You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংসদীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক পরিবর্তন
(১৯৭৩-১৯৭৫)

যদিও বিরােধী দলসমূহ ১৯৭৩ সালের নির্বাচন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে, তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী ফল মেনে নেয় এবং সংবিধানকে অন্তত এক অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে। নির্বাচন বাতিলের জন্য গণ-আন্দোলন না করে তারা সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু শাসনকারী এলিট এবং বিরােধি পক্ষ। উভয়ই সাংবিধানিক নিয়মনীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়। দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। যে-সব সমস্যার কারণে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতা সংহত করতে ব্যর্থ হয় এবং সংসদীয় পদ্ধতি ছেড়ে এক কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে সেগুলােকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যেতে পারে। যথা, জাতীয় একাত্মতার সমস্যা, অংশগ্রহণের সমস্যা এবং সরকারের কৃতির সমস্যা।

১. জাতীয় একাত্মতার সমস্যা 

প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনাে সমাজে অনৈক্য বা সংঘাতের প্রধান উৎসগুলাের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট জনগােষ্ঠীর মধ্যে আঞ্চলিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, ভাষাগত বা জাতিগত বিভাজন। তবে এই বিভাজন জাতীয় একাত্মতার প্রতি মারাত্মক হুমকি হিসাবে তখনই দেখা দিতে পারে যখন বিভিন্ন গােষ্ঠী তাদের জন্য পৃথক মর্যাদা কিংবা আত্মশাসন দাবি করে। স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলােতে বাংলাদেশের জনগণের কী ধরনের বিভাজন ছিল এবং তা জাতীয় একাত্মতার ক্ষেত্রে কিরূপ সমস্যার সৃষ্টি করে তা আলােচনা করা হলাে। 

ক. আঞ্চলিকতাবাদ

বাংলাদেশ এমন একটি ভৌগােলিক একক যেখানে কোনাে উল্লেখযােগ্য প্রাকৃতিক বিভাজন কিংবা জনগােষ্ঠীর মধ্যে আঞ্চলিক মনােভাব নাই। জনগণের একাংশের মধ্যে “উত্তর বাংলার” (রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ) প্রতি অর্থনৈতিক অবহেলার অভিযােগ রয়েছে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচি জাতীয়তভিত্তিক; কোনাে দলই বিশেষভাবে উত্তর বাংলার স্বার্থকেন্দ্রিক নয়।

১০৮

১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে একজন মাত্র প্রার্থী প্রায় অস্তিত্বহীন ন্যাশনাল বরপাবলিকান পার্টি নামে একটি দলের প্রার্থীরূপে উত্তর বাংলা ও পূর্ব বাংলার (ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) মধ্যে সমতার দাবি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন; কিন্তু তিনি পরাজিত হন। কাজেই আঞ্চলিকতাবাদ বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের প্রতি কোনাে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে মনে হয় না।

খ. অর্থনৈতিক বিভাজন

বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানে প্রায় ৭৭% লােক জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। যদিও বাংলাদেশ কোনাে জমিদার শ্রেণি নাই, তবু ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে পার্থক্যের কারণে কৃষকদের মধ্যে প্রচুর বৈষম্য বিদ্যমান। ১৯৭৭ সালের এক হিসাব অনুসারে, আট একরের বেশি ভূমির মালিক এমন বড় কৃষকদের সংখ্যা ছিল গ্রামীণ জনসংখ্যার মাত্র ৫% অথচ তারা মােট কৃষিজমির ২৫%-এরও বেশি ভােগ করতেন। ৪.০১ একর থেকে আট একর পর্যন্ত জমির অধিকারী মধ্যম কৃষকদের সংখ্যা ছিল ১০% এবং তাঁরা ভােগ করতেন প্রায় ২৫% জমি। প্রায় ২৭% লােকের বসতভিটা ছাড়া কোনাে জমি ছিল না এবং ১৪% কৃষকদের জমির পরিমাণ ছিল ০.৫ একরের কম, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক মালিকানা ছিল না। অতএব, গ্রামীণ জনগণের প্রায় ৪১% ছিল কার্যত ভূমিহীন।১

ধনী ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে কেবল আয়ের বৈষম্য ছিল তা নয়, ধনী কৃষকগণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে (যেমন খাদ্যশস্য মজুদ করে অভাবের সময় তা চড়া। দামে বিক্রি করা, অত্যধিক উচ্চ হারে অর্থ ঋণ দেয়া এবং দুর্যোগের সময় নামমাত্র মূল্যে জমিজমা ক্রয়) গরিব কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিকদের শােষণ করত। কিন্তু এক রকমের দাতা গ্রহীতা সম্পর্ক এবং দূরবর্তী পারিবারিক যােগসূত্র বা আত্মীয়তার কারণে শ্রেণিদ্বন্দ্ব প্রকট হয়নি এবং গ্রামীণ বাংলাদেশ শ্রেণি চেতনা ও শ্রেণি সংগঠনের বিকাশ ঘটেনি।২

শহরাঞ্চলের শ্রমজীবীগণ তাদের গ্রামীণ সমগােত্রীয়দের তুলনায় অধিক শ্রেণি-সচেতন এবং তারা শ্রমিক সংগঠনও গড়ে তােলেন। কিন্তু এই সংগঠনগুলাে কার্যত রাজনৈতিক দলসমূহের সহযােগী সংগঠন এবং আদর্শগত অবস্থান নির্বিশেষে সকল দলের নেতৃত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে।৩

এমন কি বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের শ্রমিক ফ্রন্টগুলাের নেতৃত্বে ছিলেন ধনী কৃষক এবং ব্যবসায়ী পরিবার থেকে আগত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লােকজন, যাঁরা শ্রেণি সংগ্রামের পরিবর্তে জাতীয় স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর বেশি জোর দিতেন।৪

সুতরাং শ্রেণি পার্থক্য বাংলাদেশে জাতীয় একাত্মতার প্রশ্নে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি

১০৯

গ. ধর্মীয় বিভাজন 

বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভাজন রয়েছে। এখনে দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। একটি মুসলমান সম্প্রদায়, যারা ১৯৭৪ সালে মােট জনসংখ্যার ৮৫% ছিল, এবং অপরটি হিন্দু সম্প্রদায় যারা ছিল মােট জনসংখ্যার ১৩.৫%। হিন্দু-মুসলমান। দ্বন্দ্বই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির কারণ ছিল। এই দ্বন্দ্বের জের হিসাবে পাকিস্তান আমলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ছিল সন্দেহ ও তিক্ততায় ভরপুর। ইসলামী দলসমূহ দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল। তারা কোনােদিনই হিন্দুদেরকে পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে মেনে নেয়নি এবং সমপ্রদায়ভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরকে পৃথক রাখার চেষ্টা করে। অপর দিকে হিন্দুগণ, যারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল তারা মাতৃভূমি হিসেবে পাকিস্তানে স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেনি এবং শাসকবর্গের রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে ইসলামীকরণের সকল প্রচেষ্টার বিরােধিতা করে।৫

তারা ধর্মনিরপেক্ষ বিরােধী দলসমূহ কর্তৃক পরিচালিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থন করে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তারা আওয়ামী লীগ সূচিত ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিজেদের একাত্মবােধ করে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী দল জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।

ঘ. ভাষা ও জাতিগত বিভাজন 

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯৯% লােক একই বংশােদ্ভূত বলে মনে করা হয়, এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে ০.৬৪% লােক ছিল উপজাতীয়, যারা নিজস্ব পৃথক ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী। মাত্র ০.২৫% লােক বিহারী বলে পরিচিত ছিল, যাদের মাতৃভাষা উর্দু। তারা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলাে থেকে বাংলাদেশে আগমন করে। জাতিগত সংখ্যালঘুরা কেবল সংখ্যায় নগণ্য নয়, তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। প্রায় পাঁচ লক্ষ লােক অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামেই কেবল উপজাতীয় লােকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; ১৯৭৪ সালে ঐ অঞ্চলে বাঙালি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৩%।

উপজাতীয় লােকেরা অনেক ভাগে বিভক্ত। পাবর্ত্য চট্টগ্রামেই কমপক্ষে ১০টি উপজাতি বাস করে। এদের নাম চাকমা, মগ, ত্রিপ্রা, লুসাই, বাম, পাঙ্খে, ভূমি, কিয়াং, মূরাং ও চক। বেশির ভাগ উপজাতীয় আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে পারেনি; তাদের প্রায় অর্ধেক আধা যাযাবর জীবন যাপন করে। কিন্তু তারা একক ও বিচিত্র সংস্কৃতির অধিকারী পৃথক সত্তা হিসেবে সচেতন।৬

যদিও প্রত্যেকটা জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে, চাকমা ও মগ ছাড়া অন্যান্যের লিখিত সাহিত্য নেই। যে স্বল্প সংখ্যক উপজাতি আধুনিক শিক্ষা লাভ করে তাদের। 

১১০

পায় সবাই আসে চাকমা ও মগদের মধ্যে থেকে। ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৮% এবং তারাই ছিল সর্বাপেক্ষা অগ্রগামী গােষ্ঠী। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি মগ, ১৯৭৪ সালে যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৮%। 

উপজাতীয় লােকেরা নিজেদের পৃথক জাতি বলে মনে করে এবং বাঙালি হিসেবে পরিচিতি দিতে অস্বীকার করে। চাকমা নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (যিনি ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন) দাবি করেন, “আমি একজন চাকমা, আমি বাঙালি নই। আমি বাংলাদেশের নাগরিক-বাংলাদেশি। আপনি বাংলাদেশি, এবং আপনার জাতিসত্তার পরিচয় বাঙালি। উপজাতিরা বাঙালি হয়ে গেছে একথা কেউ জোর গলায় বললেই তারা বাঙালি হয়ে যাবে না।৭

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে আমার দেশ’ বলে দাবি করেন এবং উপজাতীয়দের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূখণ্ডের উপর উপজাতীয়দের একচেটিয়া অধিকার দাবি করেন।৮

কিন্তু শাসনকারী এলিটগণ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্যান্য এলাকার মতােই বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন এবং উপজাতীয়দের পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তারা জোর দিয়ে বলেন যে, উপজাতীয়গণ বাঙালি বলেই পরিচিত হবে এবং জনগণের অবশিষ্টাংশের মতােই বাংলা শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করবে।”৯

সরকারের এই সাংস্কৃতিক একীভূতকরণ নীতি এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অস্বীকৃতি উপজাতীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের দাবিসমূহ আদায়ের লক্ষ্যে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন এবং “শান্তি বাহিনী” নামে এক সামরিক ফ্রন্ট গঠন করে। কিন্তু মুজিব শাসনামলে শান্তি বাহিনী প্রধানত চাকমা ছাত্রদের একটি ক্ষুদ্র সংগঠন ছিল এবং উপজাতীয় আন্দোলন তার নিয়মতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রেখেছিল। ফলে উপজাতীয় সমস্যা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি।

অতএব আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ভাষাগত কিংবা জাতিগত বিভাজন বাংলাদেশে জাতীয় একাত্মতার কোনাে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করেনি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিক ও আদর্শিক বিভেদই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। প্রধানত দুটি আদর্শিক গােষ্ঠী বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং আওয়ামী লীগ প্রবর্তিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাদের মধ্যে একটি ছিল ইসলামী ডানপন্থী গােষ্ঠী এবং অপরটি উগ্র বামপন্থী গােষ্ঠী।

১১১

ঙ. ইসলামী ডানপন্থী গােষ্ঠীসমূহ ইসলামী ডানপন্থী গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে মুসলিম লীগ, জামায়াত-ইইসলামী, নেজামে ইসলাম, জামিয়াত-ই-উলামা-ই-ইসলাম, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, প্রভৃতি রাজনৈতিক দল। তারা ধর্মভিত্তিক ইসলামী জাতীয়তাবাদ সমর্থন করতাে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কঠোর বিরােধী ছিল। তারা পাকিস্তানকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের মাতৃভূমি বলে মনে করতাে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকদের সাথে সক্রিয় সহযােগিতা করেছিল। বিজয়ী বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটগণ ইসলামী গােষ্ঠীগুলাের রাজনৈতিক আনুগত্য সম্পর্কে গভীর সন্দেহ পােষণ করতাে এবং তাদেরকে “আলবদর-রাজাকার” তথা পাকিস্তানের দালাল বলে নিন্দা করত।

যদিও ইসলামী দলসমূহ প্রকাশ্যে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করেনি, ভাবগতভাবে তারা পাকিস্তান এবং তার ইসলামী আদর্শের প্রতি অনুগত ছিল বলে। তারা দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করতাে এবং বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরের পক্ষপাতি ছিল। কাজেই তারা তথাকথিত “মুসলিম বাংলা” আন্দোলন আরম্ভ করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ইসলামী জাতীয়তাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করা। যেহেতু তখন ইসলামী দলগুলাে নিষিদ্ধ এবং তাদের নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ ছিলেন সেহেতু তারা “মুসলিম বাংলা” প্রশ্নে প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি। তারা গােপনে কাজ করতে থাকে এবং তাদের আন্দোলন গােপন আলাপ-আলােচনা, প্রচারপত্র, দেয়ালপত্র, ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।১০

“মুসলিম বাংলা আন্দোলনের পক্ষে কোনাে প্রকাশ্য জনসমর্থন ছিল না। তবে এই আন্দোলনের প্রতি মাওলানা ভাসানীর মৌন সমর্থন ছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়।১১ কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র আক্রমণের মুখে মাওলানা সাম্প্রদায়িক নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং মুসলিম বাংলা” আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন।১২

এভাবে সংগঠনিক ভিত্তি ও জনসমর্থনের অভাব এবং আওয়ামী লীগের কঠোর দমন নীতির কারণে “মুসলিম” বাংলা আন্দোলন ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। তবে এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, মুসলিম বাংলার সমর্থকগণ আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের জন্য আত্মগােপনকারী বামপন্থী সংগঠনগুলাের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।১৩

