা হয়। এই মন্ত্রিসভায় নতুন ৬ জন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হন। এই ৬ জনের মধ্যে ৪ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং ২ জন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত প্রাক্তন উপাচার্য। 

৬৫. দেখুন, ইত্তেফাক, ২০ জুন, ১৯৭৫। 

৬৬. জহুর হােসেন চৌধুরী, “দরবার-ই-জহুর”, সংবাদ, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৮।

১৬৯

Reference: বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!