You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয়ঃ রাজনৈতিক সমাধান | জয় বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ রাজনৈতিক সমাধান
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ( ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা)
তারিখঃ ১৮ জুন, ১৯৭১

রাজনৈতিক সমাধান?

বাংলাদেশ সমস্যার এক রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বের বহু দেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর রূপ পাওয়া যাচ্ছে না বলে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ এ অস্পষ্ট কথাটি অনেক কল্পনা-জল্পনার জাল বুনে চলেছে। যে কোন সমাধানের পথে কল্পনা-জল্পনা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, এবং সমস্যাটিকে জটিলতর করে। এ জন্যে সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট পথের একান্ত প্রয়োজন।
যে কোন সমস্যার মত বাংলাদেশের সমস্যাকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ না করে কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করা হলে, আমরা মনে করি এর সমাধান পাওয়া যাবে না। কেন আজ বাঙালী মরণপণ করে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে- এ কথাটির জবাব পেতে হবে।
পৃথিবীর কাছে অজানা নয় যে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক এক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাই, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়ী হয়েও শান্তিপূর্ণ, সহ-অবস্থানের জন্য আলোচনা বৈঠক মিলিত হয়েছিল। সহিংস বিপ্লবী মত ও পথ আওয়ামী লীগের নয়। তবু কেন আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে এর সদুত্তর পেতে হবে। এ সংগ্রামের, এবং ইয়াহিয়া সরকারের পৈশাচিক বর্বরতার বহু কথা বলা হয়েছে। দুনিয়ার সকলের কাছে এ সব কথা জানা।
মূল সমস্যার মৌলিক কারণগুলোকে এড়িয়ে কোন সমাধানের চেষ্টা করা হলে, সাময়িকভাবে স্বস্তি পাওয়া গেলেও স্থায়ী শান্তি আসতে পারে না। স্থায়ী সমাধানের জন্যে নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত মন, গভীর ও সুদূরপ্রসারী অন্তর্দৃষ্টি এবং বাস্তব উপলব্ধির প্রয়োজন। তাই, যারা রাজনৈতিক সমাধানের ধুয়া তুলছেন তাঁদের কাছে সংগ্রামের সার্বিক রূপটি স্পষ্ট থাকতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন শেষে স্বাভাবিক আশা করেছিল, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে, পাকিস্তানের শাসন, ভার, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত চালিয়ে যাবে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলে আসছে তারই পথ ধরে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদী, অগণতান্ত্রিক শক্তি আবারও চক্রান্ত শুরু করল। মানুষের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে তারা আকস্মিকভাবে নিরপরাধ, নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য লেলিয়ে দিল। তারা বাংলাদেশকে গোরস্থানে পরিণত করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহারা করেছে, আবাল-বৃদ্ধা-বনিতাকে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ মা বোনদের ইজ্জতহানি করেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নজিরবিহীন নির্মমতা ও পাশবিকতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মনকে রক্তাক্ত করে দিয়েছি। বাঙ্গালীর চোখে আজ তীব্র ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বলেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের কণ্ঠে যেদিন ধ্বনিত হল- ‘লক্ষ লক্ষ শহীদের লাশের উপর আলোচনা চলতে পারে না’- সেদিন ক্ষতবিক্ষত বাঙ্গালীর মনের কথাটিই প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বাস্তব ও যুক্তিবাদী বলে ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেন না। মূলত: তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে অপ্রয়োজনে রক্তপাতে আগ্রহী নন। বিনা রক্তপাতে যদি লক্ষ্যে পৌঁছান সম্ভব নয়, বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি রূপায়িত হওয়া সম্ভব হয়, সেই পথ অনুসরণে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে, তারই জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি পূর্বশর্ত দিয়েছেন। সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের কেবল দেশপ্রেমেরই পরিচায়ক নয়, এতে তাঁর মানবিকতা আন্তরিকতাকেও প্রতিভাত করেছে। তাঁর চারটি শর্ত বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বাঙালীর মনের কথাটিকে প্রতিধ্বনিত করেছে।