চ. উগ্র বামপন্থী গােষ্ঠীসমূহ 

উগ্র বামপন্থীদের একাংশ, যারা ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ করে তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন জাতি হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে।

আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি (এম এল)-এর একটি উপদল অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করতাে এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে পূর্ব

১১২

পাকিস্তান নামে ডাকতাে। এই উপদল অভিমত ব্যক্ত করে যে, দেশ বলতে আমরা পাকিস্তানকে এবং রাষ্ট্র বলতেও আমরা পাকিস্তানকে বুঝি। পূর্ব-পাকিস্তান একটি দেশ নয়, এটা পাকিস্তানের অংশ”।১৪

এই দলের মতে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সােভিয়েত রাশিয়ার প্ররােচনায় ভারত কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া একটি আক্রমণাত্মক যুদ্ধ, এবং ঐ যুদ্ধের দ্বারা পূর্ব-পাকিস্তানকে “সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশে পরিণত করা হয়। কাজেই এই দল আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে পূর্ব পাকিস্তান” পুনর্বহাল করার জন্য সশস্ত্র লড়াই শুরু করে।১৫

মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি (এস, এল)এর অপরাংশ ও মনে করে যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল সােভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় আক্রমণ, যার মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তান ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয় এবং আওয়ামী লীগ ছিল একটা পুতুল সরকার। কিন্তু এই দল যুক্তি দেখায়, যেহেতু পূর্বপাকিস্তান ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে আলাদা হয়ে গেছে, সেহেতু এটাকে পাকিস্তানের অংশ বলা যায় না। সুতরাং এই দল বাংলাদেশকে পৃথক “দেশ” হিসেবে স্বীকার করে (রাষ্ট্র হিসেবে নয়) এবং তাকে “পূর্ব বাংলা” বলে আখ্যায়িত করে। এই উপদল “পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (এম এল)” নাম ধারণ করে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে “পূর্ব বাংলাকে ভারত-সােভিয়েত “আধিপত্যবাদ” থেকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র কর্মসূচি গ্রহণ করে। আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন পূর্ব-বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি (এম এল) নামের অন্য একটি চীনপন্থী বাম দলও তােয়াহার সাম্যবাদী দলের ন্যায় অভিমত পােষণ করে।১৬

১৯৭১ সালের জুন মাসে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব-বাংলার সর্বহারা পার্টি নামে আর একটি উগ্র চীনপন্থী দল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। এই দল মনে করে যে, বাংলাদেশের জনগণ তাদের নিজস্ব ভূখণ্ড, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধিকারী একটি পৃথক জাতি। কিন্তু সর্বহারা পার্টি জাতীয় পরিচয় সম্পর্কে দ্বিমত পােষণ করে। যেহেতু বাংলাদেশ শব্দের অর্থ হচ্ছে বাংলা ভাষা-ভাষীদের দেশ, সেহেতু সর্বহারা পার্টি ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে পার্থক্য নির্দেশের উদ্দেশে বাংলাদেশকে “পূর্ব বাংলা” নামে আখ্যায়িত করতে চায়। এই দল আরও মনে করে যে পূর্ব-বাংলা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়নি; বরং ১৯৭১ সালে ভারত আক্রমণাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে তার উপনিবেশে পরিণত করে এবং সেখানে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। সর্বহারা পার্টি “ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ” ও “পূর্ব বাঙালি জাতি”-এর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে চিহ্নিত করে এবং একটা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এর মীমাংসা করতে চায়।১৭ 

এই বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য পার্টি একটি “জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” এবং একটি “দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে।

১১৩

অতএব, আব্দুল হকের পূর্ব-পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি (এম এল) ছাড়া চীন পন্থী সকল উগ্র বাম গােষ্ঠী বাংলাদেশ নামক ভৌগােলিক ইউনিটের সঙ্গে একাত্মতা ব্যক্ত করে, কিন্তু তারা কেউ বাংলাদেশকে স্বাধীন জাতি বলে স্বীকার করেনি এবং নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে মনে করতাে না। তারা জাতীয়তার সংজ্ঞাও মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং বাংলাদেশকে পূর্ব । বাংলা অথবা পূর্ব পাকিস্তান নামে আখ্যায়িত করতে থাকে। জাতীয় উৎসবসমূহেও তারা অংশগ্রহণ করতাে না। সর্বহারা পার্টি সরকারিভাবে ঘােষিত “বিজয় দিবস” (১৬ই ডিসেম্বর)-কে কালাে দিবস বলে আখ্যায়িত করে এবং সেই দিনে সাধারণ ধর্মঘট পালন করতাে। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ উভয় বছরের “বিজয় দিবস” সরকারি বাহিনী ও কম্যুনিস্ট উগ্রপন্থীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ও বােমাবাজির মধ্যে ম্লান হয়ে যায়।১৮ 

বাঙালি জাতীয়তবাদ-বিরােধী চীনপন্থী ক্যুনিস্ট গােষ্ঠীসমূহ আত্মগােপন করে থাকে, এবং তাদের ভাষায় প্রকৃত জাতীয় স্বাধীনতা আনয়নের জন্য তারা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, ব্যাংক, বাজার লুট এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের কৌশল অবলম্বন করে। এমন কি, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকটি বিরােধী দল, যেমন ন্যাপ (ভাসানী) ও জাসদ মনে করে যে, “জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব” অসম্পন্ন রয়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকার রুশ-ভারত শাসক শ্রেণির ওপর নির্ভরশীল একটা সরকার।১৯

ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী প্রকাশ্যে আত্মগােপনকারী উগ্র বামপন্থীদের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং সকলকে তাদের দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত “জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম”-এর অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।২০

তিনিও ১৬ই ডিসেম্বরকে “শােক দিবস” হিসাবে বর্ণনা করেন এবং সর্বহারা পার্টি আহুত ঐ দিনের ধর্মঘটকে সমর্থন করেন।২১

২. রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সমস্যা 

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অধিকাংশ বিরােধী দল সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আস্থাশীল ছিল না। তারা বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিল এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে সহিংস আন্দোলনের সাথে সাথে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করে। সুতরাং ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিকল্পিত ব্রিটিশ ধাচের শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য ব্রিটেনের মতাে সংবিধানের প্রতি অনুগত বিরােধী দলের অভাব ছিল। ক্ষমতাসীন দলও বিরােধী পক্ষের প্রতি প্রতিহিংসা ও অবহেলার নীতি গ্রহণ করে। ফলে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিযােগিতার বিকাশ ব্যাহত হয়। নিম্নে সংসদের ভিতরে ও বাইরে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও দলীয় রাজনীতির চিত্র তুলে ধরা হলাে।

১১৪

ক. সংসদীয় রাজনীতি 

ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার জন সাইমন ১৯৩৭ সালে বলেন, ব্রিটিশ রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন নীতি বা ধারণা এই যে, বিরােধী দল যখন বিরােধিতা করে তখন একটা জন-দায়িত্ব পালন করে।২২

দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরােধী দলকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশে কোনাে বিরােধী দল নেই”।২৩ 

বিরােধী দলসমূহ প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে এবং অনেকেই অভিযােগ উত্থাপন করে যে, আওয়ামী লীগ দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।২৪ 

তবে বিরােধী দলগুলাে সংসদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে নয় জন বিরােধীদলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্য মিলে “সংযুক্ত বিরােধী দল গঠন করে এবং আতাউর রহমান খান নেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু সরকার একে “বিরােধী দল হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। প্রধানমন্ত্রী যুক্তি দেখান যে, বিরােধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে অন্তত। ২৫ জন সদস্য থাকতে হবে, এমনকি বিরােধী গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য কমপক্ষে ১০ জন সদস্যের প্রয়ােজন।২৫  

কোনাে কোনাে আওয়ামী লীগ সংসদ-সদস্য বিরােধী দলকে “ককটেল পার্টি” বলেও পরিহাস করেন।২৬ 

সংসদীয় আমলে (১৯৭৩-৭৫ সময়কালে) জাতীয় সংসদ সাতটি অধিবেশনে মিলিত হয় এবং ১১৪ টি কর্মদিবসে মােট ৪১০ ঘণ্টা বৈঠক করে। ঐ সময়ে সংসদ চারটি সংশােধনীসহ মােট ১২২টি বিল পাস করে। তার মধ্যে ৫৫টি, অর্থাৎ ৪৯% ছিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পূর্বাহ্নে জারিকৃত অধ্যাদেশ যেগুলাে অনুমােদনের জন্য সংসদে পেশ করা হয়। অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্দেশ্য হলাে জরুরি বিষয়সমূহ মােকাবেলা করা।২৭ কিন্তু সরকার মন্ত্রিদের বেতন ও সুযােগ সুবিধা নির্ধারণের ব্যাপারেও অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা প্রয়ােগ করে।

১১২টি বিলের মধ্যে মাত্র ৩৭টি, অর্থাৎ ৩৩% ছােটখাট সংশােধনীসহ গৃহীত হয় এবং অবশিষ্ট বিলগুলাে (৬৭%) সংসদে যে আকারে উত্থাপিত হয় ঠিক সেই আকারে পাস করা হয়। তবে বিরােধী সদস্যগণকে যা সবচেয়ে বেশি নিরাশ করে তা হচ্ছে এই যে, তাদের কোনাে সংশােধনী প্রস্তাবই গৃহীত হয়নি, যদিও বিরােধী সদস্যদের কোনাে কোনাে সংশােধনী প্রস্তাব সংসদ কর্তৃক গৃহীত সরকার দলীয় সদস্যদের প্রস্তাবের অনুরূপ ছিল। তাছাড়া কিছু বিল এত তাড়াহুড়া করে পাস। করা হয় যে, সদস্যগণ সেগুলাে আলােচনা করার পর্যাপ্ত সুযােগ পাননি। জাসদ দলীয় সংসদ-সদস্য ময়েনউদ্দীন আহমদ মানিক বলেন, “দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেনের গতির মতাে যেভাবে বিলগুলাে আসছে আর পাস হয়ে যাচ্ছে, তাতে সেগুলাে ধরার মতাে শক্তি এই পরিষদের অনেক সদস্যেরই নেই।”২৮।

১১৫

জাতীয় সংসদ সরকারের আইন ও অর্থসংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ অনুমােদনকারী “রাবার স্ট্যাম্প” হিসেবেই কাজ করে। নির্বাহী ও প্রশাসনিক নীতি সম্পর্কে আলােচনার সুযােগও খুব কম দেয়া হয়। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা এবং “অনাস্থা প্রস্তাব, “মুলতবি” প্রস্তাব “সংক্ষিপ্ত আলােচনার প্রস্তাব, “মনােযােগী আকর্ষণী” প্রস্তাব ও “সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের মতাে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় পদ্ধতির ব্যবস্থা ছিল। কন্তু এই পদ্ধতিসমূহ নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়।

যে সব কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে ‘সতর্ক প্রহরী” হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয় সেগুলাের মধ্যে প্রধান ছিল সংসদে বিরােধী দলসমূহের প্রতিনিধিত্বের স্বল্পতা। কোনাে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সংসদে অন্যূন ৩০ জন সদস্যের প্রয়ােজন ছিল।২৯ যেহেতু বিরােধী পক্ষের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৯ জন সেহেতু সংসদে একটিও অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়নি।৩০

সংসদে অন্যূন ২৫ জন সদস্যের সমর্থনক্রমে কোনাে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচনার জন্য “মুলতবি” প্রস্তাব উত্থাপন করা যেত।৩১ ১৯৭৩-৭৫ সময়কালে ১৬টি মুলতবি প্রস্তাবের নােটিশ দেয়া হয়, যার মধ্যে স্পিকার মাত্র একটি প্রস্তাব বিধিসম্মত বলে গ্রহণ করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সদস্য কর্তৃক সেটি প্রত্যাহৃত হবার ফলে কোনাে মুলতবি প্রস্তাব সংসদে আলােচিত হয়নি।

কোনাে সংসদ-সদস্য অপর পাঁচজন সদস্যের সমর্থনক্রমে, কোনাে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনা প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারতেন। তবে আলােচনা এক ঘণ্টার অধিক কাল স্থায়ী হতাে না।৩২ এরূপ সংক্ষিপ্ত আলােচনার ১৯টি নােটিশ দেয়া হয়। তার মধ্যে চারটি সংসদে আলােচিত হয়।

আবার কোনাে সদস্য সংসদে স্পিকারের অনুতিক্রমে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রির মনােযােগ আকর্ষণ করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে সেই মন্ত্রিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করতে হতাে।৩৩ মােট ২৯টি মনােযােগ আকর্ষণী নােটিশ দেয়া হয়। তার মধ্যে ৫২টি স্পিকার কর্তৃক বিধিসম্মত বলে গৃহীত হয়, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২৭টি সংসদে উত্থাপিত হয়।

বেসরকারি সদস্যগণ মােট ৩৪৩টি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবের নােটিশ দেন।৩৪ যার মধ্যে ২৭৪টি স্পিকার কর্তৃক বিধিসম্মত বলে গৃহীত হয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রস্তাবই সরকার দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক প্রত্যাহৃত হয় অথবা সময়ের অভাবে বাতিল হয়ে যায়। মাত্র ছ’টি সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব সংসদে উত্থাপিত হয় যার সবগুলােই বিরােধী সদস্যগণ উত্থাপন করেন। ছ’টি প্রস্তাবের মধ্যে পাঁচটি সংসদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় এবং একটি আইনমন্ত্রীর আশ্বাসক্ৰমে সংশ্লিষ্ট সদস্য প্রত্যাহার করেন (সারণি ৫.১ দেখুন)

সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলগুলাের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিটি সংসদ কর্তৃক সর্বাপেক্ষা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। স্পিকার অন্যরূপ নির্দেশ না দিলে, সংসদের প্রত্যেক দিনের বৈঠকের প্রথম এক ঘণ্টা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও উত্তর দানের জন্য নির্ধারিত থাকতাে।৩৫

