শিরোনামঃ মুক্তিযুদ্ধে আপনার করনীয় কি?
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা (১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা)
তারিখঃ ২ জুলাই, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধে আপনার করণীয় কি?
পাঞ্জাবী শোষক গোষ্ঠীর তল্পিবাহক ইয়াহিয়ার সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে তার নজীর ইতিহাসে নেই। মুখে ইসলাম, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, এক জাতীয় বুলি আওড়িয়ে সে তার পশু সৈন্যদের হিংস্র কুকুরের মত লেলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সকল মানুষের বিরুদ্ধে। সারা দেশে সৃষ্টি করেছে এক বিভীষিকার রাজত্ব, ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। স্বাধীন বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতির গৌরব, তাদের পীঠস্থান। বাংলাদেশকে এই দানবীয় পিশাচের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য বাংলাদেশ, বাংলাদেশকে শত্রুসেনা মুক্ত করবার জন্যে আজ বাংলাদেশের মুক্তিকামী সমস্ত জনতা ইস্পাত কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ রক্তের শপথ নিয়েছে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা, তারা আঁজলা ভরে বুকের রক্ত ঢেলে দেবে, বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার বুক থেকে শত্রু সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন করবে । সুতরাং লড়ছে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা। সিংহের মত তারা ওত পেতে বসে থাকে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাক সৈন্যের ওপর, নির্মমভাবে হত্যা করছে হানাদার দস্যু পাক সেনাদের। প্রতিদিন শত শত্রুর রক্তে স্নাত হয়ে বাংলার মাটিকে করছে কলুষমুক্ত। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে অপূর্ব বীরত্বে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে পাকসেনা। প্রতিদিন শতশত পাকসেনার মৃত্যুতে পাক সেনাবাহিনীতে হাহাকার উঠেছে। তারা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে এমনিভাবে আর কিছুদিন যুদ্ধ চললে বাংলাদেশ থেকে আর একটি পাক সৈন্যও জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় বীরত্ব সারা বিশ্বের মানুষ আজ বিস্মিত, মুগ্ধ । তাদের অপূর্ব সুন্দর সাফল্যে আজ শত্রুদের অন্তিমদশা উপস্থিত ।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন, একান্ত নিষ্ঠার সংগে। তাদের অজেয় দেশপ্রেম, তাদের ত্যাগ, তাদের অপূর্ব নিষ্ঠা সারা বাঙ্গালী জাতিকে এক গৌরবময় মহিমা দান করেছে ।
মুক্তিযোদ্ধারা যেমন তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছেন অপূর্ব নিষ্ঠার সংগে তেমনি আজ বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করা । কারণ মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, মধ্যবিত্ত সমগ্র জনসাধারণের সক্রিয় সমর্থনের উপর।
মুক্তিযোদ্ধারা যেমন এ দেশের কৃষক শ্রমিক জনতার শ্রেষ্ঠ সন্তান, তেমনি বাংলাদেশের মানুষকেও মুক্তিযোদ্ধাদের একান্ত আপনজন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং সাফল্য সম্পূর্ণরূপে গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, জনতার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। বর্তমান যুদ্ধে অবলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের নীতি হল শত্রুর সন্ধান নেয়া, শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করা, ধ্বংস করা এবং নিজেকে রক্ষা করা। সুতরাং শত্রুর সন্ধান নিতে হলে শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হলে, সর্বশেষে গেরিলাদের আত্মরক্ষা করতে হলে সংঘর্ষের এলাকার এবং তার চারপাশের এলাকার কৃষক শ্রমিক জনতার সক্রিয় সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর চোখ এড়িয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে সাহায্যও তারাই করতে পারেন। তাছাড়া শত্রুকে আক্রমণের আগে এবং দ্রুত পশ্চাৎপসারণ সময়েও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য তারাই করবেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে আজ মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামির একদল অনুচর শত্রুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। এরা সব সময়ে চেষ্টা করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুকে চিনিয়ে দিতে। এদের ঘৃণ্য প্রচেষ্টায় এরা যদি সাফল্য লাভ করতে পারে তাহলে মুক্তিযুদ্ধে এরা চরম ক্ষতিসাধন করবে ।সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের প্রথম কর্তব্য হবে এই সমস্ত শত্রুচরদের দৃষ্টি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করা। তাহলে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রথম মানুষের আশু করণীয় হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটির সাথে যোগাযোগ রাখা, শত্রুর গতিবিধির খবর গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটিতে পৌছিয়ে দেয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়া, পশ্চাৎপসারণ কালে তাদের সাহায্য করা, শত্রুকে এবং শত্রুর চরদের ধ্বংস করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। এছাড়া তারা নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়ে শত্রুর চরদের খতম করবেন। গ্রামকে শত্রুচর মুক্ত করতে না পারলে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহায়কদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
উপরে উল্লিখিত উপায়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে হলে গ্রামগুলোকে সংঘটিত হতে হবে। নিঃসন্দেহে এ কথা বলা চলে যে, মুষ্টিমেয় শত্রুর অনুচর ব্যাতীরেখে সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এ কথাও একান্ত সত্য যে, গ্রামে দু একটি শত্রুচর থাকলেও গেরিলা যোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীগণ কেউ নিরাপদ নন। সুতরাং সুযোগ পেলেই শত্রুর চরকে খতম করে দিতে হবে।