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি শর্ত হলঃ (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনাশর্তে মুক্তি (২) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত সৈন্যদের অপসারণ (৩) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং (৪) বিগত ২৩ বছরের বঞ্চিত অর্থসহ বর্তমান যুদ্ধে ক্ষতিসাধিত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকে কারাগারে রেখে কোন আলোচনা চলতে পারে না। আলোচনা চালাবার জন্য তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতেই হবে। বাংলা ও বাঙালীর পক্ষে অভিমত দেবার একমাত্র অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঙ্গালীরা বিদেশী হানাদার বলে মনে করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর বাঙ্গালীদের কোন আস্থা নেই। তাদের উপস্থিতিতে বাঙ্গালী নিরাপদ মনে করতে পারে না এবং এ কারণেই ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা সত্ত্বেও কোন উদ্বাস্তু ফিরে যাননি। ভীতি ও অবিশ্বাসের মধ্যে নিরাপত্তার ভাব জাগতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ভাজন। বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত। বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই সরকার প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। আর পশ্চিম পাকিস্তানীরা গত ২৩ বছরে বাংলাকে শোষণ করে, বঞ্চিত করে এবং সর্বশেষে গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নৈতিক বা আইনগত যে কোন বিচারে বাঙ্গালী ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে। বিনা অপরাধে তার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে বলতে হয়, অনাহার-অনটনক্লিষ্ট, দারিদ্র-পীড়িত মানুষ কখনো শান্তিতে থাকিতে পারে না।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান হলে স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একটি জাতি নির্দিষ্ট এক লক্ষ্যে পৌছার জন্যে জীবন মরণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলে স্থায়ী ফল বা শান্তি আসতে পারে না। সত্য সে যতই কঠোর হোক, তাঁকে অস্বীকার করা যায় না এবং করাও উচিত নয়। বাস্তব ও সত্যকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হলেও পরিস্থিতি তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশের ব্যাপারেও সত্যকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। আজ নগ্নভাবে এ সত্য ভেসে উঠেছে যে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এক নয়, বাংলা ও বাঙালীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলনের কথাই উঠে না, এমনকি সম্প্রীতিও জাগতে পারেনা। বাংলার প্রতি ঘরে যে হাহাকার উঠেছে, প্রতিটি বাঙালীর মন যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আর কোন মধুর বাণী এ হাহাকার, এ আর্তিতে প্রলেপ দিতে পারবে না। আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলার স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধানের পথ। বাঙালীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টির কোন মিল নেই এ সর্ববাদী সম্মত বক্তব্যের সাথে গত ২৩ বছরের বঞ্চনা এবং গত কয়েক মাসের হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নির্যাতন মিলে বাঙ্গালী- মন যে ভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছে, তাতে কোন বন্ধনের কথা প্রলাপ বলেই মনে হবে। তাই আজ স্বীকার করে নিতে হবে পাকিস্তান যে কোন বাস্তব বিচারে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেবল আবেগ ও অনুভূতিতে সমস্যার বিচার চলে না।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার চিন্তাও বাতুলতার সমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর পৈশাচিকতায় শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের পথে। এ ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হলে জনসাধারণের সহযোগিতা অপরিহার্য। ভয়-ভীতি, ত্রাস, ঘৃণা, অবিশ্বাসের মধ্যে সহযোগিতা হতে পারে না। চাপে পড়ে যে কাজ তাতে আন্তরিকতা থাকে না আন্তরিকতা না থাকলে কার্যকরী প্রচেষ্টা চলতে পারে না। তাই রাজনৈতিক সমাধানের নামে যদি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা চলে তাতে সংহতি- সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক যে কোন ক্ষেত্রেই হোক, আসতে পারে না। বরং এ কথা বলা চলে, বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিলে, কালের গতিতে বর্তমানের পুঞ্জীভূত হিংসা, বিদ্বেষ,অবিশ্বাস কেটে যেতে পারে এবং এক সময়ে হয়ত প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠতে পারে।
তাই, আমাদের অভিমত ভবিষ্যতের কল্যাণ কামনায়, বর্তমানে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নির্মম সত্য-বাংলার স্বাধীনতার স্বীকৃতিতে সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় । এবং দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।