১১৬

সারণি ৫.১ 

১৯৭৩-৭৫ সময়কালে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ও আলােচিত প্রশ্ন ও অন্যান্য প্রস্তাবের বিবরণ

প্রদত্ত নোটিশের সংখ্যা স্পিকার কর্তৃক গৃহীত প্রশ্ন/প্রস্তাবের সংখ্যা সংসদে অলোচিত প্রশ্ন/প্রস্তাবের সংখ্যা
* তারকা চিহ্নিত প্রশ্ন ৭৫৭৬ ৫৪১৩ ৪৬৭৪
বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত ৩৪৩ ২৭৪
মনােযােগ আকর্ষণের প্রস্তাব ২২৯ ৫২ ২৭
সংক্ষিপ্ত আলােচনা প্রস্তাব ১৯
মুলতবি প্রস্তাব ১৬
অনাস্থা প্রস্তাব

* মন্ত্রিগণ তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের লিখিত উত্তর এবং তৎসংক্রান্ত সম্পূরক প্রশ্নের মৌখিক উত্তর দেন। অতারকাচিহ্নিত প্রশ্নের মৌখিক উত্তর দেয়া কিংবা সম্পূরক প্রশ্ন করা হয় না। 

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের-কার্যপ্রবাহের সারাংশ, ১৯৭৩-৭৫ (৭ খণ্ড)

১৯৭৩-৭৫ সময়কালে সদস্যগণ মােট ৭৫৭৬টি তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের নােটিশ দেন। তার মধ্যে ৫৪১৩টি প্রশ্ন স্পিকার কর্তৃক বিধিসম্মত বলে গৃহীত হয়, কিন্তু মন্ত্রীগণ কর্তৃক ৪৬৭৪টি প্রশ্নের উত্তর প্রদত্ত হয়। সরকার ও বিরােধী উভয় পক্ষের সদস্যগণ প্রশ্নগুলাে উত্থাপন করেন। প্রশ্ন জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য হলাে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তথ্য উদ্ঘাটন এবং সরকারের নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলােচনা করা।

প্রশ্নকে কেন্দ্র করে অনেক সময় সংসদে প্রাণবন্ত আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং অনেক বিষয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়। সংসদের কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায় যে, বিরােধী সদস্যগণ যেখানে প্রশ্নোত্তর পর্বকে সরকারের সমালােচনার উদ্দেশে অধিক মাত্রায় ব্যবহার করেন, সেখানে সরকার দলীয় সদস্যগণ নিজেদের নির্বাচনী এলাকার সমস্যা নিয়ে বেশি সােচ্চার হন।

সংসদে বিরােধী দলসমূহের স্বল্প প্রতিনিধিত্ব এবং সরকার কর্তৃক তাদের আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দানের অস্বীকৃতির ফলে সংসদের প্রতি বিরােধী দলের আগ্রহ হ্রাস পায়। তারা সংসদীয় কার্যব্যবস্থাকে সফল করার দায়িত্ব অনুভব করেনি বরং সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পর্যাপ্ত সুযােগের অভাব এবং বিরােধী দলসমূহ কর্তৃক সরকারি নীতি ও কর্মসূচিকে প্রভাবিত করার অক্ষমতার কারণে তারা ক্ষুব্ধ

১১৭

হয় এবং সংসদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার চেষ্টা চালায়। আতাউর রহমান খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই পরিষদে পাস করলেই হবে না। পরিষদের বাইরে সাধারণ মানুষ আছে…। আমরা যদি মনে করি এই পরিষদ সারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং জনগণ বলে কিছু নেই, তাহলে ভুল হবে।”৩৬

সংসদে একদলীয় প্রাধান্য এত প্রকট ছিল যে, বিকল্প সরকার গঠনের সম্ভাবনা মােটেই ছিল না। তাছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে দলত্যাগ কিংবা দলের বিপক্ষে ভােট দানের কারণে সদস্যপদ বাতিলের বিধান সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের একটা কার্যকর হাতিয়ার ছিল। ফলে সংসদের পরিবর্তে দলীয় সভায় সরকারে নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আলােচনা হতাে, এবং বিরাট সম্মােহনী ব্যক্তিত্বের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল প্রধানমন্ত্রী মুজিবের হাতে। সংসদে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের অবকাশ খুবই কম ছিল এবং সিদ্ধান্ত। গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিরােধী দলসমূহকে জড়িত করার জন্য কোনাে উল্লেখযােগ্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। 

১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ বিরােধী দলসমূহ সংসদের প্রতি তাদের অনাস্থা ব্যক্ত করে এবং সংসদ ভেঙে দেবার দাবি উত্থাপন করে। জাসদ দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, সংসদ জনগণের স্বার্থে কোনাে কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে; ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে এর কোনাে মূল্য নেই।৩৭

খ. সংসদ বহির্ভূত রাজনীতি 

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, মস্কোপন্থী বাম দলসমূহ শান্তিপূর্ণ পন্থায়। সমাজতন্ত্র উত্তরণে বিশ্বাস করতাে এবং তারা শাসক দলের সাথে ঐক্য করে। তাকে বাম পথে টেনে আনার কৌশল গ্রহণ করে। উগ্র বামপন্থীদের সহিংস কার্যকলাপে ব্যতিব্যস্ত আওয়ামী লীগ সরকারও নরমপন্থী বাম দলগুলাের সহযােগিতার প্রয়ােজন অনুভব করে। সুতরাং আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফ্ফর)-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে “গণ ঐক্য জোট” নামে একটি ত্রিদলীয় জোট গঠন করে। ঐ জোটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চীনপন্থী গােষ্ঠীসমূহের “স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা প্রতিরােধ করা।৩৮

অন্যান্য বিরােধী দলের অধিকাংশ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতাে না। তারা বিপ্লবের মাধমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা দেশের অর্থনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের মৈত্রী নীতির তীব্র সমালােচনা করে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে জনসভা, গণবিক্ষোভ, ধর্মঘট, ঘেরাও ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করে। আবার কোনাে কোনাে বিরােধী দল সমাজতন্ত্রিক বিপ্লব সংঘটনের উদ্দেশে থানা আক্রমণ, অস্ত্র-শস্ত্র লুট এবং রাজনৈতিক বিরােধিদের হত্যার মতাে সহিংস কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

১১৮

অপরপক্ষে সরকার এই উগ্রপন্থীদের সাধারণ ডাকাত ও হত্যাকারী রূপে বিবেচনা করে এবং বলে যে, বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনাে অধিকার তাদের নেই।৩৯

সরকার বিরােধী দলসমূহের উগ্র কার্যকলাপ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না এবং সেগুলাে দমন করার জন্য বল প্রয়ােগের কৌশল গ্রহণ করে। সরকার অনেক সময় বিরােধী পক্ষের জনসভা, মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদির ওপর বাধানিষেধ আরােপ করতাে। বিরােধী দলসমূহ সরকারের এই সব পদক্ষেপকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী বলে মনে করে এবং তারা ক্রমশ অধিকতর সহিংস পন্থার দিকে ধাবিত হয়। এভাবে সরকার ও উগ্র বাম বিরােধী দলসমূহের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

জাসদ ছিল ১৯৭৩-৭৫ সময়কালে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও জঙ্গী বিরােধী দল। এই দল “অবিরাম বিপ্লব”-এর কৌশল গ্রহণ করে এবং কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। জাসদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব ঢাকায় এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, কুষ্টিয়া, চাঁপাই নবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ সহ চতুর্দিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে; ভূমিহীন কৃষকরা ভূস্বামীদের জমির ফসল কেটে নিচ্ছে; সমাজতন্ত্রের জন্য এরূপ সংগ্রাম ভবিষ্যতে চলতে থাকবে।৪০

সরকার ও জাসদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ ঘটে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ, যখন দেশব্যাপী ঘেরাও আন্দোলনের অংশ হিসাবে জাসদ নেতা রব ও জলিলের নেতৃত্বে এক বিরাট জনতা ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সহিংস জাসদ কর্মীদের ওপর গুলি ছুঁড়লে অন্তত তিন ব্যক্তি নিহত ও বহু ব্যক্তি আহত হয়।”৪১

১৭ মার্চের ঘেরাও ক্ষমতাসীন দলকে জাসদের ওপর চড়াও হবার একটা সুযােগ করে দেয়। জাসদের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়সহ অনেক কার্যালয় ভাংচুর করা হয় এবং শীর্ষস্থানীয়, নেতৃবর্গসহ শত শত কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। জাসদ সমর্থিত দৈনিক গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তার সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়।

কিন্তু জাসদের দৃষ্টিতে ১৭ মার্চের ঘেরাও ছিল একটা সফল অভিযান। এটা ছিল জাসদের গণ সহানুভূতি আকর্ষণ ও কর্মীদের বিপ্লবী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সরকারকে নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে উস্কানী প্রদানের কৌশল বিশেষ। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জাসদ যুক্তি দিতে থাকে যে, আওয়ামী লীগ এখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সামান্যতম সুযােগ দিতেও নারাজ; অতএব সশস্ত্র প্রতিরােধ অবশ্য প্রয়ােজন।৪২

এরপর জাসদ বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে জাসদ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের কেন্দ্রীয় সমম্বয় কমিটির সভায় “বিপ্লবী গণবাহিনী” নামে একটি সশস্ত্র অংগ সংগঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণকে বিপ্লবী রাজনীতিতে দীক্ষাদানের জন্য জাসদ সেনাবাহিনীর মধ্যে এটি “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা” গঠন করে।৪৩

১১৯

জাসদের ওপর সরকারের চড়াও প্রমাণ করে যে, কোনাে বিরােধী দলই এককভাবে আওয়ামী লীগকে মােকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। এই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে ছ’টি বিরােধী দলের সমম্বয়ে “সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠন করা হয়। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলাে ছিল ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় লীগ, বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল ও জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)।৪৪

নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামাে সম্পর্কে মতভেদের কারণে জাসদ যুক্তফ্রন্টে যােগ দেয়নি। এই ফ্রন্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে একটা চার দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল : (১) সকল রাজবন্দির মুক্তি, (২) সারাদেশে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের রেশনিং চালু করা, (৩) দুর্নীতি, চোরাকারবার, মুনাফাখখারী, ইত্যাদি দূরীকরণ; এবং (৪) বাংলাদেশকে সকল প্রকার বৈদেশিক আধিপত্যবাদমুক্ত করা।৪৫

গণ-আন্দোলনের অংশ হিসেবে, সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন ঢাকায় এক জনসভা আহ্বান করে। মাওলানা ভাসানী হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, সরকার প্রস্তাবিত জনসভা করতে না দিলে গণভবন (প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) পুড়িয়ে ফেলা হবে। তদুত্তরে সরকার মাওলানাসহ ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে এবং জনসভা পণ্ড হয়ে যায়।৪৬

১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ হতাশাগ্রস্ত বিরােধী দলসমূহ সরকারের পদত্যাগের দাবি উত্থাপন করে। জাসদ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং আওয়ামী লীগ ও তার সহযােগী মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মুজাফফর)কে বাদ দিয়ে একটি “সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের আহ্বান জানায়। এই দল ১৯৭৪ সালের ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। হরতালের দিন বােমাবাজি, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ ইত্যাদি সহিসংস ঘটনা ঘটে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত দু’ব্যক্তি নিহত ও ২২ ব্যক্তি আহত হয়।৪৭

যুক্তফ্রন্ট ও “সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উত্থাপন করে এবং সে সম্পর্কে আলােচনার জন্য ১৯৭৫ সালের ৪-৫ জানুয়ারি বিরােধী দলসমূহের এক “মহা জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে। আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ (মােজাফফর) সমর্থিত শ্রমিক সংগঠন ছাড়া অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন মিলিতভাবে “জাতীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তারা শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও চাকরির দাবি করে এবং আওয়ামী লীগসহ সকল দেশি-বিদেশি শােষক নিপীড়ককে উৎখাত করে “জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার” কায়েমের জন্য শ্রমজীবী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দেয়। 

১২০

এভাবে স্বীকৃত বিরােধী দলগুলাে এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহ সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে একটা চূড়ান্ত গণ-আন্দোলনের জন্য ব্যাপক-ভিত্তিক ঐক্যের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে আত্মগােপনকারী উগ্র বামপন্থী গােষ্ঠীগুলাে তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপ জোরদার করে।৪৮ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের দিবালােকে হত্যা শুরু করা হয়।

এভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সরকার জরুরি অবস্থা গােষণা করে মৌলিক অধিকার ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ স্থগিত করে।

৩. সরকারের কৃতি 

বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না, এটা ছিল পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থের অর্থনৈতিক শােষণ থেকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ কর্তৃক উত্থাপিত গণতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, শােষণমুক্ত সমাজ প্রভৃতি স্লোগান সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা উন্নততর জীবনের প্রত্যাশা সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পরেও শাসক দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। কিন্তু সরকার তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা তথা নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধানের মতাে সাধারণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও শাসকদল দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে জনগণ শাসকবর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং শাসন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ আনুগত্য হ্রাস পায়। 

ক. অর্থনৈতিক উন্নয়ন 

আধুনিক যুগে সরকারের কার্যকরতার অন্যতম প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্ত সংসদীয় আমলে (১৯৭৩-৭৫) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবর্তে নানা দিক দিয়ে অবনতি ঘটে। বাংলাদেশ সেকেলে অর্থনীতির উত্তরাধিকারী একটি অন্যতম দরিদ্র দেশ। বিরাজমান দারিদ্র এবং সম্পদের স্বল্পতার সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ জনিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।”৪৯

নতুন সরকার, যার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ছিল খুবই কম, তার পক্ষে এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজটি ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তার ওপর ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় এক কোটি লােকসহ তিন কোটি গৃহছাড়া লােকের পুনর্বাসন সমস্যা। স্বাধীনতা লগ্নে বাংলাদেশের না ছিল বৈদেশিক মুদ্রা না ছিল খাদ্য মজুত। তবে জাতিসংঘ এবং বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের নিকট থেকে প্রাপ্ত ব্যাপক সাহায্য দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার সম্ভাব্যদুর্ভিক্ষ এড়াতে এবং উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্য সমাধা করতে সক্ষম হয়।৫০

১২১

আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছু ইতিবাচক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ তারিখে সরকার প্রধান প্রধান শিল্প এবং ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করে। বৈদেশিক বাণিজ্যেরও প্রায় ৮০% রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা (৩৩ একর) ধার্য করা হয় এবং ২৫ বিঘার কম জমির মালিকদের জন্য ভূমি রাজস্ব মওকুফ করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য সরকার ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে প্রথম পাঁচ-সালা পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়। এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্যসমূহ ছিল: ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের মধ্যে অর্থনীতির প্রধান খাতসমূহে উৎপাদনের মাত্রা ১৯৬৯-৭০ সালের সমান করা; মােট জাতীয় উৎপাদন ও বার্ষিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৫.৫% ও ২.৫% এ উন্নীত করা; সাধারণ মূল্য সূচকের উর্ধ্বগতি রােধ করা; এবং আয় ও সেবাসমূহের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।৫১

মােট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার যদিও ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে যথাক্রমে ৬.৭% ও ৯.৫% ছিল, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে তা দুই শতাংশে নেমে আসে; এবং জাতীয় উৎপাদন কিংবা মাথাপিছু আয় কোনােটাই ১৯৬৯-৭০ সালের মাত্রায় পৌছতে পারেনি (সারণি ৫.২ দ্রষ্টব্য)।

সরকার অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রােধ করতেও ব্যর্থ হয়, যার ফলে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ের ব্যক্তিরা চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত হয়। মধ্যম আয়ের সরকারি কর্মচারীদের জীবন যাত্রায় ব্যয়ের সূচক ১৯৬৯-৭০ সাল = ১০০ ধরে ১৯০৭৪-৭৫ সালে ৪০৭.৫৮-এ বৃদ্ধি পায়, এবং একই সময়ে শিল্প-শ্রমিকের ব্যয়ের সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩০.৬৮ (দ্রষ্টব্য : সারণি ৫.৩)।

সারণি ৫.২

বাংলাদেশের মােট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয়, ১৯৭২-৭৫

(১৯৭২-৭৩ সালের স্থিরীকৃত মূল্যে)

১৯৬৯-৭০ ১৯৭২-৭৩ ১৯৭৩-৭৪ ১৯৭৪-৭৫
মোট জাতীয় উৎপাদন (কোটি টাকায়) ৫১৮৩.৩ ৪৫৩০.০ ৪৯৬০.০ ৫০৫৯.৮
পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার- ৬.৭% ৯.৫% ২.০%
জনসংখ্যা (লক্ষ) ৬৯২ ৭৪০ ৭৬২ ৭৮৫
মাথাপিছু আয় (টাকা) ৭৪৯ ৬১২ ৬৫০ ৬৪৫

উৎস : Bangladesh Planning Commission, Economic Review, ১৯৭৫-৭৬, Appendix, Table 1.

১২২

সারণি ৫.৩ 

বাংলাদেশে মধ্যম শ্রেণির সরকারি কর্মচারি ও শিল্প-শ্রমিকদের জীবন যাত্রার

ব্যয়ের সূচক, ১৯৭১-৭২ থেকে ১৯৭৪-৭৫

(ভিত্তি ১৯৬৯-৭০ = ১০০)

অর্থ বছর মধ্যম শ্রেণির সরকারি কর্মচারি শিল্প শ্রমিক
১৯৭১ – ৭২ ১২১.৫২ ১০৮.১২
১৯৭২-৭৩ ১৮১.৫১ ১৯৩.৪৬
১৯৭৩-৭৪ ২৫২.৪৮ ২৬৮.২৭
১৯৭৪-৭৫ ৪০৭.৫৮ ৪৩০.৬৮

উৎস : Bangladesh Bureau of Statistics, 1979 Yearbook of Bangladesh, ঢাকা, ১৯৮০, সারণি ১০.১৫ ও ১০.২২, পৃষ্ঠা ৩৭৯ ও ৩৮৫।

যদিও স্বাধীনতার পর শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি পায়, দ্রব্যমূল্যের অনানুপাতিক বৃদ্ধির ফলে তাদের প্রকৃত আয় বা অর্থনৈতিক সুখ-সুবিধা ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের তুলনায় ৫০ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পায়। (দ্রষ্টব্য : সারণি ৫.৪)।

সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ সরকারি চাকরিজীবীগণও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে সরকার এক নতুন বেতন কাঠামাে প্রবর্তন করে, যেখানে সর্বোচ্চ বেতন মাসিক ৪০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০০০ টাকা ও সর্বনিম্ন বেতন মাসিক ৬৫ টাকার স্থলে ২০০ টাকা করা হয়। ফলে স্বাধীনতা পূর্বকালের তুলনায়, বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক কমে যায়।

সারণি ৫.৪সাধারণ ও শিল্প শ্রমিকদের নাম মাত্র আয় ও প্রকৃত আয়ের সূচক

১৯৭১-৭২ থেকে ১৯৭৪-৭৫

(ভিত্তি ১৯৬৯-৭০ = ১০০)

অর্থ বছর নাম মাত্র আয়ের সূচক প্রকৃত আয়ের সূচক
সাধারণ শ্রমিক শিল্প শ্রমিক সাধারণ শ্রমিক শিল্প শ্রমিক
১৯৭১-৭২ ১০৬.৫৬ ১০৯.৫৬ ৯৮.৫০ ১০১.৩৩
১৯৭২-৭৩ ১৩০.৪৭ ১৩৪.৪৯ ৬৭.৫৮ ৭০.২১
১৯৭৩-৭৪ ১৭৩.০৭ ১৬১.২৩ ৬৪.৫১ ৬০.৯৫
১৯৭৪-৭৫ ২২১.৩১ ১৯২.৩৭ ৫১.৩৯ ৪৩.৬৭

উৎস: Bangladesh Bureau of Statistics, 1979 Statistical yearbook of Bangladesh, ঢাকা, ১৯৮০, সারণি ১০,২৩ পৃষ্ঠা ৩৮৫।

১২৩

বাংলাদেশে মূল্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির অন্যতম কারণ ছিল ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি। তাছাড়া, সরকারের অদক্ষতা, অব্যবস্থা ও অনিয়ম এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শিল্পসমূহ রাষ্ট্রায়ত্ত করে। কিন্তু কলকারখানাসমূহ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় ক্যাডার কিংবা দক্ষ কর্মচারী ছিল না। এসব কারখানায় অনেক প্রশাসক বা ব্যবস্থাপককে ব্যক্তিগত অথবা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ােগদান করা হয়। ফলে শুধু দক্ষতা বা ব্যবস্থাপনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে দুর্নীতি রােধ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহে বহু অতিরিক্ত শ্রমিকও নিয়ােগ করা হয়।৫২ এসব কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস ও লােকসান বৃদ্ধি পায়।৫৩

কৃষিখাতের চেহারাও সমভাবে হতাশাজনক ছিল। বাংলাদেশে প্রায় ৮০% জমিতে ধান চাষ হয়। সুতরাং অর্থনীতিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের প্রভাব সমধিক। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন আবহাওয়া ও অন্যান্য কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭১-৭২ সালে স্বাধীনতা-যুদ্ধ জনিত বিশৃংখলার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে “সাম্প্রতিক কালের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক খরা দেখা দেয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশ “ত্রিশ বছরের ইতিহাসে অন্যতম মারাত্মক বন্যার কবলে পতিত হয়, যার ফলে প্রায় ৮৪৬ কোটি টাকা মূল্যের শস্যহানি ঘটে।৫৪ বন্যার কারণে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্য আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লক্ষ টন থেকে বেড়ে ২৯ লক্ষ টনে দাঁড়ায়।৫৫

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার ওপরে বাধানিষেধ আরােপ করায় সময়মতাে যথেষ্ট খাদ্যশস্য পৌঁছতে পারেনি।৫৬ খাদ্যশস্যের সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব দেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে, যার ফলে ১৯৭৪ সালের জুলাই-অক্টোবরে হাজার হাজার লােকের মৃত্যু ঘটে।৫৭

খ. বণ্টন ব্যবস্থা 

বিরাজমান দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট-প্রসূত সামাজিক অসন্তোষ ও উত্তেজনা অসম বণ্টনের কারণে আরাে বৃদ্ধি পায়।

স্বাধীনতার পর নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ কম ছিল এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত লাভ করতাে। এমন কি এই লভ্যাংশ সুষমভাবে বণ্টন হতাে না। বাণিজ্য লাইসেন্স বা পারমিটের একটা বড় অংশ ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্কে ভিত্তিতে অনেক অব্যবসায়ীর নামে বরাদ্দ করা হয়।৫৮ অভিজ্ঞতা বা মূলধনের অভাবে তারা এই সব লাইসেন্স পারমিট চড়া দামে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাছে। বিক্রি করে। এভাবে একাধিকবার পারমিট বেচাকেনার ফলে দ্রব্যমূল্য যেমন একদিকে বৃদ্ধি পায়, তেমনি অন্যদিকে স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়।

১২৪

যদিও ভূমি মালিকানা সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়, পরিবারের সংজ্ঞা এত শিথিল ছিল যে, একই পরিবারের বিবাহিত পুত্রগণ প্রত্যেকে ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমি রাখতে পারতাে।৫৯

এমনকি, ধনী কৃষকদের উদ্বৃত্ত জমি নিষ্ঠার সঙ্গে দখল এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভূমিহীন বা গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়নি।৬০

কৃষি ঋণের সুবিধাদিও কৃষখদের মধ্যে সমভবে বণ্টন করা হতাে না। ধনী কৃষকরাই এসব সুবিধা ভােগ করে এবং অধিকতর ধনী হয়।৬১

আরাে কয়েক শ্রেণির লােক অসদুপায়ে অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি ছিল পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসক, যারা ঐ সব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অবৈধভাবে বিক্রি বা পাচার করে অর্থ কামাই করে।৬২

দ্বিতীয়ত কিছু লােক স্বাধীনতার পর পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি জবরদখল করে এবং সেগুলাে ভাড়া দিয়ে কিংবা জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে অর্থশালী হয়।৬৩ তৃতীয়ত আমলাদের একটি অংশ দুনীতিপূর্ণ উপায়ে প্রচুর সম্পদের মালিক হয় বলে সাধারণের বিশ্বাস।

এভাবে যখন নির্দিষ্ট আয়ের পেশাজীবী, শিল্প-শ্রমিক এবং গরিব কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে, তখন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, শিল্পোদোক্তা, ধনী কৃষক, অসৎ আমলা, রাজনৈতিক কর্মী ও রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানার প্রশাসক বা ব্যবস্থাপকগণ প্রচুর অনুপার্জিত সম্পদের মালিক হয়। এই নব্য ধনীক শ্রেণি তাদের অর্থ উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়ােগ না করে বিলাসপূর্ণ জীবনযাত্রা কিংবা স্থায়ী সম্পত্তি (জমি, বাড়ি ইত্যাদি) ক্রয়ের জন্য ব্যয় করে। তাদের জীবনযাত্রার উচ্চমান ও বিলাসী ব্যয়ের প্রদর্শনী সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাম্য বােধ আরাে বৃদ্ধি করে। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের জায়গায় বাংলাদেশের ২২০০ পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয় বলে অনেকে সমালােচনা করেন।৬৪

গ. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভিন্ন বামপন্থী দল “দ্বিতীয় বিপ্লব” সমাধার উদ্দেশে রাজনৈতিক হত্যা, ব্যাংক-বাজার ও ধনী কৃষকদের শস্য-সম্পদ লুট, থানা আক্রমণ, যােগাযােগব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ, ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করে। তাছাড়া বহু সমাজ-বিরােধী ব্যক্তি, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বা তার পরে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে তারাও সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, চোরাচালান, ছিনতাই ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়। এভাবে স্বাধীনতার পর অপরাধের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৪ সালে অপরাধের সংখ্যা প্রায় ৯২% বৃদ্ধি পায়।৬৫ 

যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বাংলাদেশের ছােট পুলিশ বাহিনী ক্রমবর্ধমান অপরাধ রােধের পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল না।৬৬

১২৫

১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বে-আইনি অস্ত্র উদ্ধার, মজুতদারি ও চোরাচালান রােধে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রবিরােধী লােকজনদের আটক অভিযানে সাহায্য করার জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার সদস্যদের যৌথ অভিযানে ১৯৭৪ সালে ১৯৪৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার, ৭৬৮৪ টি অস্ত্র ও ৩,৩১,০৩৬ রাউন্ড গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।৬৭

আটক ব্যক্তিদের অনেকেই আওয়ামী লীগ অথবা তার অঙ্গ সংগঠনের সদস্য ছিল বিধায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এ অভিযান বন্ধ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন বলে অনেকে মনে করেন আটক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অনেককেই মুক্তি দেয়া হয় এবং সেনাবাহিনীর অভিযান ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়া হয়। সুতরাং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য কেবল ক্ষমতার অপর্যাপ্ততাই দায়ী ছিল না, সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা দৃঢ়তার অভাবও অনেকাংশে দায়ী ছিল।

ঘ. ক্ষমতাসীন দলের সংহতি 

সরকারের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ঐক্য ও সংহতির অভাব। আওয়ামী লীগ ছিল জাতীয়তাবাদী পাতি বুর্জোয়া একটি দল। এর লক্ষ্য ও কর্মসূচি এমন সাধারণ ভাষায় প্রণীত হয় যে, তা বিভিন্ন স্বার্থের লােকজনকে আকর্ষণ করে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে মুক্তিলাভের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা ও বিপরীতমুখী গােষ্ঠীসমূহকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত করে। সুতরাং স্বাধীনতা লাভের অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন স্বার্থগােষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ফলে ক্ষমতাসীন দল তার শক্তি ও কার্যকারিতা হারায়।

আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রধানত সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে। এই দলের ছাত্রফ্রন্টের বামপন্থী অংশ সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে একটি পৃথক দল গঠন করে। আওয়ামী লীগের মূল অংশ সমাজতন্ত্রকে তার অন্যতম আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে এবং অন্যতম মূলনীতি হিসাবে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কৌশল সম্পর্কে দলের মধ্যে স্পষ্ট মতৈক্য ছিল না। ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের গঠন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই দল দেশের প্রধান আর্থ-সামাজিক গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদীয় দলে সর্ববৃহৎ গােষ্ঠী ছিল আইনজীবীগণ, যাদের সংখ্যা ছিল ৩১%। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম গােষ্ঠী ছিল ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবী এবং তাদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮% ও ১১% (দ্রষ্টব্য : সারণি ৫.৫)। আওয়ামী লীগ-দলীয় অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ধনী। কৃষক পরিবার থেকে আগত এবং জমি ছাড়াও তাদের আয়ের উৎস ছিল বিভিন্ন ধরনের পেশা যেমন, ওকালতি, ব্যবসা বা শিক্ষকতা।৬৮ তারা কোনােরূপ আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন না।

১২৬

সারণি ৫.৫ 

বাংলাদেশের প্রথম সংসদে (১৯৭৩ – ৭৫ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের পেশাগত অবস্থান

পেশা সংখ্যা শতকরা হার
আইন ৯৫ ৩১
ব্যবসা ৫৪ ১৮
কৃষি ৩৫ ১১
শিক্ষকতা ৩২ ১০
চিকিৎসা ১৫
সাংবাদিকতা
ট্রেড ইউনিয়ন
অন্যান্য ৬১ ২০
মোট ৩০৭ ১০০

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের জীবন-বৃত্তান্ত, ঢাকা ১৯৭৫।

তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানে ব্যক্তিগত, সমবায়ী ও রাষ্ট্রীয় এই তিন রকমের মালিকানার বিধান ছিল। কিন্তু বিভিন্ন রকমের মালিকানার সীমা ও আপেক্ষিক ভূমিকা নির্ধারণের দায়িত্ব সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল অংশ, যেমন উদ্বৃত্ত কৃষক, ব্যবসায়ী ও উদীয়মান শিল্প উদ্যোক্তাগণ ব্যক্তিগত, সমবায়ী ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার সহ-অবস্থানকে স্থায়ী ব্যবস্থা মনে করতাে এবং বেসরকারি খাতের বৃহত্তর ভূমিকার পক্ষপাতী ছিল। অপরদিকে, ছাত্র ও শ্রমিক সমর্থিত আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত বামপন্থী অংশ বিরাজমান তিন রকমের মালিকানা ব্যবস্থাকে একটি অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে এবং পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মুজিব একটা মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বিপরীতমুখী গােষ্ঠীসমূহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেন।৬৯

সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে এই দ্বন্দ্ব ছাড়াও আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের মধ্যে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার প্রকট দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল, যা তার অঙ্গ সংগঠনগুলাের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালেই দলীয় অন্তর্দ্বন্দের প্রকাশ ঘটে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ কিংবা উপদলীয় নেতাদের মধ্যে পদ বণ্টনের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন।৭০

কিন্তু ১৯৭৪ সালে প্রকাশ্যে বাকবিতণ্ডা এবং সরকার ও দল থেকে পদত্যাগ কিংবা অপসারণের মধ্য দিয়ে দলীয় কোন্দল তীব্রতর হয়। ১৯৭৪ সালের ৭ জুলাই তারিখে নয়জন মন্ত্রী পদচ্যুত হন। যদিও পদচ্যুত মন্ত্রীগণ দলত্যাগ করেননি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারের সমালােচনায় লিপ্ত হন।৭১

১২৭

অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরকারের নীতিই দায়ী।৭২ ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তাকেও পদত্যাগ করতে হয়। 

আওয়ামী লীগের নিম্নতর পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের মধ্যেও উপদলীয় কোন্দল বিস্তার লাভ করে। একটি উপদলের নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন আওয়ামী যুব লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগসমর্থিত শ্রমিক লীগের ওপরও তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। অপর একটি দলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও প্রধান মন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদ। তাদের প্রধান সমর্থন ভিত্তি ছিল ছাত্রলীগ। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে রাজ্জাক-তােফায়েল সমর্থক ছাত্রলীগ নেতারা শেখ মনিকে লক্ষ্যবস্তু করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান শুরু করেন। তার ফলে ছাত্র লীগের মধ্যে যে বিবাদ ঘটে তার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাতজন ছাত্র নিহত হয়। শেখ মনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাঁর মৌলিক মতবিরােধের কথা প্রকাশ করেন। যদিও শেখ মনি পরে তার পদত্যাগ প্রত্যাহার করেন, তিনি এবং তাঁর যুবলীগের সহযােগীরা সরকারের সমালােচনা অব্যাহত রাখেন। তাঁরা “আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ”-কে অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করেন। তাছাড়া শেখ মনি যুক্তি উত্থাপন করেন যে, বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। এবং দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে “দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রয়ােজন।৭৩

যদিও ১৯৭৪ সাল ভর উপদলীয় কোন্দল চলতে থাকে, আপাত দৃষ্টিতে সব উপদলই দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রতি অনুগত ছিল। সংকীর্ণ রাজনৈতিক ভিত্তির কারণে দলের মধ্যে মন্ত্রিবর্গ এবং অন্যান্য নেতাদের অবস্থান ছিল খুব দুর্বল; তাঁদের প্রায় সবাই রাজনৈতিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ফলে মুজিবের পক্ষে বিবদমান পক্ষগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করা ও দলের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয়।

বঙ্গবন্ধু মুজিবের সম্মােহনী ব্যক্তিত্ব দলীয় ঐক্য রক্ষার ক্ষেত্রে একটা শক্তিশালী উপাদান হলেও শাসন ব্যবস্থার ওপর এর অশুভ প্রভাব কম পড়েনি। তাঁর ব্যাপক ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারাে কোনাে মূল্য ছিল না। কোনাে প্রস্তাব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদন মন্ত্রিসভার অনুমােদনেরই সামিল ছিল। প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রির আওতায় হস্তক্ষেপও করতেন। এর ফলে মন্ত্রিদের মধ্যে অংশগ্রণবােধ, উদ্যোগ ও কর্মপ্রেরণা ক্ষুন্ন হয়। এবং মন্ত্রিসভার যৌথ দায়িত্বের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।৭৪

ঙ. সরকার ও আমলাবর্গ 

দক্ষ ও অনুগত আমলার অপর্যাপ্ততার অভাবও আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। স্বাধীনতার প্রাক্কালে প্রায় সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার

১২৮

সেবার জন্যে মােট ৪,৫৪,৪৫০ জন বেসামরিক কর্মচারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১১,১৩০ জন প্রথম শ্রেণি ও ১২,৩২০ জন দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত কর্মকর্তা ছিলেন, যাদেরকে মােটামুটি উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন আমলা বলা যেতে পারে।৭৫

এভাবে বাংলাদেশে কর্মকর্তা ও জনসংখ্যার অনুপাত (প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য মাত্র তিনজন) ছিল অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার প্রথম লগ্নে বাংলাদেশ অনেক দক্ষ কর্মচারির সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়। সিনিয়র ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাঙালি কর্মচারিগণ, যারা স্বাধীনতা পূর্বকালে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসতে প্রায় দু’বছর সময় লাগে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার অনেক অভিজ্ঞ কর্মচারীকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে যােগসাজসের দায়ে চাকরিচ্যুত করে।

স্বাধীনতার পরপরই সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয় তাও আমলাতান্ত্রিক মনােবল ও শৃংখলাকে দারুণভাবে ব্যাহত করে।৭৬

প্রথমত বিরােধ বাধে পাকিস্তানের সঙ্গে যােগসাজসকে কেন্দ্র করে। যে-সব কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান এবং কোলকাতাস্থ “মুজিবনগর” সরকারের অধীনে কাজ করেন তাঁরা নিজেদের খাঁটি দেশপ্রেমিক বলে দাবি করেন।৭৭

এমনকি শীর্ষ স্থানীয় সরকারি নেতৃবৃন্দও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেন এমন সব কর্মচারীর আনুগত্য ও দেশপ্রেম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতেন।৭৮

যেখানে প্রায় ৬০০০ বেসামরিক কর্মচারী পাকিস্তানের সঙ্গে যােগসাজসের দায়ে চাকরিচ্যুত হন সেখানে “মুজিবনগর” কর্মচারীদের দ্রুত পদোন্নতি ও অতিরিক্ত বেতন বৃদ্ধি মঞ্জুর করা হয়।৭৯

পাকিস্তানে আটকে পড়া কর্মচারীদের প্রত্যাবর্তনের পর আমলাদের মধ্যেকার বিরােধ জটিলতর হয়। নতুন সরকারের অধীনে উচ্চতর পদসমূহ পূর্বেই পূরণ হয়ে যাওয়াই পাকিস্তান ফেরত কর্মচারীদের অনেকেই অধস্তন পদে নিয়ােগ লাভ করেন। ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া প্রাক্তন সি এস পি ও ই পি সি এস ক্যাডারদ্বয়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের মধ্যেকার বিরােধ আমলাতন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত করে।৮০

আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু নীতিগত পদক্ষেপও বেসামরিক আমলাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পাকিস্তান আমলে উচ্চতর ক্যাডারের আমলাগণ প্রশাসন ও রাজনীতিতে প্রাধান্য লাভ করেন।৮১ বাঙালি আমলাদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে, পাকিস্তানি, আমলাদের অবর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরাও প্রাধান্য পাবেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজনীতিকরাই সামনে চলে আসেন এবং নতুন সরকার রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমলাদের ঐতিহ্যগত ক্ষমতা ও সুযােগ-সুবিধা খর্ব করার জন্য কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত ১৯৭২ সালে গঠিত প্রশাসনিক পুনর্গঠন কমিটি বাংলাদেশের সকল প্রশাসনিক ক্যাডারের একীভূতকরণ ও সি এস পি সদস্যদের জন্য উচ্চ 

১২৯

দায়িত্ব সম্পন্ন পদসমূহ সংরক্ষণের পাকিস্তানি রীতি বিলােপের জন্য সুপারিশ করে। এর উদ্দেশ্যে ছিল এলিট ক্যাডারের অবসান।৮২

দ্বিতীয়ত ১৯৭৩ সালে প্রবর্তিত নতুন বেতন কাঠামাে কেবল উচ্চতর আমলাদের বেতনই হ্রাস করেনি, নিম্নতর পদের কর্মচারিদের সঙ্গে পার্থক্য কমিয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বােধকেও আঘাত করে। তৃতীয়ত পাকিস্তানি ঐতিহ্য ভঙ্গ করে কিছু সংখ্যক আমলাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ােগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মন্ত্রনালয়সমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও তাদের ওপর খবরদারি করার ক্ষমতাসম্পন্ন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যদের প্রায় সবাই ছিলেন। শিক্ষক এবং তাঁদেরকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। আমলাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল তাদের আওতায় অনধিকার প্রবেশ। ফলে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে উচ্চতর। আমলাদের বিবাদ সৃষ্টি হয়, যা কমিশনের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে বিস্তর বাধার সৃষ্টি করে।৮৩

সরকারের যে পদক্ষেপটি সাধারণভাবে সকল কর্মচারীকে আঘাত করে তা হলাে চাকরি সংক্রান্ত ঐতিহ্যগত সাংবিধানিক রক্ষাকবচ বাতিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিধান করা হয় যে, সরকারি কর্মচারীগণ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুযায়ী চাকরিতে বহাল থাকবেন, এবং নিয়ােগকারী কর্তৃপক্ষ কারণ প্রদর্শন না করে এবং আদালতে কোনােরূপ আপীলের সুযােগ না দিয়েই যে কোনাে কর্মচারীকে অপসারণ, পদচ্যুত কিংবা পদাবনমিত করতে পারেন। চাকরির এই নিরাপত্তাহীনতা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে।৮৪

রাজনীতিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলেও সরকারি কর্মচারীবর্গ তাদের মনােবল, দক্ষতা ও কর্মোদ্যোগ হারায়।৮৫

৪. সাংবিধানিক পরিবর্তন 

১৯৭৩ -৭৫ সময়কালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে চারটি সংশােধনী যােগ করে। চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকারের স্থলে একদলীয় রাষ্ট্রপতি সরকার প্রবর্তন করে। সংশােধনীসমূহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে নিম্নে আলােচিত হলাে।

ক. প্রথম সংশােধনী 

১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে গৃহীত প্রথম সংশােধনীর দ্বারা ৪৭ অনুচ্ছেদে একটি নতুন ধারা যােগ করা হয়। এই ধারায় বিধান করা হয় যে, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, অখবা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগের সশস্ত্র বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর কোনাে সদস্য অথবা কোনাে যুদ্ধবন্দির আটক, বিচার অথবা শাস্তির বিধান সম্বলিত কোনাে আইন সংবিধানের কোনাে ধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যতার কারণে বাতিল বলে গণ্য হবে না। প্রথম সংশােধনীর দ্বারা ৪৭ (ক) সংখ্যক একটি নতুন অনুচ্ছেদও সন্নিবেশিত হয়। এতে বলা হয়, উপযুক্ত অপরাধগুলাের জন্য

১৩০

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, আইনের ভূতাপেক্ষ প্রয়ােগের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ, প্রকাশ্য বিচারের অধিকার এবং মৌলিক অধিকার বলবৎ করার। জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

এভাবে প্রথম সংশােধনী দ্বারা গণহত্যা বা যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত যে কোনাে সশস্ত্র বা সহায়ক বাহিনীর সদস্যদের কতিপয় অধিকার খর্ব বা হরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সংসদকে যথােপযুক্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা।৮৬

খ. দ্বিতীয় সংশােধনী 

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহীত দ্বিতীয় সংশােধনীর দ্বারা নিবর্তনমূলক আটক ও জরুরি অবস্থা ঘােষণার বিধান করা হয়। এর দ্বারা সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের সংশােধন করে বলা হয় যে, সংসদ আইনের দ্বারা যে কোনাে ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে আটক রাখার ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগকে দিতে পারবে। গ্রেফতারকৃত কোনাে ব্যক্তিকে অনধিক ছ’মাস আটক রাখা যেতে পারে। কেবল সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একটি উপদেষ্টা পরিষদের সুপারিশক্রমে তাকে ছ’মাসের অধিক আটক রাখা যাবে।৮৭

হলে তাকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং উক্ত আদালতের অনুমতি ব্যতীত তাকে আর আটক রাখা যাবে না। 

দ্বিতীয় সংশােধনীর দ্বারা ৬৩ অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) ধারা বিলােপ করা হয় এবং একটি নতুন ভাগ (নবম-ক) যােগ করা হয়। এই নতুন ভাগে বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতির নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে বাংলাদেশ বা তার কোনাে অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তবে তিনি (অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে) জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারবেন। এমন কি, প্রকৃত “যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ কিংবা অভ্যন্তরীণ গােলযােগ সংঘটিত হবার আগেই রাষ্ট্রপতি যদি বিপদ আসন্ন বলে মনে করেন তবে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারবেন। অনুরূপ ঘােষণা সংসদে উপস্থাপিত হবে এবং তা সংসদ কর্তৃক অনুমােদিত না হলে ১২০ দিনের বেশি বলবৎ থাকবে না। জরুরি অবস্থা চলাকালে সংবিধানের ৩৬,৩৭,৩৮,৩৯,৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রদত্ত যথাক্রমে চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, বাক্ স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার খর্ব কিংবা রহিত করা যাবে এবং রাষ্ট্রপতির আদেশ নির্দিষ্ট অনুরূপ যে কোনাে অধিকার বলবতের জন্য আদালতে আবেদন করার অধিকার স্থগিত রাখা যাবে। 

মূল সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদের (২) ও (৩) ধারায় বিধান ছিল যে, রাষ্ট্রপতি প্রকৃত বা আসন্ন আক্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। করতে পারবেন, তবে তাকে তৎক্ষণাৎ সংসদ আহ্বান করতে হবে এবং কেবল

১৩১

সংসদই “যুদ্ধ কিংবা আক্রমণ বা সশস্ত্র বিদ্রোহের কালে” জননিরাপত্তা নিশ্চিত ও রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য যে কোনাে আইন প্রণয়ন করতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় সংশােধনীর দ্বারা নির্বাহী বিভাগকে জরুরি অবস্থা ঘােষণার অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয় এবং জরুরি অবস্থা চলাকালে নির্বাহী বিভাগ এমন কি অভ্যন্তরীণ গােলযােগের অজুহাতে মৌলিক অধিকার রহিত করে একনায়কসুলভ ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারতাে। এই ক্ষেত্রে একটি মাত্র বাধা ছিল এবং তা হলাে এই যে, কোনাে মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণের যে কোনাে আদেশ “যথাসম্ভব শীঘ্র” সংসদে পেশ করতে হবে। দ্বিতীয় সংশােধনীর দ্বারা আরাে বিধান করা হয় যে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এই কারণে সুপ্রিম কোর্ট সংসদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধানের কোনাে সংশােধনী বাতিল বলে ঘােষণা করতে পারবে না। তাছাড়া সংসদের দুই অধিবেশনের মধ্যেকার বিরতিকাল সর্বাধিক ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়।

গ. তৃতীয় সংশােধনী 

১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে তৃতীয় সংশােধনী গৃহীত হয়। এর দ্বারা সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদ সংশােধন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বালাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানা চিহ্নিতকরণ সম্পর্কে ১৯৭৪ সালের মে মাসে দু’দেশের মধ্যে দিল্লীতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা বাস্তবায়ন করা।৮৮

যেহেতু দিল্লী চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভূখণ্ড বিনিময়ের ব্যবস্থা ছিল, সেহেতু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এক মামলায় রায় প্রদানকালে অভিমত প্রদান করে না যে, উক্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের সংশােধন প্রয়ােজন, কারণ সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের সীমানা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া রয়েছে।৮৯

ঘ. চতুর্থ সংশােধনী 

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তারিখে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী দ্বারা সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয় এবং নির্বাহী বিভাগ, আইন, বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার ব্যাপক রদবদল সাধিত হয়।

নির্বাহী বিভাগ : রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধীনস্থ কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারবেন। তিনি পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবেন। চতুর্থ সংশােধনী দ্বারা উপরাষ্ট্রপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হতেন, তবে রাষ্ট্রপতি যে কোনাে সময় তাঁকে অপসারণ করতে পারতেন। রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কাজে সহায়তা ও পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদের বিধান করা হয়। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রীকে তাঁর

১৩২

স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে নিয়ােগ করতেন। সংসদ-সদস্য কিংবা সংসদ-সদস্য হবার যােগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মন্ত্রিগণ নিযুক্ত হতেন। সকল মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুযায়ী পদে বহাল থাকতেন।

জাতীয় সংসদ : জাতীয় সংসদের মূল কাঠামাে অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু তার অনেক ক্ষমতা খর্ব করা হয়। রাষ্ট্রপতি কিংবা মন্ত্রিগণ সংসদের নিকট দায়ী ছিলেন না। অপর দিকে, সংসদ কর্তৃক গৃহীত যে কোনাে বিল (সংবিধান সংশােধন বিল ব্যতীত) রাষ্ট্রপতি নাকচ করতে পারতেন (মূল সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি সংসদের পুনর্বিবেচনার জন্য কোনাে বিল ফেরৎ পাঠাতে পারতেন, কিন্তু তাঁর কোনাে ভেটো ক্ষমতা ছিল না)। রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশনে আহ্বান বা মুলতবি করতেন এবং নিজ ইচ্ছানুযায়ী সংসদ ভেঙে দিতে পারতেন। সংবিধান লংঘন, গুরুতর অসদাচরণ কিংবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন ও অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের হাতে থেকে যায়। কিন্তু মূল সংবিধানে যেখানে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের জন্য সংসদ-সদস্যদের দুইতৃতীয়াংশ ভােটের প্রয়ােজন হতাে চতুর্থ সংশােধনীর দ্বারা সেখানে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান করা হয়। সংসদ শুধু নির্বাহী বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণই হারায়নি, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির রীতি মােতাবেক নির্বাহী বিভাগের সমান মর্যাদাও তাকে দেয়া হয়নি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ােগ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমােদনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের যেরূপ ক্ষমতা রয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদকে সেরূপ কোনাে ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

বিচার বিভাগ : চতুর্থ সংশােধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়ােগ ও অপসারণ-এর বিধান সম্বলিত ৯৫ ও ৯৬ অনুচ্ছেদকে এমনভাবে সংশােধন করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারককে তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে নিয়ােগ করতেন এবং যে-কোনাে বিচারককে “প্রমাণিত অসদাচরণ কিংবা অসামর্থ্যের কারণে” অপসারণ করতে পারতেন। অবশ্য অনুরূপ অপসারণের পূর্বে বিচারকদের কারণ প্রদর্শনের জন্য “যুক্তিসঙ্গত সুযােগ দিতে হতাে। মূল সংবিধানে নিম্নতর আদালতসমূহে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিচারকদের নিয়ােগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশের যে বিধান ছিল চতুর্থ সংশােধনীর দ্বারা তা রহিত করা। হয়। তাছাড়া, বিচারকর্মে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা বিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের নিকট থেকে রাষ্ট্রপতির নিকট হস্তান্তর করা হয়। মূল সংবিধানে ৪৪ অনুচ্ছেদের দ্বারা মৌলিক অধিকার বলবৎ-এর জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিকট আবেদন করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু চতুর্থ সংশােধনীর দ্বারা মৌলিক অধিকারসমূহ বলবতের জন্য একটি সাংবিধানিক আদালত, ট্রাইব্যুনাল কিংবা কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য, সুপ্রিম কোর্টের ‘ম্যাডামাস’ ‘প্রহিবিশন’ ‘হেবিয়াস কর্পাস’, ‘কোওয়ারেন্টো’ ইত্যাদি আদেশ বা রিট জারি করার ক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে।

১৩৩

সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশােধনের ফলে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্ম কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। তার কারণ, যথাক্রমে ১১৮ ও ১৩৯ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন নির্বাচন কমিশন ও সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্যগণ সেই রূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হবেন।

দল : চতুর্থ সংশােধনীর সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী দিক ছিল একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। নবসংযােজিত নবম-ক ভাগে বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে তাঁর আদেশ বলে সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দিয়ে একটি মাত্র “জাতীয় দল গঠন করতে পারবেন এবং সেক্ষেত্রে জাতীয় দলের নামকরণ, কর্মসূচি, সদস্যপদ, সংগঠন, শৃংখলা, কার্যাবলী ও অর্থ সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। যখন জাতীয় দল গঠন করা হবে তখন (ক) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনাে সংসদ-সদস্য জাতীয় দলের সদস্যপদ গ্রহণ না করলে তিনি আর সংসদ-সদস্য থাকবেন না, (খ) জাতীয় দল কর্তৃক মনােনীত না হলে কোনাে ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি কিংবা সংসদ সদস্যরূপে নির্বাচনের যােগ্য হবেন না, এবং (গ) রাষ্ট্রপতির আদেশ সাপেক্ষে যে কোনাে সরকারি কমর্চারি জাতীয় দলের সদস্য হতে পারবেন। এই সংশােধনীর দ্বারা আরাে বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি যে-কোনাে সময় তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে একদলীয় ব্যবস্থা রহিত করতে পারবেন। 

চতুর্থ সংশােধনী দ্বারা ৭০ অনুচ্ছেদের সংশােধন করে সংসদ-সদস্যদের স্বাধীনতা আরাে সংকুচিত করা হয়। মূল সংবিধানে বলা হয় যে, কোনাে সংসদসদস্য তাঁর দল ত্যাগ করলে কিংবা সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভােট দিলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। সংশােধিত বিধান অনুসারে কোনাে সংসদ-সদস্য কেবল দলত্যাগ এবং সংসদে দলের বিপক্ষে ভােটদানের জন্যই তার সদস্যপদ হারাবেন না, তিনি দলের নির্দেশ অমান্য করে সংসদে অনুপস্থিত কিংবা ভােটদানে বিরত থাকলেও সদস্যপদ হারাবেন। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ সংশােধন করে “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিধানটি বিলােপ করা হয়। বিশেষ বিধানবলে তৎকালীন সংসদের আয়ু বৃদ্ধি করে সংশােধনীর তারিখ থেকে (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫) পাঁচ বছর ধার্য করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরবর্তী পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বলে ঘােষণা করা হয়।

এভাবে চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রবর্তন করা হয়। সংসদ, মন্ত্রীপরিষদ, বিচার বিভাগ ও দল কার্যত রাষ্ট্রপতির অধীনস্থ হয়ে পড়ে। বাস্তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির হাতে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, একজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং সােভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের ক্ষমতা একত্রীভূত করা হয়। 

১৩৪

ঙ. সংশােধন প্রক্রিয়া 

সংবিধানে লিখিত নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণে সংশােধনীসমূহ গৃহীত হয়। কিন্তু সংশােধনের প্রশ্নে কোনাে সময় জনমত যাচাই-এর কোনাে চেষ্টা করা হয়নি। এমনকি সংসদ-সদস্যগণ সংসদের ভিতরে আলােচনার পর্যাপ্ত সুযােগ পাননি। সারণি ৫.৬।

সারণি ৫.৬ 

সংশােধনীসমূহ সংসদে উত্থাপন ও গ্রহণের তারিখ এবং সেগুলাে সংসদে পাসের জন্য গৃহীত সময় (১৯৭৩-৭৫)

সংশােধনী বিল উত্থাপনের তারিখ বিল পাসের তারিখ গৃহীত সময়
প্রথম সংশােধনী ১২-০৭-৭৩ ১৪-০৭-৭৩ ৩ ঘণ্টা
দ্বিতীয় সংশােধনী ১৮-০৯-৭৩ ২০-০৯-৭৩ ২ ঘণ্টা
তৃতীয় সংশােধনী ২১-১১-৭৪ ২৩-১১-৭৪ ৫ ঘণ্টা
চতুর্থ সংশােধনী ২৫-০১-৭৫ ২৫-১-৭৫ ৭০ মিনিট

উৎস : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৩৫ (১৯৭৩); খণ্ড ৩, সংখ্যা ৫ (১৯৭৩); খণ্ড ৩, সংখ্যা ৩ (১৯৭৪); খণ্ড ৩, সংখ্যা ৫ (১৯৭৪); খণ্ড ১, সংখ্যা ২ (১৯৭৫)।

থেকে দেখা যায় যে, প্রথম তিনটি সংশােধনী বিল যেদিন সংসদে উত্থাপন করা হয় তার মাত্র একদিন পরেই গৃহীত হয় এবং চতুর্থ সংশােধনীটি উপস্থাপনের দিনই সংসদে গৃহীত হয়। চতুর্থ সংশােধনীটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে, অথচ সেটাই সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে পাস করা হয়। এই সংশােধনীটি এমন নাটকীয়ভাবে গৃহীত হয় যে, এটাকে অনেকে “সাংবিধানিক অভ্যুত্থান” বলে আখ্যায়িত করেন। চতুর্থ সংশােধনী বিলটি ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বেলা ১০ টার সময় সদস্যদের টেবিলে পেশ করা হয় এবং তার ১০ মিনিট পরই তা আলােচনার জন্য সংসদে উত্থাপিত হয়। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ স্থগিত করে কোনােরূপ আলােচনা ছাড়াই সংশােধনী বিলটি বেলা ১১টা ২০ মিনিটের সময় গৃহীত হয়। এভাবে বিলটি পাস করতে সময় লাগে সর্বমােট ৭০ মিনিট, যার মধ্যে প্রায় ৫০ মিনিট ব্যয় হয় সংসদে ডিভিশন ও ভােটগণনা করার জন্য।৯০

চ. সাংবিধানিক পরিবর্তনের আবশ্যকতা 

প্রথম ও তৃতীয় সংশােধনীদ্বয় আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে গৃহীত হয়। প্রথম সংশােধনীটির তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে ধৃত পাকিস্তানি যুদ্ধ বন্দী ও মানবতা বিরােধী কাজের বিচারের জন্য যথােপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা এবং তৃতীয়টি গৃহীত হয় ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ-ভারত সীমানা চুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়ােজনে। এ দুটি সংশােধনীর দ্বারা সরকারের কাঠামাে বা ক্ষমতার কোনাে পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশােধনীর

১৩৫

মাধ্যমে সরকারের কাঠামাে ও বৈশিষ্ট্য এবং মূল নীতি বা আদর্শের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। যেখানে দ্বিতীয় সংশােধনীর দ্বারা নাগরিকদের কতিপয় মৌলিক অধিকার খর্ব ও সরকারের দমন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় সেখানে চতুর্থ সংশােধনীর দ্বারা সংসদীয় গণতন্ত্র বিলােপ করে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এখন প্রশ্ন হলাে কেন ক্ষমতাসীন দল সংবিধান প্রবর্তনের মাত্র দু’বছরের মধ্যে সংবিধানের এরূপ আমূল পরিবর্তন সাধন করে?

তৃতীয় অধ্যায়ে দেখা গেছে যে, সংবিধান সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। ইসলামী ডানপন্থী গােষ্ঠীসমূহ দুই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, যথা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের কট্টর বিরােধী ছিল। অধিকাংশ বামপন্থী দল রাষ্ট্রীয় মূলনীতিসমূহ গ্রহণ করে কিন্তু তারা মনে করে যে, এই মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত বিধান সংবিধানে নেই। ইসলামী ও চীনপন্থী বাম গােষ্ঠীসমূহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মেনে নেয়নি এবং নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে মনে করতাে না। আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী দলগুলােকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে এবং তথাকথিত “মুসলিম বাংলা” আন্দোলন দমনে সমর্থ হয়। কিন্তু উগ্র বামপন্থীরা আত্মগােপন করে এবং আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র কার্যকলাপ চালাতে থাকে। কতিপয় প্রকাশ্য বামপন্থী বিরােধী দলও উগ্র। বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম”-এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। এভাবে জাতীয় একাত্মতা ও প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি আনুগত্যের অভাব নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সহযােগিতার বিকাশ ব্যাহত করে এবং সরকার ও বামপন্থীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের সৃষ্টি করে।

অংশগ্রহণের চাহিদা ও সাড়ার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরাে বিষাক্ত করে তােলে। আত্মগােপনকারী বামপন্থী দলসমূহ সশস্ত্র সংগ্রামের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং তারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনয়নের জন্য শ্রেণিশত্রু খতমের সন্ত্রাসী কৌশল গ্রহণ করে। প্রকাশ্য দলগুলাের মধ্যেও অনেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিল না; তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য তারা যুগপৎ সংসদীয় রাজনীতি ও গণআন্দোলনের কৌশল অনুসরণ করে। সংসদে বিরােধী দলসমূহের স্বল্প প্রতিনিধিত্ব, আওয়ামী লীগ কর্তৃক বিরােধী দলকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দানে অস্বীকৃতি এবং সংসদে পর্যাপ্ত আলােচনার সুযােগের অভাব, ইত্যাদি কারণে বিরােধী দলসমূহের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি তাদের যে সামান্য আগ্রহ ছিল তাও নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা সংসদ। বহির্ভূত সহিংস আন্দোলনের প্রতি অধিক মাত্রায় ঝুঁকে পড়ে। আবার কোনাে কোনাে দল (যেমন জাসদ) কৌশলগত কারণে সহিংস পন্থা অবলম্বন করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্ররােচিত করে জনসহানুভূতি অর্জন এবং কর্মীদের মধ্যে জঙ্গি মনােভাব সৃষ্টি করা। 

১৩৬

বিরােধী দলসমূহের সহিংস কার্যকলাপ ১৯৭৩ সালের গ্রীষ্মকাল নাগাদ ব্যাপকতা লাভ করে। তৎকালীন আইনমন্ত্রীর বিবৃতি অনুসারে, ১৯৭৩ সালে ৫২০০ টি ডাকাতি, ২৫০০টি হত্যা এবং ২৬টি ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে। ঐ বছর ৫৭টি পুলিশ টহলদার ইউনিট ও ৩০টি থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত ও লুট হয় এবং ২৩ জন পুলিশ কর্মচারী নিহত হন। ১৯৭২ সালে উগ্রপন্থীদের হাতে ১১৫ জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন। ১৯৭৩ সালে রাজনৈতিক হত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৩ (যার মধ্যে ছিলেন ৩ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ-সদস্য)৯১

কেবল ১৯৭৩ সালের জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে ১৩টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ১৮টি বাজার আক্রান্ত হয়, ১৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬৬৮০টি গােলাবারুদ লুট হয় এবং ২৬ জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন।৯২

রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকার উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহীত দ্বিতীয় সংশােধনীটি ছিল এই ব্যবস্থাকে বৈধকরণের একটি প্রক্রিয়া। এই সংশােধনীর অনুসরণে সংসদ ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “বিশেষ ক্ষমতা আইন” নামে এক নিবর্তনমূলক আইন পাস করে। এই আইনের দ্বারা যে কোনাে ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটক রাখা, যে কোনাে রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ এবং সংবাদপত্রসমূহ সেন্সর বা বন্ধ করার ক্ষমতা সরকারকে দেয়া হয়। এই আইনের অধীনে বহু বিরােধী দলীয় কর্মীকে গ্রেফতার এবং কতিপয় সংবাদপত্রকে হয়রানি করা হয়। সরকারের এইসব পদক্ষেপকে বিরােধী দলসমূহ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বরখেলাপ বলে মনে করে এবং সরকারকে বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে উৎখাতের জন্য তাদের কেউ কেউ (জাসদ) সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। 

ইতােমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে এবং ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি আমলাবর্গের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধু মুজিবের জনপ্রিয়তা অনেকাংশে হ্রাস করে। মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির জীবন যাত্রার মান যখন কমতে থাকে তখন এক বিলাসী জাঁকজমকপূর্ণ নব্য ধনীক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। এর ফলে কেবল সামাজিক উত্তেজনাই সৃষ্টি হয়নি, একটা ন্যায়ানুগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যে প্রতিশ্রুতি তার প্রতি জনগণ বিশ্বাস হারাতে থাকে। এভাবে শাসক ও শাসিতের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়।

বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারতাে যদি শাসকবর্গ তাঁদের বিরােধীদের ক্ষমতার দোরগােড়ায় আসতে দিতে প্রস্তুত থাকতেন। কিন্তু প্রধানত দুটি কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রথমত সরকার ও বিরােধী পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের প্রচণ্ড অভাব ছিল। কোনাে কোনাে বিরােধী দল আওয়ামী লীগকে পরদেশ নির্ভর সরকার বলে মনে করতাে, তেমনি ক্ষমতাসীন দল নিজেকে জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে ফেলে এবং বিরােধী পক্ষকে স্বাধীনতার শত্রু এবং বিদেশের চর বলে গণ্য করে। দ্বিতীয়ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল অত্যন্ত

১৩৭

ঝুঁকির ব্যাপার। যেহেতু অধিকাংশ বিরােধী দল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিল না সেহেতু তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি না করে সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে একটা “সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তারা আওয়ামী লীগ বা তার মিত্র শক্তিকে (বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ-মােজাফফর) এই “জাতীয়” সরকারের অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি ছিল না। এভাবে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে ক্ষমতা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার আশংকায় তার বিরােধীদের ক্ষমতা থেকে দূরে। রাখতে চায় এবং দমনমূলক নীতি অনুসরণ করে।

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে উগ্রপন্থীরা তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপ জোরদার করে এবং প্রকাশ্য দিবালােকে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের হত্যা আরম্ভ হয়। আওয়ামী লীগের একটি অংশ (যার মধ্যে শেখ মনি ছিলেন অন্যতম) এবং মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টি বলতে শুরু করে যে, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, এবং তারা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে মৌলিক পরিবর্তন আনয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ দিতে থাকে।৯৩

শেখ মুজিবও দেখেন যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে তিনি “জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। সম্ভবত “জাতিরজনক” হিসেবে তিনি তাঁর এই ব্যর্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।৯৪

সুতরাং তিনি এক নতুন সাংবিধানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেহেতু মুজিব তার দলের প্রতি আস্থা হারান, সেহেতু তিনি নিজের হাতে সামগ্রিক ক্ষমতা তুলে নিতে চান। এবং আওয়ামী লীগও তাৎক্ষণিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৫ সালের ১৯-২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ দল বঙ্গবন্ধুকে দেশের সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য প্রয়ােজনীয় যে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করে।৯৫ এবং জাতীয় সংসদ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থলে এক ধরনের রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যেখানে রাষ্ট্রপতি হিসাবে মুজিব হবেন সর্বেসর্বা এবং তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে এক দলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারবেন।

বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশােধনীর পক্ষে যে-সব যুক্তি প্রদর্শন করেন সেগুলাে ছিল। নিম্নরূপ : 

১. সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি বিরােধী দলসমূহের কোনাে আস্থা ছিল না। তারা জোরপূর্বক সরকারকে উৎখাত করতে চায় এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করে। 

২. উগ্রপন্থীগণ এবং পকিস্তানের সঙ্গে যােগসাজশকারীরা বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি। তারা দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে থাকে। বাংলাদেশের মাটিতে তাদেরকে কাজ করতে দেয়া যায় না। 

৩. অফিস-আদালত, কল-কারখানা এবং রাজনীতি-সর্বত্রই ‘ফ্রি স্টাইল বা বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, যার ফলে প্রশাসনের দক্ষতা ও উৎপাদন ব্যাহত হয়।

১৩৮

৪. বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা জনগণের মঙ্গল সাধনে ব্যর্থ হয়। যখন সাধারণ মানুষ খেতে পায় না তখন একটা ক্ষুদ্র গােষ্ঠী দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা ও সম্পদ দখলের সীমাহীন প্রতিযােগিতায় লিপ্ত । মুষ্টিমেয় ধনী এবং লুটেরাদের এই গণতন্ত্র বাদ দিয়ে “শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজতন্ত্র তথা “শােষণ মুক্ত সমাজ” প্রতিষ্ঠার জন্য এই পরিবর্তনের প্রয়ােজন ছিল।৯৬ 

শেখ মুজিবের মূল কথা ছিল এই যে, সংসদীয় ব্যবস্থা অরাজকতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং তিনি এজন্য বিরােধী দলগুলােকে দায়ী করেন। এটা সত্য যে, সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর করার জন্য যেরূপ দায়িত্বশীল বিরােধী দলের প্রয়ােজন বাংলাদেশে তার অভাব ছিল। প্রধান বিরােধী দলসমূহ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না এবং তারা সাংবিধানিক নিয়ম-রীতি লংঘন করতাে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বিরােধী দলের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতার অভাব এবং শাসক দলের মধ্যে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র ও বিশৃংখলা সংসদীয় সরকারের ব্যর্থতার জন্য কম দায়ী ছিল।৯৭

তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন একজন সংস্কারবাদী এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর নিঃশর্ত অঙ্গীকার ছিল বলে মনে হয় না। ১৯৭২ সালে গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হবার পর তিনি মন্তব্য করেন :

“আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ করে থাকে। আমরা চাই শােষিতের গণতন্ত্র এবং … সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে।… সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লােকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে”।৯৮

বাস্তবিক পক্ষে, ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা সংসদীয় গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই দুই দাবির মুখে এক আপসরফা। ১৯৭০-৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের প্রতি প্রচণ্ড জনসমর্থন হয়তাে তাঁর মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় যে, বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে তিনি কিছু সমাজতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করে জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারবেন। কিন্তু তার পরিমিত সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যেরূপ সুসংগঠিত দল, অনুগত আমলাবর্গ অথবা সৎ ক্যাডার-এর প্রয়ােজন ছিল তা তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। তিনি যখন উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্ট জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে এবং বামপন্থী বিপ্লবীরা তাঁর সরকারের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তিনি “শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে নিজ হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে নেন।

১৩৯

টীকা ও সূত্র 

১. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Group Interests and Political Changes. (নয়াদিল্লী, ১৯৮২), পৃষ্ঠা ২২২-২২৩। 

২. এ বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, ঐ, পৃষ্ঠা ২২৬-২২৮; রওনক জাহান, Bangladesh Politics. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬২-১৬৩। 

৩. রওনক জাহান, Bangladesh Politics. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৪। 

৪. আবুল ফজল হক, “Contemporary Politics and that Radical. Left in Bangladesh” The Journal of the Institute of Bangladesh Studies Vol III, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ৮৭-১১৪। 

৫. মুহম্মদ গােলাম কবির, Minority Politics in Bangladesh (ঢাকা, ১৯৮০), ২য়, ৩য় ও ৪র্থ অধ্যায়। 

৬. এ সাত্তার, Tribal Culture in Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ২। 

৭. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ৬ (২৩ জানুয়ারি, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ২৯২। 

৮. গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৯, (২৫ অক্টোবর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ২৯২-২৯৬। 

৯. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৩, (১৩ জুলাই, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ২৪০৮। 

১০. এম. রশিদুজ্জামান, “Changing Political Patterns in Bangladesh: Internal Constraints and External Fears”, Asian Survey, খণ্ড ১৭, সংখ্যা ৯, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৭৯৩-৮০৮; বদরুদ্দীন উমর, On Muslim Bengal”, Holiday, ৭ মে, ৩ ও ১০ জুন, ১৯৭৩। 

১১. এম, এন, হারুন, The Maulana’s Pitch”, Holiday, ১৩ ই মে, ১৯৭৩। 

১২ দৈনিক বাংলা, ১৮ই জন, ১৯৭৩, Holidav, ১৭ ই জুন, ১৯৭৩। 

১৩. জনযুদ্ধ (পূর্ব-পাকিস্তানের ক্যুনিস্ট পার্টির (এম এল) গােপন মুখপত্র), মে-জুন, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ৩৩। 

১৪. ঐ, পৃষ্ঠা ২৪।

১৫. ঐ, জুলাই, ১৯৭২। 

১৬. গণশক্তি, (পূর্ব-বাংলার সাম্যবাদী দলের গােপন মুখপত্র), সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ১৩-২০; আন্ত পার্টি দলিল (১), আগস্ট, ১৯৭২। 

১৭. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব-বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার কর্মসূচি, ডিসেম্বর, ১৯৭২; পূর্ব-বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনাে শেষ হয়নি, মার্চ, ১৯৭২। 

১৮. দেখুন গণকণ্ঠ, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৩; ইত্তেফাক, ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭৪। 

১৯. তালুকদার মনিরুজ্জামান, “Bangladesh: An Unfinished Revolution; The Journal of Asian Studies, খণ্ড ৩৪, সংখ্যা ৪, আগস্ট ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৮৯১-৯১১। 

২০. The Bangladesh Observer, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩। 

২১. ইত্তেফাক, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩; Holiday, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৩। 

২২. রবার্ট এ ডাল (সম্পাদক), Political Opposition in Modern Democracies, (নিউ হ্যাভেন, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৪। 

২৩. The Bangladesh Observer, ৯ মার্চ, ১৯৭৩। 

২৪. বদরুদ্দীন উমর, Now There is Opposition” Holiday, ১১ মার্চ, ১৯৭৩; গণকণ্ঠ (সম্পাদকীয়), ১০ মার্চ, ১৯৭৩। 

২৫. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ৩ (১২ এপ্রিল, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৯৬।

২৬. সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন আহমেদের মন্তব্য দেখুন, ঐ, খণ্ড ১, সংখ্যা ৪ (১৩ এপ্রিল, ১৯৭৩) পৃষ্ঠা ১৩৮।

১৪০

২৭. দেখুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৯৩। 

২৮. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ১৪ (২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ৭৬৫। 

২৯. বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি, ঢাকা ১৯৭৩, বিধি ১৪৯। 

৩০. ১৯৭৩ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে পাঁচটি আসনের মধ্যে একটিতে জাসদ প্রার্থী ও অপরটিতে নির্দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করার ফলে সংসদে বিরােধী সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯। 

৩১. জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি, প্রাগুপ্ত, বিধি ৬১-৬৩। 

৩২. ঐ, বিধি ৬৮। 

৩৩. ঐ, বিধি ৭১। 

৩৪. ঐ, বিধি ১১৯। 

৩৫. ঐ, বিধি ৪১। 

৩৬. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ১৬ (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪) পৃষ্ঠা ৮৮৯। 

৩৭. ইত্তেফাক, ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৪। 

৩৮. ঐ, ১৫ অক্টোবর, ১৯৭৩। 

৩৯. প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য দেখুন, পূর্বদেশ, ১২ নভেম্বর, ১৯৭৩; জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ১ (১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১২। 

৪০. ইত্তেফাক, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭৩। 

৪১. ঐ, ১৮ মার্চ, ১৯৭৪। 

৪২. সাম্যবাদ (জাসদের গােপন মুখপত্র), সংখ্যা-১। 

৪৩, ঐ, সংখ্যা ৪। 

৪৪. ১৯৭৩ সালের মধ্যভাগে গঠিত জাগমুই ছিল বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির সম্মুখ সংগঠন। জাগমুই গঠনের পর বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি কার্যত আত্মগােপন করে। 

৪৫. ইত্তেফাক, ১৫ এপ্রিল, ১৯৭৪। 

৪৬. Holiday, ২৩ ও ৩০ জুন, ১৯৭৪।

৪৭. ইত্তেফাক, ২৭ নভেম্বর, ১৯৭৪। 

৪৮. ১৯৭৪ সালের জুন-নভেম্বর সময়কালে সরকারি বাহিনী ও সশস্ত্র বামপন্থীদের মধ্যে শতাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। দ্রষ্টব্য : তালুকদার মনিরুজ্জামান, Bangladesh in 1974; Economic Crisis and Political Polarisation”. Asian Survey, est ,

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ১২২। 

৪৯. বাংলাদেশ জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা সংস্থা (UNROD)-এর হিসাব অনুসারে স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, The Two year Plan. (1978-80), ঢাকা, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ১।

৫০. স্বাধীনতার প্রথম দু’বছরে বাংলাদেশ সাহায্য ও ঋণ হিসাবে মােট ১৩৭৩ মিলিয়ন ডলার | লাভ করে। দ্রষ্টব্য : The Bangladesh Observer, ২৬ মার্চ, ১৯৭৪। 

৫১. বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, The First Five year Plan (1973-78) ঢাকা, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা ৯-১০। 

৫২. এক সরকারি হিসাব মতে, ১৯৭৪ সালের প্রথম নাগাদ পাটকলসমূহে মােট ১,৬২,২২০ জন শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ২৫,০০০ ছিল অতিরিক্ত। দ্রষ্টব্য : জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা। ৫ (২২ জানুয়ারি, ১৯৭৪) পৃষ্ঠা ১৮০। 

৫৩. সরকারি হিসাব মতে, ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ৩১.৭৬ কোটি টাকার লােকসান হয়। দ্রষ্টব্য : জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড, ২, সংখ্যা ১৮, (২৫ জুন, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৮৮৩। শিল্প উৎপাদনের সূচক ১৯৬৯-৭০ সালে ১০০ এর তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সালে

১৪১

৮৫.৯৮-এ হ্রাস পায়। দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে, Economic Indicators of Bangladesh. ডিসেম্বর ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৯। 

৫৪. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ৩, সংখ্যা ৪ (২২ নভেম্বর, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৭৩। 

৫৫. ঐ, পৃষ্ঠা ২০২। 

৫৬. রেহমান সােবহান, Politics of Food and Famine in Bangladesh, Economic and Political Weekly. খণ্ড ১৪, সংখ্যা ৪৮, ডিসেম্বর, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৯৭৩-১৯৮০। 

৫৭. তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রীর মতে দুর্ভিক্ষজনিত মৃতের সংখ্যা ছিল ২৭,৫০০। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি ধরা হয়। 

৫৮. তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রীর বিবৃতি অনুসারে রাজশাহী বিভাগে আমদানি লাইসেন্সধারী মােট ৩৭৬৭ জনের মধ্যে ১৯৯৫ জনই ছিল অব্যবসায়ী। দেখুন জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখা ৬ (১১ জুন, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৩৮। 

৫৯. বি.কে. জাহাঙ্গীর, Differentiation, Polarisation and Conformation in Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা ২৪৯। 

৬০. সরকারি হিসাব মতে, ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিকদের সংখ্যা ছিল ৫৩৭১ এবং উদ্বৃত্ত ঘোষিত জমির পরিমাণ ছিল ৭৬, ৭১২ একর। ১৯৭৪ সালের জুন পর্যন্ত সরকার ঐ জমির মধ্যে ৩২৪৩১.৪৫ একর জমির দখল গ্রহণ করে, কিন্তু মাত্র ১৩৩১.৮৪ একর জমি গরিব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। দেখুন জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১২ (১৮ জুন, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৩২৬; ঐ, সংখ্যা ২১, (২ জুলাই, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৪৬৬। 

৬১. নুরুল ইসলাম, Development Planning in Bangladesh, (ঢাকা, ১৯৭৭), পৃষ্ঠা ১৯৬-২০৭। 

৬২. ১৯৭৩ সালের জুন মাস নাগাদ সরকার ৬০৭টি শিল্প ইউনিট এবং ১৯০৯টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাবে অধিগ্রহণ করেন। দেখুন, জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১৬ (২২ জুন, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৬০১। 

৬৩, সরকারি হিসাব মতে, পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির মােট সংখ্যা ছিল ২২, ৯৪৮, যার মধ্যে ১৯৭৩ সালের জুন মাস নাগাদ ১৫,৮৪০টি অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাস নাগাদ মাত্র ৪৩০০টি বাড়ি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। দেখুন, জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪ (৬ জুলাই ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৮১। 

৬৪. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Bangladesh: An Unfinished Revolution” প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯০৭। 

৬৫. 1979 Statistical yearbook of Bangladesh, প্রাগুক্ত, সারণী ১২.২০ পৃষ্ঠা ৪১৫। 

৬৬. বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৭০% এবং বিপুল সংখ্যক থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের জুন মাস নাগাদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য পুলিশ কনস্টেবলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬,০০০। দেখুন, ইত্তেফাক, ১৩ জুন, ১৯৭২। 

৬৭. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ৮ (১৩ জুন, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ৫৫৮। 

৬৮. রওনক জাহান, Bangladesh Politics, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৮-১৫০। 

৬৯. নুরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪৭। 

৭০. রওনক জাহান, Bangladesh in 1973: Management of Factional Politics, Asian Survey, খণ্ড ১৪, সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ১২৯। 

৭১. প্রাক্তন মন্ত্রী মতিউর রহমানের বিবৃতি দেখুন, ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর, ১৯৭৪। 

৭২. গণকণ্ঠ এবং ইত্তেফাক, ১৪ অক্টোবর, ১৯৭৪। 

৭৩, বাংলার বাণী, ১২ ও ১৩ অক্টোবর, ১৯৭৪; ইত্তেফাক, ১৩ ও ১৪ নভেম্বর, ১৯৭৪। 

৭৪. নুরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯। 

৭৫. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, সংস্থাপন বিভাগ, Statistics on Civil Employees of the Government of Bangladesh, ঢাকা, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১।

১৪২

৭৬. রওনক জাহান, Bangladesh in 1972; Nation Building in a New Nation, Asian Survey, খণ্ড ১৩, সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ পৃষ্ঠা ২০০। 

৭৭. সরকারি হিসাব মতে, “মুজিবনগর সরকারের অধীনে চাকরি করেন এরূপ বেসামরিক কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৯৬৬৯। জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১৯ (২৯ জুন, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৪০৩। 

৭৮. প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা দেখুন, ইত্তেফাক, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭২। 

৭৯. তালুকদার মনিরুজ্জামান, Administrative Reforms and Politics within the Bureaucracy of Bangladesh, The Jounal of Commonwealth and Comparative Politics, খণ্ড ১৭, সংখ্যা ১, মার্চ ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮। 

৮০. ঐ। 

৮১. তালুকদার মনিরুজ্জামান, The Politics of Development, প্রাগুপ্ত, পৃষ্ঠা ৯১-১০৭; এমাজ উদ্দীন আহমেদ, Dominant Bureaucratic Elites in Pakistan and Bangladesh. The Journal of Social Studies, সংখ্যা ৬, ডিসেম্বর ১৯৭৯। 

৮২. নুরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫। 

৮৩, ঐ, পৃষ্ঠা ৪৬-৬২। 

৮৪. এমাজ উদ্দীন আহমেদ, Dominal Bureaucratic Elites…প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০২। 

৮৫. রওনক জাহান, Bangladesh Politics, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৮। 

৮৬, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে আটক করা হয় এবং তাদের সবাইকে ভারতে বন্দী রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার অমানবিক নিষ্ঠুরতা, গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের অভিযােগে বিচারের জন্য ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে সকল যুদ্ধবন্দীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে হয়; ফলে তাদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়নি। 

৮৭. উল্লেখিত উপদেষ্টা পরিষদ ৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। তিন জনের মধ্যে দু’জন সদস্য হবেন এমন ব্যক্তি যারা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ছিলেন, কিংবা আছেন, কিংবা বিচারক পদে নিয়ােগলাভের যােগ্যতাসম্পন্ন, এবং অপরজন হবেন একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা। 

৮৮. দিল্লী চুক্তির মূল বিবরণের জন্য দেখুন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদশের সংবিধান, ঢাকা, ১৯৭৫, পরিশিষ্ট ৪। 

৮৯, মামলার বিবরণ এবং সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের জন্য দেখুন, Holiday, ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪। 

৯০. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ২ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৪৪-৫৭। 

৯১. ঐ, খণ্ড ১, সংখ্যা ১৬ (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ৯৪১। 

৯২. ঐ, খণ্ড ৩, সংখ্যা ৮ (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩), পৃষ্ঠা ৩০৩। 

৯৩. ক্যুনিস্ট পার্টির মন্তব্যের জন্য দেখুন, উত্তেফাক, ১৮ নভেম্বর, ১৯৭৪। 

৯৪. অনুরূপ অভিমতের জন্য দেখুন, মওদুদ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২৭। 

৯৫. ইত্তেফাক, ২২ জানুয়ারি ১৯৭৫।

৯৬. জাতীয় সংসদ, বিতর্ক, খণ্ড ১, সংখ্যা ২ (২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫), পৃষ্ঠা ৬৭-৮১। 

৯৭. মুজিব প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের ওপর দোষারােপ না করলেও ১৯-২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় তিনি তার দলের লােকজনের বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনা করেন। দ্রষ্টব্য : মওদুদ আহমদ, প্রাগুপ্ত, পৃষ্ঠা ২৩৪।

৯৮. বাংলাদেশ গণপরিষদ, বিতর্ক, খণ্ড ২, সংখ্যা ১৭ (৪ নভেম্বর, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৭০১-৭০২।

১৪৩

Reference: বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন – আবুল ফজল হক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!